১৪ এপ্রিল ২০১৮, সিরিয়ার অন্য শহরের মতো দামাস্কাস ও হোমস শহরের মানুষ ঘুমিয়ে। ভোর রাতে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুহুর্মুহু ১০৫ মিসাইল হামলায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত শহর দুটি। আন্তর্জাতিক সমস্ত নিয়মকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গলি দেখিয়ে স্বাধীন দেশ সিরিয়ায় মিসাইল হামলায় মার্কিনিদের সহযোগী ছিল ব্রিটেন ও ফ্রান্স। ইরাকের পর আবারও ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসন দেখল সিরিয়া তথা বিশ্ববাসী। সিরিয়ার দৌমা শহরে সাধারণ মানুষের ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর কথিত রাসায়নিক গ্যাস হামলার অভিযোগের জবাব দিতে এই মিসাইল আক্রমণের কথা জানায় মার্কিন-ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সরকারগুলো। ন্যূনতম তথ্য উপাত্ত ও ভিডিও ছবিগুলো যাচাই বাছাই করা ছাড়াই হামলার দায় চাপিয়েছে সিরিয়ায় ক্ষমতাসীন বাশার আল আসাদ সরকারের উপর। আর এই সংবাদ ফলাও করে প্রকাশ করে তাদের মদদপুষ্ট আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো।
রাসায়নিক অস্ত্র হামলার ভুয়া অভিযোগ তুলে হামলা
রাতের আঁধার যেমন কাটে সূর্যের আলোয়, তেমনি সিরিয়ায় মার্কিনিদের নগ্ন হস্তক্ষেপের মুখোশ খুলতে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। গোয়োবোলসের কায়দায় প্রচারিত ডাহা মিথ্যার জারিজুরি ফাঁস করেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক। ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক দ্যা ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকায় সম্প্রতি বিস্তারিত তুলে ধরেছেন এই অনুসন্ধানী সাংবাদিক। গত ১৫ এপ্রিল সিরিয়ার গৌতা শহরে কথিত দেশটির সেনাবাহিনীর রাসায়নিক হামলার ঘটনাস্থলে পৌছে অনুসন্ধানে নামে মধ্যপ্রাচ্য ও যুদ্ধ সংবাদ বিশেষজ্ঞ প্রতিবেদক রবার্ট ফিস্ক। ঘুরে ঘুরে কথা বলেন, হাসপাতাল ক্লিনিকসহ প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে। তুলে আনেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট ইসলামী জঙ্গীগোষ্ঠী আল কায়েদা ও হোয়াইট হেলমেটের সাজানো নাটকের বিশদ বিবরণ। তাঁর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ফাঁস করে দিয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভয়ঙ্কর প্রতারণা আর মিথ্যাচার।
ইঙ্গ-মার্কিন সাজানো নাটক
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হঠাৎ ছড়িয়ে পরে সিরিয়ার আল কায়েদা নিয়ন্ত্রিত গৌতা শহরে রাসায়নিক অস্ত্র হামলায় আক্রান্ত শিশুদের ছবি। ভিডিওতে দেখা যায়, হাসপাতালে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে না পারছে না বেশ কিছু শিশু, কিছু লোক তাদের মাথায় পানি ঢালছে। আল কায়েদার হাত থেকে দখল নিতে সাধারণ মানুষের ওপর রাসায়নিক অস্ত্র হামলা চালিয়েছে আসাদ সরকারের সেনাবাহিনী। সেসব ছবি লুফে নিয়ে শত শত সংবাদ তুলে ধরে আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যমগুলো। যেখানে ছবিগুলোর সত্যতা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি তারা।
৭ এপ্রিল দৌমায় কী ঘটেছিল?
“অন্য দিনের মতোই দৌমার আকাশে সিরিয়ার সেনাবাহিনীর বিমান ঘোরাঘুরি করছিল। গোলাবর্ষণও চলছিল। তবে সেই রাতে প্রচ- বাতাস বইছিল। অনেকটা ঝোড়ো বাতাসে প্রচুর ধুলোবালি ঢুকে পড়েছিল মাটির নিচের সাধারণ মানুষের থাকার ঘরগুলোতে। অনেকেই হাইপোক্সিয়া বা অক্সিজেনের অভাবজনিত সমস্যায় ক্লিনিকে এসেছিল। হঠাৎ করেই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ‘হোয়াইট হেলমেট’ গোষ্ঠীর এক সদস্য চিৎকার করে উঠল ‘রাসায়নিক গ্যাস’ বলে। আর সাথে সাথে আতঙ্ক ছড়িয়ে গেল। অক্সিজেনের সমস্যায় ভোগা মানুষগুলো দ্রুত একজন আরেকজনের মাথায় পানি ঢালতে শুরু করল। শিশুদের মাথায় পানি ঢালা হলো এবং এই ক্লিনিকেই ভিডিও ছবিগুলো তোলা হয়েছিল। শিশুসহ ছবির লোকগুলো আক্রান্ত হয়েছিল রাসায়নিক গ্যাসে, কষ্ট পাচ্ছিলেন অক্সিজেন ঘাটতিতে। এটা ক্লিনিকের ডাক্তারসহ সকলেই জানে।” এভাবের রবার্ট ফিস্ক – এর কাছে সে রাতের প্রকৃত ঘটনা বর্ণনা করছিলেন দৌমার ঐ ক্লিনিকের ডাক্তার আসিম রাহাইবানি। প্রত্যক্ষদর্শী সেই ডাক্তারের বক্তব্য হুবহু ইন্ডিপেনডেন্ড পত্রিকায় তুলে ধরেন রবার্ট ফিস্ক। গ্যাসের কারণে শিশুদের মৃত্যুর মিথ্যা প্রচারণা চালানোর গুমোর ফাঁস করেন তিনি।
অথচ বিশ্ব সন্ত্রাসের মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৮ এপ্রিল টুইটারে লিখেন, “মৃতের সংখ্যা অসংখ্য, শিশু ও নারীরাও রয়েছে। সাধারণ মানুষের উপর বর্বরোচিত রাসায়নিক হামলা চালিয়েছে সিরিয়ার সেনাবাহিনী। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ও ইরান দায়ী পশু আসাদকে সহযোগিতা করছে।” একটি স্বাধীন দেশের প্রেসিডেন্টকে ‘পশু’ বলার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে ট্রাম্প। এই প্রোপাগান্ডা চালিয়েই সিরিয়ায় ১০৫ টি মিসাইল হামলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল ট্রাম্প প্রশাসন। থলের বেড়াল বেড়িয়ে আসা রুখতে আন্তর্জাতিক রাসায়নিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ সংস্থা ‘ওপিসিডব্লিউ’র কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছিল। সিরিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সংস্থাটি যখন দৌমা শহরে যাওয়া ঠিক করে সেই মুর্হুতে মিসাইল হামলা চালিয়ে প্রমাণ মুছে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মাধ্যমে ঠিকই বেড়িয়ে এসেছে আসল সত্য। সা¤্রাজ্যবাদী মিডিয়াগুলো চেপে যাওয়ার মতো বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোও রবার্ট ফিস্ক -এর ‘অনুসন্ধানী সেই প্রতিবেদন’ প্রকাশ করেনি। অথচ সিরিয়ার কথিত রাসায়নিক হামলায় আক্রান্ত শিশুদের ওপর দিনে-রাতে অসংখ্য প্রতিবেদন করেছিল দেশের সকল মিডিয়া। তাইতো সিরিয়ায় মিসাইল হামলার প্রতিবাদে বাসদ (মার্কসবাদী)র প্রতিবাদ সমাবেশের খবরও স্থান পায়নি পত্রিকার পাতায়।
সম্প্রতি স্কাই টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ জানান, “নুসরা ফ্রন্টে কথিত সেই গ্যাস অ্যাটাকের বিষয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো অনুসন্ধান না করেই ভুয়া সংবাদ ছেপেছে। কোনো ধরনের প্রমাণ ছাড়াই বিকৃত তথ্য সম্প্রচার করা হয়েছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে। যে অঞ্চলটির সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে তা নিয়ন্ত্রণ করত আল কায়েদা সিরিয়া শাখা। ফলে আল কায়েদার ভুয়া ভিডিওসহ তথ্যগুলোই প্রচারিত হয়েছে। এ জন্যই আমরাই উদ্যোগী হয়ে আন্তর্জাতিক তদন্ত দলকে আহ্বান করেছি।”
গেল সাত বছরে আইএস নির্মূলে সিরিয়া-রাশিয়ান যৌথ অভিযানে শুধু দৌমা শহরই বাকী ছিল। পূর্ব ঘৌতার পাহাড়ি এলাকা জঙ্গীমুক্ত করার পাশাপাশি ‘মানব করিডর’ করে আটকে পড়া দেড় লাখ সাধারণ মানুষকে বেরিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। এমনকি কথিত রাসায়নিক হামলার আগের দিন দেশটির বিমান বাহিনী আরেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ‘জয়েশ আল ইসলাম’র ৩০০ -এর বেশি ঘাঁটি ও অস্ত্র ভান্ডার ধ্বংস করেছে। জঙ্গী সন্ত্রাসীদের যোগাযোগ দপ্তরও গুড়িয়ে দিয়ে শহরটি মুক্ত করার দ্বারপ্রান্তে যখন আসাদ সরকার, তখনই সন্ত্রাসীদের মদদ দিতে এই সাজানো নাটক করেছে যুক্তরাষ্ট্র। টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট আসাদ আরও বলেন, “আমরা যখন আল কায়েদাসহ সন্ত্রাসীদের হাত থেকে প্রায় সবগুলো শহর মুক্ত করেছি তখন কেন আমরা রাসায়নিক অস্ত্রের হামলা চালাব? আর আমরা নৈতিকভাবে সমর্থন করি না এধরনের অস্ত্রের ব্যবহার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আল কায়েদাসহ সন্ত্রাসী জঙ্গীগোষ্ঠীকে পোষে ও মদদ দেয়। আর এই কারণে কথিত রাসায়নিক হামলার ভুয়া সংবাদ প্রচার করেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ গণমাধ্যমে।…এর চেয়ে নিন্দাজনক ঘটনা আর কী হতে পারে?”
আমাদের করণীয়
২০০৩ সালে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসনের কাছে ‘মারাত্মক মারণাস্ত্র’ আছে অভিযোগ তুলে ইরাকে আগ্রাসন চালিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সাদ্দাম হোসেনকে বর্বরোচিত কায়দায় হত্যা করে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে ইরাককে। উদ্দেশ্য ছিল দেশটির তেল-গ্যাস লুটপাট করা। সেই একই কায়দায় মিথ্যা অভিযোগে এবার সিরিয়ায় হামলা চালিয়েছিল সা¤্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের মিলিত শক্তি। ইরাকে সফল হলেও মুখোশ খুলে পড়ায় নগ্ন চেহারা দিবালোকের স্পষ্ট হয়েছে।
অস্ত্রের ব্যবসা ও তেল-গ্যাস লুণ্ঠনে দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে বাম গ্রগতিশীলসহ যুদ্ধবিরোধী শক্তিগুলোকে। একইসাথে দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদের পাহাড়াদার পুঁজিবাদী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে জোরদার করতে হবে বাম-গণতান্ত্রিক আন্দোলন। সেই শিক্ষাই যেন দিয়ে গেল দৌমা শহরের মার্কিন প্রোপাগান্ডা মেশিন।
সূত্র: https://www.independent.co.uk/voices/syria-chemical-attack-gas-douma-robert-fisk-ghouta-damascus-a8307726.html#gallery