Wednesday, December 25, 2024
Homeফিচারসর্বহারাশ্রেণীর বিপ্লবী দল গড়ে তোলার সংগ্রাম এগিয়ে নিন

সর্বহারাশ্রেণীর বিপ্লবী দল গড়ে তোলার সংগ্রাম এগিয়ে নিন

বিশেষ পার্টি কনভেনশন সফল করুন

Untitled-1সাম্যবাদ প্রতিবেদন
প্রতিদিন যে জীবনের মুখোমুখি আমাদের হতে হয়, পত্রিকার পাতা খুললে সারাদেশের যে চেহারা ভেসে ওঠে, টিভির পর্দায় যে দৃশ্য দেখতে হয় – এর বড় অংশই আমাদের জন্য আনন্দের নয়, স্বস্তির নয়, শান্তির নয়। জীবনের লাঞ্ছনা, মনুষ্যত্বের অবমাননা আর স্বপ্নের মৃত্যু দেখতে হয় প্রতিদিনই। প্রতিদিন বীভৎস সব মৃত্যু, বর্বর হত্যাকা-, নারী ও শিশু নির্যাতন, সহিংসতার খবর আমাদের মনে সন্দেহ তৈরি করে – আমরা কি কোনো সভ্য জগতে বাস করছি? যে রাষ্ট্রে আমরা বাস করছি সেই রাষ্ট্রের শাসন-প্রশাসন আমাদের ভাবতে বাধ্য করে – এই কি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশ?
সমাজে বৈষম্য তীব্র ও ব্যাপক রূপ নিয়েছে। কোটি কোটি মানুষ জীবনধারণ করতেই হিমশিম খাচ্ছে। কাজের আশায় কত মানুষ ঘুরে মরছে। সামান্য দু’মুঠো ভাতের অভাবে মানুষ অন্যের দুয়ারে হাত পাতছে, জীবন-সম্মান সব বিলিয়ে দিচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। কৃষক ফসলের ন্যায্য দাম পায় না। শ্রমিক ন্যায্য মজুরি পায় না। নারীদের জীবনে নিরাপত্তা নেই। শিক্ষা-চিকিৎসা দুর্মূল্য। এই যখন দেশের বেশিরভাগ মানুষের অবস্থা তখন দেশের অল্প কিছু মানুষের হাতে সম্পদের পাহাড় জমা হয়েছে। তাদের বিলাস-ব্যসনের পেছনেই ব্যয় হয় লক্ষ টাকা! প্রতিদিন সংবাদপত্রে উঠে আসা খবরগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয় কত প্রবল হয়েছে।
অথচ এ দেশের মানুষ উন্নত জীবনের আশায়, গণতান্ত্রিক সমাজের আশায় কত লড়াই করেছে, রক্ত দিয়েছে। এদেশের মানুষ ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে, সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, ধর্মতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। সর্বোপরি স্বাধীনতার জন্য কাতারে কাতারে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। স্বাধীনতার পরেও মানুষ গণতন্ত্রের জন্য, অধিকারের জন্য অনেক লড়াই করেছে। আজকের দেশের দিকে তাকলে, সমাজের দিকে তাকালে মনে হয় – এত আত্মবলিদান, এত সংগ্রাম সবই বুঝি বিফলে গেল।

সমাজের সংকট, জনজীবনের সংকট থেকে উত্তরণের পথ কি?

আজ মানুষের জীবনে, সমাজ জীবনে দুই ধরনের সংকট, দুই ধরনের যন্ত্রণা – একদিকে অভাব, বৈষম্য, লাঞ্ছনা, নির্যাতন-নিপীড়ন, অন্যদিকে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রবল অবক্ষয়। যন্ত্রণাকাতর মানুষ এই উভয় সংকট থেকেই মুক্তি চায়। কিন্তু এই সংকট থেকে কীভাবে মানুষ মুক্তি পাবে? কোন পথে গেলে জীবনের ওপর চেপে বসা অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ-বৈষম্য, অপমান আর লাঞ্ছনার হাত থেকে সে মুক্তি পাবে? মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয় থেকে সমাজকে কীভাবে রক্ষা করবে? এর উত্তর দেশের বেশিরভাগ মানুষই জানে না। এমনকি শিক্ষিত বলে, রাজনীতি-সচেতন বলে যারা পরিচিত তাদের অনেকেই আজ হতাশ Ñ কিছু হবে না। বড়জোর তারা নির্বাচনে ভালো সৎ প্রার্থী দেখে ভোট দেয়ার কথা বলেন। যেন ভালো আর সৎ প্রার্থী দেখে ভোট দিলেই জীবনের সংকট সমাধান হয়ে যাবে। অথচ ব্যালট পেপারে সিল দিয়ে যে সমাজের সংকট দূর হয়নি, মানুষের অবস্থার উন্নতি হয়নি, বর্তমান পরিস্থিতি সে সত্যই তো আমাদের সামনে তুলে ধরছে।
বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে এখন মানুষ জানে যে এই জগৎ নিয়ম-শাসিত, নিয়মের অধীন। বস্তুজগতে, সমাজজীবনে, ব্যক্তি জীবনে – যেখানে যত পরিবর্তন ঘটে সবই নিয়ম মেনে ঘটে। বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে মানুষ এই নিয়ম জানার সংগ্রাম করছে। সেই নিয়ম জেনে কখনো পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করছে, কখনো নিজেদের প্রয়োজন মতো পরিবর্তনকে প্রভাবিত করছে, কখনো নিজেদের প্রয়োজন মতো পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। ফলে সমাজের সংকটের প্রকৃত কারণ কি, তার থেকে উত্তরণের বিজ্ঞানসম্মত পথ ও পদ্ধতি কি সেটা না জানলে আমাদের শুধু অন্ধকারে পথ হাতড়ে মরতে হবে আর বার বার হতাশ হতে হবে। পরিবর্তন আমরা ঘটাতে পারব না। একা একাও পারব না, আবার লক্ষ লোকের জটলা তৈরি করেও পারব না।
মহান কার্ল মার্কস আমাদের সামনে রেখে গেছেন এক অমূল্য সম্পদ – দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ, যাকে আমরা বলি মার্কসবাদী বিজ্ঞান। সমাজ ও ইতিহাসর বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন, বর্তমানে যে সমাজে আমরা বাস করছি সেটির ভিত্তি হলো ব্যক্তিগত মালিকানা-নির্ভর উৎপাদন পদ্ধতি এবং শ্রমশোষণ। এই ব্যক্তি-মালিকানা এবং শ্রমশোষণই বর্তমান সমাজের সমস্ত সংকটের প্রধান কারণ। তিনি আমাদের সামনে এ শিক্ষাও রেখে গেছেন যে এই ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করে সামাজিক মালিকানাভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা এবং শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে সংকটের হাত থেকে সমাজের মুক্তি নেই, সভ্যতার মুক্তি নেই, আর তাই ব্যক্তি মানুষেরও মুক্তি নেই। কার্ল মার্কস আরো দেখিয়েছেন, এ যুগের সবচেয়ে অগ্রসর শ্রেণী হল সর্বহারাশ্রেণী যারা এই শোষণমূলক ব্যবস্থায় শোষণ-বৈষম্য-নিপীড়নের শিকার। এই শ্রেণী নিজেকে শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্য থেকে মুক্ত করার লড়াই পরিচালনার মাধ্যমে শেষপর্যন্ত মানবসভ্যতাকেই মুক্ত করবে। এই বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন ও বিকশিত করেছেন ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস, লেনিন, স্ট্যালিন, মাও সেতুঙ এবং কমরেড শিবদাস ঘোষ।

একদিকে ফ্যাসিবাদী শাসন অন্যদিকে বিভ্রান্ত বামপন্থী মহল

বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রের জন্য কত লড়াই করেছে অথচ সেই দেশেই আজ মানুষের ভোট না নিয়ে একটি অনির্বাচিত সরকার দেশ শাসন করছে। কোনো ধরনের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ নেই। আইনের শাসন রক্ষার দায়িত্ব বিচার বিভাগের। আইনের সম্পূর্ণ লংঘন করে একটা অনির্বাচিত সরকার দেশ শাসন করছে অথচ বিচারবিভাগ সম্পূর্ণ নীরব। এই বিচার বিভাগের কাছে কি ন্যায়বিচার আশা করা যায়? তার উপর, নানা ঘটনায় মানুষের মনে এ বিশ্বাসই দৃঢ়মূল হচ্ছে যে বিচার বিভাগ সরকারের ইচ্ছাপূরণের হাতিয়ার হিসাবে কাজ করছে। প্রশাসন সম্পূর্ণ শাসকদলের নিয়ন্ত্রণে, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ ও নিপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
দেশে যখন একটা ফ্যাসিবাদী শাসন চলছে তখন বামপন্থীদের অবস্থা কি? যে রাজনৈতিক শক্তির উপর মানুষ খানিকটা হলেও ভরসা করে তারা হলো বামপন্থী শক্তি। অতীতে বামপন্থীরা জনগণের দাবি নিয়ে লড়াই করেছে, বিপুল আত্মত্যাগ করেছে, সততা ও নিষ্ঠার নজির স্থাপন করেছে। কিন্তু আজ বামপন্থীদের অবস্থা উদ্ব্রান্ত ও বিভ্রান্ত।
বামপন্থী নামধারী কিছু দল সুবিধাবাদীতার নির্লজ্জ প্রতিযোগিতায় নেমে সরকারের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে যা বাম আন্দোলন সম্পর্কে জনমনে আস্থাহীনতা ও বিভ্রান্তি বাড়িয়ে তুলছে। আবার বিরোধী অবস্থানে থেকেও কোনো কোনো বামপন্থী সরকারের নীতি ও কৌশলের পক্ষেই জনমত গড়ে তোলার চাতুর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বামপন্থীদের কেউ কেউ শশব্যস্ত হয়ে শাসকশ্রেণীর সংকট সমাধান, তাদের মধ্যে সুবিবেচনা ও সুবুদ্ধি জাগিয়ে তোলার জন্য ছোটাছুটি করছেন।
অন্য যেসব সৎ ও আন্তরিক বামপন্থীরা আছেন তারাও এককভাবে কিংবা মিলিতভাবে কার্যকর কোনো গণআন্দোলন গড়ে তুলতে বা সরকারের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না। এর একটি কারণ হল বামপন্থীদের শক্তির দুর্বলতা। এ সত্য অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে আমাদের দল বা অন্য কোনো দল এককভাবে, এমনকী বামপন্থী দলগুলো সম্মিলিতভাবেও এ মুহূর্তে বিরাট কোনো গণআন্দোলন গড়ে তোলার মতো শক্তি রাখে না। কিন্তু বামপন্থীদের আজকের এই বিভ্রান্ত-উদ্ভ্রান্ত দশার মূল কারণ শক্তির দুর্বলতা নয়। মূল কারণ হলো আদর্শগত। আদর্শগত দুর্বলতা ও বিভ্রান্তির প্রধান দিকটি হল বর্তমান সমাজব্যবস্থাকে বিচার-বিশ্লেষণ করার বিভ্রান্তি। দ্বিতীয়টি হলো, বাম আন্দোলনে মূল্যবোধের প্রবল সংকট।
১৯৭১ সালের সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন পুঁজিবাদী দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েছে বাংলাদেশের বুর্জোয়াশ্রেণী। আজকে দেশে কায়েম হওয়া ফ্যাসিবাদী শাসনের পিছনে মূল ভিত্তি হিসাবে কাজ করছে ইতোমধ্যে দেশে গড়ে ওঠা একচেটিয়া পুঁজিপতি-মালিকগোষ্ঠীর স্বার্থ। কিন্তু আমাদের অনেক বামপন্থী বন্ধুই এখনো বাংলাদেশকে একটি আধা-সামন্ততান্ত্রিক আধা-উপনিবেশিক রাষ্ট্র বলে বিবেচনা করেন। কেউ কেউ সামান্য সংশোধন করে বাংলাদেশকে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র বললেও অর্থনৈতিকভাবে পরাধীন বিবেচনা করেন। তাই এইসব বামপন্থী বন্ধুরা বুর্জোয়াদের মধ্যে প্রগতিশীল অংশ ও মিত্র শক্তির সন্ধান পেয়ে থাকেন এবং বারংবার তাদের সাথে আপস-সমঝোতা করে থাকেন। আর এর মাধ্যমে তারা শেষপর্যন্ত দেশের শাসক বুর্জোয়াশ্রেণীকেই কোনো না কোনো মাত্রায় সহযোগিতা করে থাকেন।

নৈতিকতার সংকট বাম আন্দোলনকে দুর্বল করে দিচ্ছে

৭ নভেম্বর মহান রুশ বিপ্লবের ৯৭তম বার্ষিকী এবং বাসদের ৩৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এ উপলক্ষে সাম্যবাদ-এর গ্রাহক-পাঠক-শুভানুধ্যায়ীসহ দেশের শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষ, বাম-গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতাকর্মীদের প্রতি আমাদের শুভেচ্ছা।
৭ নভেম্বর মহান রুশ বিপ্লবের ৯৭তম বার্ষিকী এবং বাসদের ৩৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এ উপলক্ষে সাম্যবাদ-এর গ্রাহক-পাঠক-শুভানুধ্যায়ীসহ দেশের শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষ, বাম-গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতাকর্মীদের প্রতি আমাদের শুভেচ্ছা।

বাম রাজনীতিতে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সংকট আজ সবচেয়ে প্রকট আকার ধারণ করেছে। এই সংকটের প্রাথমিক উৎস অবশ্যই শত্রু-মিত্র নির্ধারণের ভ্রান্তি। শাসক বুর্জোয়াশ্রেণীই আজ দেশের জনগণের সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা-বঞ্চনার কারণ। কিন্তু আমাদের যে বামপন্থী বন্ধুরা বুর্জোয়াদের মধ্যে মিত্র শক্তির সন্ধান পান, তারা সেই কথাটা জনগণের সামনে স্পষ্টভাবে বলেন না। অথবা বললেও বাস্তব অবস্থার সাথে মেলাতে না পেরে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলেন। এই দলগুলো নানাভাবে শাসকগোষ্ঠীর কোনো না কোনো অংশের সাথে সংযোগ-সম্পর্ক রক্ষা করে চলেন এবং সেটা জনগণের সামনে আড়াল করেন। এই যে অস্পষ্টতা ও অস্বচ্ছতার চর্চা তারা করেন সেটাই দলীয় সংস্কৃতিতে নানাভাবে প্রকাশিত হয়।
বাম আন্দোলনে সাংস্কৃতিক সংকট সম্পর্কে বলতে গিয়ে এ যুগের মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ বলছেন, “নতুন একটি শ্রেণীহীন সমাজ গড়ে তোলবার জন্য যে বিপ্লবটি আমরা করতে চাইছি, সেই বিপ্লবের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কোন কর্মসূচি এই পার্টিগুলির আছে কি নেই। অর্থাৎ, সমাজের মধ্যে যে পুরনো মানসিকতা আজও বর্তমান রয়েছে তাকে ভেঙে আমাদের দেশের বিপ্লবের পরিপূরক নতুন মানসিকতা, অর্থাৎ নতুন উন্নততর সাংস্কৃতিক ও নৈতিক মান, যেটা সর্বহারা বিপ্লব গড়ে তোলার পরিপূরক, তা আনার জন্য জীবনের খুঁটিনাটি প্রতিটি দিককে ব্যাপ্ত করে একটি সামগ্রিক ও যৌথজ্ঞানের ভিত্তিতে একটি পথনির্দেশক নীতি সেই দলগুলি দেশের জনসাধারণের সামনে, দেশের আন্দোলনগুলোর সামনে তুলে ধরেছে কিনা এবং বিশেষ করে দলের নেতা ও কর্মীরা যাঁরা এই আদর্শগত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা, তাঁরা এই সামগ্রিক ও যৌথজ্ঞানের ভিত্তিতে প্রথমে নিজেদের জীবনে সেইগুলি প্রয়োগ করবার জন্য সংগ্রামটা শুরু করে দিয়েছেন কিনা – অর্থাৎ এককথায় রাজনৈতিক বিপ্লবের পরিপূরক আদর্শগত ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব সংগঠিত করার যথার্থই কোনরূপ চেষ্টা করছেন কিনা। … সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে, ব্যক্তিগত জীবনে আচরণের ক্ষেত্রে, রুচি ও অভ্যাসগত ক্ষেত্রে কর্মী ও নেতাদের জীবনে যদি বুর্জোয়া সংস্কৃতির প্রভাব থেকে যায়, তাহলে শুধুমাত্র বিপ্লবী তত্ত্বের বুক্নির আড়ালে সর্বহারা বিপ্লব হয়ে যাবে? এ কখনও হতে পারে? না, এ কখনও সম্ভব? অথচ, একদল নেতা এই বিপ্লবী তত্ত্বটা ঠিক হলেই বিপ্লবের স্তর নির্ধারণ ঠিক হলেই পার্টিটা ঠিক হয়ে গেল এবং তার দ্বারাই বিপ্লব হয়ে যাবে – এই কথা বলে কর্মী ও নেতাদের সর্বব্যাপক সাংস্কৃতিক বিপ্লব, যা সব বিপ্লবের আগেই সেই বিশেষ বিপ্লবের পরিপূরক অর্থে প্রথমে করা প্রয়োজন, সেই গুরুদায়িত্ব এড়িয়ে যান এবং নিজেরাও সেই অনুযায়ী মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের অভ্যাস, আচরণ ও সংস্কৃতিগত দিকটা পরিবর্তন করার চেষ্টা করেন না।” এইসব দলগুলোর অভ্যন্তরে তাই নেতাদের অহম, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব-বিরোধ, গ্রুপিং, তোষামোদি ইত্যাদি নানা ধরনের বুর্জোয়া নিকৃষ্ট সংস্কৃতির চর্চা চলতে থাকে। এসব দলের দ্বারা প্রভাবিত জনগণও বুর্জোয়া সংস্কৃতির প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। দলের অভ্যন্তরে এই নিম্ন সাংস্কৃতিক মানের ফলে দলগুলোর মধ্যে হীন প্রতিযোগিতা, সংকীর্ণ দলবাজি, প্রচারসর্বস্ব কর্মকা-, মতবাদিক বিতর্কের পরিবর্তে হীন আক্রমণ ইত্যাদি চলে। এই সংস্কৃতির কারণেই না গড়ে উঠছে যুক্ত আন্দোলন, না বামপন্থীরা পারছে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে। এর ফলে গোটা বামআন্দোলনই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বিপ্লবী দল গড়ে ওঠার সাথে সাধারণ মানুষের কী স্বার্থ, কী সম্পর্ক?

সাধারণ মানুষের এই যে দুর্বিসহ জীবন, অন্ধকারময় ভবিষ্যত, এমন অবস্থা শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা দুনিয়া জুড়েই। মাত্র কিছুদিন আগে মিশরের মানুষ স্বৈরতন্ত্র উৎখাতের জন্য কি বিরাট লড়াই করল, সেটা সারা দুনিয়ার মানুষ দেখেছে। আর এখন সেখানে মৌলবাদী চক্রের হাত ঘুরে পুনরায় সামরিক বাহিনীর হাতে দেশের শাসনভার চলে গিয়েছে। শুধু মিসর নয়, গোটা আরব বিশ্ব জুড়েই ‘আরব বসন্তের’ সুঘ্রাণ আজ ফিকে হয়ে এসেছে। ইউরোপসহ অপেক্ষাকৃত উন্নততর পুঁজিবাদী দেশগুলোতে অর্থনৈতিক মহামন্দার ধাক্কা সামাল দিতে গিয়ে জনগণের অধিকারের উপর খড়গ নামিয়ে আনা হয়েছে। অকুপাই আন্দোলন, ৯৯ বনাম ১ ভাগের (we are 99%) আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু অবস্থার বিন্দুমাত্র হেরফের হয়নি।
সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাস আমাদের সামনে এ শিক্ষা রেখে গেছে যে মানুষের সচেতন ও সংগঠিত প্রচেষ্টা ছাড়া সমাজে মৌলিক কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়। বর্তমান এই শোষণমূলক-বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা উচ্ছেদ করতে হলে চাই উপযুক্ত হাতিয়ার। সর্বহারাশ্রেণীর বিপ্লবী দলই হলো সেই হাতিয়ার। কমরেড লেনিন বিপ্লবী দল গঠন-সম্পর্কিত বিজ্ঞান আমাদের হাতে তুলে দিয়ে গেছেন। এরপর এ যুগের মহান মার্কসবাদী চিন্তাবিদ কমরেড শিবদাস ঘোষ এ বিজ্ঞানকে আরো উন্নত ও বিকশিত করে গেছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন যে এই সুসংগঠিত বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করতে হলে চাই উচ্চ আদর্শ ও উন্নত মূল্যবোধের শক্তিতে বলীয়ান এক পার্টি। এই পার্টিই জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি নিয়ে ধারাবাহিক, দীর্ঘমেয়াদী, কষ্টকর গণআন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে আন্দোলনকারী জনগণের শক্তি গড়ে তুলবে, যে শক্তি এই ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করবে। ফলে একটি সঠিক বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার কাজে শোষিত-নিপীড়িত মানুষকে অবশ্যই আত্মনিয়োগ করতে হবে।

চাই সঠিক আদর্শ, সঠিক নিয়ম-পদ্ধতি ও উন্নত মূল্যবোধ-নৈতিকতা

শোষণ-বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা শুধু মানুষকে অভাবের মধ্যে নিক্ষেপ করে না, মানুষকে নৈতিকভাবেও অবক্ষয়ের দিকে টেনে নিয়ে চলে। গোটা সমাজ ক্লেদাক্ত হয়ে ওঠে। ফলে সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে, বিপ্লবী রাজনীতিতে যেমন সঠিক আদর্শ চাই, সেই সাথে সাথে ওই আদর্শের ভিত্তিতে সঠিক নিয়ম-পদ্ধতি ও উন্নত মূল্যবোধের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত বেশি। আমাদের দল গড়ে উঠেছে এ যুগের সবচেয়ে উন্নত আদর্শ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে। কমরেড শিবদাস ঘোষ আমাদের সামনে এই শিক্ষাই রেখে গেছেন যে, একটি বিপ্লবী দলের প্রাণস্বত্ত্বা তার উন্নত সাংস্কৃতিক মানের মধ্যেই নিহিত থাকে। এই আদর্শ ও মূল্যবোধের ঝান্ডা সমুন্নত রাখতে গিয়েই আমাদের দলের অভ্যন্তরে তীব্র মতাদর্শগত বিতর্ক হয়েছে যার ধারাবাহিকতায় আমাদের এই বিশেষ কনভেনশন।
ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে আদর্শ ও মূল্যবোধের শক্তিই সবচেয়ে বড় শক্তি। এই ভিত্তির উপরই ধীরে ধীরে সমাজ পরিবর্তনের ক্ষমতাসম্পন্ন বিরাট শক্তি গড়ে ওঠে। আমাদের দলের বিশেষ কনভেনশন সেই আদর্শ ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে একটি সঠিক বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার কনভেনশন। পার্টি গড়ে তোলার এ সংগ্রাম শুধু আমাদের সংগ্রাম নয়, সমাজের প্রতিটি শোষিত-নিপীড়িত মানুষের সংগ্রাম, প্রতিটি দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষের সংগ্রাম। আমাদের এই সংগ্রামকে সকলে সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে নেবেন, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments