(সমাজতন্ত্রের গৌরবগাঁথাকে যারা মিথ্যা প্রমাণ করতে চায়, তারা সবচেয়ে বেশি আক্রমণ করে যোসেফ স্ট্যালিনকে। কারণ স্ট্যালিনের সাথে জড়িয়ে আছে পৃথিবীব্যাপী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার নেতৃত্বদানকারী ভূমিকার অসামান্য ইতিহাস। সেই ইতিহাসকে কালিমালিপ্ত করতে ব্যক্তি স্ট্যালিন থেকে রাষ্ট্র প্রশাসক স্ট্যালিন — সবই কর্পোরেট মিডিয়ার আলোচ্য বিষয়। কিন্তু তার কতটুকু সত্যি? কেমন ছিলেন মানুষ স্ট্যালিন? নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষে এই বিপ্লবী মনীষীকে শ্রদ্ধা জানিয়ে নিবন্ধটি প্রকাশিত হলো।)
“ধৈর্যে ও প্রজ্ঞায় প্রবলচেতা বলে মনে হয় ওঁকে দেখে। কোমল প্রীতিরসে ভরা তাঁর বাদামী রঙের চোখ দুটি। মনে হয় যেন শিশুরা ভালবাসবে তাঁর কোলে বসে থাকতে,…অত্যন্ত সুরসিক, প্রকা- তাঁর মনীষা, ক্ষুরধার বুদ্ধি, …তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রুরা তাঁর সম্পর্কে যা কিছু বলে, একেবারে তার বিপরীত কথাটা যদি ধারণা করতে পারো, তাহলেই স্ট্যালিনের সঠিক চিত্রটি পাওয়া যাবে।”
সোভিয়েত ইউনিয়নে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস তাঁর কন্যাকে যে ব্যক্তিটি সম্পর্কে কথাগুলো বলেছিলেন তাঁর নাম যোসেফ স্ট্যালিন। প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের সার্থক রূপকার। স্ট্যালিন জর্জিয়ার একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জুতা সেলাই আর মা ধোপার কাজ করতেন। ছোটবেলায় অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার কারণে বাবা-মা তাঁকে অতি কষ্টে চার্চে পড়াশুনার জন্য ভর্তি করান। চার্চে পড়ানো বিষয়বস্তুর বাইরেও জানার আগ্রহ গড়ে উঠে তাঁর। চার্চে যা তখন নিষিদ্ধ ছিলো। কিন্তু গোপনে পুরাতন দোকান থেকে বই কিনে বন্ধুদের সাথে নিয়ে পড়তে থাকেন। লেনিনের আন্দোলনের খবর শুনে রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন এবং বন্ধুদের সাথে নিয়ে পাঠচক্র গ্রুপ গড়ে তুলেন। চার্চে জোরপূর্বক রাশিয়ান ভাষা শেখানোর প্রতিবাদ করেন। তাই চার্চ কর্তৃপক্ষ তাঁকে বহিষ্কার করে। এসময় তিনি সরাসরি রাজনীতিতে যোগ দেন। রেলওয়ে ও তৈলখনির শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন। শ্রমিকদেরকে সংগঠিত করার অপরাধে বহুবার কারারুদ্ধ ও নির্বাসিত হয়েছেন। যদিও নির্বাসন থেকে প্রতিবারই পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করার সময় তাঁর ইস্পাততুল্য চরিত্রের জন্য তাঁর সহকর্মীরা তাকে ‘স্ট্যালিন’ নামে অভিহিত করে। এই মানুষটি সোভিয়েত ইউনিয়নকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করা, রুশ সমাজতন্ত্র বিনির্মাণ, পদানত রুশ জাতিকে সমস্ত শোষণ থেকে মুক্ত করে পূর্ণ মনুষ্যত্ব দান করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের আক্রমণ থেকে বিশ্বের সমস্ত মানুষকে রক্ষা করেন। কিন্তু স্ট্যালিনের কৃতিত্ব আজকের বিশ্বের মিডিয়া স্বীকার তো করেই না বরং তাকে নিয়ে চালায় নানা ধরনের মিথ্যা প্রচারণা। বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোতে চলছে স্ট্যালিন সম্পর্কে নানা ভুল তথ্যের রমরমা প্রচারণা। তাই সত্যটা সকলের সামনে তুলে ধরার কিছুটা প্রয়াস করছি।
সমাজতন্ত্র, পার্টি ও জনগণের প্রতি একনিষ্ঠতা ও দায়বদ্ধতাই স্ট্যালিনকে নেতৃত্বে নিয়ে এসেছিলো
রেলওয়ে ও তৈলখনির শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করার সময় অসীম সাহস, দৃঢ়তা, বুদ্ধি ও দলের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার মনোভাবের কারণে স্ট্যালিন, লেনিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। স্ট্যালিন ১৯১৩ সালে ‘জাতি সমস্যা’ নিয়ে একটি অসাধারণ রচনা লিখলেন। স্ট্যালিনের ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে লেনিন বলেছিলেন, “এমন কোনও সমস্যা যদি আসে পলিটব্যুরোর সামনে, যার বিচারে অত্যন্ত বেশি মাত্রায় বিচার বুদ্ধির আবশ্যক, তাহলে স্ট্যালিনকেই সেই দায়িত্ব দিতে হবে।” ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর স্ট্যালিন জেলের বাইরে এসে দেখেন পার্টি প্রায় নেতৃত্বহীন অবস্থায় আছে। লেনিন তখনও দেশে ফিরেননি। স্ট্যালিন নিজে দায়িত্ব নিলেন পার্টি পরিচালনার, মুখপত্র ইস্ক্রা পুনরায় চালু হলো। লেনিন ফিরে আসলে কেরেনস্কি সরকার তাঁকে আত্মসমর্পন করতে বলল। ট্রটস্কি, জিনোভিয়েভরা লেনিনকে আত্মসমর্পনের পরামর্শ দিয়েছিলেন, কিন্তু স্ট্যালিন লেনিনকে সতর্ক করলেন- আত্মসমর্পন করলে কেরেনস্কিরা তাঁকে হত্যা করবে। লেনিনকে তিনি অন্যত্র সরিয়ে তাঁর জীবন রক্ষা করলেন। ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাসে লেনিনের আনীত দলের নতুন রাজনৈতিক লাইন ও বিপ্লবের স্তর (যা এপ্রিল থিসিস নামে পরিচিত) নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। ট্রটস্কি, কামেনেভ, জিনোভিয়েভদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লেনিনের পক্ষে লড়লেন স্ট্যালিনই। অন্যদের সমর্থনে লেনিনের নতুন রাজনৈতিক লাইন গৃহীত হলো। ১৯১৭ সালে নভেম্বরে বিপ্লবের মাধ্যমে সোভিয়েতগুলোকে সাথে নিয়ে ক্ষমতা দখলের সিদ্ধান্ত হলো। কামেনেভ, জিনোভিয়েভ খবরটি মেনশেভিকদের কাছে প্রকাশ করে দেয়। যার ফলে পূর্ব নির্ধারিত তারিখের পূর্বেই বিপ্লব সংঘটিত করতে হয়েছিলো। ট্রটস্কি, কামেনেভ, জিনোভিয়েভ, বুখারিন এদের সবার সম্বন্ধে লেনিন বলেছিলেন, ‘এরা ইনটেলেকচ্যুয়াল। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা কম। কারণ এরা কেউই সরাসরি জনগণকে সংগঠিত করার কাজ করেননি।’ এদের বাইরে স্ট্যালিনই একমাত্র জারের আমলে গুপ্তভাবে জনগণকে সংগঠিত করেন, দলের রাজনীতিকে ও লেনিনের শিক্ষাকে জার সরকারের সমস্ত প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে জনগণের মাঝে নিয়ে যান। যার কারণে সংগঠন পরিচালনা করার সমস্ত দক্ষতা ও সংগঠনের চিন্তাকে জনগণের মাঝে পৌঁছে দেয়ার সামর্থ্য স্ট্যালিনের ছিলো। আর লেনিন স্ট্যালিনের যোগ্যতার স্বীকৃতি দিলেন পার্টি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়ে। ইতিহাস বলছে, সেদিন যোগ্য উত্তরসূরিকেই বেছে নিয়েছিলেন লেনিন। তার প্রমাণ পরবর্তীতে বিশ্ব পেয়েছিলো স্ট্যালিনের কর্মের মাধ্যমে। স্ট্যালিন কেন নেতৃত্বে এসেছিলো তা নিয়ে ঘোর স্ট্যালিনবিরোধী আইজাক ডয়েৎসারের লেখা- ‘কেন ট্রটস্কি, জিনোভিয়েভ, কামেনেভ, বুখারিনরা নেতৃত্বে এলেন না, কেন স্ট্যালিন এলেন? কারণ এরা শুধু তত্ত্ব নিয়েই বাকবিতন্ডা করতেন। এদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিলো, কে নেতৃত্বে আসবে তা নিয়ে? আর স্ট্যালিন ছিলেন একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি নীরবে নিঃশব্দে সমাজতন্ত্র ও পার্টিকে রক্ষা করার কাজ করে যেতেন। কে নেতৃত্বে এলো, কে এলো না— এ নিয়ে তাঁর কোনো মাথাব্যথা ছিলোনা।’
হিটলারের পঞ্চমবাহিনীর পরাজয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জয়ের প্রথম পদক্ষেপ
ট্রটস্কি, কামেনেভ, জিনোভিয়েভ লেনিনের সময়ই একের পর এক পার্টি বিরোধী কাজ করেছিলেন। নিজস্ব চিন্তাকে প্রাধান্য দিয়ে চলছিলেন। লেনিন জীবিত থাকা অবস্থায়ই স্ট্যালিনকে এদের সম্পর্কে সতর্ক করে বলেছিলেন, “এদের মার্কসবাদের যথার্থ উপলব্ধি ঘটেনি।” লেনিনের মৃত্যুর পরেও এদের লেখা প্রকাশ করাসহ মতামত ব্যক্ত করার নানা সুযোগ ছিলো, যাকে কাজে লাগিয়ে পার্টিতে নানা বিভাজন গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন এরা। কিন্তু স্ট্যালিনের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়ছিলো। বিভাজন সৃষ্টি করে ক্ষমতা দখল করা তাই অসম্ভব হয়ে পড়লো। ১৯২৯ সালে পার্টি কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত হয় পার্টি সদস্যদের বিরোধীপক্ষের সাথে যোগাযোগ রাখা ঠিক নয়। এই কংগ্রেসে ট্রটস্কিসহ কয়েকজনের বিরোধীপক্ষের সাথে যোগাযোগের প্রমাণ মিলে। অন্যরা ভুল সংশোধন করলেও ট্রটস্কি তা অস্বীকার করেছিলেন। ফলে নেতৃত্ব তাকে রার্শিয়া থেকে নির্বাসনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতার মোহে জিনোভিয়েভ, কামেনেভ, বুখারিনরা প্রশাসনে নিজেদের প্রভাবকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করলেন। বিদেশি শক্তির সাথে হাত মেলালেন। যা ছিল হিটলারের পঞ্চম বাহিনীরই সূত্রপাত। যার সত্যতা ১৯৩৪ সালে সের্গেই কিরভ হত্যার মধ্যে পাওয়া যায়। লেনিনগ্রাদের পার্টি সম্পাদক কিরভ ছিলেন স্ট্যালিনের ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা ও সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী। তাঁকে পার্টি সদর দপ্তরে খুন করা হয়। যে ব্যক্তি খুন করেছিলো সে পার্টি সদস্য কার্ড দেখিয়ে প্রবেশাধিকার পেয়েছিলো। যে রাজনৈতিক পুলিশ তাঁকে সুরক্ষার দায়িত্বে ছিলো দেখা গেলো তারাও জড়িত। তাদের সঙ্গে বাল্টিক রাজ্য মারফত জার্মানি যুক্ত। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের ফলে জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছিলো। স্বস্তির মধ্যে এই হত্যাকান্ড জনগণকে প্রবল ধাক্কা দিয়েছিলো। দেড় বছর যাবৎ এই হত্যার তদন্ত হয়েছিলো। তদন্ত বেরিয়ে আসলো উচ্চতর পর্যায়ের পার্টি নেতারা জড়িত। ১৯৩৬ সালের ১৬ আগস্ট বিচার শুরু হলো। পৃথিবীর মানুষ লক্ষ্য করলো এক অভূতপূর্ব বিচার। বিচারে দেশি-বিদেশি সাংবাদিক, বিদেশি কুটনীতিক, কারখানা-সরকারি দপ্তরের প্রতিনিধিদের প্রবেশাধিকার দেয়া হয়েছিলো। বিচারে কামেনেভ, জিনোভিয়েভ তাদের দোষ স্বীকার করেছিলো। সেদিন সাংবাদিক, বিদেশি কুটনীতিক কাউকে এই বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দেখা যায়নি, উল্টো বিচারের প্রশংসাই এদের মুখে শোনা গিয়েছিলো। কিন্তু আজ কিরভ হত্যার দায় স্ট্যালিনকে দেয়া হচ্ছে ও এই বিচারকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে আজকের মিডিয়াগুলো। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস তাঁর ‘মিশন টু মস্কো’ পুস্তকে বলেছিলেন, “এই বিচারের মধ্যে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য অর্ভিযুক্তদের উপর কোনো জবরদস্তি ছিলোনা এবং সোভিয়েত রাষ্ট্র অভিযুক্তদের অপরাধ প্রমাণ করতে পেরেছে। অকাট্য প্রমাণ, সাক্ষ্য ও জেরার মুখে শেষ পর্যন্ত অভিযুক্তরা একে একে নিজেদের অপরাধ স্বীকার করতে বাধ্য হয়।” বিশাল ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনাকারীরা এক এক করে ধরা পড়তে শুরু করলো। যাদের নাম দোষীরা আদালতে বলেছিলো তাদের অনেকেই আত্মহত্যা করে ও বিদেশে পালিয়ে গ্রেপ্তার এড়িয়েছিলো। সৈন্যবাহিনীর অনেকের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিলো। সাতজন উচ্চপদস্থ সামরিক অধিনায়কসহ মার্শাল তুর্কাচেভস্কির সামরিক বিচারে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছিলো। রাজনৈতিক পুলিশের বড়কর্তা যগোদাকে গ্রেপ্তার করা হলো। তার সাথে বহু রাজনৈতিক পুলিশকে নির্দোষ নাগরিকদের গ্রেপ্তার ও অন্যায়ভাবে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। জনগণের মধ্যে অনিরাপত্তার ভাব ছড়িয়ে পড়লো। এই অনিরাপত্তার ভাব শুধু নিজের পরিবার বা বন্ধুদের জন্য নয়। রুশরা বুঝেছিলো এটা তাদের জাতির বেঁচে থাকার লড়াই। রুশদের এই মনোভাবের কারণে হিটলারের পঞ্চম বাহিনী সোভিয়েতে নিশ্চিহ্ন হয়েছিলো, যে মনোভাবের সাথে হিটলার এর আগে পরিচিত ছিলোনা। সেসময় বিভিন্ন জায়গায় ট্রায়ালের দ্বারা যে গ্রেপ্তার ও বিচার হয়েছিলো তার সবটাই নির্ভুল ছিলোনা। এই গ্রেপ্তারের সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেকেই তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরানোর চেষ্টা করেছিলো। যেটা স্ট্যালিন বুঝতে পেরেছিলেন। যার কারণে অষ্টাদশ কংগ্রেসের রিপোর্টে বলেছেন, “গুরুতর ত্রুটি হয়েছে, যতটা আশঙ্কা করেছিলাম তার চেয়েও বেশি ত্রুটি হয়েছে। কিন্তু সমাজতন্ত্রকে বাঁচানোর জন্যই এই পার্জিংয়ের প্রয়োজন ছিল।” এই গ্রেপ্তার ও বিচার না হলে জার্মানির কাছে পরাজয়ের সম্ভাবনা অনেক বেশি ছিল। কারণ পঞ্চম বাহিনীর লোক পার্টির ভেতরে, রাষ্ট্রের ভেতরে, রেড আর্মির ভেতরে থেকে যেতো। যে সুবিধা হিটলার ইউরোপ দখলের সময় পেয়েছিলো, তা সোভিয়েতে পেলোনা। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী চার্চিল তাঁর বেতার ভাষণে বলেছিলেন, “হিটলার রাশিয়ায় যে পঞ্চম বাহিনীর আশা করেছিলো সেটা পায়নি।” ফলে বিচার না হলে সমাজতন্ত্র তো ধ্বংস হতোই, হিটলারের হাত থেকে পুরো ইউরোপ তথা বিশ্বকে রক্ষা করা যেত না। সেসময়ের বিচারের পক্ষে আইনস্টাইন বলেছিলেন, “রাশিয়ায় যে বিচার চলছে তা সাজানো নয়। যারা স্ট্যালিনকে বিপ্লবের প্রতি বিশ্বাসঘাতক একজন নির্বোধ প্রতিক্রিয়াশীল বলে অভিহিত করেন- তারাই একটা ষড়যন্ত্র করেছিলেন। প্রথমদিকে আমি মনে করতাম একজন স্বৈরাচারী একনায়কের ক্রিয়াকলাপ, কিন্তু তা ছিলো আমার ভ্রান্ত ধারণা।” সেদিনের সে বিচারের জন্য আজ কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই স্ট্যালিনকে খুনি, স্বৈরাচারী বলা হচ্ছে। ফ্রান্সে প্যারি কমিউনকে ধ্বংসের জন্য হাজার হাজার শ্রমিক খুন, আমেরিকার দ্বারা হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পারমানবিক বোমা বিস্ফোরণ ও আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়ায় কোটি কোটি মানুষ হত্যা করা সত্ত্বেও পত্র-পত্রিকা-মিডিয়াতে এদেরকে খুনি-স্বৈরাচারী বলা হয়না, বরং এদেরকেই গণতন্ত্রের রক্ষাকর্তা হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে।
ব্যক্তিগত জীবনে স্ট্যালিন
স্ট্যালিন খুবই সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। দু-তিনটের বেশি জামাকাপড় পড়তেন না। তাঁর সিকিউরিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত রিবিন লিখেছেন “কোর্ট ছিড়ে গেলে সেলাই করিয়ে পড়তেন। আমরা রাগারাগি করে অনেক সময় পুরনো জামা প্যান্ট কেড়ে নিয়ে যেতাম, নতুন জামা প্যান্ট করে দেওয়ার জন্য। জুতো পুরনো হয়ে গেলে সহজে পাল্টাতে চাইতেন না, জোর করতে হতো।” ব্রিটেন থেকে ওয়েব দম্পতি গিয়েছিলেন রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র দেখতে। স্ট্যালিনের স্ত্রীকে দেখতে গেলেন কারখানায়। তারা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলো স্ট্যালিনের স্ত্রীকে একজন সাধারণ শ্রমিকের বেশে দেখে। তার মেয়ের জন্য একটি ভালো ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। স্ট্যালিন শুনে রেগে গেলেন। বললেন, ‘ও কি সেন্ট্রাল কমিটির মেম্বার, না পলিটব্যুরোর মেম্বার যে ওর জন্য আলাদা ব্যবস্থা করতে হবে? যেখানে সকলে থাকবে সেখানেই ও থাকবে।’ চমৎকার নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি। সকল পেশার মানুষের সাথে আপন হয়ে মিশতেন, গল্প-খেলাধুলা-খাওয়া-দাওয়া করতেন। বিরোধীদের মত খুবই গুরুত্ব সহকারে শুনতেন। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এইচ জি ওয়েলস লিখেছেন, “আমার ধারণা হয়েছিলো, লোকে তাকে ভয় করে বলেই তিনি এতদিন শাসন ক্ষমতায় আছেন। কিন্তু তার সাথে কথা বলার পর বুঝলাম, তিনি এমন একজন মানুষ যাঁর সম্পর্কে ভয়ের কোনও কারণই থাকতে পারে না। আর তাঁকে ভয় পায় না বলেই, তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আছে বলেই, দেশের লোকে তাঁকে নেতা হিসাবে মেনে নিয়েছে।” প্রখ্যাত আমেরিকান সাংবাদিক আনা লুই স্ট্রং স্ট্যালিনের সাথে বৈঠকের সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, “যেকোনো বৈঠকে সব থেকে শেষে বলতেন তিনি। আসলে অন্যদের মন খুলে বক্তব্য প্রকাশে যাতে কোনও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয়, তার জন্যে সভার শুরুতে তিনি কখনই বলতেন না, যদিও বলার অধিকার তাঁর ছিলো। আসলে তিনি ধরতে পেরেছিলেন, মানুষের কথা যত বেশি শোনা যায়, ততই শেখা যায়। …তিনি সমস্ত সিদ্ধান্তই নিতেন সভা বা আলোচনা করে এবং সকলের মতামতের ভিত্তিতে। …তিনি কখনই নিজেকে জাহির করেন না।” এভাবে তিনি সত্যিকারের গণতন্ত্রের চর্চা করতেন। প্রমাণ মেলে রাশিয়ার সংবিধান রচনার ইতিহাস থেকেও। সংবিধান রচনার জন্য স্ট্যালিনকে চেয়ারম্যান করে ৩১ জন ইতিহাসবিদ, অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদকে নিয়ে কমিশন হয়। কমিশন পৃথিবীর সমস্ত দেশের সংবিধানসহ অনেক সংগঠনের সংবিধান স্টাডি করে খসড়া তৈরি করে। যার ৬ কোটি কপি জনসাধারণের কাছে পেশ করা হয়। ৫ লক্ষ ২৭ হাজার সভায় ৩ কোটি ৬০ লক্ষ অংশগ্রহণকারী সংবিধান নিয়ে আলোচনা করে। সংবাদপত্রে চিঠি দিয়ে মতামত সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। ১ লক্ষ ৫৪ হাজার সংশোধন প্রস্তাব এলো। সর্বশেষ সংবিধান সম্মেলনে ২ হাজার ১৬ জনকে ডাকা হয়েছিলো। এটাই হলো আসলে প্রকৃত ‘গণতন্ত্র’ যা একমাত্র সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম দেখিয়েছিলো।
নিজের সম্পর্কে অতিশয়োক্তি স্ট্যালিন একদম পছন্দ করতেন না। ১৯৩৮ সালে স্ট্যালিনের ছেলেবেলা নিয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়েছিলো, বইটিতে তাঁর ছেলেবেলা সম্পর্কে অতিশয়োক্তি, অসত্য ও অতিরঞ্জিত বর্ণনা ছিলো। স্ট্যালিন খুবই বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, এই বই মিথ্যায় ভর্তি, এ বীরপূজা, ব্যক্তিপূজা — বইটা পুড়িয়ে ফেলা দরকার। অথচ প্রচার করা হয় এই মানুষটি নাকি রাশিয়ার জাতীয় সংগীতে নিজের নাম লিখিয়েছিলেন! দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে তিনি সুপ্রিম কমান্ডার মনোনীত হলেন। অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিলেন বৃদ্ধ বয়সে। সোভিয়েতের বিমানবিধ্বংসী রকেট কেন জার্মান বিমানকে ভূপাতিত করতে পারছে না, তা যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে লক্ষ্য করেছিলেন। সেই সম্পর্কে রকেট তৈরির কারখানায় গিয়ে আলোচনা করেছিলেন। শত্রুর আক্রমণের সময় যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে রেড আর্মিকে উৎসাহিত করেছেন, তাদের অসুবিধাগুলি লক্ষ্য করেছেন। কোথায় কত ক্ষতি হলো তা দেখার জন্য মস্কোর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছেন। মস্কো তখন চারদিক থেকে আক্রান্ত। স্ট্যালিনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেবার জন্য সবাই উদ্বিগ্ন। কিন্তু স্ট্যালিন সম্মত হলেন না। উপরন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রকাশ্যে নভেম্বর বিপ্লব দিবস, মে দিবস উদ্যাপন করেছেন, বক্তব্য রেখেছেন। জনগণ তাঁকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলো। ৫৮তম জন্মদিনে বলেছিলেন, ‘রাশিয়ার সমাজতন্ত্র রক্ষার জন্য, বিশে^র শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির জন্য আমার শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে আমি লড়ে যাব।’ কথাটি অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণ করলেন যুদ্ধের সময় অক্লান্ত পরিশ্রম করে। মার্শাল জুকভ লিখেছেন, “তিনি যে কখন ঘুমাতেন, বিশ্রাম করতেন, আমরা বুঝতে পারতাম না। আমরা যুবক হয়েও তাঁর সাথে পেরে উঠতাম না।” তাঁর অসাধারণ নেতৃত্বে রাশিয়ার বিজয় হলো। নিজেকে কখনও জাহির করতেন না। তার প্রমাণ আবার দিলেন এ সময়। যুদ্ধে জয়ের পর মস্কোতে ভিকট্রি প্যারেড হচ্ছে। সবাই জানেন স্ট্যালিন ভিকট্রি প্যারেডে স্যালুট নেবেন। কিন্তু স্ট্যালিন মার্শাল জুকভকে স্যালুট নিতে বললেন। শুনে বিস্ময়ে চমকে উঠলেন জুকভ। কারণ স্ট্যালিন জানতেন তাঁর গাইডেন্সে জুকভ অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। বক্তব্যে বললেন, “জয়ের কৃতিত্ব সোভিয়েত জনগণের, রেড আর্মির।” বললেন, “নেতৃত্ব প্রথম দিকে ভুল করেছিলো। অন্য দেশের জনগণ হলে এই নেতৃত্বকে ছুড়ে ফেলে দিত। কিন্তু রাশিয়ার জনগণ নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্থা রেখে লড়াই করে গিয়েছিলো বলেই আমরা সাফল্য অর্জন করলাম।” ভাবতে পারেন, যখন দুনিয়ার মানুষ অপরের কৃতিত্ব নিজের নামে করতে ব্যস্ত তখন স্ট্যালিন কত বড় মহান চরিত্রের অধিকারী হলে এই কাজ করতে পারেন!
যুগ যুগ অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন এই মহান চরিত্র
১৯৫৩ সালের ৫ মার্চ সেই ভয়ানক দুঃসংবাদ এলো— স্ট্যালিন আর নেই। সমগ্র বিশ্ব শোকস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো। শুধু রাশিয়ায় নয়, পুরো ইউরোপ, এশিয়ায় স্কুল-কলেজ-কারখানা-অফিস সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। মারা যাওয়ার পর দেখা গেলো কিছু জামাকাপড়, জুতো, বইপত্র আর কয়েকটি রুবল ছাড়া তিনি আর কিছুই রেখে যাননি। আজ আমাদের সামনে নেতা মানেই তো রাজনীতিকে ব্যবসায় পরিণত করবে, লুটপাট করবে আর দেশ-বিদেশে অঢেল সম্পত্তির পাহাড় তৈরি করবে। তাই আজ আমাদের সামনে জেগে উঠুক স্ট্যালিনের মতো চরিত্র, যে স্ট্যালিনের সাথে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময় সাক্ষাৎ করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, “প্রধানমন্ত্রী স্ট্যালিনের সাথে সাক্ষাৎকার আমার এক বিরাট অভিজ্ঞতা। জাতির এই গভীর দুঃখের মুহূর্তে এই বলবান নেতা যে তার শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছেন তা রাশিয়ার পক্ষে খুবই সৌভাগ্যের কথা। তিনি এক অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ, এই প্রকার ব্যক্তিত্বেরই প্রয়োজন এই অন্ধকার, ঝঞ্ঝাতাড়িত যুগের কর্ণধার রূপে। অসীম তাঁর সাহস, তাঁর ইচ্ছাশক্তি, সরল প্রকৃতি, কথাবার্তায় এমনকি একটু অপ্রত্যাশিত স্পষ্টবাদিতাও দেখা যায়, … সবচেয়ে বড় কথা, তাঁর চরিত্র এমন একটা রসিকের গুণ আছে যে তাঁর ফলে অনেক সমস্যা সহজেই কাটিয়ে ওঠা যায়, যেকোনও ব্যক্তির বা জাতির পক্ষেই এ এক দুর্লভ গুণ। প্রধানমন্ত্রী স্ট্যালিনকে দেখে আমার মনে হয়েছে যে তিনি এক গভীর ও অবিচল প্রজ্ঞার আধার, কোনও প্রকার অবাস্তব মোহই স্থান পায় না তাঁর মনে …।”
এমন মহান চরিত্রের একজন মানুষ হবার পরও স্ট্যালিনের নামে নানা কুৎসায় বুর্জোয়া মিডিয়া সরব। আজ স্ট্যালিনকে স্বৈরাচারী, হত্যাকারী হিসেবে পরিচিত করানো হচ্ছে। কারণ পুঁজিপতিরা জানে স্ট্যালিনের সাথে একটা যুগ জড়িত, সমাজতন্ত্রের মহান গৌরব জড়িত, মার্কসবাদের অব্যর্থতার ইতিহাস জড়িত। স্ট্যালিনকে কালিমালিপ্ত না করলে এই গৌরবকে ধ্বংস করা যাবেনা। তাই এমন করে তাঁকে চিত্রিত করা হয়। কিন্তু তারা এটা জানেনা যে, যুগে যুগে যুবক-তরুণ-ছাত্ররা, যারা এই অসাম্য থেকে মুক্তির পথ খুঁজবে, স্ট্যালিনকে তারা খুঁজে নেবেই। স্ট্যালিন তাদের মুক্তিপথের দিশারী হয়ে থাকবেন।
(ভারতের এস.ইউ.সি.আই (কমিউনিস্ট) পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের ‘মহান স্ট্যালিন’ বই থেকে কিছুটা সংক্ষেপিত করে ও পরিমার্জন করে লেখাটি তৈরি করা হয়েছে)
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট মুখপত্র — অনুশীলন ফেব্রুয়ারি ২০১৭