Wednesday, December 25, 2024
Homeফিচারসরকারের ছত্রছায়ায় চালের দাম বাড়াচ্ছে চালকল মালিক-মজুতদার-ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট

সরকারের ছত্রছায়ায় চালের দাম বাড়াচ্ছে চালকল মালিক-মজুতদার-ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট

 

rice_price_edit

রেকর্ড শব্দটি শুনলে সাফল্যের কথা মনে আসে। কিন্তু এই বাংলাদেশে ‘রেকর্ড’ শব্দটি জন দুর্ভোগেরই আরেকটি প্রতিশব্দ যেন। চুরি-দুর্নীতি, অর্থপাচার নারী নির্যাতন চালের দাম অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। টিসিবি (ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ) এর হিসাব মতে — মোটা, সরু সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে (গত বছরে এ সময়ের তুলনায়) ১৮-১২ টাকা। অর্থাৎ শুধু মাত্র চাল কেনা বাবদ একটি পরিবারকে অন্তত: ৪০০ টাকা (মাসে ৫০ কেজি চাল কিনলে) বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। চালের দাম এত বেশি কখনোই ছিল না।

বর্তমানে মোটা চালের দাম অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। চলতি বছরের ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ(টিসিবি) প্রকাশিত ১০ মে-র হিসাবে প্রতি কেজি মোটা চাল ৪২ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা ২০১৬ সালের একইদিনে ছিল ৩০ থেকে ৩৪ টাকা। প্রতি কেজি সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৬ টাকা। যা ২০১৬ সালের এ দিনে ছিল ৪৪থেকে ৫৫ টাকা। নাজির বা মিনিকেটের সাধারণ চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকা। যা ২০১৬ সালের এ দিনে ছিল ৪৪ থেকে ৪৮ টাকা। গত বছর বোরো মৌসুমের পর আগস্ট থেকে চালের দাম বাড়তে শুরু করেছিল, কিন্তু এবার তা এখনই রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। জানুয়ারিতে আমন ধানের চাল বাজারে উঠলেও বাজারের অস্থিরতা কমাতে পারেনি। এখন বোরোর চাল বাজারে আসতে শুরু করেছে। তারপরও চালের দাম কমছে না। এর আগে কয়েক বছর মোটা চালের খুচরা দর কেজি প্রতি ৩০-৩২ টাকার আশপাশে ছিল। মিনিকেট মিলত ৪২ থেকে ৪৪ টাকা দরে। অন্যদিকে মাঝারি আকারের চাল কেজি প্রতি ৩৬ থেকে ৩৮ টাকার মধ্যেই পাওয়া যেত। এ দামের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, একটি পরিবারকে মাসে ৫০ কেজি চাল কিনতে ৪০০ টাকা বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। ন্যাশনাল ফুড পলিসি ক্যাপাসিটি স্ট্রেংদেনিং প্রোগ্রামের ওয়েবসাইটে দেওয়া ২০০৭ সাল থেকে চালের দাম ওঠানামার লেখচিত্রে দেখা যায়, চালের দাম এত বেশি কখনো ছিল না।
চালের দাম বাড়লে সব শ্রেণির ক্রেতাকেই সেই বাড়তি দামে চাল কিনতে হয়। এতে সবচেয়ে বিপাকে পড়ে নিম্নবিত্তের মানুষ এবং যাদের আয় সুনির্দিষ্ট। আয়-রোজগারের উপায় এমনিতেই সীমিত। যাদের নিয়মিত আয়ের ব্যবস্থা নেই এবং যারা মাস-মাইনের চাকুরে তারাই বেশি নাজুক অবস্থায় পড়ে। সংসার চালাতে গেলে খরচের কোনো শেষ নেই। পণ্য, সেবা ইত্যাদির মূল্যবৃদ্ধির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় সাধ্যের বাইরে চলে গেছে। নিরুপায় হয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো খরচ কমানো যায়, কিন্তু চালের খরচ কমানো যায় না। যত দামই হোক, জীবন বাঁচাতে চাল কিনতেই হয়। সরকারি হিসাবমতে, দেশে এখনও ৪ কোটির বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। মোটা চালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় এদের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। শুধু দরিদ্র ও হতদরিদ্ররা নয়, চালের দাম বৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মধ্যবিত্ত ও নি¤œ মধ্যবিত্তরাও, বিশেষ করে যাদের আয় নির্দিষ্ট। চালের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের মাছ-মাংস, ডিম, দুধ অর্থাৎ আমিষ জাতীয় খাবার কেনা অনেকটা কমিয়ে দিতে হবে। এতে তাদের পরিবারে, বিশেষ করে শিশু ও নারীদের মধ্যে পুষ্টির অভাব ঘটবে।

চালের দাম বাড়লেও এর সুফল পায়নি ধান উৎপাদনকারী কৃষক। কারণ কৃষক পর্যায় থেকে ন্যায্যমূল্যের চেয়ে কম দামে ধান কিনে মজুদ করা হয়েছে। এখন মজুদকৃত ধানের দাম বাড়িয়ে চালের বাজার থেকে অতি মুনাফা করছেন মিলমালিকরা। এছাড়া এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে স্থানীয় দালাল ও ফড়িয়ারাও। নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের অভাবে এই শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্রের কারসাজিতে দাম কমছে না। অথচ, প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতসহ বিশ্বের প্রধান ধান উৎপাদনকারী দেশে এখন চালের দাম নিম্নমুখী ধারায় রয়েছে।
সার্বিকভাবে এই অঞ্চলের ধান উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে এখন বাংলাদেশেই মোটা চালের দাম সবচেয়ে বেশি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারত থেকে ৫ শতাংশ ভাঙা সেদ্ধ চাল আমদানি করলে এখন দেশের বাজারে প্রতি কেজির সম্ভাব্য মূল্য দাঁড়াবে ৩২ টাকার কিছু বেশি। পাকিস্তান থেকে আনলে তা কেজি প্রতি প্রায় ৩৫ টাকা পড়বে। অন্যদিকে থাইল্যান্ড থেকে আতপ চাল আমদানি করলে প্রতি কেজি ৩২ টাকা ৪৪ পয়সা ও ভিয়েতনাম থেকে আনলে পড়বে ৩৩ টাকা ৬৪ পয়সা।

চলতি মৌসুমে ৭ লাখ টন ধান কিনবে সরকার। প্রতি কেজি ধানের ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২৪ টাকা। অন্যদিকে ৮ লাখ টন চাল কেনা হবে সরকারিভাবে। এজন্য প্রতি কেজি চালের দাম ৩৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকারী হিসাবে, চলতি মৌসুমে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে ২২ ও চালে ৩১ টাকা খরচ হয়েছে। উৎপাদন খরচ মাথায় রেখেই সংগ্রহমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এই হিসেবে প্রতি কেজিতে গড়ে ১০ টাকা বাড়তি দিয়ে চাল কিনছে ক্রেতারা। দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি হলে ভিজিএফ/ভিজিডি/খাদ্য বান্ধব কর্মসূচি ইত্যাদি সামাজিক নিরাপত্তা জালের বাইরে থাকা পরিবারের সংখ্যা ৩ কোটির মত হবে। প্রত্যেক পরিবারে দিনে অন্ততঃ ২ কেজি চাল লাগলে ১০ টাকা বাড়তি দরে প্রতিদিন ৬০ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে। এভাবে একমাসে অন্ততঃ ১৮০০ কোটি টাকা সাধারণ মানুষের পকেট থেকে মূল্য বৃদ্ধিকারী সিন্ডিকেট আত্মসাৎ করছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে ৩ কোটি ৪৯ লাখ ৬৮ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ২ লাখ ৫৮ হাজার টন বেশি। অর্থাৎ, দেশে বর্তমানে চালের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। কৃষকরা, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীরা মৌসুমের শুরুতে ধান বিক্রি করেন, ধান কাটার মৌসুম শেষ হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে তারা চাল ক্রেতায় পরিণত হন। মৌসুমে কম দামে কেনা ধান-চাল এখন মজুদ আছে অটোরাইস মিলার, আড়তদার বা পাইকারি ব্যবসায়ীদের গুদামে। চালের দর বৃদ্ধি বা কমা পুরোটাই এখন তাদের ওপর নির্ভর করছে। সরকারি গুদামে চালের মজুত এখন ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন, আড়াই লাখ টনের কিছু বেশি। কিন্তু গত বছর এই সময় মজুতের পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৩০ হাজার টন। সরকারি গুদামে চালের মজুদ এমন উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছায় চালকল মালিকরা বুঝতে পেরেছেন, সরকার সহসা ওএমএসসহ অন্য ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে চালু করে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এ পরিস্থিতি চালকল মালিকদের খেয়ালখুশিমতো চালের দাম বাড়াতে উৎসাহ জুগিয়েছে।

খাদ্যমন্ত্রী এড. কামরুল ইসলাম জানিয়েছেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজির জন্য চালের দাম বেড়েছে। আমরা বাজার পর্যবেক্ষণ করছি। দেশে ধান-চালের কোনো সংকট নেই। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, হাওরে অকাল বন্যায় ও ব্লাস্ট রোগে এবার ১৫ লাখ টন ধান নষ্ট হয়েছে, যা চালের হিসেবে ১০ থেকে ১২ লাখ টন। তবে প্রতি বছর ১৫ থেকে ২০ লাখ টন চাল উদ্বৃৃত্ত থাকে। এছাড়া বর্তমানে সরকারের গুদামে সাড়ে ৫ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। তাই দেশে বছরে প্রায় ৩ কোটি টন চালের চাহিদা মেটাতে কোনো সমস্যা হবে না। অথচ, বাজার ‘পর্যবেক্ষণ’ করে সরকার এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়নি। ‘অসাধু’ ব্যবসায়ী যারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কারসাজি করছে তাদের কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।

ধানের এ ভরা মওসুমে চালের দাম বাড়ার কথা নয়। অথচ বাড়ছে এবং তা নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কৃষক থেকে মিলার-ব্যবসায়ী ও সেখান থেকে প্রান্তিক ক্রেতা পর্যন্ত চাল আসার যে চেইন, তাতে কোনো সমস্যা হলে বাজারে তার প্রতিক্রিয়া হতে বাধ্য। এখন বাজারে যেসব চাল বিক্রি হচ্ছে তার বেশির ভাগ হলো মজুতদার, মধ্যস্বত্বভোগী বড় বড় মিলার ও পাইকারি ব্যবসায়ীর। মিলার ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে অতি মুনাফা শিকারের প্রবণতা বরাবরই লক্ষ্য করা যায়। দেশে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে মিল মালিক ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। বোরো ও আমন মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে কম দামে চাল কিনে গুদামজাত করেন তারা। বাজারে সংকট সৃষ্টি করে বাজার অস্থির করে তোলেন। সংকটকে পুঁজি করে তারাই দাম বাড়ায়।

চাল বা খাদ্যশস্যের বাজারের ওপর সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। বাজার ব্যবস্থাপনা বলতে যা বুঝায়, তারও কোন বালাই নেই। চালের দাম বাড়লে, কেন বাড়ছে তা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ খোঁজ-খবর করে না। সেই অতি পুরনো পন্থা অনুসরণ করে স্বল্পমূল্যে খোলাবাজারের চাল বিক্রির ব্যবস্থা নেয়। এই কার্যক্রম হয়তো কিছুদিন থাকে, তাও গ্রামে-গঞ্জে নয়, শহরাঞ্চলে; তারপর এই কর্মসূচি এক সময় হাওয়া হয়ে যায়। সরকারের তরফে সব সময় বড়-গলা করে বলা হয়, দেশে খাদ্যশস্যের কোনো সঙ্কট নেই, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সত্য বটে, দেশে ধান-চালের অভাব নেই। প্রয়োজনে আমদানির ব্যবস্থাও আছে এবং আমদানিও হয়ে থাকে। তারপরও চালের বাজারে অস্থিরতা-অস্থিতিশীলতা কেন তার কোনো জবাব খুঁজে দেখা হয় না। অসৎ মিলার-ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। খুচরা, পাইকারি ও মিলারদের একে অপরকে দায়ী করে গা বাঁচানোর চেষ্টা করে। মাঝখান থেকে ক্রেতা-ভোক্তার পকেট কাটা যায়। তাদের সুবিধা-অসুবিধা দেখার কেউ নেই।

মজুতদারদের কারসাজির বিষয়ে কোন নজরদারি না থাকায় চালের দাম বাড়ছে। পাশপাশি বাজারে সরকারের হস্তক্ষেপ ও অংশগ্রহণ দরকার। খাদ্য বিভাগের খোলা বাজারে চাল বিক্রি কার্যক্রম নিয়মিত চালু রাখতে হবে। বাংলাদেশ কৃষিতে ভর্তুকি কম দেয়। তাই এ দেশে চালের উৎপাদন খরচ একটু বেশি। ধানের উৎপাদন খরচ কমাতে কৃষি খাতে ভর্তুকি বৃদ্ধি, ধানচাষীদের স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান, উন্নত জাতের বীজ সরবরাহ, সার সহজলভ্যকরণ, সেচ সুবিধা বাড়ানো ইত্যাদি কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে। চলতি অর্থবছরে (২০১৬-২০১৭) চাল আমদানির ওপর শুল্কের হার ১০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে উন্নীত করায় বেসরকারি খাতে চাল আমদানি ভীষণভাবে কমে গেছে। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারকে এখন চাল আমদানি করতে হবে। বেসরকারি আমদানিকারকদের সুবিধার্থে চালের আমদানি শুল্ক সাময়িকভাবে কমানোও যেতে পারে।

সাম্যবাদ জুন ২০১৭

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments