Sunday, December 22, 2024
Homeবিশেষ নিবন্ধসংস্কৃতি, বিনোদন ও আমরা -- চন্ডীদাস ভট্টাচার্য

সংস্কৃতি, বিনোদন ও আমরা — চন্ডীদাস ভট্টাচার্য

finial coverকয়েক বছর আগের একটি ঘটনা। আমেরিকার এক শহরের চৌদ্দ বছরের কিশোরী তার বন্ধুকে জানাচ্ছে ‘চৌষট্টি বছরের এক বৃদ্ধাকে মারলাম। বুঝলি, কী কাঁদছিল, ছটফট করছিল – কী দারুণ দেখতে!’ ইদানীং স্কুলের ছাত্র গুলি চালিয়ে তার বন্ধুদের হত্যা করছে – আমরা দেখছি। সংবাদ মাধ্যম থেকে জানছি কানেটিকাটের নিউটাউনে, সান্ডিহুক প্রাইমারি স্কুলে গুলি চালিয়ে হত্যার মর্মান্তিক ঘটনার কথা। দেখছি, কম্পিউটারের সামনে বসে নবীন প্রজন্মের কেউ ‘কিংপিন’ খেলছে- গেমের একটা দৃশ্যে ময়লা ফেলা বাক্সের সামনে খেলোয়াড় একটি মেয়ের সাথে কথা বলছে। যখন আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, তখন খেলোয়াড় কম্পিউটারের বোতাম টিপে মেয়েটির মাথা ফাটিয়ে দিচ্ছে। বইছে রক্তস্রোত। দেখলে মনে হবে সত্যিকারের রক্ত। রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ছে মাথার ঘিলু। খেলোয়াড় জিতে গেল কম্পিউটার গেম-এ। সে আনন্দিত, পুলকিত। বিশ শতকের একেবারে শেষে একটি ঘটনায় দেখা যায়, ব্রাজিলে ডাক্তারি পড়া এক ছাত্র গুলি করে তিনজনকে মারে। জানা যায় ‘ডিউক নুকেম’ নামে এক কম্পিউটার খেলার দৃশ্য দেখে সে ছিল উৎসাহিত।

আনন্দ পাওয়া ও বিনোদনের এই বেদনাময় বিবরণে শিউরে উঠতে হয়। কেউ যদি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমার আনন্দ পাওয়ার, আমার তৃপ্তি পাওয়ার স্বাধীনতা আছে। আমি যেমন করেই আনন্দ পাই তা আমার ব্যক্তিগত বিষয়’ –  তখন সেই কথা কি আমাদের সংবেদনশীল মন মানতে পারে? বর্তমানের এক সঙ্গীতশিল্পী গানের ভাষায় বলেছেন, ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও, আমি নিজেকে নিজের মত গুছিয়ে নিয়েছি’। এই প্রকট স্বার্থপরতার গান কি মূল্যবোধসম্পন্ন কোন মানুষকে আনন্দ দিতে পারে? এই গানের ভাষায় যে আনন্দ পায় তার রুচি, সংস্কৃতি ও চেতনার মান কতটুকু? আমরা জানি মানবসভ্যতার ইতিহাসের যাত্রাপথে এসেছে বিনোদন এবং বিনোদনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মূল্যবোধের প্রশ্ন, এসেছে আনন্দ বেদনা অনুভূতি – এসেছে তার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রূপ। জন্ম হয়েছে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির নানান আঙ্গিকের। তারও বিকাশ ঘটেছে। কত বিচিত্র রসে, ছন্দে ভরা সে সব। তাই ‘সংস্কৃতি’, ‘বিনোদন’, এবং তার সাথে মানব সমাজের সম্পর্কের বিষয়টির গভীর অনুসন্ধান বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। অন্ততঃ যারা মানব সমাজের অগ্রগতি, তার সাথে শিল্প সাহিত্যের সম্পর্কের বিষয়টি বিশেষভাবে দেখতে চান – তাদের কাছে এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। শিল্প, সাহিত্য, সিনেমাসহ বিনোদনের বিভিন্ন উপকরণের কাছে মানুষকে যেতেই হয় –  তার রসকে আস্বাদন করতে হয়। কিন্তু তা আমাদের সমাজ এবং জীবনকে প্রভাবিত করে কি? করলে তা কীভাবে করে? জীবনকে আরও সুন্দর, আরও উন্নত করতে সহায়তা করে কি? সংস্কৃতির সঙ্গে জীবনের কোন পারস্পরিক যোগ আছে কি? এ কথাগুলো বিচার করা দরকার।

যথার্থ ব্যক্তি স্বাধীনতার ধারণা সমাজ প্রগতির পরিপূরক

অনেকে মনে করেন যে, এটা ব্যক্তিস্বাধীনতার যুগ। আমরা ব্যক্তিগতভাবে স্বাধীন। স্বাধীন দুনিয়ার মুক্ত চিন্তার মানুষ আমরা। ফলে ব্যক্তিগতভাবে যেটাকে ভালো বলে মনে করবো আমি সেটাই করবো। আমার যা ভালো লাগে তাই আমি করবো। অপর কেউ সেটাকে যুক্তি দিয়ে বা সামাজিক শৃঙ্খলার কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তাহলে, তা হবে ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা’য় হস্তক্ষেপ। ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে যথেচ্ছাচারের এই ধারণাকে ‘বাজারী’ পত্রিকা খুব প্রচার করে। নিজেদের আভিজাত্য বোঝাতে তারা সাড়ম্বরে বিজ্ঞাপন দেয়- ‘আমি আমার মত’। এর অর্থ হল, আমি আমার ইচ্ছামতো চলব, ভাবব, ক্রিয়া করব। আমার মন যা চায়, তাই করব। কোন কিছুর পরোয়া করব না। নীতি, আদর্শ, মূল্যবোধের কোনও রকম প্রশ্ন তোলাকে তারা ‘খবরদারি’ বা ‘জেঠামশায়গিরি’ বলে ব্যঙ্গ করে। শৃঙ্খল আর শৃঙ্খলাকে তারা সমার্থক করে জনমতকে বিভ্রান্ত করে। পত্রিকার নামী দামী লেখকদের কলমে এরকম লেখা প্রকাশিত হয়। বলে, এটা বিশ্বায়নের যুগ, ডিজিটাইজেশনের যুগ। তাঁদের মতে, বাজারের নিয়ম যেমন, যেভাবে পার দখল করো – সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তাই। বিশ্বায়নের যুগে যা খুশি করার নামই নাকি স্বাধীনতা! তাই শিল্প সাহিত্যে বিনোদনের প্রকরণগুলোতেও আমদানি করা হচ্ছে অনাবশ্যক জটিলতা, বেপরোয়া মানসিকতা, কোনও নিয়মশৃঙ্খলাকে না মানার প্রবণতা। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, স্বাধীনতা মানে কি যথেচ্ছাচার? যথার্থ স্বাধীনতা বলতে কী বোঝায়? দার্শনিক হেগেল বলেছেন- recognition of necessity of freedom, অর্থাৎ প্রয়োজনের স্বীকৃতিই হলো স্বাধীনতা। মার্কসবাদে বিশ্বাসীরা হেগেলের এই কথাটিতে যথাযথ গুরুত্ব দেন। মনে রাখতে হবে, এই প্রয়োজন ব্যক্তির নিজস্ব প্রয়োজন নয়। সমাজের বিকাশের বিশেষ একটা স্তরের সামাজিক প্রয়োজনই যথার্থ প্রয়োজন। আমরা জানি, সমাজ অভ্যন্তরে পরস্পরবিরোধী দুটি শক্তি অবস্থান করছে। তার মধ্যে একটি শক্তি সমাজকে প্রগতির দিকে ক্রমাগত এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। অপর শক্তিটি সমাজের বিকাশের পথে বাধার সৃষ্টি করে। তারা স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে চায়। মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতার উপলব্ধি হল, সমাজের প্রগতির প্রয়োজনকে বুঝে নিজের জীবনে সেই প্রয়োজনকে স্বীকৃতি দেওয়া। একথা বুঝতে হবে, সমাজের অগ্রগতি ব্যাহত হলে সেই সমাজের মধ্যে বাস করা ব্যক্তির বিকাশও ব্যাহত হয়। সমাজকে বাদ দিয়ে কেউই একা একা মুক্তি বা যথার্থ স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে না। সমাজের বিকাশ বা অগ্রগতির সঙ্গে ব্যক্তির বিকাশের প্রশ্নটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই ব্যক্তি তার মুক্তির জন্যই নিজের সমস্ত ক্রিয়াকে সমাজ বিকাশের পরিপূরক করে  পরিচালিত করে। এই উপলব্ধি থেকে বিচ্যুত স্বাধীনতার ধারণা হল প্রকৃত পক্ষে স্বার্থপরতা এবং যথেচ্ছাচার। তা সমাজের প্রতিক্রিয়ার শক্তিকেই শক্তিশালী করে, সমাজকে পিছিয়ে দিতে সাহায্য করে।

প্রায়শই দেখা যায়, এই স্বেচ্ছাচার নিয়ে চলতে গিয়ে প্রথম প্রথম যে আনন্দ-উন্মাদনাই থাকুক তাও একসময় একঘেয়ে হয়ে যায়। জীবনের প্রশান্তি যায় হারিয়ে। এক অদ্ভুত ধরণের restlessness জীবনের মাধুর্যকে ধ্বংস করে। আমরা যারা মনে করছি, আমরা ভালোই আছি- বিশেষ করে সমাজের মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত একটি অংশের মানুষÑযাদের বাড়ি গাড়ি বিত্ত যশ সবই আছে, যেমন খুশি তারা জীবন-যাপন করতে পারেন – তারা মনে করতে পারেন, ‘আমরা বেশ আনন্দে আছি’, কিন্তু বিষয়টা কি সত্যিই তাই? যৌবনের দিনগুলো চলে যাওয়ার পরে সেই আমরা অনেকেই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। অনেকেই বলি, ‘জীবনে যা চেয়েছিলাম তা পেলাম না।’ যেন কোথায় একটা মস্ত ফাঁক। কোথায় যেন একটা একাকীত্বের জায়গা। একটা শূন্যতা। কী যেন পেলাম না। বহু মানুষের, প্রধানত বয়স্ক মানুষের কুঞ্চিত ভ্রু’র দিকে তাকালেই দেখা যাবে, সেখানে বিরাজ করছে কী গভীর শূন্যতা! তার কারণ অনুসন্ধান করে পান না। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বলেন, অতীত যুগ ছিল ভালো। আবার যারা বর্তমান প্রজন্মের নবীন প্রতিনিধি, তাঁরা বলেন, আগের যুগটা ছিল প্রাচীন, গোঁড়ামিতে পরিপূর্ণ। কালের প্রবাহে বর্তমান নবীন প্রজন্ম যখন বয়ঃবৃদ্ধির সাথে সাথে পিতা হন, মাতা হন, সন্তানের সম্পর্কে যখন তাদের মধ্যে দায়িত্ববোধ জাগে, তখন তাঁরাই সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হন। যেমন করে নিজেদের ছেলেবেলা কাটিয়েছেন  সেই দিকে তাঁদের ছেলেমেয়েদের যেতে দিতে চান না। এ এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বের মধ্যে আমরা বাস করছি। আমরা সকলেই বলছি, আমরা উন্নত প্রযুক্তির যুগে বাস করছি। প্রযুক্তি এগোচ্ছে, আমরাও ক্রমাগত ছুটে চলেছি। কিন্তু একটু গভীরে ভাবলেই  সকলে অনুভব করছেন, এই প্রযুক্তির আলোকছটার মধ্যেও কোথায় যেন আমাদের প্রত্যাশাপূরণ না হওয়ার ব্যথা, একটা গভীর শূন্যতা থেকেই যাচ্ছে। প্রযুক্তি এগোচ্ছে, তার প্রয়োজনও আছে। কিন্তু তার সাথে সাথে জীবনের মূল্যবোধ এগোচ্ছে কি? আমরা উন্নত মানুষ হয়ে উঠতে পারছি কি? এই প্রশ্ন শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে।

উন্নত সংস্কৃতি প্রতিফলিত হয় জীবনের উন্নত ক্রিয়ার মধ্য দিয়েই

এই মূল্যবোধের ধারণার সঙ্গে সংস্কৃতির ধারণা জড়িয়ে আছে। সংস্কৃতি বলতে আমরা বুঝি সাধারণভাবে শিল্পকলাকে। কিন্তু শিল্প ও সংস্কৃতি হুবহু এক জিনিস নয়। সংস্কৃতি প্রসঙ্গে এ যুগের একজন মহান মার্কসবাদী দার্শনিক শিবদাস ঘোষ বলেছেন, ‘মানুষের মননশীলতার সামগ্রিক ও সুন্দরতম প্রকাশ হচ্ছে সংস্কৃতি। শিল্প, সাহিত্য, কাব্য প্রভৃতি এই সংস্কৃতির বাহন।’ মননশীলতা গড়ে ওঠে বুদ্ধি এবং হৃদয়বৃত্তির যথার্থ সম্মিলনে। মনে রাখা দরকার, মানুষের জীবনে শুধু বুদ্ধি বা যুক্তিই সব নয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে – কেন? বুদ্ধিবৃত্তি থাকার ফলেই তো মানুষ এত উন্নত ও সভ্য হয়েছে। সামন্তী সমাজের বা মধ্যযুগের কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাসের নিগড় ভেঙ্গে যুক্তিই তো সত্যকে সেদিন তুলে ধরেছে। সেদিনের সেই সত্যকে স্বীকার করে নিয়েই তিনি একটি অনন্য সাধারণ কথাকে তুলে ধরে বলেছেন, ‘কোন বড় জিনিসই শুধু বুদ্ধির কারবার নয়, বুদ্ধি এবং হৃদয়বৃত্তির কারবার’। বুদ্ধি যদি হৃদয়বৃত্তির রসে সিঞ্চিত না হয়  তাহলে চরিত্র গঠিত হয় না। শুধুমাত্র বুদ্ধির বড় কথা বলে মানুষের বুকে আঁচড় কাটা যাবে না। আমরা অনেকেই ছাত্রছাত্রী, যুবক যুবতীদের প্রায়ই বলছি, ‘ভালো হতে হবে, চরিত্রবান হতে হবে’। কিন্তু শুধু তার দ্বারাই কি কেউ ভালো হচ্ছে? হচ্ছে না। প্রসঙ্গত রবীন্দ্রনাথের একটি কথা মনে পড়ে। তিনি বলেছেন, ‘মানুষ মানুষের কাছ থেকেই শেখে, প্রদীপের দ্বারাই প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত হয়, জলের দ্বারাই জলাশয় পূর্ণ হয়’। অর্থাৎ আমাদের বুঝতে হবে, জীবন্ত চরিত্রবান মানুষের সংস্পর্শেই মানুষের মধ্যে চরিত্র, মূল্যবোধ গড়ে ওঠে। এখানেই রয়েছে সংস্কৃতির প্রশ্ন। শেষের কবিতায় রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছেন, কমল হীরের পাথরটা হচ্ছে বিদ্যে, আর সেখান থেকে যে আলো ঠিকরে বের হয়, সেটা হলো সংস্কৃতি। সংস্কৃতি প্রতিফলিত হয় জীবনের ক্রিয়ায়। সংস্কৃতি সঙ্গীত নয়, সংস্কৃতি আবৃত্তিও নয়, সংস্কৃতি ভালো বক্তৃতাপাঠও নয়। তাহলে যথার্থ সংস্কৃতিবান মানুষ বলতে কী বোঝায়?

এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা আমার খুব মনে পড়ে। আমার পরিচিত এক বোন উত্তর বারাসাত স্টেশনে বসেছিলেন। এক ভিখারি তার কাছে ভিক্ষে চেয়েছেন। ট্রেন চলে যাওয়ার পর ফাঁকা স্টেশন। সেই ফাঁকা স্টেশনে তিনি সেই ভিখারির সাথে গল্প করছিলেন। গল্প করতে করতে ভিখারি হঠাৎ বললেন, ‘জানো তো মা, কালকে আমি ভিক্ষে করতে করতে একটু দূরে চলে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখি আমার কাঁথা আর বাঁটিটা নেই। বোধ হয় কেউ নিয়ে পালিয়েছে’। কথাটায় তার নির্লিপ্ত ভাব দেখে আমার বোনের খুব খারাপ লেগেছে। সে বলে, ‘সে কী! তোমার রাগ হলো না?’ উত্তরে ভিখারিটি বলেছিলেন, ‘জানো মা, আমি তো একটা ভিখারি, আমার ছেঁড়া কাঁথা আর ভাঙা বাঁটি যে নিয়ে চলে যায়, সে তো আরও বড় ভিখারি। তার ওপর কী করে রাগ করি বল তো?’ অত্যন্ত সীমিত ক্ষেত্রে হলেও যে উন্নত মননশীলতার পরিচয় ওই বৃদ্ধ ভিখারিটি দিলেন, তাকেই আমরা বলি সংস্কৃতি বা বলা ভাল, সংস্কৃতির উপাদান। এভাবেই সংস্কৃতি উন্নত জীবনবোধে প্রতিফলিত হয়। আমরা যারা সংস্কৃতি বলতে ভালো ভালো নাচ গান আবৃত্তি নাটক সিনেমা বুঝি তারা অনেক বড় বড় কথা  শুনি বা বলি। কিন্তু ঐ বৃদ্ধ অশিক্ষিত ভিখারি যে উন্নত রুচির পরিচয় দিলেন, তা আমরা অর্থাৎ তথাকথিত শিক্ষিতরা অনেকেই জীবনে চলার পথে দিতে পারি না। শুধু কথায় নয়, সংস্কৃতি প্রতিফলিত হয় জীবনের ক্রিয়ায় এবং তা যুক্তির ভিত্তিতে ধীরে ধীরে ক্রিয়া করতে করতে আমাদের দেহ-মনের প্রতিটি অনু-পরমাণুর সাথে মিশে গিয়ে আমাদের জীবনের মূল্যবোধকে পাল্টে দেয়।

মার্কসবাদী দার্শনিক শিবদাস ঘোষ বলতেন যে, শুধু যুক্তি দিয়ে যখন আমরা জানলাম, তখন আমরা এলাম প্রশান্ত মহাসাগরের উপরের তলে। সেই জানার ভিত্তিতে যখন আমি ক্রিয়া করলাম তখনই আমার জানা হবে আরও ক্ষুরধার, শাণিত। সেই শাণিত জানার ভিত্তিতে আমার পরবর্তী জানার সংগ্রাম হবে আরও উন্নত। আবার তাকে ভিত্তি করে আমার ক্রিয়া হবে আরও কার্যকরী। এই অবিরাম জীবন্ত প্রক্রিয়ায় আমরা ক্রমাগত প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরে যেতে পারব। আমাদের মধ্যে আসবে প্রজ্ঞা। ধীরে ধীরে স্বাভাবিকভাবে আমার মধ্যে গড়ে উঠবে উন্নত মনন। সংস্কৃতিগত দিক থেকে আমি তখন অন্য মানুষে পরিণত হবো। কিন্তু সে তো কেবলমাত্র নিজের ছোট্ট আঙিনায় আবদ্ধ থেকে হয় না। শুধু আত্মমগ্ন স্বার্থপর জীবন যাপন করলে হয় না। উন্নত সংস্কৃতির যে অধিকারী সে জীবনে উন্নত মূল্যবোধের পরিচয় দেবে। জীবনে অনেক কিছুরই প্রয়োজন হয়। কিন্তু তা কি সম্মান হারিয়ে আমরা পেতে চাইব? সে পাওয়া কি মনুষ্যত্বকে তৃপ্ত করে? যেমন, আমরা জীবন ধারণের জন্য জল খাই। কিন্তু পিপাসা পেয়েছে বলে, কেউ নর্দমার জল এনে দিলেই আমি সেটা খাবো কি? পেটে ক্ষুধার জ্বালা, তবু অবমাননার অন্ন বিবেকবান মানুষের গলা দিয়ে নামতে চায় না। দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে গিয়ে বাঘাযতীন ইংরেজ পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন। মৃত্যুশয্যায় শায়িত তৃষ্ণার্ত বাঘাযতীন জল খেতে চাইলেন। তখন তাঁর দেহের অণু-পরমাণু জল চায়। তাঁকে জল এনে দিয়েছিলেন অত্যাচারী ইংরেজ পুলিশ অফিসার। বাঘা যতীন সেই জল ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। এই হল উন্নত সংস্কৃতির পরিচয়। মানুষ কোনো জিনিস গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু গ্রহণ করার সাথে তার রুচি সংস্কৃতি মূল্যবোধ-এর প্রশ্ন যুক্ত থাকে এবং ধীরে ধীরে তার স্তর আরও পরিশীলিত ও উন্নত হয়। সত্যকে জীবনে গ্রহণ করার মধ্যে যে আত্মমর্যাদাবোধ সৃষ্টি হয় সেই আত্মমর্যাদাবোধকে অবনমিত করে সে কোন কিছু গ্রহণ করতে পারে না। সমগ্র ধনতান্ত্রিক সমাজ আজ ‘খাও-দাও-স্ফূর্তি’ করার জীবনবোধকে নানা ভাবে প্রচার করে আত্মমর্যাদাকেই ধ্বংস করছে। তার বিষময় ফল সম্পর্কে আমরা সদাসতর্ক থাকছি না। ব্যক্তিগতভাবে ভোগ করার জন্য মানুষের কামনাকে প্রতিদিন প্রতি মূহুর্তে এই পুঁজিবাদী সমাজে সুকৌশলে বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। কোন কিছু ভোগ্যবস্তু যেমন করেই হোক পাওয়ার উদগ্র বাসনা সমাজ মননে এমন করে তৈরি করা হচ্ছে, যেন না পেলেই জীবন ব্যর্থ। একদল এমনও মনে করেন, যেমন তেমন করে ভোগ করার মধ্যেই আছে ব্যক্তির আনন্দ, তার তৃপ্তি। মনে করেন, আমার যা ভালো লাগে সেটা আমি করবো, আমার যা খুশি তাই আমি জীবনে করবো – এতে অন্যায় কোথায়? প্রসঙ্গটা বঙ্কিমচন্দ্র তুলেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘তুমি সাহিত্য পড়ে যে আনন্দ পাও আমি শতরঞ্জ খেলে যদি সেই আনন্দই পাই তাহলে কি সাহিত্য পাঠ আর শতরঞ্জ খেলা একই’? প্রশ্নটা তুললেও, ঐতিহাসিক কারণেই তাঁর পক্ষে উত্তর দিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় নি। তাই তিনি লোকশিক্ষার প্রশ্ন তুলে সাহিত্য পাঠের পক্ষে বলেছেন। মনে রাখা দরকার, ভোগের মধ্যে এক ধরনের তৃপ্তি আছে একথা আপাতভাবে ঠিক। কিন্তু তার একটা সামাজিক তাৎপর্য আছে; তৃপ্তির সাথে সত্য, ন্যায়- অন্যায়বোধ মানুষের হৃদয়ের আদান-প্রদানের মাধুর্য থাকে, তা বাদ দিয়ে সত্যকার তৃপ্তি হয় কি?

যেমন ধরুন, আমাদের দরিদ্র পরিবারে মা আছেন। একটা ভালো খাবার এসেছে। আমাদের ভাইবোনদের ও বাবাকে মা সে খাবার ভাগ করে দিলেন, শেষে হয়ত দেখা গেল তাঁর নিজের জন্যই নেই। আমরা তো খেয়ে তৃপ্ত হলাম। কিন্তু আমাদের মা কীসে তৃপ্ত হলেন? তিনি আমাদেরকে দিয়ে তৃপ্ত হলেন। তাই তৃপ্তিরও দুটি আলাদা কাঠামো আছে। যেমন,জালালাবাদ যুদ্ধে মাষ্টারদা লড়াই করছেন। সঙ্গে আছেন নির্মল সেন সহ আরো অনেকে। দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ হয়ে আছেন, খাদ্য নেই। দুটো তরমুজ পাওয়া গিয়েছিল। একখ- করে প্রত্যেককে দেওয়া হয়েছে। সকলকে দেওয়ার পর নির্মল সেন যখন তরমুজের শেষ টুকরো মুখে তুলতে যাবেন, তখন টেগরা (আরেকজন বিপ্লবী) এসে বলছে- ‘আছে না কি দাদা আরেকটা?’ নির্মল সেন সঙ্গে সঙ্গে নিজেরটা টেগরাকে দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ রে নে।’ এতেই নির্মল সেনের তৃপ্তি। যদিও পরের ঘটনা আমাদের সকলের মধ্যেই বেদনা সৃষ্টি  করে। রাতে যখন সবাই শুয়ে পড়েছে, তরমুজের যে খোসাগুলো পড়েছিলো সেটা নির্মল সেন চিবিয়ে খাচ্ছেন। তা দেখে টেগরা কেঁদে ফেললেন। বললেন- ‘তুমি অমানুষ। তুমি কেন তোমার খাবার আমায় দিয়ে দিলে?’ নির্মল সেনের মুখে তৃপ্তির হাসি, চোখের কোণে আনন্দের অশ্রু। এ এক সুন্দর আদান-প্রদান। গভীর হৃদয়াবেগের এক অপরূপ দৃষ্টান্ত। তৃপ্তিবোধের কী মাধুর্যম-িত রূপ! এ জিনিস আমরা পাই মানবসমাজের মধ্যেই। মানুষ ব্যতীত অন্য কোন প্রাণীর মধ্যে পাই না। তার কারণ, একমাত্র মানুষেরই চিন্তা করার ক্ষমতা আছে। এই চিন্তা করার ক্ষমতার জন্য মানুষ সমাজবদ্ধ হয়েছে, সমাজে এসেছে মমতা, ভালবাসা, প্রীতি, মান-অভিমান। সমাজের অগ্রগতির সাথে সেইসব অনুভূতিগুলো কত সূক্ষ্ম রূপ পেয়েছে! মানুষের রসবোধকে কত উচ্চস্তরে পৌঁছে দিয়েছে। এখানেই যথার্থ আনন্দ অনুভূতির বৈচিত্র্য, যার সঙ্গে যুক্ত সংস্কৃতির প্রশ্ন।

সমাজের বিভাজনের ফলে দু-ধরনের সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে

মানুষ বাঁচতে গিয়ে সমাজবদ্ধ হয়েছে। বহু প্রাণী দলবদ্ধ হয়ে বাঁচে। দলবদ্ধতা আর সমাজবদ্ধতা এক নয়। মানুষ সমাজবদ্ধ হয়েছে উৎপাদনের উদ্দেশ্যেই। একেবারে শুরু থেকেই এই সমাজবদ্ধতার মধ্যে চিন্তার ক্ষমতার ভিত্তিতে সামান্য হলেও চেতনার ভূমিকা থাকে – যা মানুষ ছাড়া কোন প্রাণীর থাকে না। প্রথমে বানর যে রকম পাথর ছুঁড়েছে, মানুষও পাথর ছুঁড়েছে। কিন্তু চিন্তা করার ক্ষমতা থাকায় মানুষ বানরের মত শুধু পাথর ছুঁড়ে চিরদিন থেমে থাকেনি। সে কিন্তু পাথরটাকে ধারালো করেছে, পাথরকে কাজে লাগিয়েছে। এটা হল মানুষের উৎপাদন। আবার পাথরের বাঁটকে সে কারুকার্য খচিত করেছে। পাথর ধারালো করাটা মানুষের বস্তুগত উৎপাদন, আর পাথরের বাঁটকে কারুকার্য খচিত করাটা তার ভাবগত উৎপাদন। মানুষের উৎপাদন দু’ধরনের। বস্তুগত ও ভাবগত। মানুষের ভাবগত উৎপাদনটা বস্তুগত উৎপাদন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। ভাবগত উৎপাদনের ভিত্তি যে বস্তুগত উৎপাদন এটাই দেখিয়েছে মার্কসবাদ।

মানুষ জীবনে বাঁচতে চায়। পশুদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে চায়, প্রকৃতির তা-ব থেকে বাঁচতে চায়। কী করে বাঁচবে? এখানে মনে রাখতে হবে, পশুরা হচ্ছে অবস্থার দাস। মানুষ কিন্তু তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর প্রভাব বিস্তার করে তাকে পরিবর্তন করতে পারে। তবে একথা ঠিক, মানুষ বস্তুজগতের কোনো নিয়মকে পরিবর্তন করতে পারে না। মানুষ কোন নিয়ম তৈরী করতেও পারে না, ধ্বংসও করতে পারে না। জানতে পারে, জেনে তাকে কাজে লাগাতে পারে। কী করে কাজে লাগায়? নিয়মের কোনও দিককে সে সক্রিয় করে আবার কোনও নিয়মকে মানুষ নিষ্ক্রিয় করে অন্য কোনও নিয়মকে সক্রিয় হতে সুযোগ দেয়। মানুষ শুধু যূথবদ্ধ নয় সমাজবদ্ধ হয়ে এই নিয়মকে কাজে লাগিয়েছে। উন্নততর বাঁচার তাগিদেই মানুষ সমাজবদ্ধ হয়েছে। আজ যেমন আমরা ক্লাব করি, সংগঠন করি কি মিটিং করি একত্রিত হওয়ার জন্য, তখনতো আর এরকম ছিলো না। বাঁচবার প্রয়োজনকে সামনে রেখেই মানুষের সমাজবদ্ধ হওয়ার ইতিহাস রচিত। এর জন্যই প্রয়োজন হয়েছিল একজনের অভিজ্ঞতা আরেকজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া। দেখা গেল, কোন গুহায় পশুর আক্রমণে হয়তো মানুষ মারা গিয়েছে। যে কটা মানুষ বেঁচে আছে চলে যাওয়ার সময় অপটু হাতে সে খোদাই করে দিয়ে যেত ওই পশুর তখনকার একটা মূর্তি। যাতে পরে যে আসবে সে বুঝতে পারবে যে, এখানে হিংস্র পশু আছে। বা এঁকে মানুষ বুঝিয়েছে পশুর শরীরে হৃদপি-টা কোথায়, যেখানে তীর মারতে পারলে অমোঘ হবে। ছবি এঁকে এই জ্ঞানটা সে পরবর্তী প্রজন্মকে দিয়ে গিয়েছে।

এইভাবেই শিল্পের শুরু। মানুষ কোনো না কোনো মাধ্যমে তার অভিজ্ঞতাকে অন্যের কাছে পৌঁছে দিয়েছে জীবনকে উন্নত করার জন্য। তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠেছে শিল্পের নানান আঙ্গিক। সেই শিল্প যেমন ব্যক্তির জীবনের অভিজ্ঞতাকে সম্মিলিত অভিজ্ঞতায় পরিণত করেছে, তেমনি নানান আঙ্গিকে পরিবেশনার মধ্য দিয়ে মানুষের রসবোধ উন্নত হয়েছে। আনন্দ-বিনোদনের নানান উপাদান সৃষ্টি করেছে। প্রকৃতির সঙ্গে নিয়ত সংগ্রাম করতে করতে মানুষ ভীষণ পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ত। তারপর একতাবদ্ধ হয়ে যখন  ফিরে আসত, তখন কী করতো? একত্রিত হয়ে তখন তারা নাচত, গাইত, নানান অঙ্গভঙ্গী করত শ্রান্তি কাটানোর জন্য। অর্থাৎ একটি শ্রমের পর দৈহিক মানসিক শ্রান্তিকে কাটিয়ে পরবর্তী শ্রমে যাওয়ার জন্য অন্তর্বর্তী পর্যায়ে যে শিল্প ও ভাবগত উপভোগ – সেটাই বিনোদন।  প্রাথমিক পর্যায়ে এই বিনোদন ছিল ঐক্যবদ্ধ। বিনোদনটা ছিল সমগ্র গোষ্ঠীর, ছিল সকলের। তখনকার দিনের বিনোদনের উপকরণগুলো নিশ্চয়ই এখনকার মতো ছিল না। প্রাথমিক পর্যায়ে বিনোদন সরাসরি জীবনের প্রয়োজনের সঙ্গে যুক্ত ছিল, সেটা বোঝাও ছিল সহজ। শিকারে ভাল পশুর সন্ধান পাওয়া, কৃষির শুরুতে বৃষ্টির আকুতি এই সবই ছিল দলবদ্ধ নাচগানের বিষয়। জীবন যত উন্নত হয়েছে, মানুষের চিন্তাধারা যত সূক্ষ্ম স্তরে গিয়েছে বিনোদনের ক্ষেত্রে তার রূপটাও একটু একটু করে পরিবর্তিত হয়েছে। উন্নত থেকে উন্নততর হয়েছে। পরিবর্তিত হতে হতে একসময় যূথবদ্ধ বিনোদনের রূপটা কিন্তু ভেঙে গেল। ইতিহাস থেকে আমরা জানি, স্থায়ী সম্পত্তিকে কেন্দ্র করে মানুষে মানুষে প্রথম বিভেদ সৃষ্টি হলো। একসময়ে যে পৃথিবীটা ছিল সকলের- তা হয়ে গেল একদলের। একদল হল প্রভু, বাকিরা হলো ক্রীতদাস। সমাজে এই বিভাজনটি যে হলো, এই বিভাজনের ফলে বিনোদনটাও হল বিভাজিত। যদিও শিল্পীদের মধ্যে একটা অংশ শিল্প সাহিত্যের চিরন্তনতা, সৌন্দর্যবোধের চিরন্তনতাতে বিশ্বাস করেন এবং এই সামাজিক বিভাজনকে অস্বীকার করেন।

আবার কেউ কেউ অর্থনৈতিক বিভাজন মেনে নিলেও শিল্প সংস্কৃতির বিভাজনকে মানতে চান না। কিন্তু বাস্তব তো তাই। দাস প্রভুর যাতে বিনোদন, ক্রীতদাস তো তাতে আনন্দ পেল না। দাসপ্রথাতে দেখা গেল যে, দাসপ্রভুর বিনোদনের জন্য ক্রীতদাসের রক্ত দরকার। গ্লাডিয়েটরদের অস্ত্র হাতে পরস্পরের বিরুদ্ধে বা হিংস্্র পশুদের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়া হতো রোমের কলোসিয়ামে। যতক্ষণ পর্যন্ত না একজনের মৃত্যু হচ্ছে ততক্ষণ লড়াই চলতো। আর দর্শকাসনে বসে প্রভুরা এই পাশবিক দৃশ্য দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতেন। আবার দাসরা যাতে বিদ্রোহ না করে, তার জন্য এই দাস প্রভুরাই তাদের বিনোদনের একটা অংশ দাসদের মধ্যে পরিবেশন করে দাসদের ভুলিয়ে রাখতে চাইত। এর দ্বারা কিছু বশম্বদ তৈরি করলেও ব্যাপক অংশের অত্যাচারিত দাসেরা কিন্তু তা মেনে নেয়নি। এর পাল্টা হিসেবে তাদের মধ্যে জন্ম নিল পাল্টা সংস্কৃতি। যেমন দাস বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক স্পার্টাকাস প্রথম খনিতে কাজ করতেন। দাসপ্রভুদের ক্রমাগত চাবুক পড়ত গায়ে, খাদ্য হিসেবে বরাদ্দ ছিল অতি সামান্য গম আর সারাদিনের জন্য চামড়ার ছোট্ট থলিতে একটুখানি জল। সারা দিনরাত অন্ধকার খনি গর্ভে অবর্ণনীয় অত্যাচারে দিন কাটাতো তারা। এমনকি পরস্পরের সাথে কথা বলাও ছিল নিষিদ্ধ। জনশ্রুতি আছে, স্পার্টাকাস নিজে শুধু গুন গুন করে গান গাইত। সেই গান তার পাশের কাছাকাছি দাসরা শুনতো। সেই গানের মধ্য দিয়ে নিজেদের জীবনের দুঃখ-ব্যথা বেদনার কথা, এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বাণী অন্য দাসেদের কাছে পৌঁছাতো। তারা আবার সেই গান পৌঁছে দিত পাশের জনকে। এভাবেই সেদিন বিদ্রোহের অঙ্গীকার সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল সমগ্র দাস সমাজের মধ্যে। গান শুধুমাত্র গান থাকল না, ‘বিশুদ্ধ’ বিনোদনের পরিবর্তে বিনোদন হয়ে উঠেছিল তাদের বিদ্রোহের হাতিয়ার। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, সমাজ জীবনের শুরু থেকেই বিনোদন শিকারের জন্য আকুতি বা বৃষ্টির জন্য আকুতির মতো কিছু বক্তব্য পৌঁছে দিয়ে শ্রমের কষ্টকে লঘু করেছে, মানুষকে তৈরি করেছে পরবর্তী পর্যায়ের শ্রমের জন্য। তাই, বিনোদন যেমন শ্রমকে লাঘব করে, তার পাশাপাশি সেই বিনোদনের মাধ্যম দিয়েই কিছু বক্তব্য পৌঁছে দেওয়া হয়। তাই সচেতন শিল্পীর কাজ কিন্তু শুধু যেমন তেমন করে বিনোদন দেওয়া নয়। মানুষ যাতে বিনোদনের মধ্য দিয়ে, শিল্পের রস আস্বাদন করতে করতেই সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠে এবং মিথ্যার জাল ছিন্ন করে সত্যের আলোকে জীবনকে উদ্ভাসিত করতে পারে তা দেখাও শিল্পীর কাজ। এখানে শিল্পের একটা বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে। তাই বিনোদন যেমন মনকে ভারমুক্ত বা অবসাদমুক্ত করে, পরবর্তী শ্রমে উজ্জীবিত করে- আবার পাশাপাশি শিল্পের মধ্য দিয়ে মনন জগতে উন্নত সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি আকুতি সৃষ্টি হয়। তার আভাস মানুষ পায়। সেই উদ্দেশ্যমুখিনতাটা খেয়ালে না থাকলে বিনোদনের ফলটা হয় প্রতিক্রিয়াশীল, তা যথার্থ বিনোদন হয় না।

মধ্যযুগেও সামন্তপ্রভুদের বিনোদন ও ভূমিদাসদের বিনোদন ছিল ভিন্ন চরিত্রের

মধ্যযুগে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবার পর প্রথম দিকে তাদের সংস্কৃতি ছিল দাসপ্রভুদের তুলনায় খানিকটা প্রগতিশীল। পরে যত দিন যেতে লাগল তত সেই প্রগতির রূপটা হারিয়ে তা ক্ষয়ের দিকে চলে যেতে লাগল। মধ্যযুগে শিল্প সাহিত্য বিনোদন প্রধানত ছিল ধর্মকেন্দ্রিক। ধর্মীয় মাহাত্ম্য বর্ণনাই ছিল মূল। ধর্মীয় ধারণায় রাজা ছিলেন ঈশ্বরের সন্তান। ফলে সাহিত্য শিল্প সর্বত্রই ছিল রাজা-রাজড়াদের মাহাত্ম্য বর্ণনা। পুরোহিততন্ত্র এবং রাজতন্ত্র মিলে ভূমিদাসদেরও এই চিন্তায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল জমিদারদের শাসনের সুবিধার্থে। আবার মধ্যযুগে সমস্ত শিল্প সাহিত্য ঈশ্বর-রাজা-অথরিটির চিন্তাকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে আবর্তিত হলেও তার বিপরীতে এই যুগের শিল্প সাহিত্যে সমাজের বঞ্চিত মানুষের ব্যথা-বেদনা অসহায় জীবন ও তাদের ক্ষোভের চিত্রও বারবার ফুটে উঠেছে। আমাদের বাংলাদেশের কথাই ধরুন। এখানে লোকসাহিত্যে বা মঙ্গলকাব্যে বারে বারে এই ছবিগুলি উঠে এসেছে। চর্যাপদ-শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-মঙ্গলকাব্য-শাক্তপদাবলী সর্বত্রই আমরা দেখতে পাই এগুলি সমসাময়িক কালের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে সাধারণ শোষিত মানুষের নিপীড়িত অবস্থার ছবি তুলে ধরেছে। চর্যাপদগুলি লেখা হয় খ্রীষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে। ওই সময় বাংলায় দুটি রাজ বংশের দেখা মেলে পাল ও সেন রাজবংশ। প্রথমোক্তরা অস্তাচলে, দ্বিতীয়োক্তরা উদয়াচলে। ধর্ম মতে পাল রাজারা বৌদ্ধ ও সেন রাজারা কট্টরভাবে ব্রাহ্মণপন্থী। পৌরণিক হিন্দু ধর্ম তার যাবতীয় আচার বিচার, কৃত্য সংস্কার, সামাজিক স্তরভেদ ইত্যাদি নিয়ে সেন আমলে আত্মপ্রকাশ করেছিল। ব্রাহ্মণ্য ধর্মও কঠোরভাবে অনুসৃত হতে থাকে। ফলে হাড়ি, ডোম, শবর প্রভৃতি তথাকথিত অন্ত্যজ জাতিগুলো উচ্চবর্ণের প্রবল নির্যাতনের মুখে পড়ে। সামাজিক স্তরভেদে এরা ‘অস্পৃশ্যে’ পরিণত হয়। চর্যাপদে ও মঙ্গলকাব্যগুলিতে সমাজের নীচের তলায় পড়ে থাকা এই অন্ত্যজ-অস্পৃশ্য শোষিত মানুষের কথা বারে বারে এসেছে।

চর্চার কবি ঢেন্ডনপাদ বলছেন, ‘টালত মোর ঘর নাহি পরবেসি, হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেসি’ অন্ত্যজ মানুষের ঘর টিলার উপর তার কোনো প্রতিবেশি নেই, অতিথি এলেও তার হাড়িতে ভাত নেই। কেন এত অভাব? কবির প্রশ্নÑ ‘দুহিল দুধু কি বেন্টে যামায়’? দোহন করা দুধ কি আবার বাঁটে ফিরে যাচ্ছে? কবি মুকুন্দরামের ধর্মমঙ্গলের ফুল্লরার বারমাস্যায় বারোমাসের অভানীয় দুঃখের ছবি, শীতবস্ত্রের অভাবে ‘জানু-ভানু-কৃশাণু শীতের পরিত্রাণ।’

কবিতার কারণে মঙ্গলকাব্যের কবিরাও বারে বারে অত্যাচারিত নিগৃহীত হয়েছেন। মুকুন্দরাম-ক্ষেমানন্দ-রামদাস আদক-ঘনরাম চক্রবর্তী-রামেশ্বর ভট্টাচার্য-ভারতচন্দ্র প্রমুখরা সকলেই কমবেশি সামাজিক রাজনৈতিক উপদ্রবের শিকার হয়েছেন। আকবরী বাংলায় নতুন করে রাজস্ব নির্ধারণের সময় অরাজকতা দেখা দেয়। অত্যাচারে মুকুন্দরাম গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হন, দুমুঠো ভাতের জন্য শিশুর কান্নায় কবির হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যায়।

এমন আরও অসংখ্য উদাহরণ ছড়িয়ে আছে মধ্যযুগের শিল্প-সাহিত্য-কাব্যসহ বিনোদনের উপকরণগুলিতে। তাই মধ্যযুগেও সাধারণ মানুষের বিনোদন সংস্কৃতি আর ধর্মীয় প্রভু বা রাজাদের সংস্কৃতি ছিল আলাদা। মধ্যযুগের শেষ পর্যায়ে বিনোদন একটু একটু করে ব্যবসায়িক বা অর্থ রোজগারী হতে থাকে। যে বিনোদন ছিল শ্রমকে লাঘব করা এবং মানুষের জীবনকে আরও উন্নততর দিকে নিয়ে যাওয়ার হাতিয়ার সেটা ধীরে ধীরে পণ্যে পরিণত হতে থাকল। এলো নতুন ধনতান্ত্রিক সভ্যতা। এই ধনতান্ত্রিক সভ্যতা এলো নব জাগরণের মধ্য দিয়ে। গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের লড়াই যাঁরা করেছিলেন, তাঁরাই প্রথম এই কথা তুললেন যে, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই। ধর্মীয় মহাপুরুষরা তাঁদের সময়ে বড় মানুষ ছিলেন এ কথা ঠিক কিন্তু ধর্মীয় মহাপুরুষরা আপামর জনতার জীবনের সমস্ত সমস্যা সমাধানের সঠিক বৈজ্ঞানিক পথকে পাননি। সে যুগের ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতার জন্য তা সম্ভবও ছিল না। এ কথা সত্য, সমাজের শ্রেণী বিভাজনের পরই বস্তু জগত বহির্ভূত অতি প্রাকৃত সত্ত্বা বা ঈশ্বর চিন্তার জন্ম হয়েছে এবং সবসময় না হলেও মূলত তা শোষক শ্রেণীকেই সাহায্য করেছে। কিন্তু সমাজের বিশেষ একটা স্তরে ধর্মীয় মহাপুরুষরা মানব কল্যাণের কথা ভেবে এই প্রশ্ন তুলেছিলেনÑ ভগবান বা আল্লাহর সৃষ্টি যদি আমরা হই তাহলে আমাদের মধ্যে বিভেদ থাকবে কেন? পরবর্তীকালে সেই ধর্মও কুসংস্কারের জন্ম দিল। আমাদের এই বাংলায় সতীদাহ প্রথাসহ হিন্দু কুসংস্কার গোটা দেশকে নষ্ট করে দিল। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় খুব দুঃখ করে বলেছেন, প্রাচীন ভারত একসময় ছিল অনেক উন্নত। তখন মানসিক ও দৈহিক শ্রমের মধ্যে বিভাজন ছিল না কিন্তু হিন্দু ঋষি মনু জাতিভেদ প্রথা সৃষ্টি করলেন। মাথা থেকে হাতকে বিচ্ছিন্ন করা হল। মানসিক ও দৈহিক শ্রম আলাদা হয়ে গেল। ইউরোপ আমেরিকাতে একই জিনিস হলেও পরে সেই বিষ থেকে সেই দেশগুলি অনেকটা মুক্ত হয়েছিল। এদেশের ধর্মীয় কুসংস্কারের জন্য তা হল না।

নবজাগরণের যুগ নিয়ে এসেছিল সত্যোপলব্ধির ভিত্তিতে যথার্থ সৌন্দর্য সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা

মধ্যযুগের এই অন্ধতা, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক চেতনাকে সামনে রেখে এল নবজাগরণ। নবজাগরণ শিল্প সাহিত্য সঙ্গীত সব দিক থেকেই পুরাতন অন্ধ ঈশ্বরকেন্দ্রিক সমাজের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল। এল মানবতাবাদী উন্নত চিন্তা। ইউরোপে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, শেলী, শেক্সপিয়ার আরও অসংখ্য মনীষী তাঁদের অবিস্মরণীয় শিল্প সৃষ্টির মধ্য দিয়ে এই উন্নত মানবতাবাদী চিন্তার প্রসার ঘটান। আমাদের দেশেও রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, প্রেমচন্দ, কবি সুব্রহ্মণম ভারতী, পরবর্তীকালে নজরুল, শরৎচন্দ্র, ইকবাল, ফৈজ আহমেদ ফৈজ সৃষ্টি করলেন অবিস্মরণীয় সাহিত্য কীর্তি। রামমোহন-বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কারের পাশাপাশি এলেন পণ্ডিতা রমাবাঈ, জ্যোতিবা রাও ফুলে। এই সময়েই প্রশ্ন উঠল সত্য কোনটা? যে সমাজে আমি আজ আছি, তা তো পূতিগন্ধময় আবর্জনায় পরিণত হয়েছে, সমস্ত প্রগতির পথে আজ সে বাধা। এই সমাজের বন্ধ্যাত্ব থেকে আমি মুক্ত হতে চাই – এই হল যুগের আকাঙ্ক্ষা । নতুন সমাজের আকুতি বা আকাঙ্ক্ষা মানুষের মধ্যে প্রতি মূহুর্তে অনুভূত হচ্ছে। এইটি যুগসত্য হিসেবে দেখা দিল। যে কবিতা, যে গান, যে গল্প, যে আনন্দ, যে শিল্প, যে বিনোদন এই আকুতি অর্থাৎ এই যুগসত্যের পরিপূরক, তাই একমাত্র সুন্দর। সেই আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করার দিকেই আমার মানসিকতা যখন ধাবিত, তখনই তা সুন্দর। নবজাগরণের এই যুগে প্রশ্ন উঠেছিল, সুন্দর পাবে কোথায়? সুন্দরের অস্তিত্ব কোথায়? একমাত্র সত্যে। ইউরোপে কবি কীট্সের কণ্ঠে ধ্বনিত হল, Truth beauty, beauty truth। সত্য পাবে কোথায়? সমাজের অগ্রগতির জন্য যা প্রয়োজন, তাকে উপলব্ধি করার মধ্যেই রয়েছে সত্যের উপলব্ধি। তাই যে সমাজ চলবার পথে অকার্যকরী হয়ে পড়ে, স্থবির হয়ে পড়ে, তা ভেঙ্গে নতুন সমাজ গড়বার মধ্যেই সত্য নিহিত থাকে। কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘পুরাতন পচা সমাজের গায়ে স্নেহের হাত বুলিয়ে তার মঙ্গল করা যায় না।’ তাকে দ্রুত ভাঙতে হয়। নতুন সৃষ্টির জন্যই ভাঙতে হয়। এ নতুন সভ্যতার দিকে আমার কবিতা কি পাঠকদের এগিয়ে দেয়? নাকি বলে ঘরের মধ্যে বসে থাকো? আমার গানের অনুভূতির দ্বারা মানুষের মধ্যে নতুন সমাজ গড়ার আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠছে কি? কাজের অনুপ্রেরণা আসছে কি? নাকি সেই গান দিয়ে কতগুলো উন্মত্ত জৈবিক প্রবৃত্তি জেগে উঠছে? এইভাবেই কবিতা, নাটক, গল্প, গান যথার্থই সুন্দর কিনা বা সত্যভিত্তিক কিনা তা বিচার করা যাবে। আমাদের বোঝা দরকার, নবজাগরণের মধ্য দিয়ে যে উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজ সৃষ্টি হয়েছিল কালের নিয়মে সেই সমাজও আজ আর অগ্রগতির পথ দেখাতে পারছে না। মানুষের মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য একদিন যে মর্যাদাবোধের জন্ম দিয়েছিল – আজ তা নিকৃষ্ট ব্যক্তিস্বার্থ এবং ব্যক্তিবাদ সৃষ্টি করছে। এই সমাজের আমূল পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা এবং তার প্রয়োজন নূতন যুগ সত্যের জন্ম দিয়েছে। জীবনে তাকে স্বীকৃতি দিতে পারার মধ্যেই নিহিত রয়েছে আজকের আত্মমর্যাদার প্রশ্ন।

বর্তমান সমাজব্যবস্থায় মালিক মজুরকে এই সমাজের পচা-গলা সংস্কৃতির শিকার বানিয়ে তোলে

নবজাগরণের এবং আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মদানের ঘাম-রক্ত ঝরা পথ বেয়ে আমরা এই যে বর্তমান সমাজে বাস করছি মনে রাখা দরকার, তা দুটি ভাগে বিভক্ত। একদিকে শাসকশ্রেণী অপরদিকে শোষিত-নির্যাতিত মানুষ। একদিকে একদলের ঘরে স্তূপীকৃত সম্পদের পাহাড় – অন্যদিকে তীব্র হাহাকার। মালিকরাই ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতায়। এই দুই শ্রেণীর দুটি চাহিদা – দুটি স্বার্থ। কোনওভাবেই তাকে অস্বীকার করা যায় না। এখানে বিনোদনের চরিত্রও দুটি। মালিকের আনন্দ বিনোদন আর মজুরের আনন্দ বিনোদনের প্রকৃতি আলাদা। ধনতান্ত্রিক এই সভ্যতার ইতিহাস খুললে দেখতে পাওয়া যাবে, মালিক শ্রেণী গণতন্ত্রের নামে মজুরদের কাছে এক বিশেষ ধরনের বিনোদনের পথ খুলে দিয়েছে। কিন্তু তার তাৎপর্য কী? সেই বিনোদন কি মালিকরা দিয়েছে? শোষিত মানুষের মধ্যে সত্য চেতনার পথকে প্রশস্ত করতে? না, তা নয়। অভাব অভিযোগ পরিশ্রমের মধ্যে পড়ে থাকা রিক্ত, শ্রান্ত মজুর তার পুরো শ্রম মালিকের মুনাফার কাজে যখন দিতে অপারগ হয়Ñ তখন তাদেরকে ‘বিশেষ বিনোদন’ দেয় মালিক। ‘বিশেষ বিনোদন’ এই কারণে যে, এই বিনোদন অশান্ত মনকে সাময়িকভাবে চেতনাহীন, নিষ্ক্রিয় করে দেয়। উদয়াস্ত পরিশ্রম করার পরে দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের অভাবজনিত কারণে যে অতৃপ্তি এবং সেই অতৃপ্তি থেকে যে বিদ্রোহ, তা যদি উৎসাহিত হয়, তাহলে তো মালিকের ঘোর দুর্দিন। ফলে, মালিক চায় না-পাওয়ার কথা, অধিকারের কথা, বিদ্রোহের কথা মজুর ভুলে থাকুক। সে যাতে ভুলে থাকে, সেজন্য তাকে উন্মত্ত করে রাখে। নেশায় বেহুশ করে। দেখা যায়, পৃথিবীর সমস্ত কারখানার কাছাকাছি শ্রমিক বস্তি আছে এবং সমস্ত বস্তির কাছে মদের দোকান আর দেহব্যবসার বন্দোবস্ত রয়েছে। ‘কেন সব থেকেও কোন কিছুতেই তার অধিকার নেই’ – এসব ভাবনা চিন্তার অবসর যাতে সে না পায় তার আয়োজনে ‘বিনোদন’। জীবনযাপনটাকে এমন করে দাও যে, দু’বেলা দু’মুঠো খাবার যোগাড় করার জন্য শ্রমিক উদ্ভ্রান্তের মত সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কেবলই ছুটবে। আর, যদি অবসর থাকে, তখন তাকে এমন সবকিছুতে মাতিয়ে রাখ, যার সাথে আদতে তার জীবনের কোন সম্পর্কই নেই। মাতিয়ে রাখতে পারলে সে আর অন্য কিছু নিয়ে ভাববে না, ভাবার সুযোগই পাবে না।

অপরদিকে এও সত্য যে, এর দ্বারা দেহ-মনে ভারমুক্ত শ্রমিকের শ্রমকে সে আরও বেশি করে নিংড়ে নিতে পারে। তাই ঝুপড়ি থেকে তাকে কোয়ার্টারে নিয়ে যায়। হয়ত টিভি দেয় – কিছু তথাকথিত বিনোদনের রাস্তা খুলে দেয়। সে বিনোদনের মাধ্যমে মালিক কিন্তু এই মালিকী ব্যবস্থার স্বার্থরক্ষাকারী সমাজের পচা-গলা চিন্তা-সংস্কৃতির শিকার বানিয়ে তোলে মজুরকে। তাদের মধ্যে অবক্ষয়িত নানা জিনিস দেখে আমরা যে বিস্মিত হই, তা মালিকের-ই কৌশলী খেলা। ‘পথের দাবী’তে সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র রামদাস তলোয়ারকরের মুখ দিয়ে শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে বলছেন, ‘তোমরা অসাধু, তোমরা উচ্ছৃঙ্খল, তোমরা ইন্দ্রিয়াসক্ত’- এই অপবাদটাই তোমরা শুনেছ। তোমাদের কষ্টের মূলে তোমাদের অসংযত চরিত্রকেই মালিকরাই দায়ী করে প্রচার করে। এ কথা সম্পূর্ণ সত্য নয়, তোমাদের প্রবঞ্চিত হীন অবস্থাও তোমাদের চরিত্রের জন্য দায়ী।’ ফলে, এ কথা আমাদের বিচার করতে হবে যে, বিনোদনের যে পথ এই সমাজের ধারকরা আজ দুনিয়া জুড়ে তুলে ধরছে তার মধ্যে সত্য, সংস্কৃতি, রুচির ছাপ কতটুকু রয়েছে? শুধু তো মজুর শ্রেণিই নয়, সমস্ত নির্যাতিত বঞ্চিত মানুষ, মধ্যবিত্ত, দরিদ্র জনসাধারণের কাছে এই বিনোদনের পক্ষে ব্যাপক প্রচার এমনকি আমাদের বুদ্ধি-বৃত্তিকেও প্রভাবিত করছে। বহুজনকেই বলতে শোনা যায় – সিনেমা, নাটকে এই একটু ‘উল্টোপাল্টা’ দৃশ্য, ঘটনা দেখলাম -মনটা একটু অন্যদিকে গেল – এইতো ভালো। জীবনে আছেই সিনেমাতেও তাই? গানেও তাই? এক প্রবীণ আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘গান আজকাল চোখ মেলে দেখতে হয়। যে অঙ্গভঙ্গি আর বুক চাপরানোর উদ্দামতা – তা না দেখলে তো নাকি গানই হয় না।’ গানের বাণী বা সুর এবং তার সামঞ্জস্য – এসব এখন আর বিচার্য নয় বহুক্ষেত্রে। গান শুনে শ্রোতারাও উদ্দাম হয়ে পড়ে! অর্থাৎ যেমন তেমন বিনোদন। অনেকে মনে করেন, এই ভালো, কিছুক্ষণ সব ভুলে থাকা। সত্যিই কি তাই? এর প্রভাব পড়ে না জীবনে চলার পথে? সারাদিন ধরে টিভির চ্যানেলে চ্যানেলে চলছে অসংখ্য সিরিয়াল। তার বেশিরভাগেরই বিষয় অসুস্থ সম্পর্ক, ঘরে ঘরে স্বামী-স্ত্রী, শাশুড়ি-পুত্রবধূর ঝগড়া, মেয়েদের উপর অত্যাচার বা ত্রিকোণ চতুষ্কোণ প্রেম, এ ধরনের বিষয়। এগুলি দেখতে দেখতে মানুষ কী প্রভাবিত হয় না? চ্যানেল কর্তারা বলছেনÑ ‘এসব শুধুই বিনোদন এর সঙ্গে বাস্তব জীবনকে মেলাবেন না’। এসবই হচ্ছে বাজার অর্থনীতির সুবাদে এবং চ্যানেল কর্তাদের রোজগারের জন্য। একজন মনোবিদের কথায় – ‘বাস্তবে দেখা যায় বহু পরিবারে মহিলারা সিরিয়ালে একটু আধটু বধূ নির্যাতনকে সমর্থন করছেন। টিন এজার বা যুব সমাজের মধ্যে ভঙ্গুর সম্পর্ক যখন সমর্থন পায় সিরিয়াল কাহিনীতে, তার ভঙ্গুরতা আরও বাড়ে। যেমন বাড়ে নেশা নানা ধরনের উপকরণের প্রচার ও তার বাস্তব ব্যবহার।’ হিংসা আর যৌনতার উদ্দীপক সিনেমার কুফল নেই? তথাকথিত উন্নত দেশের ঘটনাপ্রবাহের দিকে দৃষ্টি দিলেই তা বোঝা যায়। কত মর্মান্তিক সব সংবাদ! এইসব ‘বিনোদনের’ প্রভাবে মানুষকে বিশেষ করে যৌবনকে পুরোপুরি দাস বানিয়ে তোলা হচ্ছে নাকি? কত উন্নত সাহিত্যে, সঙ্গীতে কত ট্রাজেডির মধ্যে সুন্দরের রূপ, সত্যের বাণী রসসমৃদ্ধ হয়ে মানুষের মনের সুক্ষ্ম অনুভূতিকে জাগিয়ে তোলে, কী গভীর বেদনা-সুন্দরের ছন্দে তাকে দোলায়িত করে। এই ইতিহাসকেই বদলে দিতে চাইছে পুঁজিবাদের স্বার্থরক্ষাকারী বর্তমান শাসককুল।

মূল্যবোধহীন উন্নত প্রযুক্তিভিত্তিক বিনোদন মানুষকে একাকীত্ব ও মনোবিকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে

বর্তমান যুগ, বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব বিকাশের যুগ। বর্তমান যুগে চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণাকে ব্যাপক অংশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যম অত্যন্ত উন্নত। তা জীবনে গতি এনেছে। একদিক থেকে জীবনকে উন্নতও করেছে। কিন্তু তার অপর দিকটা অর্থাৎ তার বিষময় ফলের দিকটা খেয়াল রাখছি কি আমরা? নি¤œ মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তের হাতে হাতে মোবাইল, ঘরে ঘরে কম্পিউটার। বাড়ির ছেলেমেয়েদের অন্যদের সঙ্গে মিশতে না দিয়ে বাইরের সংস্রব থেকে সরিয়ে এনে রাখছি ঘরে। তাদের দিচ্ছি ল্যাপটপ, কম্পিউটার, স্মার্ট ফোন। সেও সর্বদা ব্যস্ত থাকে এই নিয়ে। কিন্তু আমরা কি খবর রাখি, তার মধ্যে দিয়ে সত্যি কোন পথে সে যাচ্ছে? আপনারা দেখবেন, বাড়িতে ছেলেমেয়েরা সারাক্ষণ কম্পিউটার গেম খেলছে। আগে খেলাধুলা ছিল অনেকের সাথে। মাঠে গিয়ে ধূলোকাদা মেখে, বন্ধুদের সঙ্গে কখনও মন কষাকষি – তারপর আবার মিল – হাসতে হাসতে একসাথে বাড়ি ফেরা। ক্রমাগত এসব জিনিস কমছে। এখন প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে সবাই। খেলাতেও সে একা। আবার কম্পিউটারে কী রকম গেম? সব অবাস্তব।  মটোর রেস, যার কোন নিয়ম মানার বালাই নেই: যেভাবে পার শত্রুকে মারো, গুলি চালাও। কীভাবে গুলি চালিয়ে ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা হয়ে যাচ্ছে সেটা দেখে আনন্দ পাও। দেখাচ্ছে একটা হাতুড়ি দিয়ে একটা মানুষ চিড়ে চ্যাপ্টা করা হচ্ছে। আমি একটা খেলোয়াড়কে জেতাতে চাইছি। এই জেতাতে চাইছি কোন নিয়ম না মেনে। কম্পিউটারের বোতাম টিপে আমি তাকে ছোটাচ্ছি। কত রকমের গেমস! কত বিচিত্র নাম! বিটডাউন, পোস্টাল, সোলজার অফ ফরচুন, কুইক-থ্রি-এরিনা, ক্রাইসিস – আরও কত! মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন এতে কিশোর মনের ভয়ঙ্কর ক্ষতি হচ্ছে। আগেকারদিনের একটা লেখা পড়ে, একটা ফিল্ম দেখে, একটা কবিতা শুনে পাঠক বা দর্শক, হাসত, কাঁদত, আনন্দ পেত, দুঃখ পেত, মাকে জড়িয়ে ধরত – সেসব অনুভূতি থেকে কিশোররা বঞ্চিত। ছোটবেলার আনন্দ, কৈশোরের আনন্দ, এই সময়ের বন্ধুত্ব যে একটা নিখাদ নির্মল আনন্দের বিষয় তা থেকে এই সমাজ তাদের একাকীত্বের দিকে টেনে নিয়ে চলে যাচ্ছে। ফলে একাকীত্ব তার মধ্যে মনোবিকার তৈরি করছে। সম্প্রতি সংবাদপত্রে সকলেই দেখেছেন, শিশু-কিশোররাও নিদ্রাহীনতায় ভুগছে। কম্পিউটারে বা টিভির পর্দায় যেসব দৃশ্য দেখছে তার প্রতিক্রিয়ায় রাতে তাদের ঘুম হচ্ছে না। হঠাৎ হঠাৎ জেগে উঠছে এবং বিছানায় বসে থাকছে। ডাক্তাররা উদ্বিগ্ন। এই শিশুকিশোরদের জন্য কোন অন্ধকার ভবিষ্যত অপেক্ষা করে আছে তা ভাবলে আতঙ্ক লাগে।

ফলে বিনোদনের মধ্যে একসময় যে সামাজিক বৈশিষ্ট্য ছিল, সেই যূথবদ্ধ বিনোদন থেকে ধীরে ধীরে ব্যক্তির বিনোদন এল। বর্তমানে তাকে করে তোলা হচ্ছে একান্ত ব্যক্তিগত- শুধু আমার আনন্দ, নিছক আমার। আর কারু সঙ্গে তার সংস্রব নেই। তাই বর্তমানে আমাদের বিনোদন বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্ন বিনোদন আমাদের মধ্যে আরও বিচ্ছিন্নতা এনে দেবে। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। শুধু তাই নয়, আরও ভয়াবহ ভবিষ্যৎ আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। কয়েকদিন আগে সংবাদপত্রের পাতায় দেখা গেল শিশু-কিশোরদের হাতে হাতে দেদার ‘রেপ-গেম’। ইন্টারনেটে এর নাম ‘রেপ্লে’। শৈশবেই দুঃশাসন হয়ে উঠার খেলা – নারীর আব্রু নিয়ে কম্পিউটারের পর্দায় টানাটানি। ইন্টারনেটের মাধ্যমে পর্দায় দেখা যায় কিশোরীর ছবি। পাশে কয়েকটা নম্বর। ঠিকমত নম্বরে ক্লিক করলে অনাবৃত হয়ে পড়ে শরীর। তারপরের কথাটা ভাবা বা বলাই তো  অসম্ভব! প্রযুক্তির বিকাশ যেমন আমাদের সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে, তেমনি রুচি, মূল্যবোধ, আদর্শের তোয়াক্কা না থাকায় আমরা কোথায় চলেছি? পুঁজিবাদ আমাদের নবীন প্রজন্মকে কোথায় নিয়ে যাবে ভবিষ্যতে – তা ভেবে শিউরে উঠতে হয় এ কি সত্যিই বিনোদন? নাকি, যথার্থ বিনোদন সেটাই যা মানুষকে কলুষতার হাত থেকে মুক্ত করে। তার সমস্ত চিন্তা, হৃদয়বৃত্তিকে প্রসারিত করে সকল মানুষের মুক্তি, সকল মানুষের মঙ্গল এবং এই সমাজের মঙ্গলের জন্য ক্রিয়াশীল করে?

এ কথা সত্য যে, বিনোদন তো মানুষের দরকার। মানুষের জীবনে তার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। ক্লান্ত আমি একটা কালো মেঘের নধপশমৎড়ঁহফ এ কাশফুল দেখছি। প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখছি। এ কি সৃষ্টি করে? আমার মধ্যে একটা প্রশান্তি আনে। আমাকে টেনশন থেকে মুক্ত করে দেয়। একটা সঙ্গীতের মূর্ছনা আমার ক্লান্তিকে দূর করে দেয়। জীবনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমার মধ্যে নানারকম বিরক্তিকর যে অনুভূতিগুলো আসছিল তার হাত থেকে পাখির কলতান আমাকে মুক্ত করে। প্রস্ফুটিত কুসুমের শোভা আমার মনকে ক্লান্তি থেকে অন্যদিকে নিয়ে চলে যায়। এই হচ্ছে আমার বিনোদন। তা আমাকে ফ্রেশ করে দেয়। ফ্রেশ করে দিলে আমি কী করতে পারি? আরও বেশি কাজ করতে পারি। এজন্য বিনোদন সকলের প্রয়োজন।

আবার এও ঠিক, প্রকৃতিতে কতো ঘটনাই তো ঘটে। মানুষের অনুভূতি তার মধ্যে কিছুকে রাখে কিছুকে বাদ দেয়। কিছুকে ভালো বলে, কিছুকে খারাপ বলে। ফুল ফোটে ভালো লাগে। পায়ে দলা ফুল ভালো লাগে না। পাখির ডাক ভালো লাগে। ঝড়ের পাখির মৃত্যু ভালো লাগে না। তাহলে ভালো লাগা আর ভালো না লাগার মধ্যে যে পযড়রপব আছে, তা কেন এসেছে? কারণ যা যথার্থই ভালো, তা আমাদের হৃদয়ের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে জাগরুক করে; হৃদয়ের আদান প্রদানের দ্বারা মনের প্রসারতাকে বাড়ায়; আমাদের মান-অভিমান-ভালোবাসাকে নিবিড় এবং রসঘন করে তোলে।

মানুষের সমস্ত সৃষ্টিকে যৌথভাবে ভোগ করার চেতনাই বর্তমান সময়ের বিনোদনের যথার্থ রূপ

প্রকৃতপক্ষে, মানবসমাজ তার যাত্রাপথে যে রূপ রস গন্ধ ঐশ্বর্য সৃষ্টি করেছে, আমরা তাকে ভোগ করতেই চাই। কিন্তু সকলে মিলে ভোগ করতে চাই, একা নয়, কারো সাথে প্রতিযোগিতা করে নয়। পুঁজিবাদ এই চিন্তা এনে দিয়েছে, আমি একা ভোগ করবো। আমি একা নেবো, প্রতিযোগিতা করে অন্য সকলের থেকে বেশি নেব। Sportsman spirit কে মেরে দিয়ে আমরা বলব killer instinct। অনেককে বঞ্চিত করে কিছু পেলেও কি পরিপূর্ণ তৃপ্তি আমরা পাই? যেমন, কোনো নিমন্ত্রণ বাড়ির খাওয়া সেরে ফেরার পথে আমাদেরই এঁটো পাতা খুঁটে অনাথ শিশুদের খেতে দেখলে খাওয়ার সব তৃপ্তি যেমন চলে যায়- আপনার আমার সকলের। একাকী থাকলে চিন্তা করতে করতে মনে পড়ে সকলেই যদি এই জিনিস পেত তাহলে আমার তৃপ্তি আরও কত সুন্দর হত। এই চিন্তা কি সঠিক নয়? অন্য আরেক দিক থেকে আনন্দের অপূর্ব রূপও তো আমরা দেখি। তা হল, সত্যকে গ্রহণ করার আনন্দ। এমন কী সত্য গ্রহণ করতে গিয়ে মৃত্যুবরণেও আনন্দ। শহীদ কানাইলাল দত্তের কথা স্মরণে আসে। এক সাদা চামড়ার রক্ষী তাঁকে বলেছিলেন, তোমার এত হাসি বেড়িয়ে যাবে যেদিন ফাঁসির দড়ি গলায় পড়বে। তারপর যেদিন কানাইলালের ফাঁসি হবে, সেদিন তিনি ঐ রক্ষীকে বললেন, ‘তুমি দেখবে একজন ভারতীয় বিপ্লবী কীভাবে মৃত্যুবরণ করে। আমার দিকে চেয়ে দেখ তো, হাসছি কিনা।’ রক্ষী কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কানাইলাল আনন্দিত গর্বিত তৃপ্ত। দৃপ্ত পদক্ষেপে ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলেন। এই ইতিহাসই রচনা করেছেন ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং, মাস্টারদা। তাঁদের তৃপ্তির কাঠামোটাই আলাদা।

আনন্দ দু’ধরনের। নোংরা ঘেটে আনন্দ আর অন্যায়ের প্রতিবাদ করে আনন্দ। বিগত শতাব্দীর ছয়-সাতের দশকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের মানুষ যখন জঙ্গল থেকে সংগ্রাম করেছে, তখন রাতের পর রাত তাদের জাগতে হয়েছে। কতদিন খাওয়াও জোটে নি। সেই সময় মার্কসবাদী দার্শনিক শিবদাস ঘোষ তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় বলেছিলেন, ‘এই মানুষদের কি জীবনে কোন দুঃখ ব্যথা ছিল না? ছিল। তবু তাঁরা ছিলেন অতলান্ত প্রশান্তির প্রতিমূর্তি। আনন্দের সাগরে তাঁরা ডুবেছিলেন। লড়াইয়ের মধ্যে যে দুঃখ, সে দুঃখের মধ্যেই তাঁদের আনন্দ। তাদের জীবন দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছে, দুঃখও আনন্দের একটা রূপ হতে পারে। জ্ঞানী মানুষরা জানেন দুঃখ ও আনন্দ মাসতুতো পিসতুতো ভাই।’ আজও এই কথাগুলি হৃদয়ের গভীরে অনুরণিত হয় এবং বিবেকের সামনে প্রশ্ন তোলে।

বর্তমান সময়ে আমরা প্রবল সামাজিক অবক্ষয়ের মধ্যেও কিছু উৎসাহপূর্ণ ঘটনা প্রত্যক্ষ করছি। দেখেছি কীভাবে দিল্লীর লাঞ্ছিতা, নির্যাতিতা তরুণীর মর্মান্তিক মৃত্যুর প্রতিবাদে তরুণ তরুণী দিল্লীর রাজপথে, প্রবল শীতকে উপেক্ষা করে এবং পুলিশের লাঠি গ্যাস জলকামানের পরোয়া না করে লড়াইয়ের মধ্যে পেয়েছেন আনন্দ। এই ঘটনা আমাদের কাছে নিঃসন্দেহে আশার একটি আলোকরেখা। শুধু কি তাই? যে যুবসমাজ ছাত্রসমাজকে আমরা উচ্ছৃঙ্খল বলে ভাবি বা বলি যাদের মধ্যে শালীনতার অভাব দেখে আমরা মনের মধ্যে বেদনা অনুভব করি – তারা রাতের পর রাত ছেলে-মেয়েরা একত্রে রাস্তায় থাকলো অথচ নেই কোন অশালীনতার কালো ছায়া, নেই কোন অশ্লীল আচরণ। কারণ, অন্যায়ের প্রতিবাদ মানুষের মধ্যে উন্নত সংস্কৃতির জন্ম দেয়। একটা মানুষকে তা পাল্টে দেয়। শাসকদের হয়ে ‘বাজারী’ পত্রিকাগুলি প্রচার করেÑ প্রতিবাদ, আন্দোলন, মিছিলের জন্যই নাকি বাংলা তথা আমাদের দেশ উচ্ছন্নে গেল। অথচ স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসও তা বলে না এবং দিল্লীর এই আন্দোলনও ‘বাজারী’ পত্রিকার প্রচারকে মিথ্যার বেসাতি বলে প্রমাণ করেছে। বর্তমান পত্রিকায় কিছুদিন আগে প্রকাশিত একটি কাহিনী বলে লেখক লিখছেন, একটি কিশোরী বাইরে যাবার জন্য পোষাক বদলাবে। নানা অছিলায় সে দেরি করায় তার মা বলছেন, যা তাড়াতাড়ি কর। কিশোরী ইঙ্গিতে দেখায় অদূরে এক বাড়ির চিলেকোঠায় এক তরুণ পড়াশুনা করছে তার জানালাটা খোলা। কিশোরী স্বভাবতই লজ্জা পাচ্ছে। তার মা তখন বললেন – ‘আরে ও তো বিনু! স্বদেশি করে, ওর এত সময় কোথা!’ এই ছিল আমাদের দেশ।

পাশের বাংলাদেশ। শাহবাগের ‘প্রজন্ম চত্বর’। সেখানে চলছে প্রবল আন্দোলন। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ষড়যন্ত্রকারী যুদ্ধ-অপরাধী পাকিস্তানের দালাল ‘রাজাকার’দের শাস্তির দাবিতে। সেই আন্দোলন প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক মোবেশ্বরা খানম লিখছেনÑ ‘আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখলাম সারারাত, সারাদিন ছেলে-মেয়েরা একসঙ্গে বসে শ্লোগান দিচ্ছে, গান গাইছে সব বয়সী নারী-পুরুষ, একসঙ্গে আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে… কিন্তু আজ অবধি কোন ‘ইভটিজিং’ দূরে থাক, কোন অশালীন শব্দ পর্যন্ত কেউ উচ্চারণ করেনি। স্কুল-কলেজের কিশোর কিশোরীরা আসছে, মায়েরা আসছেন শিশুদের নিয়ে, সব শ্রেণী, সব পেশার মানুষ পাশাপাশি বসে আছেন, নেই কোনও কটুক্তি, কোনও বাজে কথা’। তাঁর কথায় এটি একটি ‘অসাধারণ সামাজিক অর্জন’। আন্দোলনের রাজনৈতিক বিচার – বিশ্লেষণের প্রশ্ন বাদ দিয়েও বলা যায়, এই ‘সামাজিক অর্জন’ সম্ভব হয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মধ্যে নিহিত যথার্থ সংস্কৃতির রস আস্বাদনের পথ বেয়ে। আন্দোলন এমনি করেই মানুষকে বদলে দেয়। নন্দীগ্রামের ইতিহাস আমরা জানি দু’বছর সেখানে কোনও পুলিশ ঢুকতে পারেনি। অথচ তখনকার শাসকদলের দুর্বৃত্তদের হাতে ছাড়া একটি নারীও ইজ্জত খোয়ায়নি, ছোটখাট চুরি ডাকাতিও হয়নি, ঘটেনি জাতপাত ধর্ম নিয়ে কোনো হানাহানির ঘটনা।

এই সমস্ত প্রতিবাদী সংগ্রামের ঘটনাপ্রবাহ আরেকটা সত্যকেও তুলে ধরেছে। আমাদের রাষ্ট্রের শাসকরা যতই ‘বাজারী’ পত্রিকার মধ্য সিনেমা দেখতে গিয়ে চোখে জল! ওসব ভালো লাগে না। দুঃখ তো দিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষক বলে নিজেদের পক্ষে প্রচার করুকÑ আসলে তাদের চরিত্র কী? তারা ততক্ষণই স্বাধীনতা দেয় যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রের স্বার্থে ঘা না লাগে। অর্থাৎ তুমি স্বাধীন তোমার ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে- যেমন খুশি গান গাও, যা খুশি দেখ, মদ খাও, নোংরামি করÑএর মধ্যেই আনন্দ-বিনোদনে মত্ত থাকো। কিন্তু খবরদার, শাসকদের বিরুদ্ধে কিছু করো না। তাহলে পুলিশ-মিলিটারি তোমায় ছাড়বে না। দিল্লীর নির্যাতিতা তরুণীর সমবেদনায় প্রতিবাদী যুবক-যুবতীরা রাষ্ট্র থেকে সেই পুলিশি নির্যাতনই পেয়েছে। নির্যাতন সহ্য করে যারা আন্দোলন করেছেন তাদের মধ্যে আনন্দ পাওয়ার রূপটা প্রচলিত অর্থে বিনোদনের মতো হলেও এর মধ্যে রয়েছে সত্য অনুভূতি। এ কথা কি আমরা অস্বীকার করতে পারি? এই সংস্কৃতিই তো আমাদের সভ্যতাকে এগোতে সাহায্য করবে।

আরেকটি কথাও বর্তমান সমাজে আমাদের মনে রাখতে হবে। আজ এই মুনাফা সর্বস্ব পুঁজিবাদী সমাজ বিনোদনকে একটা পণ্যের স্তরে নামিয়ে দিয়েছে। কীভাবে বিনোদনকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা করা যায় – বাজার অর্থনীতির ‘মাহাত্ম্য’ বর্ণনা করে কীভাবে তার থেকে মুনাফা অর্জন করা যায় – তার জন্য মানুষের জৈবিক বৃত্তিগুলিকে উত্তেজিত করার উপকরণের কারখানা খুলছে। নাম দিয়েছে ‘বিনোদন শিল্প’। বলা হচ্ছে, এ এক সম্ভাবনাময় বৈচিত্র্যপূর্ণ শিল্প। ইন্টারনেট, স্মার্ট ফোন, ডিজিটাইজেশন আসার ফলে এই শিল্পের প্রসার গত কয়েক বছরে বেড়ে গিয়েছে কয়েক শতাংশ। এর উপর গ্রাহকদের হাতে অসংখ্য বিকল্পের পথ খুলে দিয়ে আসছে ‘মিডিয়া কনজার্ভেন্সের’ যুগ। অর্থাৎ প্রচারের গণমাধ্যমগুলি একে অপরের সাথে মিশে যাবে। ব্যবসায়ী মহল এমনও ভাবছে যে, এদেশে অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি হয়ে উঠতে পারে ‘ডিজিটাল লাইফ-স্টাইল’ বা ‘মিডিয়া কনজার্ভেন্সীর’ বিনোদন বা মনোরঞ্জন শিল্প! ইতিমধ্যেই টি আর পি বা রেটিং পয়েন্টের পর্যালোচনা করে এই শিল্পে প্রত্যক্ষ বিদেশি পুঁজিলগ্নীকে ৪৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭৪ শতাংশ করার অনুমোদন দিয়েছে ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক। ফলে মুনাফা সর্বস্বতার কারণে জনসাধারণের মধ্যে যে সব চাহিদা সৃষ্টি করা হবে এবং তাকে পূরণ করার চেষ্টা হবেÑ তাতে আর যাই হোক মূল্যবোধের সংস্পর্শ যে থাকবে না, তা হলফ করেই বলা যায়। তাই দেখা যাচ্ছে, পৃথিবী জুড়ে সফটওয়ার – এর লগ্নীর দ্বিগুণ লগ্নী আজ জৈবিকবৃত্তি উত্তেজক খেলনা তৈরিতে। এই কি বিনোদন? ‘বাজারী’ পত্রিকাগুলি এরই প্রচারক। যে সংবাদমাধ্যমে নারীর সম্ভ্রমহানির খবর দেখি, সেখানেই নানান বিজ্ঞাপনে চলে নগ্ন দেহের অশালীন প্রদর্শন – উদ্দেশ্য যৌনতার প্রসার। ক্রিকেটের মাঠে যে নৃত্য দেখি তা কি খেলার জন্য প্রয়োজন? নাকি, তা কে কেন্দ্র করে মানুষের যথার্থ বিনোদনের পরিবর্তে বিকৃত রুচির পথে মানুষকে পরিচালিত করে ব্যবসা করা? বর্তমান সময়ের চূড়ান্ত অবক্ষয় না দেখেও ধনতন্ত্রের মুনাফাসর্বস্বতাকে বুঝে গভীর দুঃখে সাহিত্যিক প্রেমচন্দ বলেছিলেন, ‘এই ধনতান্ত্রিক সমাজে, শিল্প, চারুকলা, সঙ্গীত, মমতা, ভালোবাসা সবই পুঁজির কাছে নতজানু।’ এ বেদনার সহমর্মিতা চাই সমাজ অভ্যন্তরে। চাই পুঁজির সর্বগ্রাসী জাল থেকে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির মুক্তি –  চাই মানুষের যথার্থ বিনোদন।

পরিশেষে বলব, মানুষের তৃপ্তির মধ্যে, বিনোদনের মধ্যে, সংস্কৃতি মমতা অনুভূতি –  এই সুকুমার বৃত্তিগুলো যুক্ত হয়ে রয়েছে। তার ভিত্তিতে উন্নত বিনোদন আমাদের আরও উন্নত রসবোধে সমৃদ্ধ করবে। কিন্তু তথাকথিত আধুনিক সমাজ বিনোদনকে অবনমিত করেছে। বিনোদনের বিকৃত রূপ দিয়ে শাসকশ্রেণী আমাদের প্রবৃত্তিকে উত্তেজিত করছে, আমাদেরকে সমাজবিমুখ করছে। সেজন্য আমরা যথার্থ তৃপ্তি খুঁজে পাচ্ছিনা। সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, ‘চিত্তরঞ্জন-  চিত্ত এবং রঞ্জন। শুধু রঞ্জন নয়।’ অর্থাৎ আমাদের চেতনার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা যে চিত্ত, তা যাতে রঞ্জিত হয় –  তাই তো সত্যি বিনোদন। আজ সেই বিনোদন চাই, যা সভ্যতার অগ্রগতির অনুসারী। তিনি এও বলেছিলেন, ‘ভয়শূন্য যে দুঃখ তাকে আনন্দের মতোই উপভোগ করা যায়’। অর্থাৎ নির্ভীক মন নিয়ে একটা মূল্যবোধের জন্য দৃঢ়চিত্তে যারা ক্রিয়া করে বা সংগ্রাম করে তাদের কাছে বেদনাটা কেবলমাত্র একটি বেদনা নয়-  বেদনার মধ্যেই তারা খুঁজে পায় তার আনন্দময় রূপ। আজ প্রচলিত এই ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী সমাজ সমস্ত শোষণ, নিপীড়ন, বঞ্চনা, অবক্ষয়ের উৎসভূমি। এর পরিবর্তনের প্রতীক্ষার প্রহর গুনছি আমরা। এই আকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন, যাকে আমরা বিপ্লব বলি সে প্রসঙ্গে শিবদাস ঘোষ বলেছেন যে, ‘এ শুধুমাত্র আর্থিক শোষণ থেকে মুক্তির লড়াই নয়। এ হল গোটা উৎপাদনকে, জ্ঞানবিজ্ঞানকে, আমাদের মূল্যবোধ, রুচি এবং শিল্প-সাহিত্য সমস্ত কিছুকে পুঁজিবাদী জুলুম এবং মোটিভ, যা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে তার থেকে মুক্তির লড়াই। এমনকি ভালোবাসা, পারিবারিক শান্তির ক্ষেত্রেও মুক্তির লড়াই’। এই বৈপ্লবিক সংগ্রামের মধ্যেই মূর্ত হয়েছে বর্তমান যুগসত্য। এই যুগসত্যকে স্বীকৃতি দেয়া এবং উপলব্ধি করার মধ্যেই রয়েছে জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তোলার প্রশ্ন- রয়েছে ব্যক্তির সত্যিকারের স্বাধীনতা। তাই প্রচলিত এই পুঁজিবাদী সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়ে যৌথভাবে সকলে মিলে সভ্যতার সকল সম্পদ ও সৃষ্টিকে, সকল সুন্দরকে ভোগ করতে পারা যাবে এমন একটি সমাজ গড়ে তোলার আকুতি জাগায় যে সংস্কৃতি, তার চর্চাই আজ সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। তার মধ্যেই নিহিত রয়েছে আমাদের যথার্থ আনন্দ-বিনোদনের প্রশ্নটি।

(লেখাটি ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক পত্রিকা ‘পথিকৃৎ’ এর আগস্ট, ২০১৩ সংখ্যা থেকে সংগৃহিত)

অনুশীলন : অক্টোবর ২০১৪ || সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments