[আমিরুল হক চৌধুরী। অভিনেতা ও নাট্যব্যক্তিত্ব। বাসদ (মার্কসবাদী)’র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, এদেশের অনন্যসাধারণ কমিউনিস্ট বিপ্লবী কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী গত ৬ জুলাই ২০২১ তারিখে প্রয়াণের পর ২৪ জুলাই ২০২১ চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র-এর উদ্যোগে অনলাইনে আয়োজিত ‘সংশপ্তক বহমান’ শীর্ষক স্মরণসভায় আমিরুল হক চৌধুরী বক্তব্য রাখেন। তাঁর বক্তব্যটি পরবর্তীতে সম্পাদিতরূপে ‘কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী স্মারকগ্রন্থ’-এ সংকলিত হয়। কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর ১ম মৃত্যুবার্ষিকীতে বক্তব্যটি এখানে তুলে ধরা হলো]
হায়দার ভাইকে স্মরণ করে চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র যে আয়োজন করেছে, এর জন্যে তাদেরকে অনেক ধন্যবাদ। হায়দার ভাই চলে যাবেন এবং তাঁর সম্পর্কে এভাবে কথা বলতে হবে–এর জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু এটা খুব স্বাভাবিক। মানুষ চলে যায়। হায়দার ভাইও চলে গেছেন। কিন্তু আমাদের সাথে সমস্ত কর্মের মধ্য দিয়ে যেভাবে জড়িয়ে ছিলেন, তাতে ওঁনাকে মনে হতোই। আমি মনে করি, যারা ওঁনার সান্নিধ্যে এসেছেন, তাঁদেরও প্রত্যেকের এভাবেই তাঁকে মনে হয়। হায়দার ভাইয়ের সাথে আমি খুব দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি একসাথে। একসাথে প্রায় পঞ্চাশটি বছর। শেষের দিকে এসে হায়দার ভাই ব্যস্ত হয়ে গেলেন। বয়সও বেড়ে গেল। আমাদেরও বয়স বেড়ে গেছে। যার যার পরিমণ্ডলে আমরা তো ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। হায়দার ভাই তাঁর আদর্শ, তাঁর নীতি, তাঁর রাজনীতি–এগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়েছেন।
আমরা তো হায়দার ভাইয়ের মতো নিজের জীবনকে এইভাবে উৎসর্গ করতে পারিনি। যতদিন বেঁচে আছি ততদিন পর্যন্ত হায়দার ভাই বিভিন্নভাবে স্মৃতিতে জড়িয়ে থাকবেন। যেরকম কিছুক্ষণ আগে আলাপ হলো, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে। বিশেষ করে আমি তো অভিনয় করি। সেজন্য এগুলোর কথা বলছি। সর্ববিষয়। আমি আবার একটু খাওয়া পছন্দ করতাম। খাদ্যরসিক-এর কথা বলছি। আমাদের এখানে একটু সমস্যা আছে। খাদক আর খাদ্য রসের মধ্যে সমার্থক করে ফেলে। কিন্তু খাদ্য-খাদক আর খাদ্যরস তো এক জিনিস না। খাদ্যরস একটা সভ্য মানুষকে, একটা সভ্য সমাজকে জানতেই হবে। তো সেই জায়গাটায় হায়দার ভাইয়ের সাথে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। আলোচনা করেছেন রাজনীতি নিয়ে, বিভিন্নভাবে।
আমি আর হায়দার ভাই কলকাতা ইনডোর স্টেডিয়ামে প্রায়ই হোলনাইট প্রোগ্রাম দেখতাম। একবার গেলাম একটা প্রোগ্রামে। তো কারা কারা আছেন! তাদের নাম শুনলে যারা সংগীত পছন্দ করেন বা উচ্চাঙ্গসংগীত পছন্দ করেন তাদের প্রত্যেকের কাছে মনে হবে যে, আরে এরকম মানুষগুলো! হ্যাঁ, সেটা হচ্ছে যে, সেতারে ওস্তাদ বেলায়েত আলী খান, সরোদে আমজাদ আলী খান এবং শেষে সংগীত পরিবেশন করবেন পণ্ডিত ভীমসেন যোশী। এই তিনজনের প্রোগ্রাম কলকাতা ইনডোর স্টেডিয়ামে। তো আমি আর হায়দার ভাই বসে বসে সেই সংগীত উপলব্ধি করছি। সেই সংগীত শুনছি। আমার চারপাশে যে সংস্কৃতিবান, সংগীতপ্রিয় মানুষ বসেছিলেন, আমার চোখে আজও তারা ভাস্বর হয়ে আছেন। হায়দার ভাই তো আমার পাশে ছিলেনই কিন্তু … উঁনিই তো আমাকে নিয়ে গেছেন ওখানে। সেখানে একজন ব্যক্তি এসেছেন। ব্যক্তিটির অবয়বটা যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই। চুলটা আরেকটু বড়, একটু বাঁধা পেছনদিকে। একজন পুতপবিত্র মানুষ। তার সঙ্গে আমাদের কোনো পরিচয় নেই। পাশে বসা উনি, তার পুত্রবধূ তার সাথে। মহিলাটি প্রেগন্যান্ট। তার বাচ্চা হবে–এরকম পরিস্থিতি নিয়ে শ্বশুরের সাথে গান শুনতে এসেছেন। উচ্চাঙ্গসংগীত এইভাবে বোঝেন এবং যারা গাইবেন যারা বাজাবেন তাদেরকে উঁনি এইভাবে জানতে দেখতে চান। যে ভদ্রমহিলাকে দেখে আমার নিজেরই মনে হচ্ছে নিজের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল; শিল্পীরা রাগের ওই সমস্ত জায়গায় যখন স্পর্শ করছেন, সেই ভদ্রমহিলা ওই শরীর নিয়ে এরকম উঁচু হয়ে যাচ্ছেন সিট থেকে। ‘বাবা দেখেছ!’–আমি এইগুলোও দেখছিলাম। পরিবেশ-পরিমণ্ডল ওই সংগীতের, ওই সংগীত শোনার মতন লোক যে তৈরি হয়েছে ওখানে, যেখানে হায়দার ভাইয়ের জীবনটাও দীর্ঘদিন ছিল। দীর্ঘদিন ওই সংস্পর্শে ছিল। ওই পরিবেশে ছিল। তাঁর কাছের মানুষগুলোও ওখানে ছিলেন।
রাশিয়ান ব্যালে এসেছে কলকাতায়। আমি তো শুনে একেবারে উৎসুক। আমি ওই সময় আছি কলকাতায়। হঠাৎ এসে গেছে ব্যালে। হঠাৎ নয়, তাদের প্রোগ্রাম হয়তো আছেই। ভাবলাম আরে! দারুণ জিনিস পাওয়া গেল! রাশিয়ান ব্যালে তো! বললেন, ঠিক আছে চলেন যাই। তো হায়দার ভাই যেতে পারলেন না। আমার জন্য একটা টিকিট কেটে দিলেন। আমি রাশিয়ান ব্যালেটা দেখলাম। উঁনি একজন লোক দিয়ে দিলেন। ওইখানকার একজন কমরেডকে। উঁনি আমাকে নিয়ে ওখানে গেলেন। এই হায়দার ভাই, যাঁর কারণে আমি রাশিয়ান ব্যালেটা দেখতে পেলাম। যেটা আমার মনে খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু রাশিয়াতে গিয়ে দেখবার কোনো সৌভাগ্য বা রাশিয়াতে গিয়ে দেখবার সেরকম সুযোগও তো ছিল না। তো এই রকম কিছু ঘটনা আমার সাথে প্রচুর।
আমার একমাত্র হবিই হচ্ছে, আমি ঘুরে দেখতে চাই পৃথিবীটাকে। এটা হায়দার ভাই জানতেন। খুব মনেপ্রাণে জানতেন, ফিল করতেন। আমাকে বলতেনও। হায়দার ভাইয়ের সাথে ইন্ডিয়াতে অনেক জায়গায় গিয়েছি ঘুরতে। একবার তো আমি আর হায়দার ভাই হাওড়া রেলস্টেশনের ওয়েটিং রুমে এই রাজনীতির আলোচনায়, এই সমস্ত নিয়ে একেবারে চূড়ান্ত আড্ডা দিচ্ছি। ট্রেন চলে গেল। বাইরে গিয়ে দেখি বোম্বের ট্রেন চলে যাচ্ছে। গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস। ও চলে গেল, তো আমরা পেছনে একটু দৌড় মারলাম। দৌড় মেরে কি আর গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস ধরা যায়! তারপরে দুদিন পরে আবার গেলাম। উঁনি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন, থাকবেন একারণে। এই সমস্ত জিনিসগুলোর মধ্যে যে বড়ত্বটা ছিল, সেটা হলো আটপৌরে ভাব। আমাদের সবকিছু আটপৌরে। আমরা যে একেবারে ফার্স্ট ক্লাসে করে যাচ্ছি, তা কিন্তু না। তবে আমরা ভদ্রভাবেই যাচ্ছি। কিন্তু আটপৌরে ব্যাপারগুলো খুব জড়িয়ে ছিল, যেটা আমাদের সবকিছুর মধ্যে যায়।
জলগাঁও বলে একটা স্টেশন আছে। বোম্বের পাঁচশ কিলোমিটার আগে। আগে মানে বোম্বের আগে, তারপরে বোম্বে। ওখানকার এক হেডমিস্ট্রেস। হাই স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। উনি মহারাষ্ট্রের এডুকেশন মিনিস্টারকে তার স্কুলে আনবার জন্য যাচ্ছেন। তা আমাদের সামনে আমাদের পাশে বসেছেন। পাশে শব্দের অর্থ যে সিটে আমি আছি (আমি আর হায়দার ভাই) তার সামনের সিটে ওনারা বসা। তো গল্প করতে করতে ওনাদের সাথে একটা সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেল। ভদ্রমহিলা চমৎকার। একজন হেডমিস্ট্রেস-এর অবয়ব বলতে যেটা বোঝা যায়। প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে খুব সংস্কৃতিবান মানুষ। খাদ্য-টাদ্যও সমস্ত সম্পর্কে অত্যন্ত বিশদ একেবারে। কীভাবে এটা কো-ইনসিডেন্স হয়ে গেল। তারপরে কথায় কথায় উঁনি কিছু রাজনীতির কথাও শুরু করলেন, সেটা খুব এলোমেলো। সেটা এলোমেলো এই অর্থে যে, নানাভাবে নানা দেশের অবস্থা, এটা-সেটা ভারতের। আমাদের এখানে তখন শাসন অন্যেরা করছেন। তো উনি কিছু বলতে চাইলেন, মন্তব্য করতে চাইলেন। আমরা সেই মন্তব্যতে পার্ট করলাম না। আমরা বললাম যে, দেখেন এটা আমাদের দেশের ব্যাপার। আমরা এখন এই জাতীয় আলোচনা করতে চাচ্ছি না। খাবারের কথা যখন আসল, উনি বললেন, দিল্লির দরবার নামে বোম্বেতে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। ‘আপনারা দিল্লি দরবারে অবশ্যই খাবেন।’ একটা সময় হায়দার ভাই আর আমি খেলাম। তাতে বোঝা গেল যে, ভদ্রমহিলা রসিক। এই দিল্লি দরবারটা কিন্তু দিল্লিতে নেই। এটার নাম দিল্লি দরবার। এটা হচ্ছে বোম্বেতে। আমি অনেক চেইনের খাবার খেয়েছি ভারতে। বুঝবার জন্য, দেখবার জন্য যে টেস্ট কী রকম, খাবারের কীরকম বিকাশ ঘটেছে নানাভাবে। তো দেখলাম যে, অসাধারণ! হ্যাঁ, মোগলাই খাবারের প্রাধান্য আছে ওখানে। এগুলো বলছি খাদ্যের কথা, বেড়াবার কথা। এগুলো বলছি সংগীতের কথা।
একবার অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এ গিয়ে যখন শিল্পকর্মগুলো দেখছি, যখন একটা স্কাল্পচার নিয়ে কথা হচ্ছে, তখন হায়দার ভাই দেখাচ্ছেন যে স্কাল্পচার-এর এই মূর্তির হাতটা কত নরমভাবে এসে পড়েছে, একবার খেয়াল করে দেখুন। পাথরের মূর্তির হাত যে এত নরমভাবে নরম ভঙ্গিতে এসে পড়ল–এটিই হচ্ছে শিল্পের সৃষ্টি। শিল্পীর সৃষ্টি শিল্প। কী সংগীত, কী পেইন্টিংস–সবদিকে ওঁনার অগাধ জ্ঞান ছিল। এভাবে হায়দার ভাইয়ের সাথে ইউরোপের বড় বড় শিল্পীদের নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। সালভাদর ডালি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
আমি ব্যক্তিসম্পত্তি প্রসূত জীবনযাপনের বলয়ের মধ্যে আছি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে, ব্যক্তিসম্পত্তি প্রসূত জায়গাটাই হচ্ছে সাংঘাতিক জায়গা, যেটা মানুষকে মানুষ থেকে সরিয়ে দেয়। সেই জায়গাটা চিহ্নিত করিয়েছেন, বুঝিয়েছেন মুবিনুল হায়দার চৌধুরী। আমার যে দায়িত্ব সমাজে, আমি এত বড় বিপ্লবী না। আমি হায়দার ভাইয়ের মতো এত বড় মানুষ না। সেটা হতে পারিনি। অনেক কিছুই ব্যক্তি জীবনে মেনে চলতে পারিনি। হ্যাঁ, পারিনি শব্দটি একটি ব্রডবেইস শব্দ। আমার জীবনের অনেক কিছুই কাট করেছি, কিন্তু লোভের কাছে সমর্পিত হইনি। তার জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। লোভের ধারার মধ্যে প্রবাহিত না হয়ে একটা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে থাকলে সুবিধা আছে। আমি তো গোষ্ঠীবদ্ধ নই। আমার জন্য বিরাট বিপদ। আমি যখন একটা উচিত কথা বলি, আমার এই বয়সে, এই পরিচিতি নিয়ে তখন ভয়াবহ আউটসাইডার হয়ে যেতে হয়। এটা হায়দার ভাই সামান্য হলেও ফিল করতেন। হয়তো মুখে বলতেন না। কিন্তু তাঁর বডি ল্যাঙ্গুয়েজে বুঝতে পারতাম। কারণ আমি যদি চারণের এই বৃত্তে থাকতাম, তাহলে আমার রিস্ক অনেক কম থাকত। কারণ, আমার একটা দলবদ্ধতা থাকত। আমার দলবদ্ধতার জায়গাটা আমাকে সমর্থন করত। কিন্তু যে প্রবাহে আমি প্রবাহিত, আমার জীবনটা যে প্রবাহে আছে, সেখানে যখন আমি এই কাজগুলো করি, যেটা হায়দার ভাইয়ের কাছ থেকে শিখেছি, শিক্ষায় আমি বিশ্বাস করে শিখেছি। শুধু শুনেছি তা নয়। সেগুলোর একটা দ্বন্দ্ব তো হচ্ছেই। কিন্তু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি যে ব্যক্তিপ্রসূত যে সম্পত্তির ধারণা, সেখান থেকে যে লোভের উৎপত্তি, সেটাই মানুষকে ভয়াবহ দিকে নিয়ে যায়। সমগ্র মানবজাতিকে ভয়াবহ দিকে নিয়ে যায়।
আপনারা বোধহয় সবাই জানেন, হায়দার ভাই খুব একটা বর্ধিষ্ণু সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। তাঁর বাড়ি হচ্ছে চিটাগং বাড়বকুণ্ডে। আমার সঙ্গে তো সব রকম আলাপ হতো। ওঁনার একটা ভাগিনা বা ভাস্তে ওঁনার সাথে আসতেন, চুপচাপ থাকতেন। একটু পাশে পাশে থাকতেন। তিনি বোধহয় ওঁনার কিছু প্রাপ্য ওঁনাকে দিয়েছিলেন। সেটা ওঁনার পার্টিকে দিয়ে দেন। আমি এটা বলতে চাইছি যে, যে বিশ্বাসটা তিনি করতেন, নিজের জন্য গাড়ি, ফ্ল্যাট অমুক-তমুক, এটার মধ্যে তিনি ছিলেন না। সেই বিশ্বাসটা উঁনি শেষ পর্যন্ত রক্ষা করেছেন। আজকের দিনে আমাদের সামনে এরকম উদাহরণ বিরল! আমি তো এরকম উদাহরণের মানুষ খুঁজে পাই না। খুঁজেই পাই না! মুখ দিয়ে অনেক কিছু বলা যায়। অনেকেই বলেছেন, আমি এটা করিনি। তারপর হায়দার ভাইয়ের কাছ থেকে যে যুক্তিবোধটা এসেছে, তখন আমি বলেছি, আপনি মিড্ল ক্লাস, আমিও মিড্ল ক্লাস। আপনি এটা করেননি, সেটা করেননি। তাহলে এটা কী কী করেছেন! এগুলো কী? সেগুলো সাংঘাতিক।
অজয় বাবুর (অজয় দত্ত, চিত্রশিল্পী ও শিক্ষক, নোয়াখালী জেলা স্কুল) কথাগুলিই সত্যি। উনি হয়তো ওনার মতো করে বললেন, আর্টিকুলেট করলেন। আমার কাছে খুব ভালো লাগল। অজয় বাবুর সাথে আমার এর আগে ওইভাবে আলাপ হয়নি। আজকে মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর কথা বলব, সেটার জন্য মোটেও আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না ওইভাবে। কিন্তু কিছুটা আলাপ করলাম এভাবে। যদিও সময়ের স্বল্পতা আছে।
কত স্মৃতি তাঁকে নিয়ে! চলচ্চিত্র-নাটক দেখেছি। ফুটবল খেলা দেখেছি। পুরো রাত জেগে ওয়ার্ল্ড-কাপ দেখেছি। ম্যারাডোনা আমাদের খুব প্রিয় খেলোয়াড় ছিল। এখনও আছে। হায়দার ভাইও খুব পছন্দ করতেন। এরকম ইন্ডিভিজুয়াল স্কিলের ব্যাপার নিয়ে আলাপ হতো যে, আজকে ইন্ডিভিজুয়াল স্কিলটা কমে যাচ্ছে। কালেক্টিভ স্কিলের জায়গায় যাচ্ছে। এই সমস্ত তো আর বিশদভাবে এখানে বলা যাবে না। সেটি বলছি যে, কী নেই তাঁর মধ্যে!
খাওয়া নিয়ে আলাপ হতো। ‘এই খাওয়াটা কেন ভালো লাগছে না, কেন আমাদের মনে লাগছে না’–এভাবে। হায়দার ভাই বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেছেন কলকাতায়। আমার খুব প্রিয় এখন দোসা। তো প্রথম হায়দার ভাইদের অফিসের নিচে (এসইউসিআই) যে দোসার দোকান ছিল, খুব ভালো। বহু বছরের আগের কথা বলছি। তো সেখানে খেতে গিয়েছি। দোসা। ভেতরে সবজি দিয়েছে, ওটা তো আমি পছন্দ করিনি। তখন আমি একেবারেই দোসা খেয়ে অভ্যস্ত না। আপনাদেরকে জানি না আমি বিরক্ত করছি কি না। কিন্তু এই টুকরো টুকরো বিষয়গুলো যখন জোড়া দেবেন, তখন বুঝতে পারবেন যে পুরো পরিপূর্ণ বিষয়ে চলে আসবে আপনাদের সামনে। হায়দার ভাই বললেন দোসা এরকম। আমি বললাম, হতে পারে কিন্তু আমি খাব না। মাঝখানে একটা সবজি ভেজা, আমি ওই যে মচমচে যে শরীরটা আছে ওটাই আমার কাছে পছন্দের। আমি ওটা খেলাম। আমি ওটা বাটিতে করে বললাম যে, আমাকে ছোলা মটর-এ আলাদা করে দিন। দরকার হলে ওখানে ডুবিয়ে নেব। কিন্তু ওটা ওর সাথে মাখিয়ে দেওয়া হলে–ওটা আমি খাব না। পরবর্তীতে অনেক পরে এই আজ থেকে বছর দশেক আগে হবে, দোসা ওরা যে রকম করে দেয়, দক্ষিণ ভারতের লোক বানায় কলকাতায় উল্টোডাঙায় দারুণ। আমি ওখানে যাই গাড়ি ভাড়া করে ঐ ত্রিশ টাকার দোসা খাবার জন্য। ওরা ভিতরে যেটা দেয় হায়দার ভাই যেটা বলেছিলেন, তখন সেটা ওইভাবে খাইনি। কারণ আমি দোসাটা ওইভাবে জানতাম না। আমি আমার মতো করে বলেছি এবং হায়দার ভাই সম্মান করেছেন। বলেছেন ঠিক আছে, আপনি ছোলা মটর-এ নিয়ে নিন। আমি বললাম, মাখিয়ে দিল এটার মধ্যে, কী একটা ব্যাপার। এইভাবে খুব আটপৌরে, খুব আন্তরিক। কত তর্ক-বিতর্ক করেছি। ‘কেন! হায়দার ভাই–এটা আপনি রাগ হলে তো হবে না, আপনি যুক্তি শিখিয়েছেন। যুক্তির একটা জায়গা পর্যন্ত মানবেন, তারপরে আমি যুক্তি করব না, এটা হবে কী করে, এটা কী বলছেন!’ হায়দার ভাইকে এতটা আপন এতটা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিলাম। কারণ, ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশ পাথর। আমি বোধহয় একজন মুবিনুল হায়দার চৌধুরীকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। সেই আমিরুল হক চৌধুরী মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর মতো মানুষটাকে পেয়েছিল। যার সঙ্গে তর্ক করা যায়। কেন যাবে না! সমস্ত কিছু করা যায়। সবশেষে একটা কথা বলি। তাঁর আত্মা যেখানেই থাকুন সুখে থাকুন, শান্তিতে থাকুন। বা উঁনি যেভাবেই আছেন বা না আছেন, যদি থাকেন শান্তিতে থাকুন। এ ব্যাপার নিয়েও কথা হয়েছে ওঁনার সাথে। বলেছেন–পরকাল, এই বিষয় নিয়ে এখন কোনো আলোচনা নেই। আমাদের মানুষের জীবনযাপন, সেইটা নিয়ে আলোচনা। মানুষ, তার জীবনযাপন–তার সবকিছু সেগুলো নিয়ে। সুতরাং হায়দার ভাই এই সমস্ত বিষয় নিয়ে বলতেন।
ব্যক্তি মালিকানার বিপরীতে যে সামাজিক মালিকানার আদর্শগত অভ্যাসে হায়দার ভাই নিজেকে তৈরি করেছিলেন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর জীবনে, যাপনে সে ছাপ তিনি রেখে গেছেন, অন্যদের মধ্যে সে আদর্শ ছড়িয়ে দিয়েছেন।
শেষ করার আগে একটা ছোট্ট কথা বলি। যে কথাটা আমি জানি না। সবার কাছে হয়তো ভালো লাগবে না। লাগতেও পারে। সেটা হচ্ছে ওঁনার একটা ডায়াবেটিক বিস্কিটের প্যাকেট আমার কাছে আছে। সেটা হায়দার ভাই আমাকে দিয়েছিলেন। একটা প্যাকেট-এর মধ্যে একটা বিস্কিট সাদা, উপরে একটা জেলি-জ্যাম জমানো। আমি খুব বিস্কিট খুঁজে বেড়াই। ইউরোপে গেলেও খুঁজে বেড়াই। যেখানেই যাই, খুঁজি। এখন তো জাপানে বেড়াতে গিয়ে বাচ্চাদের বেকারিগুলোতে গিয়ে গিয়ে আমি অনেকক্ষণ ঘুরতাম। ভালো লাগত। নানারকম, মানে অভিভূত হতে হয় ওদের ওখানে বেকারিতে ঢুকলে। তো সেখানে হায়দার ভাইয়ের সেই শেষ বিস্কিটের প্যাকেটটা আমার কাছে আছে। আমি কলকাতায় গিয়ে আবার খুঁজলাম সল্টলেকে। আমি পেলাম না। ওখানকার দারোয়ান বলল যে, স্যার দোকানটা উঠে গেছে। সেই প্যাকেটটা আমি ফেলিনি। রেখে দিয়েছি ওটা আমার কাছে। আমার খুব ভালো লেগেছে। ভালো বিস্কিট খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল। এইভাবে করেছি। আপনারা বুঝতেই পারছেন আমার আবেগটা। আমি অভিনয় করি। আমি তো একটু আবেগপ্রবণ মানুষ।
যতটাই সংযত হই না কেন, কিন্তু কিছু আবেগ তো আছেই। সবাইকে ধন্যবাদ। যারা বিশেষ করে হায়দার ভাইকে স্মরণ করার এই আয়োজনটি করেছে সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ। আমরা যে বলতে পারলাম, আমরা যে এক জায়গায় একে অপরের চেহারা দেখতে পারলাম। মনে হলো হায়দার ভাই আশপাশ দিয়ে আছেন। ঐতো ছবি। ওখানেই আছেন হায়দার ভাই এরকম মনে হচ্ছে। সবাইকে ধন্যবাদ।