দেশের চলমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কোন নতুন বিশ্লেষণের দাবি রাখে না। একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র যেমনভাবে পরিচালিত হওয়ার কথা, সম্পূর্ণ সেরকমভাবেই আমাদের দেশ পরিচালিত হচ্ছে। এরই মধ্যে কখনও কখনও কোন কোন বিষয় মানুষের দৃষ্টি বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। একটা আলোচনা-তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়। বিষয়ের গুরুত্বের দিক থেকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এখন মানুষের রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে। আমরা বিগত বিভিন্ন সংখ্যায় এই সরকারের ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্যের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা এই সময়ে রাজনৈতিক আলোচনায় প্রাধান্য নিয়ে থাকা আগামী নির্বাচন সম্পর্কিত আমাদের মূল্যায়ন তুলে ধরবো।
আরেকটি ৫ জানুয়ারিকে বাধা দেয়ার মতো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শক্তি এখনও তৈরি হয়নি
নির্বাচন নিয়ে এতো আলোচনা কেন? এ প্রশ্নটা আসা খুবই স্বাভাবিক। কারণ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন যাদের স্মরণে আছে এবং যারা তার পরবর্তী সময়ের সরকারবিরোধী আন্দোলনকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন, তারা কমবেশি নিশ্চয়ই এই মত ধারণ করেন যে, আরেকটি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় যাওয়া আওয়ামী লীগের পক্ষে এখন কোন কঠিন বিষয় নয়। বিএনপি’র সাংগঠনিক অবস্থান খুবই দুর্বল। জনগণের দাবি নিয়ে রাস্তায় লড়াই করার সংগঠন সে নয়। জামায়াতও জনগণের জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে লড়াই করার দল নয়। মানুষের সাম্প্রদায়িক চিন্তাকে উস্কানি দিয়ে, তাকে অন্ধ ও উগ্র করে দিয়ে ক্ষমতার রাজনীতিতে যতটুকু ভাগ বসানো যায় – সেটার চিন্তাই সবসময়ে সে করেছে।
এই সময়ে আওয়ামী লীগের শাসনে মানুষ বিক্ষুব্ধ, আবার ভারতের সমর্থন আওয়ামী লীগের পেছনে আছে – এটা মানুষের কাছে একেবারে স্পষ্ট। ফলে তীব্র ভারত বিরোধিতা অন্যান্য সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি। এই ভারত বিরোধিতাটা ভারত নামক সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের চরিত্র বুঝে তার শাসকগোষ্ঠীর প্রতি বিরোধিতা যদি হতো – তবে এর একটা মানে থাকতো। সেটা সঠিকভাবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই গড়ে তুলতে পারতো। কিন্তু তা না হলে এই উগ্র ভারত বিরোধিতার মধ্যে একটি সাম্প্রদায়িক উপাদান থেকেই যায়। এই ক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক উপাদানটি তখন ভারতের শাসকগোষ্ঠীর সাথে সেই রাষ্ট্রের জনগণের পার্থক্য ভুলিয়ে দেয়। ভারতের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সে দেশের মেহনতি মানুষ লড়াই করছে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দুটি দেশের সাধারণ মানুষ পরস্পরের প্রতিপক্ষ হয়ে যায়। এই সময় যেহেতু দেশের সরকার ও তাকে যারা সাহায্য করে তাদের বিরুদ্ধে মানুষের প্রবল ক্ষোভ ও রাগ আছে এবং সাধারণভাবেই এই সময় সচেতন না থাকলে গভীর যুক্তিবোধ ও বিচার-বিশ্লেষণাত্মক মনন ক্রিয়াশীল থাকে না, ফলে এর সুযোগ একটা গোষ্ঠী নেয়। আবার রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী রূপ অর্থাৎ কোন মতকেই দাঁড়াতে না দেয়া, বলপ্রয়োগে সমালোচনা চাপা দেয়া ইত্যাদি বিষয় জনমানসেও প্রভাব ফেলে। একটা পাল্টা শক্তিশালী গণতান্ত্রিক আন্দোলন জারি না থাকলে চাপা পড়া জনমানসে উগ্রতার উপাদান বৃদ্ধি পায়। যে কোন রক্ষণশীল শক্তির বৃদ্ধির জন্য এ পরিবেশ উপযোগী। জামায়াত সেই পরিবেশের সহযোগিতা কিছুটা পাচ্ছে।
উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে মানুষকে উস্কে দিয়ে, কিংবা পিলখানার ঘটনাকে সামনে এনে সেনাবাহিনীর সহানুভূতি আদায়ের প্রচেষ্টা করে- এককথায় বলতে গেলে কিছু এজিটেশনাল ট্যাকটিক্স প্রয়োগ করে ফ্যাসিবাদবিরোধী অভ্যুত্থান হয় না। এগুলো ক্ষমতায় আসার জন্য কিছু পরিকল্পিত ট্যাকটিক্যাল চালমাত্র। বুর্জোয়া রাজনীতিই দুনিয়াতে এসব আমদানি করেছে। মানুষ এর স্বরূপ বুঝতে না পেরে কখনও বিরাট সংখ্যায়ও এর শিকার হয়েছে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সত্যিকারের লড়াই করতে হলে মানুষকে ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে ধারণা দিতে হয়। সেটা করতে গেলে তাকে বুর্জোয়া রাজনীতির অসারতাও ধরাতে হয়। বিএনপি-জামায়াত কারও পক্ষেই এটা সম্ভব নয়। কারণ তারা এবং আওয়ামী লীগ একই শ্রেণীর দল। দেশের পুঁজিপতি-শিল্পপতিরা আজ বিএনপি-জামায়াতকে চাইছে না, তাই এক সময়ে ক্ষমতার দন্ড হাতে নিয়ে জনতাকে ঠেঙ্গিয়ে বেড়ানো এই দুই দল আজ কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না। তাদের লক্ষ লক্ষ নেতা-কর্মী, কোটি কোটি সমর্থক আজ যেন হাওয়াতে মিশে গেছে। এটা বুর্জোয়া রাজনীতি ছাড়া আর কোথাও দেখা যাবে না। আবার কখনও যদি বুর্জোয়াদের কাছে আওয়ামী লীগের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়, এদেরকেই দরকার হয় – তবে মুহুর্তেই সমর্থনের বান ছুটে যাবে, দশদিক পূর্ণ করে লাখো-কোটি স্বরের জয়ধ্বনি তোপের মতো দাগবে, কাপড় বদলে, চেহারা পরিস্কার করে এই নেতারাই জনসমুদ্রের সেলাম নেবেন – এই তো বুর্জোয়া রাজনীতি! এই তো তার খেলা।
এ পরিস্থিতি ভাঙতে পারতো যদি বামপন্থী দলসমূহ এবং দেশের শিক্ষিত-সচেতন মানুষ, যারা বুর্জোয়া মানবতাবাদের শুরুর দিকের চিন্তাকে এখনও ধারণ করেন, তার বিকৃতি দেখে কষ্ট পান – সেই গণতন্ত্রমনা মানুষরা যদি একসাথে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারতেন। কিছু কিছু ব্যাপারে যতটুকুই আন্দোলন গড়ে উঠেছে যেমন রামপালে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনবিরোধী, গ্যাস-বিদ্যুৎ-নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদ ইত্যাদি ইস্যুতে, তাতে মানুষের সাড়াও অনেক ভালো। কিন্তু এখনও এই শক্তি দুর্বল।
এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে একতরফাভাবে যাই করুক, তাকে রুখে দেয়ার সম্ভাবনা যেহেতু ক্ষীণ, তাহলে আগামী নির্বাচন আবার আলোচনার বিষয়বস্তু কেন হলো? এই অবস্থার কোন পরিবর্তন হওয়ার কি কোন সম্ভাবনা ছিলো?
আমরা আন্তরিক – এই ভঙ্গিটি আনাই কি আসল উদ্দেশ্য?
সব রকমের গণতান্ত্রিক চেতনাকে পায়ে দলিত করেও গণতন্ত্রের নাটক সাজাতে হয় বুর্জোয়াদেরকে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এমনই এক সমাজব্যবস্থা যেখানে প্রতিদিন নতুন নতুন প্রতারণা না করে, জনগণকে না ঠকিয়ে সে টিকে থাকতে পারে না। এজন্যই দু’দিন পরপর নতুন শ্লোগান ওঠে। নতুন আশা তৈরি করা হয়। আবার আশাভঙ্গ হয়। তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলে কিছুদিন। তারপর আসে নতুন নাটক। এ চলতেই থাকে যতদিন না জনগণ তা ধরতে পেরে এই ব্যবস্থাকে ভাঙ্গার লড়াই গড়ে তুলেছে। বুর্জোয়া মিডিয়াগুলো মানুষের মনন কাঠামো ও মতামত তৈরির ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম আছে এই মতামত তৈরির জন্য, তা হলো রাষ্ট্রের বেতনভুক্ত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়; এদের সাথে আপাত স্বাধীন, স্পষ্ট ভাষায় সত্য উচ্চারণ করা বুদ্ধিজীবীদের পার্থক্য আছে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সমাপ্ত হওয়ার পর বুর্জোয়া মিডিয়া ও মিডিয়াম্যানরা একটা হইচই তৈরি করলেন। এরকম নির্বাচনই দেশের মানুষ চায়, এ ধরনের রাজনৈতিক পরিবেশ দেশে থাকা দরকার, আওয়ামী লীগেরও শিক্ষা হলো যে উপযুক্ত প্রার্থী দিলে সেই জয়ী হবে – ইত্যাদি কথার ফুল ফুটতে শুরু করলো। অর্থাৎ দেশ এখন একটা স্থিতির দিকে যেতে চায়, আওয়ামী লীগ যা করেছে তা করেছে, এখন সে সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন চায় – সেসময় গোটা ব্যাপারটা দেখতে লাগছিলো এমনই। এটাও মনে করা হচ্ছিলো যে, যেহেতু একা নির্বাচন করে জিতলেও এর মধ্যে জনগণের অনাস্থা থেকেই যায় এবং সেটা একসময় ফেটে পড়তে পারে, তাই বিষয়টিকে সহজ করার চেষ্টা আওয়ামী লীগ করছে।
একই সময়ে কর্মরত প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মেয়াদও শেষ হয়ে আসে। পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে সামনে আসে কারণ তাদের নেতৃত্বেই পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। রাষ্ট্রপতি তখন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা শুরু করেন সার্চ কমিটি গঠনের জন্য। কারণ সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। তবে তিনি তা করবেন সুনির্দিষ্ট আইনের ভিত্তিতে। আইন সুনির্দিষ্ট না হওয়ায় ২০১২ সালে যেমন সার্চ কমিটি করে কমিশন গঠন করা হয়েছিলো, এবারও তাই করা হয়েছে।
এবারের নতুন বৈশিষ্ট্য হলো সকল রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা। যেটা পূর্বে হয়নি। এতে সারাদেশে আলোচনা শুরু হয়ে যায়। রাষ্ট্রীয়ভাবে বিএনপিকে দীর্ঘদিন পর আলোচনায় ডাকাকে সরকারের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে পজেটিভ মনোভাব বলে আখ্যায়িত করা হয়, মিডিয়ায় মাতামাতি শুরু হয়ে যায় এবং জনগণের শিক্ষিত-সচেতন অংশ এ নিয়ে তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি ঘোষিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকারের মনোভাব অনেকখানি স্পষ্ট হলেও অনেকেই আশা ছাড়েননি, বিশেষ করে এই সার্চ কমিটি যখন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের সাথে মত বিনিময় করে ও অনেকের মতামত নেয়।
সেই সার্চ কমিটির প্রস্তাবনা থেকে বাছাই করে রাষ্ট্রপতি নতুন নির্বাচন কমিশনারদের নাম ঘোষণা করেছেন। বলা বাহুল্য আওয়ামী লীগ ব্যতীত আর কোন দলই একে স্বাগত জানায়নি। এই নির্বাচন কমিশনই স্পষ্ট করেছে আগামী নির্বাচন কেমন হবে। অর্থাৎ আমরা আন্তরিক, সবাই আসুক আমরা চাই – মানুষকে এসবও দেখানো হলো, আবার চূড়ান্ত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে থাকা মানুষকে কিছুদিন ব্যস্ত রাখাও গেলো। তাদের রাজনীতি পুরোটাই এখন একটা কৌশল, একটা মারপ্যাঁচের খেলা।
দেশের আইন-সংবিধান কি সুশাসনের জন্য, না রাজনৈতিক প্যাঁচ কষার জন্য?
এই পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচনে বিএনপি যাবে কি’না সে প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিএনপি ও অন্যান্য দলের অংশগ্রহণ করা নিয়ে আলোচনা এখন চলছে, যদিও আওয়ামী লীগ যে আপেক্ষিক অর্থে নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোন পরিবেশ রাখেনি সে ব্যাপারে সবাই একমত। বিএনপি কি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে? এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তাহলে আইন অনুযায়ী তাদের নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। এই বোকামি নিশ্চয়ই বিএনপি করবে না।’ তার এধরনের দ্বিধাহীন উক্তি শঙ্কার মধ্যে থাকা মানুষকে আরও শঙ্কিত করে। অর্থাৎ এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা হলো, যেখানে একটা আপেক্ষিক নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রস্তুতির ব্যাপারে সবার যে মত নেয়া হলো, সেগুলোর গ্রহণ-বর্জন কোন প্রক্রিয়ায়, কি ভিত্তিতে হলো – তার কোন আলোচনাই নেই। আইনের প্যাঁচে ফেলে রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধ্য করে, সবাই অংশগ্রহণ করেছে দেশে-বিদেশে এই প্রচার করে, পারলে বিরোধীদের মধ্য থেকে কিছু লোক ভাঙিয়ে নিশ্চিত ক্ষমতাকে হস্তগত করাই এখন উদ্দেশ্য এবং তা প্রকাশ্য উদ্দেশ্য। গোপন নয়। এখন আর কোন রাখঢাকও নেই। তবে এই সময়ে বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন নেতারা বলছেন যে, নিবন্ধন বাতিলের ভয়ে তারা প্রহসনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন – এমন হবে না।
এ সবই ঘটনা। এ বিষয়সমূহ বিবৃত করার মধ্যে আমাদের উদ্দেশ্য একটা জিনিস দেখানো। তা হলো এই যে, বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার নির্বাচনের আর কোন প্রয়োজন নেই। অনেক বড় কথা বলে বুর্জোয়া রাষ্ট্র পত্তনের শুরুতে নির্বাচন, পার্লামেন্ট ইত্যাদি তারা এনেছিলো বলে এখন রাতারাতি সবই গুটিয়ে নিতে পারছে না, কিন্তু তার অবস্থা যে কি দাঁড়িয়েছে তা দেশের মানুষ দেখতেই পারছেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বের বুর্জোয়া রাজনীতিই আজ সংকটগ্রস্থ।
জনগণের ম্যান্ডেটকে আওয়ামী লীগের এতো ভয় কেনো?
সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বলতে যা বোঝায় তা এ সময়কালে বিশ্বের কোথাও হয় না। কিছুদিন আগে আমেরিকার নির্বাচন মানুষ দেখেছে। তাতে জেফারসন, লিংকনের দেশের অবস্থা কি তা মানুষের সামনে পরিষ্কার হলো। এখন নিরপেক্ষ নির্বাচন মানে হলো জনগণ যাতে মোটামুটিভাবে ভোট দিতে পারে। কিন্তু ভোট পূর্ববর্তী ও চলাকালীন সময়ে টাকা, মিডিয়া, মাসল পাওয়ারের খেলা এখন স্বীকৃত ব্যাপার। বিভিন্ন দেশে এর ফর্ম বিভিন্ন কিন্তু কন্টেন্ট এক।
কিন্তু এইটুকু আপেক্ষিক নিরপেক্ষতা পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার মানতে চাইছে না। কেন মানতে চাইছে না? জনগণের ম্যান্ডেটকে তাদের কিসের ভয়? তার মানে, ভীষণ ক্ষোভ মানুষের মধ্যে তৈরি হয়ে আছে, এতটুকু সুযোগ পেলেই তা ফেটে পড়বে। একটু পরিবেশ দিলে বিএনপি’র উপর ভরসা থেকে নয়, আওয়ামী লীগের উপর প্রবল ক্ষোভ থেকে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে।
কিন্তু এই ক্ষোভই কোন পরিবর্তন এনে দিতে পারে না। কারণ এতদিনের শাসনে তারা বিরোধী বুর্জোয়া দলগুলোর (যারা তাদের ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে) সকল রকম সাংগঠনিক কাঠামোকে পর্যুদস্ত করেছে, পাশাপাশি উপর থেকে নিচ পর্যন্ত কায়েমি স্বার্থের এক বিশাল জাল বিস্তার করেছে। গরীব-নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত মানুষের এক বিরাট অংশ এই চক্রে বন্দী। আবার শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের একটা অংশও সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানের ভয়, উন্নয়নের বিভ্রান্তি ইত্যাদির কারণে এ সরকারের পরোক্ষ সমর্থক। একটা ক্ষোভ সঠিক রাজনৈতিক ভাষা না পেলে সঠিক পথে প্রকাশিত হতে পারে না। একটা লড়াই শুরু হলে বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে আত্মগ্লানিতে ভুগে গুটিয়ে থাকা বহু মানুষও রাস্তায় নামে। তাই বাম গণতান্ত্রিক শক্তি লড়াইয়ের বিকল্প হয়ে না ওঠা পর্যন্ত এটা ফেটে পড়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আবার চূড়ান্ত দুঃশাসন রাষ্ট্রকে ভেতর থেকে চিড় ধরিয়ে দিলে জনগণের ক্ষোভ একটা সরকার পরিবর্তন করতে পারে, কিন্তু এই ব্যবস্থা থেকে বের হতে পারবে না।
মানুষের ভবিষ্যৎ কোথায়?
লড়াই ছাড়া মানুষের কোন ভবিষ্যৎ নেই। লড়াই না হলে মানুষের ভাগ্যে আছে বারবার সেই একই অত্যাচার-নিপীড়ন-নির্যাতন, পদে পদে অপমানিত হওয়া। আগামী নির্বাচন হবে কি হবে না, হলে কারা অংশগ্রহণ করবে, আপেক্ষিকভাবে নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে কি’না – ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর এখন সময়ের অধিকারে। কিন্তু জনগণকে তাদের নিজস্ব সমস্যা-সংকটসমূহ নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলতে হবে – তবেই ফ্যাসিবাদের আক্রমণে ব্যক্তিগতভাবে বিচ্ছিন্ন মানুষ যে অসহায়ত্ব বোধ করে, সেই পরিবেশ আর থাকবে না। সংগঠিত অবস্থানের শক্তি মানুষ টের পাবে। মানুষের সংগঠিত অবস্থানই এই নিপীড়ন-নিষ্পেষণ থেকে মুক্তি দিতে পারে।