পার্টির কেন্দ্রীয় কার্য পরিচালনা কমিটির নেতৃবৃন্দ, সারাদেশ থেকে আগত দলের নেতা-কর্মী-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীবৃন্দ, আমাদের অন্য দুই নেতা বিভিন্ন দিক থেকে দেশের সমস্যাগুলির ওপর আলোচনা করেছেন। আমি তার আর পুনরাবৃত্তি করবো না। কমরেড শিবদাস ঘোষ, যার চিন্তাধারার ভিত্তিতে দল গড়ে তোলার সংগ্রাম আমরা করছি, তিনি বিভিন্ন বক্তব্যে দেখিয়েছেন, কীভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভুল রাজনীতির চর্চা করতে করতে, আপোষকামী রাজনীতির চর্চা করতে করতে, ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ বিপথগামী হয়ে গেলো। এ বিষয়গুলো তিনি মার্কসবাদী বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে কেটে কেটে ব্যাখ্যা করে একেবারে স্পষ্ট দেখিয়েছেন। মনে রাখবেন, কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার কথা বলছি মানে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা এভাবেই বলছি। কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা আলাদা কিছু নয়, মার্কসবাদ-লেনিবাদেরই উন্নত ও সঠিক উপলব্ধি।
এক নতুন সভ্যতা নির্মাণকারী সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপথগামী হওয়াটাকে তিনি কোনো একটা বিশেষ অবজারভেশনের মাধ্যমে দেখাননি। অনেকগুলো দিকই তিনি তুলে ধরেছিলেন। আমি আজকের বক্তব্যে এর যতটুকু পারি সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
আপনারা জানেন আমি শারীরিকভাবে খুবই অসুস্থ। তার উপর এতক্ষণ ধরে বসেছিলাম বলে আমি খুবই ক্লান্ত বোধ করছি। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অল্প অল্প করে কর্মী-সংগঠকরা এসেছেন বক্তব্য শুনতে, তাদের হয়তো পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে পারবো না। যাই হোক আমি চেষ্টা করবো।
শুরুতেই বলে রাখি, যে সকল বন্ধুরা আমার সামনে বসে আছেন তাদের অনেক ইতিহাসই জানা থাকার কথা নয়। সেসব অনেক আগের কথা এবং সেগুলো নিয়ে আলোচনাও হয় কম। সে কারণে তারা বুঝতে পারেন না যে, এতবড় একটা সমাজতান্ত্রিক দেশ, বিরাট বিশাল শক্তি ও সম্ভাবনা নিয়ে যে দাঁড়িয়েছিলো, কীভাবে তার পতন ঘটে গেলো। কোনো বাইরের শক্তি এসে একে ধ্বংস করে দেয়নি, তারা নিজেরাই, ভেতর থেকেই সমাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে দিলো। কীভাবে সে ভেতর থেকে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছিল, কী কী ঘটনায় তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছিল, সেসকল বিষয়গুলো কমরেড শিবদাস ঘোষ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন।
রুশ বিপ্লবের প্রেক্ষিতটার দিকে যদি তাকাই তবে দেখবো, বিপ্লবের আগে ইউরোপের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া দেশ ছিলো রাশিয়া। বিপ্লবের পরেও তার স্থিতিশীল হতে অনেক সময় লেগেছে। ১৯১৭ সালে বিপ্লব হয়েছিলো। ১৯২৩ সাল পর্যন্ত গৃহযুদ্ধ চলেছে। দেশের ভেতরের পরাজিত জমিদার-পুঁজিপতিশ্রেণী আবার দেশের বাইরে বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশের আক্রমণের মুখে তাকে লড়াই করতে হয়েছে। অথচ বিপ্লবের পর এই রাষ্ট্রই এমন সব অধিকার মানুষকে দিয়েছিলো, যা তখনকার সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত পুঁজিবাদী দেশও কল্পনা করতে পারতো না, এখনও পারে না। রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব সমস্ত সক্ষম যুবক-যুবতীদেরকে কাজ দেয়া, সোভিয়েত রাষ্ট্র তা দিয়েছিলো। এমন একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তারা প্রবর্তন করেছিলো, যে ব্যবস্থায় জনগণ নির্বাচিত প্রতিধিদের ‘কল ব্যাক’ করতে পারে। এর মানে হলো, যাকে জনগণ নির্বাচিত করলো, সে যদি তাদের আশানুরূপ কাজ না করে তবে জনগণ তাকে ফিরিয়ে নিতে পারে। অর্থাৎ ঐ প্রতিষ্ঠানে তার সদস্যপদ বাতিল করে দিতে পারে। এই ‘রাইট টু রিকল’ সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া জনগণকে দিয়েছিলো। এই অধিকারটি বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সূচনা থেকে আজ অবধি কোনো পুঁজিবাদী দেশ জনগণকে দিতে পারেনি। আবার দিতে যে পারে না তা নয়। ধরুন, আমাদের দেশে সরকার ‘কল ব্যাক’ করার অধিকার দিয়ে আইন পাশ করলো। তাতে কি জনগণ এই অধিকার চাইলেই প্রয়োগ করতে পারবে? পারবে না। কারণ আমাদের দেশের মানুষ অসংগঠিত। বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে সাধারণ মানুষ অবস্থান করে। অসংগঠিত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জনগণ প্রত্যেকে ব্যক্তিগতভাবে চাইলেও ‘কল ব্যাক’ করতে পারে না। অপরদিকে সমাজতান্ত্রিক সমাজ একটি সংগঠিত সমাজ। সেখানে প্রত্যেকেই কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে সংগঠিত। যিনি নির্বাচনে দাঁড়ান তিনিও সেই সংগঠিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই দাঁড়ান। এই সংগঠিত নির্বাচকরা চাইলেই তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ‘কল ব্যাক’ করতে পারে, যে অধিকার আমাদের দিলেও আমরা তার চর্চা করতে পারবো না।
আমি সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় গণতন্ত্রের কতবড় উন্নত রূপ প্রকাশ পেয়েছিলো তা দেখানোর জন্য এই একটা উদাহরণ দিলাম। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাশিয়া অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছিলো। রাশিয়ায় বিপুল খনিজ সম্পদ ছিলো এবং তা উত্তোলনের মাধ্যমে দেশকে দ্রুত শিল্পোন্নত করে গড়ে তোলার জন্য তাদের মধ্যে প্রবল প্রচেষ্টা সৃষ্টি হয়েছিলো। কয়লা, লোহাসহ বিভিন্ন খনিজ সম্পদ সর্বোচ্চ উত্তোলন করে এমন একটা অবস্থা তারা তৈরি করেছিলো যে, দুুুনিয়ার আর কোনো দেশ তাদের সাথে পাল্লা দেয়ার মতো ছিলো না। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময় স্তাখানভ নামে এক শ্রমিক কয়লা উত্তোলনের উন্নত কৌশল উদ্ভাবন করে ও রেকর্ড সংখ্যক উৎপাদন করে তাক লাগিয়ে দেয়। এরপর দেশে এক আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। কে কাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে এই আন্দোলনে। এটি ‘স্তাখানোভাইট মুভমেন্ট’ নামে খ্যাত। কয়লা খনির শ্রমিকরা এটি শুরু করলেও এই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সবগুলো ক্ষেত্রেই তা ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করে।
দেশের নারীদের বড় হয়ে ওঠার সমস্ত পথ তারা খুলে দিয়েছিলো। স্বাধীন মানুষ হিসেবে তাদের পরিপূর্ণ বিকাশের রাস্তা তৈরি করে দিয়েছিলো। মেয়েরা তখন ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে সব রকম কাজে অংশগ্রহণ করতে পারতো। মেয়েদের মধ্য থেকে হাজার হাজার ডাক্তার, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী ইত্যাদি প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই বিশেষজ্ঞ লোক তৈরি হয়েছিলো।
তখনকার সময়ের একটা ঘটনা বললে সমাজতন্ত্রের আদর্শে বলীয়ান এই জাতির তেজ ও শৌর্য্যরে একটা দিক বোঝা যাবে। প্রথমদিকে যখন তাদের একবারে অনুন্নত অবস্থা, তখন তারা একটা অটোমোবাইল কারখানা তৈরির পরিকল্পনা করলো। যখন পরিকল্পনা করলো, তখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় কারখানা তৈরিরই পরিকল্পনা করলো। আমেরিকা, জার্মানী ইত্যাদি দেশ থেকে বেশ কিছু ইঞ্জিনিয়ার সোভিয়েতে এসেছিলো বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজ করতে। তারা শুনে তো হেসেই অস্থির। এ তাদের কাছে কোনো বিশ্বাসযোগ্য কথাই নয়। তারা বললো, ‘তোমরা অনভিজ্ঞ, অদক্ষ একদল লোক। বিশ বছরের দক্ষতা তোমরা এক বছরে অর্জন করতে চাও, এ কি করে সম্ভব?’ সোভিয়েত শ্রমিকরা এর জবাবে শুধু বলত, ‘আমাদের তো করতেই হবে। না করে কোনো উপায় নেই। আমাদের পারতেই হবে। বেশি সময় তো আমরা নিতে পারবো না। আমাদের নিজেদেরকে দ্রুত প্রস্তুত করতে হবে। বিরাট বিপদ আমাদের সামনে আসছে। সেই বিপদ মোকাবেলায় আমাদের তৈরি থাকতে হবে।’ একথায় বোঝা যায়, বিশ্বের একমাত্র শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রকে রক্ষা করা ও দ্রুত উন্নত করে তুলে গোটা বিশ্বের মুক্তি আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিরাট দায়িত্ববোধে কী রকমভাবে উজ্জীবিত ছিলো রাশিয়ার শ্রমিকশ্রেণী। তাই তারা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকে চার বছরেই সমাপ্ত করতে পেরেছিলো। শুধু শিল্প নয়, কৃষি উৎপাদনেও তারা অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছিলো। একর প্রতি গম উৎপাদনে, বীট উৎপাদনে তাদের একজন আরেকজনকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলো।
এরকম অবাক করার মতো প্রচুর কথা আছে। এসব নিয়ে অনেক বইও বেরিয়েছে। আমি আর এ ব্যাপারে কথা বাড়াচ্ছি না। এ বিরাট সমাজতান্ত্রিক উন্নতি ঘটেছিলো কমরেড স্ট্যালিনের সময়ে। স্ট্যালিন, লেনিনের ছাত্র হিসেবে, লেনিনবাদই যে আজকের দিনের মার্কসবাদ এটা দেখান এবং মার্কসবাদকে সমস্ত রকম বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করেন। সেদিন স্ট্যালিনকে বাইরের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে যেমন লড়তে হয়েছে, তেমনি দলের ভেতরে ট্রটস্কিদের মার্কসবাদ সম্পর্কিত ভুল ব্যাখ্যার বিরুদ্ধেও লড়তে হয়েছে। তিনি তাঁর জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও সুদৃঢ় নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়নকে এক উন্নত দেশে রূপান্তরিত করেন। এভাবে চলতে চলতে এক সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ১৯৪১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীর দুর্ধর্ষ ফ্যাসিস্ট শক্তি জার্মানীর দ্বারা আক্রান্ত হলো। জার্মানীর আক্রমণে সোভিয়েত প্রথমে খানিকটা পিছিয়ে আসলেও পরবর্তীতে তাকে এমনভাবে মোকাবেলা করলো যে জার্মান সৈন্যদের একবারে বার্লিন পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে গেলো। এই বিরাট জয় পৃথিবীর দেশে দেশে মুক্তি আন্দোলনকে নতুন শক্তি দিলো। উপনিবেশিক শাসন হতে বিভিন্ন দেশ মুক্ত হওয়া শুরু করলো। পূর্ব ইউরোপের পূর্ব জার্মানী, চেকোশ্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, আলবেনিয়া, হাঙ্গেরিসহ অনেকগুলো দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলো। এরপর চীন তার ৭০ কোটি মানুষ নিয়ে সমাজতান্ত্রিক শিবিরে যোগ দিলো। সমাজতান্ত্রিক শিবিরে এরপর যুক্ত হলো লাওস, কম্বোডিয়া, মঙ্গোলিয়া, উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশ। অর্থাৎ বিশ্বের এক বিরাট ভূ-খন্ড জুড়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলো। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন এই বিরাট সমাজতান্ত্রিক শিবিরের নেতৃত্বকারী দেশ। বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে সে তখন আর একা নয়, তার পেছনে তখন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ।
এখন প্রশ্ন আসে এতবড় শক্তিশালী এই সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতনের কারণ কী? বিশাল লড়াই সংগ্রামের ঐতিহ্য বহনকারী এই গোটা সমাজতান্ত্রিক শিবির এই পরিণতি কেন বরণ করলো? একথা বুঝতে হলে আপনাদের ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্যবাদী শিবিরের যখন বিরাট জয় জয়কার, তখনও তাদের মধ্যে আদর্শগত ও চিন্তার ঐক্যের ভিত্তিতে দৃঢ় সংহতির অনেক ঘাটতি ছিলো। বিশেষ করে যুগোশ্লাভিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মার্শাল টিটোর উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তার কারণে তাকে কমিনফর্ম থেকে বহিষ্কার করার সময়ই বোঝা গেলো যে, কমিউনিস্ট পার্টিগুলি যখন পরস্পরের সাথে বিভিন্ন সময় মিলিত হতো, তখন নিজেদের মধ্যে চিন্তার ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে বিপ্লবের সাধারণ লাইন গড়ে তোলার যে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি, সেটা অনুসরণ করতো না। ফলে বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের বিরাট জয়ের সময়েও নেতৃবৃন্দের চিন্তাপদ্ধতি যান্ত্রিকতার দ্বারা প্রভাবিত ছিলো। বিশেষত সাম্যবাদী শিবিরের দীর্ঘ সাহচর্য ও বহু সংগ্রামের ইতিহাস সৃষ্টিকারী যুগোশ্লাভিয়ার পার্টির পরিণতি তাই প্রমাণ করে। কমিনফর্ম থেকে মার্শাল টিটোকে বহিষ্কার করার অব্যবহিত পরে কমরেড শিবদাস ঘোষ ‘সাম্যবাদী শিবিরের আত্মসমালোচনা’ রচনায় এই বিষয়টি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন। তাঁর সেই লেখায় তিনি বলেন যে, “আমরা যে বিষয়টির প্রতি সমস্ত কমিউনিস্টদের বিশেষ করে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি, তা হচ্ছে, সোভিয়েত বা কমিনফর্ম নেতৃত্বের প্রতি অন্ধবিশ্বাস ঐ নেতৃত্বকে দুর্বল করতেই সাহায্য করবে। আমাদের হাতে রয়েছে বিশ্বসর্বহারা বিপ্লবী আন্দোলনের অভিজ্ঞতার ভান্ডার, আমাদের সম্পদ হচ্ছে দ্বন্দ্বতত্ত্বের মার্কসীয় বিজ্ঞান যার মানদন্ডে আমাদের অবশ্যই নেতৃত্বকেও বিচার করে নিতে হবে- তা সে সোভিয়েত নেতৃত্বই হোক বা কমিনফর্ম নেতৃত্বই হোক। একথা ক্ষণিকের জন্য ভুললে চলবে না যে, প্রতিটি কমিউনিস্ট পার্টির নিজস্ব উদ্যোগই আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সংগঠনের সক্রিয়তা ও কার্যকারিতার সুদৃঢ় ভিত্তি। চোখ বুঁজে নেতৃত্বকে শুধু অন্ধ সমর্থন জানিয়ে গেলে কোনও নেতৃত্বের পক্ষেই বিশ্বপরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করা ও সঠিক কার্যক্রম গ্রহণ করা সম্ভব নয়।”
এমনকি সেই লেখায় তিনি এই বলেও হুশিয়ারি দেন যে, “…মতাদর্শগত ক্ষেত্রে বর্তমানে যে অমার্কসীয় যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা রয়েছে, তা যদি সময়মতো ঠিকভাবে সমাধান করা না হয়, তাহলে বিশ্ব ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না যখন মানুষ দেখবে যে, বিভিন্ন দেশে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পরও কমিউনিস্টরা নিজেদের মধ্যে ঐক্যকে আরও সুদৃঢ় করা ও বিশ্বসাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার দিকে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে নিজেদের মধ্যে খোলাখুলি দ্বন্দ্ব-কলহে ও এমনকি যুুদ্ধ বিগ্রহেও লিপ্ত হয়ে পড়েছে।”
কমরেড শিবদাষ ঘোষের এই আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত হয়, যখন পরবর্তীতে দেখা যায় যে, সমাজতান্ত্রিক চীন ও সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনাম পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু এখানে যে বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার, তিনি এই কথাগুলো যখন বলেছেন তখন ১৯৪৮ সাল। সে সময়ে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের শক্তি ছিলো প্রশ্নাতীত। তখন কিছু সমস্যা ছিলো কিন্তু এরকম কিছু ঘটবে তা কেউ কল্পনাও করতে পারতো না। অসাধারণ প্রজ্ঞার সাথে তিনি সেই বিপদটি ধরতে পেরেছিলেন। কিন্তু এই যান্ত্রিক চিন্তাপদ্ধতি আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলন থেকে কেটে যায়নি। এই যান্ত্রিক চিন্তাপদ্ধতির কারণে চেতনার যে নিম্নমান সৃষ্টি হলো সোভিয়েত পার্টিও এর বাইরে বেরুতে পারলো না। অর্থাৎ শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট নেতৃত্বের পরস্পরের ক্ষেত্রে নয়, বিভিন্ন পার্টির অভ্যন্তরে, এমনকি সোভিয়েত পার্টির অভ্যন্তরে এই যান্ত্রিক চিন্তাপদ্ধতি ছিলো এবং তা চেতনার নিম্নমানের জন্য দায়ী। দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি ব্যতিরেকে চেতনার মান উন্নত হতে পারে না। স্ট্যালিনের নেতৃত্বের সময়েও চেতনার নিম্নমানের কারণে অনেক ভুল হয়েছে, কিন্তু সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির মূল জায়গাটায় তা আঘাত করতে পারেনি। কিন্তু সেই নেতৃত্বের অনুপস্থিতির পর চেতনার নিম্নমানের ফলে সেই মূল জায়গাটা ঘা খেলো এবং সংশোধনবাদী রাজনীতির প্রভাব ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো। এটা বাড়তে বাড়তে এক সময় সোভিয়েত সমাজতন্ত্রকে পতনের দিকে নিয়ে গেলো।
স্ট্যালিন এ ব্যাপারে ঊনবিংশতিতম পার্টি কংগ্রেসে সতর্ক করে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন,“বুর্জোয়া ভাবাদর্শের অবশেষ আজও আমাদের দেশে আছে। ব্যক্তিসম্পত্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নৈতিকবোধ ও মানসিকতার ধ্বংসাবশেষ আজও টিকে আছে। এটি কখনও আপনা আপনিই শেষ হয়ে যাবে না; এগুলির টিকে থাকার ক্ষমতা খুব বেশি এবং এরা নিজেদের প্রভাব শক্তিশালী করতে পারে। তাই এগুলোর বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সাথে সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে। আবার বাইরের পুঁজিবাদী দেশগুলি এবং আমাদের দেশের ভেতরের সোভিয়েত রাষ্ট্রবিরোধী গ্রুপগুলির অবশিষ্টাংশ- যা সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা যায়নি- এই উভয় শক্তি থেকে সমাজতন্ত্রবিরোধী চিন্তা, ভাবনাধারণা এবং মানসিকতা সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রবেশ করবে না এমন গ্যারান্টিও আমাদের কাছে নেই। একথাও ভুলে যাওয়া চলে না যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের শত্রুরা আমাদের সমাজের দুর্বল মানুুষদের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর চিন্তা প্রবেশ করাতে, সেগুলি উস্কে দিতে ও তাতে মদত দিয়ে বাড়িয়ে দিতে অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
কিছু পার্টি সংগঠন অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্যেই তাদের সকল দৃষ্টি আবদ্ধ করে ফেলেছে, আদর্শগত সংগ্রাম ভুলে যাচ্ছে, তার চর্চা পিছনে ঠেলে দিচ্ছে। এমনকি মস্কো সংগঠনের মতো পার্টি সংগঠনেও মতাদর্শ চর্চার দিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। এই অবহেলা অবাধে চলতে দেয়া যায় না। যখনই মতাদর্শ চর্চার শৈথিল্য ঘটছে, তখনই সমাজতন্ত্রবিরোধী চিন্তা ও ভাবধারার পুনরুত্থানের উর্বর জমি তৈরি হচ্ছে। কোথাও কোন একটি জায়গাতেও যদি আদর্শগত চর্চার দিকটি কোন কারণে পার্টি সংগঠনের নজরের বাইরে থেকে যায়; কোন একটা ক্ষেত্রেও যদি পার্টির নেতৃত্ব ও প্রভাব দুর্বল হয়, তাহলে সেই ক্ষেত্রগুলিকেই, সমাজতন্ত্রের শত্রুরা, লেনিনবাদবিরোধী দুষ্টচক্রের অবশিষ্টাংশ, যারা এখনও রয়েছে, তারা দখল করবে এবং নিজেদের রাজনৈতিক লাইন চালু করার জন্য তা ব্যবহার করবে, সবরকম অমার্কসীয় ‘চিন্তা’ ও ‘ধারণা’ পুনরুজ্জীবিত করার ও ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তাকে কাজে লাগাবে।” কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরে ক্রুশ্চেভ এসে দলের ভেতরে সেই আদর্শগত সংগ্রাম জোরদার করার কাজতো করলেনই না বরং ব্যক্তিপূজার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নাম করে স্ট্যালিনকেই কালিমালিপ্ত করা শুরু করলেন। এর ফলে তিনি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সঠিক উপলব্ধিরই গন্ডগোল করে দিলেন। সাথে সাথে ক্রুশ্চেভ পুঁজিবাদী দেশগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ‘ব্যক্তিগত ইনসেনটিভ’ দেয়া শুরু করলেন। এরকম অনেক ভুল নিয়ে কমরেড শিবদাস ঘোষ আলোচনা করেছেন এবং বাস্তবিকপক্ষে এই ভুলগুলো করতে করতে একসময় সোভিয়েত পার্টিটি পুরোপুরি সংশোধনবাদী লাইনে চলে গেলো। এইরকম কয়েকটি ঘটনা নিয়ে আমি আজ আলোচনা করবো, তাতে আমাদের এই কমরেডরা ঘটনা ধরে ধরে সমস্যাটা বুঝতে পারবেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্বপুঁজিবাদের বাজার সংকট আরও তীব্র হলো। কারণ পৃথিবীর এক বিরাট জায়গা জুড়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হওয়ার কারণে পুঁজিবাদী বাজার অনেকটা সংকুচিত হয়ে পড়লো। তার উপরে নতুন নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলো, যাদের ‘রিসার্জেন্ট ন্যাশনালিস্ট’ দেশ বলা হতো, তারা আবার নতুন প্রতিযোগী হিসেবে পুঁজিবাদী বাজারে প্রবেশ করলো। এ পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে একটি নতুন উপসর্গ দেখা গেলো। সেটা হলো অর্থনীতির সামরিকীকরণের ঝোঁক। এর সুবিধা হলো পুঁজির মালিককে বাজার খুঁজতে হয় না। রাষ্ট্রই অস্ত্র উৎপাদনের অর্ডার দেয়, মালামাল সে নিজেই কেনে। এই বিরাট কারখানা চালু রাখতে ও তার জন্য যে সহযোগী প্রতিষ্ঠান দরকার হয়, তাদের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি একরকম গতিশীল থাকে। কিন্তু এর আরেকদিকে সমস্যা আছে। তা হলো, রাষ্ট্র অস্ত্র কিনে তো আর শুধু শুধু জমিয়ে রাখতে পারে না। তাকে এগুলো খালাস করতে হবে। তবেই সে আরও নতুন অস্ত্রের অর্ডার দিতে পারবে। এর জন্য যুদ্ধ তার খুব দরকার। বিশ্বযুদ্ধ লাগাবার মতো বাস্তবতা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত আংশিক ও আঞ্চলিক যুদ্ধ তাকে লাগিয়ে রাখতে হবে। সেটা অন্য সবার চেয়ে বেশি দরকার আমেরিকার। কারণ আমেরিকার অর্থনীতি পুরোপুুরি অস্ত্র নির্ভর। এই জন্য আমেরিকা বিভিন্ন দেশকে একে অপরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেয়া, দেশে দেশে ক্যু করাসহ বিভিন্ন নোংরা ষড়যন্ত্র করতে থাকে। আবার সে সারা বিশ্বের মানুষকে এমন ভয় দেখাতে থাকে যে তাকে খোঁচালে আণবিক যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। আর তা শুরু হলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। অতএব, সভ্যতা রক্ষার স্বার্থে যাতে তাকে বিরক্ত করা না হয়।
আমেরিকার এই যুদ্ধচক্রান্ত বানচাল করাই ছিলো সমাজতান্ত্রিক দেশের নেতা হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাজ। কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন, এর জন্য সমাজতান্ত্রিক শিবিরের দরকার ছিলো চারটি কার্যক্রম। প্রথমত, সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের নিজেদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব আছে তাকে কাজে লাগানো। দ্বিতীয়ত, নয়া স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলোর সাথে সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের যে দ্বন্দ্ব আছে তাকে কাজে লাগানো। তৃতীয়ত, যেসকল পুঁজিবাদী দেশগুলোতে শ্রমিকশ্রেণী বিপ্লবের জন্য এবং যে সকল ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে জনগণ স্বাধীনতার জন্য লড়ছে- সে সকল লড়াইকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করা। চতুর্থত, আন্তর্জাতিক দিক থেকে এমন ‘ডিপ্লোমেটিক লাইন’ নেয়া যাতে আমেরিকা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে একবারে একঘরে হয়ে যায়। কারণ আমেরিকাই আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিবিপ্লব সংগঠিত করার কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
অথচ সোভিয়েত ইউনিয়ন অদ্ভুতভাবে আমেরিকার নিউক্লিয়ার ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হয়ে পড়লো। আণবিক বোমার অধিকারী দু’দেশই ছিলো। আমেরিকা যেমন ছিলো, তেমনি সোভিয়েত ইউনিয়নও ছিলো। কিন্তু গোটা বিশ্ব ফুঁস করে ধ্বংস হয়ে যাবে- আমেরিকার এরকম একটা তৃতীয় শ্রেণীর ক্যাম্পেইনে সাধারণ একটা মানুষের মতো সোভিয়েত ইউনিয়নও ভয় পেয়ে গেলো। ভয় পেয়ে গেলো এজন্য যে তারা তো নিজে এটাকে কোথাও প্রয়োগ করবে না। যদি আমেরিকা প্রয়োগ করে তাহলে তো দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে। তখন দুনিয়া ধ্বংস না হয়ে যাবার জন্যে যতরকম ছাড় আমেরিকাকে দিতে হয় তা তারা দেয়া শুরু করলো। আপোষ করতে শুরু করলো।
অথচ আণবিক যুদ্ধ বানচাল করার শর্তই ছিলো আনবিক শক্তিতে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখা। মানুষকেও দেখানো দরকার ছিলো যে, আমেরিকা যুদ্ধ লাগলে কি হয়ে যেতে পারে তা বলছে, অথচ এমন ভাব দেখাচ্ছে যে, যুদ্ধ লাগা না লাগার ব্যাপারে তার যেন কোনো দায়িত্ব নেই। তার এই চালাকিটাও উন্মোচিত করা উচিত ছিলো।
কিন্তু সোভিয়েত নেতৃত্ব তা ধরতেই পারলেন না। উপরন্তু এমন কিছু ভুল পদক্ষেপ তারা নিলেন যে তা সমাজতান্ত্রিক শিবিরের গৌরবকেই অনেকখানি খাটো করে দিলো।
আপনারা জানেন ১৯৫৩-৫৪ সালের দিকে আমেরিকা কোরিয়ায় হস্তক্ষেপ করে। কমরেড কিম ইল সুন- এর নেতৃত্বে কোরিয়ার ওয়ার্কার্স পার্টি কোরিয়ার স্বাধীন জনগণকে সাথে নিয়ে লড়াই করতে করতে যখন সামনে এগোচ্ছিলো, তখন আমেরিকা জাতিসংঘের নামেই চৌদ্দটি দেশকে সাথে নিয়ে এতে হস্তক্ষেপ করে। তখন চীন সেখানে কোরিয়ানদের পক্ষে দুই লক্ষ ভলান্টিয়ার পাঠায়। এরা কোরিয়ান বিপ্লবীদের সাথে মিলে আমেরিকান বাহিনীকে বলতে গেলে প্রায় লাঠি পিটিয়ে সিউল পর্যন্ত নিয়ে আসলো। কারণ আমেরিকান বাহিনীর মতো অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র তাদের ছিলো না। এই যুদ্ধে হেরে আমেরিকা পরাজয়ের গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছিলো। তার বন্ধু দেশসমূহের সামনে দাঁড়িয়ে সে যে শ্রেষ্ঠ এই কথা বলার মুখ আর তার ছিলো না। এই মর্যাদা পুনরুদ্ধারের জন্য সে নানারকম চেষ্টা করছিলো।
এই হারানো মর্যাদা সে ফিরে পেতে সক্ষম হয় সোভিয়েতের একটা ভুলের কারণে। সোভিয়েত কিউবায় তার একটি মিসাইল স্থাপন করলো। আমেরিকা এটি দেখিয়ে ক্যাম্পেইন করতে থাকে যে, সোভিয়েত আমার নাকের ডগায় মিসাইল বসিয়েছে, সে আমাকে আক্রমণ করতে চায়। অথচ সোভিয়েতের এই মিসাইল স্থাপনার কোনো দরকার ছিলো না। কারণ তার কাছে ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালাস্টিক মিসাইল মজুত ছিলো যা দিয়ে সে যে কোনো সময় আমেরিকার মূল ভূমিতে আঘাত হানতে পারে। কিন্তু আমেরিকা এই ঘটনাকে দেখিয়ে একদিকে বিশ্ববাসীর কাছে প্রচার চালায় যে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধবাজ, যে কোনো সময় সে যুদ্ধ লাগাতে পারে, অন্যদিকে সোভিয়েতের কিউবাগামী বাণিজ্য জাহাজকে ‘ষষ্ঠ নৌবহর’ দিয়ে আটকে দেয়। তার উদ্দেশ্য ছিলো এখানে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ লাগিয়ে দেয়া। ক্রুশ্চেভ এই ঘটনা শুনে বোকার মতো বাণিজ্য জাহাজকে নৌবহর ভেঙ্গে বেরিয়ে যেতে বললেন। খবরটি গণমাধ্যমে প্রকাশও পায়। সাথে সাথে আবার সোভিয়েতের সমর বিশেষজ্ঞরা এ ভুল ঠিক করে দেন। আর একথা সহজেই অনুমেয় যে, ঐ জায়গায় কোনো আঞ্চলিক যুদ্ধ লাগলে আমেরিকাই জিতবে। কারণ সেখান থেকে সোভিয়েত মূল ভূখন্ডের দূরত্ব প্রায় ৬০০০ মাইল কিন্তু আমেরিকার দূরত্ব ৯০ মাইল। ফলে সেখানে যুদ্ধ হলে সোভিয়েত কোনো লজিস্টিক সাপোর্ট পাবে না। সোভিয়েত তখন কিউবা থেকে তার মিসাইল স্থাপনা প্রত্যাহার করে নেয়। এই ঘটনায় আমেরিকা কোরিয়াতে হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করে।
আরেকটা ঘটনা ঘটালো তারা ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে। যেটি সাংবাদিকদের ভাষায় ‘টনকিন সঙ্কট’ নামে পরিচিত। ভিয়েতনামের ইতিহাসটা আমি ছোট করে একটু বলি। ভিয়েতনাম বহুকাল ফ্রান্সের কলোনী ছিলো। ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধে উত্তর ভিয়েতনামের স্বাধীন হওয়ার ভিত্তি তৈরি হয়। দিয়েন তিয়েন ফু বলে একটা জায়গায় ফ্রান্সকে তারা পুরোপুরি পরাজিত করে। ফ্রান্স তখন সে দেশ ছেড়ে চলে যায়, কিন্তু যাওয়ার আগে তারা জাতিসংঘের সাথে যুক্ত হয়ে দক্ষিণ ভিয়েতনামকে একটি আলাদা দেশ হিসেবে ঘোষণা করে। বাদওয়াই সম্রাটের শাসনে তা পরিচালিত হতে থাকে। দক্ষিণ ভিয়েতনামে তখন মুক্তির জন্য লড়াই চলতে থাকে। এই আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্য লক্ষ লক্ষ আমেরিকান সৈন্য সেখানে নামতে থাকে। প্রচুর আমেরিকান সৈন্য মারাও যায় সে যুদ্ধে। যুদ্ধের একটা পর্যায়ে এসে আমেরিকা উত্তর ভিয়েতনামে বোমা মারতে শুরু করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন সাধারণ কিছু যুদ্ধসাহায্য ছাড়া উত্তর ভিয়েতনামের জন্য আর কিছু করলো না। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের দায়বদ্ধতা ছিলো এই যে, কোনো একটা সমাজতান্ত্রিক দেশের উপর যদি আক্রমণ হয়, তাহলে তা সোভিয়েতের উপর আক্রমণ বলেই তারা মনে করবে। অথচ সমাজতান্ত্রিক উত্তর ভিয়েতনামের ব্যাপারে তাদের এই ভূমিকা দেখা গেলো না। কিছু অস্ত্রশস্ত্র দেয়া ছাড়া তারা আর কিছু করলো না। করলো না আমেরিকার আণবিক ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হওয়ার কারণে, স্ট্যালিনের শান্তিুপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি বুঝতে না পারার কারণে।
স্ট্যালিনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি ক্রুশ্চেভ নেতৃত্ব বিকৃত করে ফেললেন। স্ট্যালিনের নীতি ছিলো সোভিয়েত কোনো দেশে কখনও হস্তক্ষেপ করবে না, তার দরকারও নেই। বিপ্লব করার জন্যও সে করবে না। কারণ বিপ্লব নিজ নিজ দেশের মধ্য থেকে তার নিজস্ব নিয়মেই গড়ে ওঠে। একে আমদানি-রপ্তানী করা যায় না। সেকারণে সোভিয়েতের অন্য দেশ আক্রমণের কোনো চিন্তাও নেই। কিন্তু আমেরিকারও উচিত নয় অন্য দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা। তাকেও সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
অথচ ক্রুশ্চেভ এই নীতি থেকে সরে আসলো। সোভিয়েত নেতৃত্ব বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক শিবিরের নেতৃত্বের আসনে বসে থেকে একের পর এক ভুল পদক্ষেপ নিতে থাকলো। এই সকল আলোচনার মধ্য দিয়ে আমি বুঝাতে চাইছি যে, ঘটনার সময় ভুল পদক্ষেপ নেয়াটাতো একটা ভুল। কিন্তু সে ভুল কেন হয়? সোভিয়েত নেতৃত্বের চেতনার অনুন্নত মানই এই সমস্ত ভুল চিন্তা গড়ে ওঠার পেছনে দায়ী। দলের মধ্যে আদর্শগত চর্চা ও নেতা-কর্মীর দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক না থাকলে চেতনার এই অনুন্নত মান দূর হয় না। আর এটি প্রতিনিয়ত উন্নত করার বিষয়। একবার উন্নত হলেই যে সবসময় একইরকম থাকবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের ‘ন্যাশনাল ভ্যানিটিমুক্ত’ বোঝাপড়াও তখনকার সময়ে জরুরি ছিলো। কারণ যেহেতু বিপ্লবটা জাতীয় তাই তার মধ্যে ‘ন্যাশনাল ফিলিং’ থাকেই। সেটা যাতে আঘাতপ্রাপ্ত না হয় পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সে দিকে দৃষ্টি দেয়া দরকার আবার এই ‘ন্যাশনাল ফিলিং’-কে আন্তর্জাতিকতাবাদী চেতনা দিয়ে প্রতিস্থাপনও করা দরকার। তখন সেটা আর আগের মতো থাকে না। ক্রমাগত কমতে থাকে। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর বোঝাপড়া পুঁজিবাদী দেশগুলোর মতো হলে চলে না। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক- সমস্ত দিক থেকে তাদের পারস্পরিক বোঝাপড়া জরুরি ছিলো। কিন্তু দুঃখজনক, তা হয়নি। এসবের নেতৃত্ব দেয়ার কথা ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নের, তারা তা পারেনি। এরকম আরও বহু ব্যাপার আছে কমরেড, একটা সভায় যার সবকিছু আলোচনা করা সম্ভব নয়। আমার এই আলোচনা সে অর্থে পূর্ণাঙ্গও নয়। আমি একটা আংশিক ক্ষেত্র, একটা দিক দেখানোর চেষ্টা করলাম।
আমি যে কথাটা বলে আমার বক্তব্য শেষ করতে চাই, কমরেড, তত্ত্ব ও চরিত্রের সাধনা খুবই দরকার। এ ছাড়া কোনো দেশের কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা বিপ্লব সম্পন্ন করতে পারবে না, বিপ্লবকে উন্নত স্তরে নিয়ে যেতে পারবে না। সে আন্তর্জাতিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হারিয়ে ফেলবে, জাতীয়তাবাদী নানা ধরনের চিন্তার শিকার হয়ে যাবে। ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টি অতুলনীয় লড়াই করে, বিরাট শৌর্য-বীর্য দেখিয়েও শেষ পর্যন্ত নিজেদের রক্ষা করতে পারেনি। সেসময়ে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে যে সকল সমস্যা চলছিলো তাতে তাদের নিজস্ব কোনো বক্তব্য ছিলো না। ফলে তারা অনেক আত্মত্যাগের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করলো ঠিকই, কিন্তু দেশটি আবার জাতীয়তাবাদী চিন্তায় ফেঁসে গেলো। চীনের উদাহরণ দেখুন। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নবম ও দশম কংগ্রেসের রিপোর্ট আলোচনা করতে গিয়ে কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছিলেন, তারা তাদের তত্ত্বগত সংগ্রামের ক্ষেত্রে কিছু ঘাটতি এখনও পূরণ করতে পারেনি। যৌথ নেতৃত্ব ও তার বিশেষীকৃত প্রকাশের মধ্য দিয়ে দলের মধ্যেকার সমস্ত রকম ব্যক্তিবাদী চিন্তাকে পরাস্ত করার সংগ্রামকে তারা তত্ত্বায়িত করতে পারেনি। পারেনি বলে একদিন না একদিন এর ক্ষতিকারক দিক তারা টের পাবে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থা এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি। মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লব করা এই পার্টি কী করুণ পরিণতি বরণ করলো।
ফলে কমরেড, আদর্শগত চর্চা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দলের ক্ষেত্রেও বলতে হয়, আমাদের দলকে আদর্শগতভাবে সংহত করা খুব জরুরি, যতক্ষণ পর্যন্ত যৌথ নেতৃত্বের সর্বোন্নত প্রকাশ ঘটাবার মতো বাস্তব অবস্থা আমরা সৃষ্টি করতে না পারি- ততক্ষণ পর্যন্ত এ সংগ্রামকে আমাদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। মহান নভেম্বর বিপ্লবের ইতিহাস থেকে এই শিক্ষা নিয়ে আগামীদিনে দল গড়ে তোলার সংগ্রামে আপনারা ব্যক্তিগত সকল বাধা তুচ্ছ করে নিমগ্ন হবেন- এই আহবান রেখে, সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি।