স্বাধীনতার ৪৫ বছর পূর্ণ হলো এ ডিসেম্বরে। যাদের রক্তে- ত্যাগে এদেশ স্বাধীন হলো তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ছিলো শ্রমিক কৃষক মেহনতী মানুষ। শ্রমজীবি মানুষের স্বপ্ন ছিল দেশ স্বাধীন হলে শোষণ থাকবে না, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত হবে। স্বাধীন দেশের সংবিধানের ১৪ নং অনুচ্ছেদে এ স্বপ্ন ও আকাঙ্খাই প্রতিফলিত হয়েছিল।
এতে বলা হয়েছিল – “রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে মেহনতী মানুষকে, কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।” সংবিধানের প্রতিশ্রুতি কি রাষ্ট্র রক্ষা করেছে? রাষ্ট্র শ্রমিককে সকল প্রকার শোষণ হতে মুক্তি দেওয়া তো দূরের কথা, বরং স্বাধীনতার পর যে সরকার ক্ষমতায় ছিলো বা আছে, তারা মালিকী শোষণকে আরো তীব্র করেছে। সম্প্রতি টাম্পাকো কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে শ্রমিক মৃত্যু, তাজরীন-রানা প্লাজা ধ্বসে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনায় শ্রমিকের উপর শোষণ নির্যাতন এর মাত্রা বোঝা যায়। শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তা, মর্যাদাকর জীবনের নিশ্চয়তা, ট্রেড ইউনিয়ন ও ন্যায্য মজুরির অধিকার সবই উপেক্ষিত। আইন ও তার প্রয়োগ শ্রমিক নয়, সবই মালিকের স্বার্থ রক্ষার জন্য। ২০০৬ সালে প্রণীত ও ২০১৩ সালে সংশোধিত বাংলাদেশ শ্রম আইন ও শ্রম আইনকে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগের ব্যাখ্যা সম্বলিত বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা ২০১৫ তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
২০০৬ সালে তৎকালীন বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকার অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ পাস করে। কোন আলোচনার সুযোগ না দিয়ে মাত্র দুই মিনিটে সংসদে এই আইন পাস করিয়ে নেওয়া হয়। শ্রমিক সংগঠনগুলো এই আইনটিকে ‘অগণতান্ত্রিক শ্রম আইন’ হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করে। ২০১৩ সালে তাজরিন ফ্যাশন এ অগ্নিকান্ডে শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু, এর পর সাভারে রানা প্লাজা ধ্বসে হাজারের অধিক শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দেশে বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। সারা বিশ্বে বাংলাদেশের গার্মেন্টস মালিক ও বিশ্বের নামী দামী পোশাক কোম্পানীগুলোর মুনাফার লিপ্সা ও নির্মমতার চেহারা প্রকাশ্যে আসে। সমালোচনার মুখে পড়ে আইএলও সহ সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক মহলও সরকারকে চাপ দেয়। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, কারখানায় জীবনের নিরাপত্তার বিধান সম্বলিত শ্রমআইন ও বিধিমালা প্রণয়ণের জন্য আমেরিকা জিএসপি সুবিধা পুর্নবহালের শর্ত হিসেবে সংশোধন ও শ্রম বিধিমালা প্রণয়নের শর্ত জুড়ে দেয়। অব্যাহত আন্তর্জাতিক চাপ ও এই সেক্টর অস্থিতিশীল হয়ে উঠায় বিদেশী বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়ার আশংকায় মালিকের মুনাফার অবাধ প্রবাহ রক্ষার স্বার্থেই সরকার তড়িঘড়ি করে সংশোধিত শ্রম আইন ২০১৩ প্রণয়ন করে।
শ্রম আইন সংশোধনের পর বিধিমালা প্রনয়ণের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। শ্রম বিধিমালা হলো শ্রম আইন বাস্তবায়নের খুটিনাটি বিষয়গুলোর বিস্তারিত বিবরণ। অবশেষে ২০১৫ সালে সরকার বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা ২০১৫ প্রণয়ন করেছে। এ বিধিমালাও প্রণয়ন হয়েছে আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। ত্রিপক্ষীয় (সরকার, মালিক, শ্রমিক) পরামর্শক কমিটির আলোচনায় খসড়া বিধিমালা নিয়ে আপত্তি তুলে কিছু সুপারিশ করে শ্রমিক পক্ষ। সেসব সুপারিশ যোগ করে পুনরায় বিধিমালাটি শ্রমিক পক্ষকে দেখানোর পরই গেজেট আকারে প্রকাশের কথা ছিল। কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি মানা হয়নি। বিধিতে জায়গা পায়নি শ্রমিক পক্ষের সুপারিশ। মালিক পক্ষের চাপে মূলত মালিক সহায়ক বিধিমালা তৈরী করেছে সরকার।
সংশোধিত শ্রম আইন ও বিধিমালা বাংলাদেশ সরকার অনুসমর্থিত আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ এ স্বীকৃত অধিকারসমূহ বাস্তবায়ন করা হয়নি। সংগঠন করা ও নেতা নির্বাচন করা শ্রমিকের অধিকার। শ্রম আইনে শ্রমিককে যতটুকু ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার দেওয়া হয়েছে কাগজে কলমে, মালিকেরা তাও দিতে চায় না। ৯৯% গার্মেন্টসে কোন ট্রেড ইউনিয়ন নেই। শ্রমিকরা ইউনিয়ন গঠনের উদ্যোগ নিলেই মালিকরা নির্যাতন, ছাঁটাই চালায়। তারপরও যতটুকু ট্রেড ইউনিয়ন চর্চার সুযোগ আছে, তাও কৌশলে কঠিন করে তোলা হয়েছে। শ্রম (সংশোধন) আইনে কৌশলে শ্রমিকদের অংশগ্রহণমূলক কমিটিকে (Workers participatory committee) ট্রেড ইউনিয়নের বিকল্প হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে। বলা হয়েছে সে প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত না হওয়া পর্যন্ত অংশগ্রহণকারী কমিটি যৌথ দরকষাকষি কার্যক্রম (সিবিএ) পরিচালনা করতে পারবে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলার বাধ্যবাধকতা নেই। মালিক ও শ্রমিকের সমন্বয়ে গঠিত এ কমিটি কখনোই ট্রেড ইউনিয়নের বিকল্প হতে পারে না। মালিকরা অংশগ্রহণকারী কমিটিকেই সামনে এনে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন বাধাগ্রস্থ করবে। মালিকরা চায় না কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে উঠুক।
ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়নের দাবিও দীর্ঘদিনের। সর্বশেষ বাংলাদেশ ইপিজেড শ্রম আইন ২০১৬ তেও ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়নের পরিবর্তে ‘শ্রমিক কল্যাণ সমিতি’ (Workers welfare Association- WWA) গঠনের নামে শ্রমিকদের সাধে প্রতারণা করা হয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠানে তিনটির বেশি ইউনিয়ন করা যাবে না, ৩৫ জনের বেশি ইউনিয়ন কর্মকর্তা থাকতে পারবে না, কারখানায় কর্মরত শ্রমিক ছাড়া কেউ ট্রেড ইউনিয়নের কার্য নির্বাহী কমিটির সদস্য হতে পারবে না ইত্যাদি ধারার মাধ্যমে শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার খর্ব করা হয়েছে। এছাড়া ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন আরো কঠিন করা হয়েছে।
শ্রম বিধিমালায় দুই বছর পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পরে ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে পুনঃনবায়ন করতে বলা হয়েছে। এর অর্থ সরকার ইচ্ছা করলে চালু করা ট্রেড ইউনিয়ন বন্ধ করতে পারবে। বিধিতে কেবল স্থায়ী শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার কথা বলা হয়েছে। যা আইএলও কনভেনশনের পরিপন্থী।
সংশোধিত শ্রম আইনে অসদাচরণের যে ত্রুটিপূর্ণ সংজ্ঞা (প্রতিষ্ঠানের উচ্ছৃঙ্খলতা বা দাঙ্গা হাঙ্গামামূলক আচরণ অথবা শৃঙ্খলা হানিকর কোন কর্ম) দেওয়া হয়েছে, তাতে মালিক কারখানা বা কারখানার বাইরে যে কোন ঘটনায় – দুর্ঘটনায় শ্রমিকের উপর দোষ চাপাতে পারবে। বাস্তবে মালিকের হাতে শ্রমিক নির্যাতনের একটা বড় অস্ত্র তুলে দেওয়া হলো।
পূর্বের শ্রম আইনে মুনাফার ৫% সকল শ্রমিকদের প্রাপ্য ছিল। কিন্তু তা সংশোধন করে শতভাগ রপ্তানীমুখী শিল্পের ক্ষেত্রে তা বাদ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও নীট মুনাফার ৫% অর্থ ৮০:১০:১০ অনুপাতে যথাক্রমে অংশগ্রহণ তহবিল, কল্যাণ তহবিল এবং বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিলে প্রদান করবে। এর ফলে শ্রমিক তার ন্যায়সঙ্গত প্রাপ্য মুনাফার সম্পূর্ণ অংশ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে।
বর্তমান বিধিতে শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি কার্যাদেশের বিপরীতে মোট প্রাপ্ত অর্থের ০.০৩ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে জমা হবে। যা ৫ শতাংশের তুলনায় অনেক কম। এ তহবিল যে শ্রমিকের কল্যাণে ব্যয় হবে না, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
এছাড়া সংশোধিত আইনে ধর্মঘট করার গণতান্ত্রিক অধিকার আরো কঠিন করা হয়েছে। বিধিমালায় ঠিকাদার সংস্থার বৈধতাকে আরো পাকাপোক্ত রূপ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে মালিকরা তাদের মুনাফার জন্য ঠিকাদার কতৃক সরবরাহকৃত শ্রমিকদের দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতে চাইবে এবং শ্রমিকরাও তাদের অনেক পাওনা থেকে বঞ্চিত হবে। শ্রমিক বিনা অনুমতিতে ১০দিনের বেশি অনুপস্থিত থাকলে মালিক শ্রমিককে বিনা ক্ষতিপূরণে চাকুরিচ্যুত করতে পারে। এছাড়া যে কোন শ্রমিককে ৪ মাসের বেতন দিয়ে বা ৪ মাস আগে নোটিস দিয়ে ছাঁটাই করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই ধারার অপপ্রয়োগ করে মালিকরা ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার বাধাগ্রস্ত করবে।
এটা স্পষ্ট শ্রম (সংশোধিত) আইন ২০১৩ ও শ্রম বিধিমালা ২০১৫ মালিকদের স্বার্থই রক্ষা করবে এবং শ্রমিকের অধিকার হরণ করবে। এ অবস্থায় একটি গণতান্ত্রিক শ্রম আইনের দাবিতে আন্দোলন আরো জোরদার করতে হবে।