Monday, December 23, 2024
Homeফিচারসাম্প্রদায়িক আক্রমণ, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও ধর্ম অবমাননা-র অভিযোগ প্রসঙ্গে

সাম্প্রদায়িক আক্রমণ, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও ধর্ম অবমাননা-র অভিযোগ প্রসঙ্গে

ফেসবুকে দেয়া এক পোস্টকে কেন্দ্র করে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলায় দীঘলিয়া গ্রামের সাহা পাড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকটি বাড়ি, দোকান ও মন্দিরে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে গত ১৫ জুলাই শুক্রবার সন্ধ্যায়। এর মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই ইসলামের নবীকে নিয়ে মন্তব্যের জন্য সমালোচিত ভারতের বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার সমর্থনে ফেসবুকে নড়াইলের এক হিন্দু কলেজ ছাত্রের পোস্টকে কেন্দ্র করে কলেজ অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতোর মালা পরানোর ঘটনা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। এর আগে ভারতে বিজেপি নেত্রী নুপূর শর্মা কর্তৃক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ইসলাম ধর্মের নবী সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য, প্রতিবাদে বিক্ষোভ, এর জেরে সেখানে দুই মুসলমান উগ্রপন্থী কর্তৃক একজন সাধারণ হিন্দু দর্জিকে কুপিয়ে হত্যা করার ঘটনাগুলো সমাজে প্রবল আলোড়ন ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গত বছর ১০ বছরে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়িঘর, দোকানপাট এবং উপাসনালয়ের ওপর হামলার অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে।

 

যেকোন ধর্ম এবং ধর্মপ্রবর্তক বা সমাজসংস্কারক, যাঁদের প্রতি অগণিত অনুসারীদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-আবেগ রয়েছে, তাঁদের সম্পর্কে অসৎ উদ্দেশ্যে বিদ্বেষপ্রসূত মন্তব্য বা ‘হেটস্পীচ’ নিশ্চয় নিন্দনীয়। এর প্রতিবাদ জানানোর অধিকার সবার রয়েছে। পাশাপাশি এধরণের কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেলে ‘প্রতিশোধ’-এর নামে ভিন্নধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো ও নিপীড়নের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হওয়া দরকার মানবতার স্বার্থে। বর্তমানে বিশ্বের যেকোনো দেশে বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ-জাতি-লিঙ্গ ও রাজনৈতিক বিশ্বাসের মানুষ পাশাপাশি বাস করে এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু সকলের অধিকার সমান। ‘বাংলাদেশ ৯০% মুসলমানের দেশ’ বা ‘ভারত ৮০% হিন্দুর দেশ’–একথা বলে কেউ যদি দাবি করে যে, ইসলাম ধর্মের নিয়মে বাংলাদেশ বা হিন্দু ধর্মের নিয়মে ভারত চলবে, তাহলে সেখানে সংখ্যালঘুদের সমান অধিকার থাকা সম্ভব নয়। রাষ্ট্র ও সরকার কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব বা বৈষম্য করতে পারে না। এই প্রাথমিক গণতান্ত্রিক নীতিমালা ও মানসিকতার চর্চা, যাকে আজকের দুনিয়ায় ক্ষমতাশালীদের প্রশ্রয়ে পদদলিত করা হচ্ছে, তাকে রক্ষা ও চর্চার সংগ্রাম বেগবান করতে হলে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার ক্রমবর্ধমান বাস্তবতা সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধান ও বিজ্ঞানসম্মত উপলব্ধি দরকার। আমাদের দেশ, ভারত-পাকিস্তানসহ সারা বিশ্বেই বর্তমানে কম-বেশি একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অথচ সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, পারস্পরিক সহযোগিতা ও অগ্রগতির জন্য চাই জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা-বিদ্বেষের অবসান করে শ্রদ্ধা-সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি, আইনের শাসনের মাধ্যমে সকলের সমান অধিকারের নিশ্চয়তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও পরমতসহিষ্ণুতা।

 

বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার মন্তব্য প্রসঙ্গে

ভারতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি-র জাতীয় দাপ্তরিক মুখপাত্র নূপুর শর্মা গত ২৭ মে একটি টিভি চ্যানেলের টক শো-তে উত্তর প্রদেশের জ্ঞানবাপী মসজিদের স্থানে মন্দির নির্মাণের দাবি নিয়ে বিতর্কের এক পর্যায়ে আপত্তিকর মন্তব্যটি করেন। মুসলমানদের আক্রমণ ও হেয় করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘৬ বছরের বাচ্চাকে বিয়ে করে ৯ বছর বয়সে তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন নবী’। এর মাধ্যমে তিনি ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক-এর চরিত্র হনন করতে চেয়েছেন। স্থান-কাল-পরিপ্রেক্ষিতহীনভাবে একটি তথ্যকে বিচ্ছিন্নভাবে উল্লেখ করলে ঐতিহাসিক কোনো ব্যক্তিত্ব বা ঘটনা সম্পর্কে যথাযথ মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। আজ থেকে ১৫০০ বছর আগে আরবের মধ্যযুগীয় সমাজে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ ছিল একটি বাস্তবতা। সেকালে এর জন্য কেউ আপত্তি জানায়নি। ইসলাম ধর্মের নবী তাঁর ২৫ বছর বয়সে প্রথম বিয়ে করেছিলেন ৪০ বছর বয়সী বিধবা বিবি খাদিজাকে। তাঁর প্রিয় এই স্ত্রীর মৃত্যুর পরই কেবল তিনি পরবর্তী বিয়েগুলো করেছিলেন বৃদ্ধ বয়সে। তৎকালীন রক্তসম্পর্কীয় গোত্রভিত্তিক সমাজে বিয়েগুলোর প্রেক্ষাপট হিসেবে তাঁর ব্যক্তিগত চাহিদার চাইতেও সেসময়ের রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও সামাজিক বিভিন্ন প্রয়োজন বা আত্মীয়তার গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেন তাঁর অনুসারীরা। নবীর দ্বিতীয় স্ত্রী বিবি আয়েশা (বিয়ের সময় অল্পবয়স্কা) ছিলেন তাঁর প্রধান সহযোগী হযরত আবু বকরের কন্যা এবং পিতার আগ্রহেই এই বিয়ে হয় বলে উল্লেখ করা হয়। বিবি আয়েশাকে নবী অত্যন্ত ভালোবাসতেন, গুরুত্ব দিতেন, ছোটবেলায় তিনি তাঁকে স্নেহ করে তাঁর সাথে খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতেন বলে জানা যায়। নবীকে ‘ভোগলিপ্সু’ হিসেবে চিত্রিত করলে আরবের সমাজসংস্কারে তাঁর ভূমিকা, তৎকালীন সময়ে বিশাল জনগোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম তাঁর বড় চরিত্র ও সংগ্রাম-ত্যাগ সম্পর্কে যথার্থ ও সামগ্রিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়।

 

পাশাপাশি মনে রাখতে হবে–সময় ও পরিবেশের সাথে মূল্যবোধও পাল্টায়। আজকের দিনে বেশিরভাগ ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহকে নিজেরা চর্চা করেন না বা সমর্থন করেন না। সেসময় দাসপ্রথা অনুমোদিত ছিল, কিন্তু সমাজ পরিবর্তনের ফলে আজকের দিনে দাসপ্রথা মানবাধিকারসম্মত নয়। মধ্যযুগে সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র ধর্মভিত্তিক ছিল, আধুনিক যুগে ভোটাধিকারের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র-এর ধারণা এসেছে, যেখানে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-জাতি নির্বিশেষে সকলে সমান অধিকার ও সমমর্যাদাসম্পন্ন নাগরিক। নিপীড়িত নারী-দরিদ্র ও দাসদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন নবী সেসময়ের প্রেক্ষিতে এদের যতটা অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, আজকের সমাজে তার সীমানা আরও প্রসারিত হয়েছে। সেসময় চুরির জন্য হাত কাটা, গুরুতর অপরাধে শিরচ্ছেদ, ব্যাভিচারীদের পাথর ছুড়ে হত্যার বিধান থাকলেও গত কয়েকশো বছরে অপরাধীর শাস্তি ও সংশোধনের ধারণা অনেক বেশি মানবিক ও আধুনিক হয়েছে, অনেক দেশে মৃত্যুদণ্ড তুলে দেয়া হয়েছে। ফলে, নূপুর শর্মার বক্তব্যে এই ঐতিহাসিক ও বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গির ঘাটতি তো ছিলই, সবচেয়ে বড় কথা তিনি বিজেপি-র মুসলিমবিদ্বেষী রাজনৈতিক এজেণ্ডা বাস্তবায়ন করতে সম্প্রদায়গতভাবে মুসলমানদের কালিমালিপ্ত করতে ও তাদের প্রতি ঘৃণা ছড়াতে টকশোতে এই মন্তব্য করেছেন। ভালো-মন্দ সব সম্প্রদায়, দেশ বা জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেই আছে এবং তা পরিবর্তনশীল। ‘মুসলিমরা নিষ্ঠুর’, ‘হিন্দুরা খারাপ’, ‘কালোরা অপরাধী’ বা ‘ইহুদিরা লোভী’–এধরনের গড় ও অপরিবর্তনীয় ধারণা বিজ্ঞানসম্মত নয়, বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণও নয়, বরং তা ধর্ম-জাতিবিদ্বেষী বা বর্ণবাদী মানসিকতার জন্ম দেয়।

 

বিজেপি-র মুসলিম বিদ্বেষের নির্বাচনী কার্ড ও ভারতে প্রতিক্রিয়া

মুসলিমদের পাশাপাশি নূপুর শর্মার বিতর্কিত মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে ভারতের বিভিন্ন বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠন, সেদেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীসহ সমাজের বিভিন্ন অংশ। যেমন–এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ ১২ জুন এক বিবৃতিতে বলেন, “বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের দ্বারা নিযুক্ত দলের দুই জাতীয় মুখপাত্র চরম নিন্দনীয় এবং ক্ষমার অযোগ্য যে অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন তা তাঁদের ব্যক্তিগতও নয়, আকস্মিকও নয়। এটা জনসাধারণকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি ও দাঙ্গায় উস্কানি দিয়ে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক তৈরির হীন প্রচেষ্টা। সংঘ পরিবার এবং বিজেপি তাদের নির্বাচনী স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে দীর্ঘদিন ধরে হিন্দুত্বের ‘গৌরবগাথা’ প্রচার এবং ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা সৃষ্টির যে চেষ্টা চালাচ্ছে এটা তারই ফসল। উপরন্তু এর মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট সংস্কৃতি সৃষ্টির লক্ষ্যে ধর্মান্ধ হিন্দু মৌলবাদকে শক্তিশালী করা হচ্ছে। একই সাথে এর দ্বারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে প্ররোচিত করে তাদের ইসলামিক মৌলবাদের শিকারে পরিণত করার অপচেষ্টা চলছে, যাতে তা বিজেপি-সংঘ পরিবারের পক্ষে হিন্দু মৌলবাদকে আরও শক্তিশালী করার কাজে সহায়ক হয়। বর্তমানে, যাঁরা এখানে সেখানে বিচ্ছিন্ন ও অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটাচ্ছেন তাঁরা কার্যত বিজেপি-সংঘ পরিবারের এই ষড়যন্ত্রকেই সাহায্য করছেন।” ভারতে ইসলাম-বিদ্বেষ ও মুসলমানদের ওপর আক্রমণের ঘটনা বাড়ছে ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই। দেশটিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর, বিশেষ করে মুসলমানদের ওপর হামলার অনেক ঘটনা ঘটেছে। গরু রক্ষার নামে বেশ কয়েকজন মুসলমানকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

 

অন্যদিকে, মহানবীকে নিয়ে কটূক্তির জেরে রাজস্থানের উদয়পুরে কানহাইয়া লাল নামে এক দর্জিকে দুই মুসলিম উগ্রপন্থী হত্যা করেছে গত ২৮ জুন। রাজস্থান পুলিশ এই নৃশংস খুনে অভিযুক্ত মহম্মদ রিয়াজ আখতারি ও মহম্মদ গাউস-কে গ্রেফতার করেছে। কানহাইয়া লাল দিনকয়েক আগে সমাজমাধ্যমে নূপুর শর্মার বিতর্কিত মন্তব্যের সমর্থনে একটি পোস্ট করেছিলেন। ওই দর্জির বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের হয়। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তারও করে। দর্জি অবশ্য জানিয়েছিলেন, তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতে জানেন না। তার নাবালক ছেলে ভুল করে ওই পোস্ট করে ফেলে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে থানায় ডেকে বিষয়টির মীমাংসার চেষ্টা করে। মুক্তি পান কানহাইয়া। পুলিশি হেফাজত থেকে ফিরে কানহাইয়া ফের নিজের দোকান খুললে সেই দোকানে ঢুকে তাকে কুপিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয়। সেই ঘটনার ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে হামলাকারীরা। নূপুর শর্মাকে সমর্থন জানানোর জন্যই তারা একাজ করেছে বলে জানায়। এরপর আরেকটি ভিডিওতে তারা এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে গর্ব প্রকাশ করে এবং ভারী ছুরি প্রদর্শন করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে হুমকি দেয়। এছাড়া, নূপুর শর্মার শিরশ্ছেদ করলে নিজের বাড়ি উপহার দিতে চাওয়া আজমীর শরীফ দরগার সালমান চিশতী নামে এক খাদেমকে গ্রেপ্তার করেছে রাজস্থান পুলিশ। ভারতের একাধিক শহেও সাধারণ মানুষের ওপর আত্মঘাতী হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছে ইসলামী জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা।

 

‘ইসলাম বা রাসুল অবমাননা’র শাস্তি দাবি প্রসঙ্গে

এখন, নূপুর শর্মার মন্তব্যের সমালোচনা বা তার মুসলিম বিদ্বেষের বিরোধিতা যে কেউ করতে পারেন। কিন্তু নূপুর শর্মার বক্তব্যের জন্য তার হত্যাকারীকে পুরস্কৃত করার ঘোষণা বা ধর্মীয় অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে বলে নিরীহ হিন্দু দর্জিকে হত্যা করা কি সমর্থন করা যায়? কারো কথায় যদি ইসলামবিদ্বেষ প্রকাশ পেয়েও থাকে, তার জবাব কি পাল্টা হিন্দু বা খ্রিস্টানবিদ্বেষ প্রকাশ করা? নাকি সহনশীলতা ও উন্নত আচরণ দিয়ে তার মন জয় করার চেষ্টা করা দরকার? নাহলে তো হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেষ অনন্তকাল চলতেই থাকবে কোন একপক্ষ নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত।

 

এ বিষয়ে ইসলামী বিধান কী–সে বিষয়ে বিতর্ক আছে। কোরানে এবং নবীর জীবনে বিভিন্নরকম বক্তব্য ও উদাহরণ পাওয়া যায়। বেশকিছু জায়গায় বলা হয়েছে–কেউ খোদা ও রাসুলের নিন্দা করলে তার সঙ্গ সাময়িকভাবে বর্জন করতে হবে, উপেক্ষা করতে হবে, তাদের প্রত্যুত্তর দেয়া যাবে না। কারণ কারো ধর্ম সম্পর্কে কটূ কথা বললে সেও তোমার ধর্ম সম্পর্কে পাল্টা অসম্মানসূচক কথা বলবে। এক্ষেত্রে ধৈর্য্যশীল হতে বলা হয়েছে। নবীর জীবনেই তাঁর সাথে শত্রুতাকারীদের ক্ষমা করার দৃষ্টান্ত আছে। আবার কিছুক্ষেত্রে শত্রুদের প্রতি কঠোর হওয়া ও তাদের সাথে যুদ্ধ করার কথাও বলা হয়েছে। অনেক ইসলামী ধর্মীয় নেতারা বলেন—‘শাতিমে রাসুল’ বা রাসুল নিন্দাকারীদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, তবে এ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে পারে একমাত্র ইসলামী রাষ্ট্রের আদালত বা খলিফা। আবার কিছু ইসলাম ব্যাখ্যাকারীরা বলেন, যেকোন মুসলমানের দায়িত্ব রাসুল বা খোদাদ্রোহীদের হত্যা করা বা তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা।

 

ইসলামের সহনশীল বা চরমপন্থী বিভিন্ন ধরণের ব্যাখ্যার মধ্যে কোনটি কতটুকু একজন সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলিম গ্রহণ বা অনুসরণ করবেন–তা নির্ভর করবে প্রত্যেকের বুদ্ধি-বিবেক-বিবেচনা ও চেতনার মানের ওপর। আর মানুষের এই চেতনা অনেকাংশে নির্ভর করে–কোন ধরনের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা পরিবেশে সে বাস করে তার ওপর। ধর্মীয় বিতর্কে না গিয়ে আমরা এটুকু বলতে পারি–সামাজিক অগ্রগতির জন্য যা যুক্তিযুক্ত ও মানবকল্যাণের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, সাধারণভাবে তা-ই গ্রহণ ও চর্চা করা উচিত। প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীরাই বিশ্বাস করেন–তাঁর ধর্মই শ্রেষ্ঠ। অনেকসময়ই নিজের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে গিয়ে অন্য ধর্মের সমালোচনা করে এমন মন্তব্য করা হয় যা ওই ধর্মের অনুসারীদের অনুভূতি ও বিশ্বাসকে আহত করতে পারে। এধরনের প্রতিটি মন্তব্যের জন্য যদি মন্তব্যকারীকে হামলা-মামলা করে শায়েস্তা করা হয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে, তাহলে তো বাংলাদেশে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান সংখ্যালঘু বা ভারতে মুসলিমসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের প্রতিনিয়ত আতঙ্কগ্রস্ত থাকতে হবে। এরকম অসহিষ্ণুতার পরিবেশে সংখ্যালঘুরা কি স্বাধীনভাবে তাদের ধর্মচর্চা, ধর্মীয় বিশ্বাস ও মত প্রকাশ করতে পারবেন? না পারলে তাকে কি গণতান্ত্রিক সমাজ বা প্রত্যেকের সমান অধিকার আছে এমন ব্যবস্থা বলা যায়?

 

আবার ‘ধর্মীয় অনুভূতি আহত হওয়া’ বলতে ঠিক কি কি বোঝায়, তার সংজ্ঞাও অনেকক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নয়, অস্পষ্ট বা ছড়ানো। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার সাথে যুক্ত অনেক বিষয়কে চাইলে কেউ ‘ধর্ম অবমাননা’-র আওতায় ফেলে দিতে পারেন। যেমন–মধ্যযুগে ইউরোপে বিজ্ঞানী কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও বা ব্রুনোর গবেষণা-পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞান খ্রীস্টধর্মের বিশ্বাসের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ হওয়ায় চার্চ-এর বিচারে ব্লাসফেমি বা ধর্মনিন্দার অভিযোগে ব্রুনোকে আগুনে পুড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড ও গ্যালিলিওর কারাবাসের ঐতিহাসিক ঘটনা আমরা জানি। ডারউইনের বিবর্তনবাদ, যা বিজ্ঞানে প্রমাণিত, তা নিয়ে ক্লাসে বা অন্যত্র আলোচনা করলে একজন মুসলিম বা খ্রীস্টান ধর্মবিশ্বাসী মানুষের ‘ধর্মীয় অনুভূতি আহত’ হচ্ছে বলে তিনি মনে করতে পারেন। ক্লাসে বিজ্ঞানশিক্ষক বৃষ্টি হওয়ার আবহাওয়াগত কারণ পড়ানোর সময় ধর্মপ্রাণ ছাত্র যদি দাবি করে বসে যে–‘মিকাইল ফেরেশতা বৃষ্টি নামান’, তাহলে এর সমাধান কী? ফলে ধর্ম হচ্ছে কোন সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা চর্চার বিষয়, এই সীমানা ছাড়িয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সামাজিক-রাষ্ট্রীয় বিষয় ধর্ম দিয়ে পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে নানা জটিলতা তৈরি হবে। শোসকশ্রেণীর স্বার্থে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার অগ্রগতি রুদ্ধ হওয়ার সাথে অন্ধবিশ্বাসও গোঁড়ামি মানবসভ্যতার ইতিহাসে কিভাবে ‘অন্ধকার যুগ’ নামিয়ে এনেছিল–তার উদাহরণ বিশ্ব ইতিহাসে আছে।

 

আরেকটি বিষয়ও বিবেচনায় রাখা দরকার। ইতিহাস-দর্শন-নৃতত্ত্ব-অর্থনীতি-আইন ইত্যাদি মানবজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিতর্ক-পর্যালোচনা-সমালোচনা হয়, এর মাধ্যমেই জ্ঞানের অগ্রগতি হয়। ধর্ম সমাজবিকাশের ইতিহাসে ও মানুষের মননজগৎ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দাসসমাজে আনুষ্ঠানিক ধর্মগুলোর উদ্ভবের মাধ্যমে তৎকালীন গোত্রভিত্তিক সমাজে নিয়ম-শৃঙ্খলা ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা, সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ও সমাজসংষ্কারে ধর্ম ও ধর্মপ্রচারকরা নির্ধারক অবদান রেখেছেন। আবার পরবর্তীতে শাসকশ্রেণীর শাসন-শোষণের হাতিয়ার হিসেবেও ধর্ম ব্যবহৃত হয়েছে। ফলে সমাজবিজ্ঞান-ইতিহাস ও দর্শনশাস্ত্রের বিষয় হিসেবে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, ধর্মের ভূমিকা, বিকাশ ইত্যাদি নিয়েও পর্যালোচনা-সমালোচনা হতে পারে। কেউ যদি দাবি করে যে–‘জ্ঞানজগতের অন্যান্য বিষয়ের মত ধর্মের সমালোচনা করা যাবে না, কারণ আমার ধর্মীয় অনুভূতি আহত হতে পারে’, তাতে ধর্মবিষয়ক জ্ঞানচর্চার পথও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

 

বাংলাদেশে ধর্ম অবমাননার কথিত অভিযোগে ধারাবাহিক হিন্দু ও সংখ্যালঘু নিগ্রহ

নূপুর শর্মার বক্তব্য সমর্থনের অভিযোগ তুলে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকজনকে হেনস্থা ও আটক করা হয়েছে। গত ১৮ জুন নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় পুলিশের সামনেই জুতোর মালা পরান আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দসহ ওই কলেজের ছাত্র ও স্থানীয় কিছু ব্যক্তি। সেখানে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সবাই উপস্থিত ছিলেন। অথচ, তিনি ছিলেন নিরপরাধ। তাঁর কলেজের একজন হিন্দু ছাত্রের বিরুদ্ধে ফেসবুকে ‘রাসুল অবমাননা’র অভিযোগে উত্তেজনা সৃষ্টি হলে তিনি সবার সাথে আলোচনা করে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কেন ওই ছাত্রকে উত্তেজিত জনতার হাতে ছেড়ে দেয়া হল না, ‘তিনি হিন্দু বলে তাকে রক্ষা করছেন’–এই অভিযোগে তাঁদের লাঞ্ছিত করা হলো।

 

গত ২০ মার্চ মুন্সিগঞ্জের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের ওপর হামলা হলো ক্লাসে ধর্ম অবমাননার নামে। ক্লাসে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান ও ধর্ম নিয়ে তর্ক-বিতর্ক তুলে সেটার অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে হৃদয় মণ্ডলকে ফাঁসিয়ে দেয়। উন্মত্ত এলাকাবাসী হামলে পড়ে তাঁর ওপর। পুরো বিষয়টিই ছিল পরিকল্পিত। মারও খেলেন তিনি, মামলাও খেলেন তিনি। ১৯ দিন জেলেও কাটাতে হয়েছে হৃদয় মণ্ডলকে। ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগ এনে স্থানীয় মসজিদের মাইকে ঘোষণা করে গ্রামবাসীকে ক্ষেপিয়ে তোলা হয়। একপর্যায়ে জনসমক্ষে তাঁকে কান ধরে ওঠবস করান নারায়ণগঞ্জের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান। কিন্তু সত্য জানা গেল শ্যামল কান্তি ভক্তের মুখ থেকে–তাঁকে স্কুল থেকে বিতাড়িত করতে দীর্ঘদিন ধরে ষড়যন্ত্র করছে স্কুল কমিটি। কমিটির সভাপতি ফারুকুল ইসলামের বোন পারভীন আক্তারকে প্রধান শিক্ষক করতেই মূলত তাঁর বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র।

 

২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর পাটগ্রামের বুড়িমারিতে শুধু একটা গুজবের ওপর ভর করে একদা শিক্ষক, গ্রন্থাগারিক, নিরীহ এবং কিছুটা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শহিদুন্নবী জুয়েলকে দিনে দুপুরে সবার সামনে পিটিয়ে মারা হয়! পৈশাচিক উল্লাসে তার মৃতদেহ পোড়াল তারই ধর্মের লোকেরা। ২০১৬ সালে গুলশানের হলি আর্টিজানে ধর্মের নামে ২০ জন দেশী-বিদেশী নিরপরাধ মানুষের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করে দেখুন। তার আগের দুই বছর ধরে জঙ্গী গোষ্ঠীগুলো ইসলাম অবমাননার অভিযোগে পরিকল্পিতভাবে একের পর এক ব্লগার-লেখক-প্রকাশক-হিন্দু পুরোহিত-খ্রীস্টান পাদ্রী-বৌদ্ধ ভিক্ষু-সুফি-শিয়া-আহমদিয়া-বাহাই সম্প্রদায়ের সংখ্যালঘুদের কুপিয়ে-জবাই করে খুন করে।

 

২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধদের বাড়িঘর ও বৌদ্ধবিহারে হামলার ঘটনা, ২০১৬ সালের ৩০শে অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে আক্রান্ত হিন্দু গ্রাম, ২০১৭ সালের ১০ই নভেম্বর রংপুরের গঙ্গাচড়াতে ফেসবুক থেকে ছড়ানো গুজবের জের ধরে এক জনের মৃত্যুসহ অসংখ্য ঘটনায় অভিযোগ সেই একই–হিন্দু বা সংখ্যালঘু তরুণের ফেসবুক থেকে নবীকে অবমাননার অভিযোগ। বিগত এক দশকে সারাদেশে অসংখ্য সাম্প্রদায়িক নির্যাতন ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে শুধু ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার অজুহাতে! প্রায় প্রতিটি ঘটনায় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী, জনপ্রতিনিধি এবং পুলিশ ও সরকারি প্রশাসন অতি সক্রিয় হয়ে ‘আশু’ বিচারের ব্যবস্থা করেছেন। প্রায় প্রত্যেকটি ঘটনায় পরে প্রমাণিত হয়েছে যে কাউকে পরিকল্পিত উপায়ে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ফাঁসানোর জন্য তার ফেসবুক হ্যাক করে ফটোশপকৃত ছবি বা উস্কানিমূলক বক্তব্য পোস্ট করা হয়েছিল।

 

গতবছর দুর্গাপূজার সময় কুমিল্লার পূজামণ্ডপে কোরান রেখে দিয়ে অবমাননার অভিযোগ তুলে সারাদেশে পূজামণ্ডপ ও হিন্দুদের ওপর হামলা করা হয়। পরে উদঘাটিত হয়–দেবীমূর্তির পায়ের কাছে পরিকল্পিতভাবে কোরান রেখে এসেছে একজন মুসলিম। গত এক দশকে ঘটে যাওয়া এধরণের অসংখ্য সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের মামলায় ন্যায়বিচার পাওয়া যায়নি। এক্ষেত্রে আমরা পাকিস্তানের প্রায় সমকক্ষ।

 

উল্টোদিকে বাংলাদেশে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ধর্ম অবমাননার জন্য মামলা হয়েছে এমন ঘটনা বিরল। অনেকের কাছে সমীকরণ অত্যন্ত সহজ–মামলা যেহেতু হয় না, সুতরাং ধরে নিতে হবে তাদের ধর্মবিশ্বাসের প্রতি অবমাননার কোনো ঘটনাও ঘটে না। বাস্তবেই কি পরিস্থিতি তা-ই? না কি, সংখ্যালঘু হওয়ায় আক্রমণের আশংকায় তাঁরা প্রতিবাদ করতে পারেন না?

 

ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা চর্চার পরিণতি : পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা

পাকিস্তানে গত মার্চ মাসে আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের ডেরা ইসমাইল খানে ধর্ম অবমাননার (ব্লাসফেমি) অভিযোগে এক স্কুল শিক্ষিকাকে হত্যার খবর পাওয়া গেছে। দেশটির একটি ধর্মীয় নারী বিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে তাঁরই নারী সহকর্মী ও দুই শিক্ষার্থী হত্যা করেছে। হত্যাকাণ্ডে জড়িত দুই শিক্ষার্থী পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, তাঁদের এক আত্মীয় স্বপ্নে দেখেছেন-তাঁদের ওই শিক্ষিকা (সফুরা) নবী মুহাম্মদ সা.-এর বিরুদ্ধে ‘নিন্দা করেছেন’। তাই তাঁরা তাকে হত্যা করেছে। এর আগে, গত বছর পাকিস্তানে কর্মরত এক শ্রীলঙ্কান নাগরিককে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে সাধারণ জনতা পিটিয়ে হত্যা করে আগুনে পুড়িয়ে দেয়। এ বছরের ৫ জুলাই পাকিস্তানের আদালত আশফাক মাসিহ নামের এক মেকানিককে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়। ২০১৭ সালের জুনে আশফাক লাহোরে এক ব্যক্তির মোটরবাইক সারিয়েছিলেন। অথচ তারপরে ওই ব্যক্তি তাঁকে পুরো টাকা দেননি। উল্টে তিনি দাবি করেন, ইসলাম ধর্ম সততার সঙ্গে পালন করেন তিনি। সেই কারণে তাঁকে ছাড় দেওয়া উচিত। আশফাক প্রত্যাখ্যান করে বলেন, তিনি খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাস করেন। এই নিয়ে দু’জনের মধ্যে তর্কাতর্কি শুরু হয়। ভিড় জমে যায়। উত্তেজিত জনতা মাসিহকে নবী মোহম্মদকে ‘অসম্মান’ করার অভিযোগ তোলে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ আশফাককে গ্রেফতার করে এবং তাঁর বিরুদ্ধে ‘ব্লাসফেমি’ (ধর্ম অবমাননা) মামলা দায়ের করে। এই উন্মক্ততা এমন যুক্তিহীন রূপ নিয়েছে যে, সম্প্রতি করাচিতে একটি শপিং মলে স্যামসাং কোম্পানির ওয়াইফাই ডিভাইসে দেয়া কিউআর কোডের মাধ্যমে আল্লাহ বা নবীর নাম বিকৃত করার হাস্যকর অভিযোগে ওই কোম্পানির ২৭ কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

 

২০১৪ সালে লাহোরের ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণের গ্রাম কোট রাধাকিষানের উন্মত্ত জনতা কোরান অবমাননার মিথ্যা অভিযোগে প্রথমে পদদলিত করে এবং পরে আগুনে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারে নিরীহ খ্রিস্টান দম্পতি শামা বিবি এবং শাহজাদ মসীহকে। এই অসহায় খ্রিস্টান দম্পতির দশ বছর বয়সি পুত্র সুলেমান এবং দুই বছরের কন্যাসন্তান পুনমকে এই ভয়ানক হত্যাকাণ্ডের নির্মম চিত্র দেখতে হয়েছে। শামা বিবি এবং শাহজাদ মসিহের রক্তঝরা আর্তনাদ পাকিস্তানে ধর্মের উন্মত্ততায় মানুষ হত্যা বন্ধ করতে পারেনি। কোট রাধাকিষান গ্রামের বর্বরতার ঠিক একমাস বারো দিন পর এই ধর্মের নামেই পাকিস্তানের পেশোয়ারে একটি স্কুলে জঙ্গি হামলা চালানো হয়। মুসলিম জঙ্গিদের বুলেট ১৩২জন নিরীহ স্কুলছাত্রসহ ১৪৯জন মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। পেশোয়ারের আর্মি পাবলিক স্কুলে সংঘটিত এই হত্যাকাণ্ড দুনিয়ার চতুর্থ ভয়াবহ স্কুল হত্যাকাণ্ড বলে চিহ্নিত হয়। অনেকে সেদিন প্রশ্ন করেছিল, স্কুলের এই নিরীহ বাচ্চাদের কি অপরাধ ছিল? তারা কি কোনো ধর্মের অবমাননা করেছিল?

 

শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ জরুরি

সাম্প্রতিককালে ফেসবুকে লেখায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে অনেকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা-গ্রেপ্তার-প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় পুলিশের তৎপরতা চোখে পড়ে না। জনগণকে বিভ্রান্ত করতে লোক দেখানো কিছু পদক্ষেপ নিলেও কোনও ঘটনারই যথার্থ বিচার শেষপর্যন্ত হয় না। ২০১২ সালে কক্সবাজারে বৌদ্ধ মন্দিরে অগ্নিসংযোগের ঘটনার বিচার ও দোষীদের শাস্তি এখনো হয়নি, ২০১৬ সালে নাসিরনগরে হামলার ঘটনায়ও বিচার হয়নি। আইনের শাসনের অভাব ও বিচারহীনতার কারণে ক্রমাগত এই ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা বাড়ছে।

 

জনগণের ম্যাণ্ডেট ছাড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক শক্তি বলে দাবি করে। এদেশের হিন্দুসম্প্রদায়ও নিরুপায় হয়ে সাধারণভাবে আওয়ামী লীগকেই ভোট দেয় ও সমর্থন করে। অথচ তাদের এই ১৩ বছরের অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী শাসনামলে হিন্দু-বৌদ্ধসহ ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর অসংখ্য সাম্প্রদায়িক আক্রমণ হয়েছে। কোনো ঘটনারই যথার্থ বিচার ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি, সাম্প্রদায়িকতা প্রতিহত করতে প্রশাসনিক-রাজনৈতিক ও আদর্শগত-সাংস্কৃতিক উদ্যোগও শাসকদলের দেখা যায়নি। বরং সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক আক্রমণসহ বেশিরভাগ ঘটনায় অন্যান্যদের সাথে আওয়ামী-যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাও যুক্ত বলে সংবাদমাধ্যমে এসেছে। দমন-পীড়ন চালিয়ে সারাদেশকে বিরোধীদল শূন্য করে ফেলা হয়েছে, সমাজের সবক্ষেত্রে সরকারদলীয়দের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব। ফলে, দেশে বর্তমানে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতার দায় আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে।

 

এখানেই শেষ নয়, আওয়ামী লীগ সরকার নিজেদের গণবিরোধী ও দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনকে জায়েজ করতে একদিকে যেমন ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ ও ‘উন্নয়ন’-এর বুলি আউড়াচ্ছে, তেমনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে সুড়সুড়ি দিতে ‘ইসলামপসন্দ’ সাজারও চেষ্টা করছে। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি হেফাজতে ইসলামের সাথে আপোষ ও আঁতাত, পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন, ভাস্কর্য সরানো, মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসার ও বাজেট বৃদ্ধি, ওয়াজ মাহফিলের নামে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর বিষয়ে নিষ্ক্রিয়তা, কওমী মাদ্রাসার সনদকে মাস্টার্সের সমমান দেয়া, ইসলামী জঙ্গীদের হাতে ব্লগার-লেখক-প্রকাশক হত্যার জন্য তাদের লেখালেখিকে দায়ী করা, সব উপজেলায় বিপুল ব্যয়ে মডেল মসজিদসহ ইসলামী কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠাসহ এর অনেক উদাহরণ দেয়া যায়। ধর্মকে ব্যবহারের এই রাজনীতির প্রভাব এই দলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে তৃণমূল পর্যন্ত প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে। যেকোন পন্থায় ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে আওয়ামী লীগ সরকার হেফাজতে ইসলাম, চরমোনাই পীরসহ মৌলবাদী শক্তির সাথে আঁতাত ও আপোস করছে এবং নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।

 

অন্যদিকে সমাজে মানুষের মধ্যে দিন দিন ধর্মান্ধতা, যুক্তিহীন আচরণ ও অগণতান্ত্রিক মনোভাব বাড়ছে। দেশের শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্রহীনতা ও স্বৈরতান্ত্রিকতা সমাজমননেও প্রভাব ফেলছে। জাতীয় এই পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের সুযোগ নিয়ে ইসলামী মৌলবাদীদের শক্তিবৃদ্ধি ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও উগ্রতা বাড়াচ্ছে। দেশে মূল্যবৃদ্ধি-ঘুষ-দুর্নীতি-স্বৈরশাসন-বেকারত্ব-দলীয়করণ-মানবাধিকার লঙ্ঘন-ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র হরণ ইত্যাদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে এদের সংগঠিত প্রতিবাদ তেমন দেখা যায় না। কিন্তু ‘ইসলাম অবমাননা’কারীদের শাস্তি দিতে প্রায়ই ‘তৌহিদী’ জনতার নামে তারা মাঠে নামে। কেউ যদি অসৎ উদ্দেশ্যে কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়, তাহলে তার নিন্দা-সমালোচনা করা যেতে পারে, প্রচলিত আইনে তার বিচারও হতে পারে। কেউ যদি ভুল বা অন্যায় কথাও বলে, তাকে তাৎক্ষণিক শাস্তি দেয়া বা তার বাড়িঘরে হামলা করার অধিকার কারো নেই। একজন যদি ‘অপরাধ’ করেও থাকে এর জন্য তার সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালানো যায় না। কোন আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ও সভ্য সমাজে এধরণের সম্প্রদায়গত শাস্তি চলতে পারে না। যেকোনো নাগরিকের নিরাপত্তা দেয়া সরকারের দায়িত্ব।

 

এধরণের হামলা সবসময় না হলেও সাম্প্রদায়িক ঘৃণা-বৈষম্য-নিরাপত্তাহীনতা ও বিচ্ছিন্নতাবোধের অনুভূতির মধ্যেই বসবাস এদেশের সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষদের। উন্নত আদর্শ ও নৈতিকতা দিয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষমতা আজ আর বুর্জোয়াদের নেই। কারণ তারা সবাই দুর্নীতি-লুটপাট, সাধারণের সম্পত্তি আত্মসাৎ ও গণবিরোধী শাসনে লিপ্ত। ফলে ভোটের রাজনীতিতে জনগণের পশ্চাদপদ চিন্তাকে সুড়সুড়ি দিয়ে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করা ছাড়া তাদের আর পথ নেই। এই অবস্থায় সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে হলে–ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের অবসানে ও জনজীবনের সমস্যা সমাধানে ধর্ম–জাতি নির্বিশেষে শোষিত জনসাধারণের ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক আন্দোলন শক্তিশালী করতে হবে এবং তার সাথে সাম্প্রদায়িকতা ও জাতিগত নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনকে মেলাতে হবে। এর সহযোগিতায় প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে সমাজের তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে দিতে হবে। সমাজে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে যে শূন্যতা বিরাজ করছে, তা পূরণে উন্নততর আদর্শের ভিত্তিতে এই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে গড়ে তুলতে হবে। সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী শক্তি এবং এই শক্তিকে প্রশ্রয়দানকারী শাসকদল আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আমরা সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, দেশপ্রেমিক, গণতন্ত্রমনা মানুষকে এই লক্ষ্যে সংগঠিত হওয়া এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আবেদন জানাই।

সাম্যবাদ-আগস্ট ২০২২

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments