Wednesday, December 25, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - জুলাই ২০১৯সিআইএ কবুল করছে স্ট্যালিনের রাশিয়া সম্পর্কে তাদের প্রচারগুলি ছিল মিথ্যা

সিআইএ কবুল করছে স্ট্যালিনের রাশিয়া সম্পর্কে তাদের প্রচারগুলি ছিল মিথ্যা

‘গুলাগ’ শব্দটি সোভিয়েট রাশিয়া এবং সমাজতন্ত্র বিরোধী প্রচার, আলোচনা ও লেখাপত্রে বহুচর্চিত। রুশ ভাষায় ‘গুলাগ’ শব্দটির অর্থ বন্দিদের শ্রম শিবির। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ায় ক্ষমতাসীন কমিউনিস্টরা নাকি যোশেফ স্ট্যালিনের নেতৃত্বে তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীদের বন্দি করে এই শ্রম শিবিরে ভরে দিতেন। প্রতিদিন চলত অকথ্য নির্যাতন, যার রোমহর্ষক বিবরণ সারা বিশ্বের অধিকাংশ সংবাদ মাধ্যম গত ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে নিরলসভাবে প্রচার করে আসছে। এমনকী নানা গল্প– উপন্যাসের মাধ্যমেও বিশ্বাসযোগ্য সত্যের আকারে এই গুলাগের কল্পিত কাহিনি প্রচার করা হয়েছে। এ ধরনের লেখকদের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে ঢালাও আর্থিক সাহায্য, রাজনৈতিক আশ্রয়, তাদের রচনার ব্যাপক প্রচার এমনকী তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিতও করা হয়েছে।

সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ও তার মতাদর্শকে আক্রমণ করার বিশ্বব্যাপী এই পরিকল্পনায় প্রধানতম ভূমিকা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র। এহেন সিআইএ-র অতীতের সেই সব কর্মকান্ডের ডকুমেন্টগুলি প্রকাশ করা হয়েছে সম্প্রতি। সেইসব নথিপত্রের প্রকাশিত তথ্য সকলকে চমকে দিয়ে বলছে যে, এ পর্যন্ত গুলাগ নিয়ে যত প্রচার হয়েছে তা আসলে উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা প্রচার ছাড়া আর কিছু নয়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে পৃথিবীর দেশে দেশে অন্তর্ঘাত, খুন, গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দেওয়া, সন্ত্রাসবাদী নানা গোষ্ঠীকে অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করে বর্বর নরহত্যায় মদত দেওয়া, সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ, ষড়যন্ত্র, রাষ্ট্রপ্রধানদের হত্যা ইত্যাদি অসংখ্য অপকর্মে কুখ্যাত সিআইএ সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ বিষয়েও নাক গলানোর জন্য নানা ধরনের গোয়েন্দাগিরি এবং অপকর্ম চালিয়ে গিয়েছিল ধারাবাহিকভাবে। তাদের সেই গোপন কাজকর্ম এবং অনুসন্ধানের রিপোর্ট তারা মার্কিন প্রশাসনের কর্তা তথা রাষ্ট্রপ্রধানদের উদ্দেশ্যে পাঠাতেন।

সোভিয়েত রাশিয়া সম্পর্কে প্রচার করা হয়েছিল যে শুধু ’৩০-এর দশকে কুড়ি লক্ষ লোককে জেলে ভরা হয়েছিল এবং তাদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক বন্দি। আর প্রকাশিত ডকুমেন্ট অনুযায়ী সোভিয়েত শাসনে কারাগারগুলিতে ’৫৪ সাল পর্যন্ত মোট বন্দির সংখ্যা ছিল ২৩ লক্ষ ৬৯ হাজার ২২০ জন। একটি গোপন রিপোর্টে সিআইএ ওয়াশিংটনকে জানায় যে তথাকথিত এই গুলাগের ৯৫ শতাংশ কয়েদি হচ্ছে সত্যিকার ক্রিমিন্যাল। চুরি-ডাকাতি-খুন ইত্যাদির মতো অপরাধে তারা অপরাধী। তাদের কোনও রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড নেই।

সিআইএ-র রিপোর্টই বলছে, ১৯৫৩ সালে এই সব কয়েদির ৭০ শতাংশকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। এই সব কয়েদীদের নিরপরাধ হিসাবে দেখান স্ট্যালিন পরবর্তী সংশোধনবাদী কর্তারা। কিন্তু মুক্তি দেওয়ার এক সপ্তাহ থেকে ৩ মাসের মধ্যেই এই সব অপরাধীদের অধিকাংশই আবার অপরাধ করে এবং সরকারের পুলিশ তাদের পুনরায় গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ কয়েদিদের রাজনৈতিক আক্রোশের বলি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা মিথ্যে প্রমাণিত হয়ে যায়। যদিও সে খবর সে সময় রাশিয়াসহ বিশ্বের সংবাদমাধ্যম সম্পূর্ণ চেপে দেয়।

জেলখানায় অত্যাচার-অনাহার ইত্যাদির সম্পর্কে প্রচারের কোনও শেষ ছিল না। অথচ সিআইএ-র প্রকাশিত ডকুমেন্ট থেকে দেখা যাচ্ছে যে সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত বন্দিদের শ্রমদান ব্যবস্থাটি শ্রম ও মজুরির নিয়ম অনুযায়ী পরিচালিত হত। কয়েদিরা বেশি কাজ করলে বেশি মজুরি পেত। সিআইএ জানাচ্ছে, যে সব কয়েদি তাদের নির্ধারিত কাজের মাত্র পাঁচ শতাংশ বেশি করত, তাদের একদিনের জেলখাটাকে দুই দিন হিসেবে গণ্য করা হত।

সিআইএ তাদের রিপোর্ট-এ খাবারের জন্য মাথাপিছু যে রেশন-এর উল্লেখ করেছে, তা এমনকী তথাকথিত বনেদি পুঁজিবাদী পাশ্চাত্য দেশের যে কোনও জেলের খাদ্য তালিকা থেকে অনেক উন্নত। সেই খাদ্য তালিকায় ছিল স্যুপ, ব্রেড, ভেজিটেবল এবং মাংস অথবা মাছ।

ইতালীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন ঐতিহাসিক মাইকেল প্যারেন্টি সোভিয়েত আর্কাইভ এবং সিআইএ-র তথ্য বিশ্লেষণ করে সন্দেহাতীতভাবে দেখিয়েছেন যে, সোভিয়েত লেবার ক্যাম্প (শ্রম শিবির) কোনওভাবেই নাৎসিদের মতো ডেথ ক্যাম্প ছিল না। কোনও রকমের প্রণালীবদ্ধ গণনিধন ব্যবস্থা, গ্যাস চেম্বার ইত্যাদি যা নাৎসিরা গোটা ইউরোপে তৈরি করেছিল, এখানে সেরকম কোনও ব্যাপারই ছিল না। গুলাগের অধিকাংশ বাসিন্দাই তাদের মেয়াদ শেষের পর সশরীরে ছাড়া পেয়েছে। অথবা ক্ষমা প্রদর্শনের কারণে মেয়াদের আগেই মুক্তি পেয়েছে। সিআইএ-র রিপোর্টে আছে প্রতি বছরে এই ক্যাম্পগুলি থেকে ২০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ কয়েদি মুক্তি পেত। বিস্ময়কর হল, তাদেরই জানা সত্যের ঠিক বিপরীত কথা তারা তাদের বিশ্বময় নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে দীর্ঘদিন প্রচার করে গেছে এবং সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে একটা দানবীয় সমাজ হিসাবে প্রচার চালিয়ে গেছে।

সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিতদের গুলাগের মৃত্যুর যে সংখ্যা দেখিয়ে তাকে অনাহারে মৃত্যু বা হত্যা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে, তা যে ইচ্ছাকৃত তথ্য বিকৃতি তা মাইকেল প্যারেন্টি (সোভিয়েত আর্কাইভ ও সিআইএ-র প্রকাশিত তথ্য থেকে) দেখিয়েছেন। ১৯৩৪-১৯৫৩ পর্যন্ত এই কুড়ি বছরে যত মৃত্যু গুলাগে হয়েছিল তার অর্ধেকেরও বেশি হয়েছিল ১৯৪১-১৯৪৫ এই চার বছরে। ১৯৪৪ সালে গুলাগ ক্যাম্পে মৃত্যুর হার ছিল প্রতি হাজারে ৯২ জন। বাস্তব সত্য হচ্ছে, এই সময়কালে রাশিয়ার সাধারণ মানুষের মৃত্যুর হার ছিল এরও অনেক বেশি। এই সময় গোটা দেশে ২ কোটি ২০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল যুদ্ধে কিংবা অনাহারে। এই সময় গুরুতর অপরাধে অপরাধীদের বাদ দিয়ে ইচ্ছুক কয়েদিদের অধিকাংশকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য।

রুশ সরকার যে জেলখানার পরিবেশ উন্নতিতে আন্তরিক ছিল তার প্রমাণ আছে এই দুই নথিতেই। যুদ্ধের সময় গুলাগের মৃত্যুর হার যেখানে ছিল প্রতি হাজারে ৯২ জন, ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার অব্যবহিত পরেই তা নেমে আসে মাত্র ৩-এ। এরকম অসংখ্য তথ্য সিআইএ তথা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মিথ্যাচারী কুৎসিত চরিত্রকে এনে দিয়েছে দিনের আলোয়।

সম্মিলিত এই মিথ্যা প্রচারের চিত্রনাট্য প্রস্তুত হয়েছিল গত শতাব্দীর পাঁচের দশকের গোড়ার দিকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন শেষ হয়েছে কয়েক বছর আগে। ফ্যাসিস্ট হিটলারের নেতৃত্বাধীন সামরিক শক্তির চূড়ান্ত পরাজয় ঘটেছে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার হাতে। জার্মানিসহ সারা ইউরোপে লক্ষ-কোটি মানুষের উপর চরম অবর্ণনীয় অত্যাচার আর বিশাল নিখুঁত পরিকল্পনায় সংগঠিত গণহত্যার, তথা আউসভিৎস, ব্রাভেন বুর্ক, মাথাউসেন ইত্যাদি অসংখ্য কুখ্যাত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প-এর লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করার হাড় হিম করা ঘটনাবলির কথা তখন সারা বিশ্বের মানুষের কাছে উদ্ঘাটিত। অন্য দিকে সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী অন্যান্য সমস্ত দেশও অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চরম সংকটে নিমজ্জিত। বস্তুতপক্ষে পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ অনিবার্য এই সংকটই জার্মানিকে ঠেলে দিয়েছিল ফ্যাসিবাদের দিকে। অন্যদিকে চরম ক্ষয়ক্ষতি, অসংখ্য জীবনহানিসহ প্রায় ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে রণক্লান্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন তার সমাজতান্ত্রিক শক্তিতে গড়ে তুলছে সমস্ত দিক থেকে উন্নত সমৃদ্ধ এক নতুন দেশ। গোটা বিশ্বের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে উঠেছে এক স্বপ্নের বাস্তব। পূর্ব ইউরোপে, চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে। পৃথিবীর প্রতিটি পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী দেশের অভ্যন্তরে সমাজতন্ত্রের দাবি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে ক্রমশ। এমতাবস্থায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের নতুন নেতা হিসেবে উঠে আসা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার দোসররা খুব ভাল করে বুঝতে পারছিলেন, সমাজতন্ত্রের প্রতি আকর্ষণের এই ক্রমবর্ধমান উৎসাহের অর্থ ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির মৃত্যুর পদধ্বনি। তাই যেকোনও উপায়ে সমাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের তীব্র আকর্ষণের এই বিশ্বব্যাপী প্রবণতাকে ঠেকাতে তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরেও তাদের বন্ধু জুটিয়ে ফেলে। এরা ক্ষমতাচ্যুত পুঁজিপতি শ্রেণির প্রতিনিধি, যারা কমিউনিস্ট পার্টি ও সোভিয়েত রাষ্ট্রের নানা স্তরে আত্মগোপন করেছিল। স্ট্যালিনের নেতৃত্বে দলের উনবিংশতিতম কংগ্রেসে এদের সম্পূর্ণ পরাজিত করার আহ্বান জানানোর পর অস্তিত্বের সংকটের আতঙ্ক এদের তাড়া করেছিল। মহান স্ট্যালিনের আকস্মিক মৃত্যু এদের সুযোগ করে দেয় সমস্ত কিছুকে ওলট-পালট করে দেওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে।

সভ্যতা ও মানবতাবিরোধী তাদের কীর্তিকলাপের নথিপত্র প্রকাশিত হওয়ার পর সিআইএ হয়ত তাদের পেশাদারিত্ব, বুদ্ধিমত্তা এবং দিনকে রাত করে দেওয়ার নিখুঁত পরিকল্পনার ছকে আত্মমুগ্ধ হবে। কিন্তু এই চরম মিথ্যার কোরাসে যারা গলা মিলিয়েছিলেন, অন্তত একটু লজ্জা বা অনুশোচনা কি পাওয়া যাবে তাদের আচরণে?

(ভারতের এসইউসিআই(সি) দলের বাংলা মুখপত্র সাপ্তাহিক গণদাবী : ৭১ বর্ষ ২২ সংখ্যা থেকে পুনঃমুদ্রিত)
তথ্য সূত্র :
‘দ্য ট্রুথ অ্যাবাউট দ্য সোভিয়েট গুলাগ সারপ্রাইজিংলি রিভিল্ড বাই দ্য সিআইএ’। (সাইদ তৈমূর অক্টোবর-০৭, ২০১৮)
ওয়েবসাইট : স্টারমিশকাটিইউশা, ডবিøউআইএক্সআইটিই ডট কম
সিআইএ (ডকুমেন্ট ডিক্লাসিফায়েড। সোভিয়েট আর্কাইভাল ডকুমেন্ট)

সাম্যবাদ জুলাই ২০১৯

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments