সুনামগঞ্জসহ ক্ষতিগ্রস্থ হাওর অঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণাসহ ১২ দফা দাবি বাস্তবায়ন কর
দেশের রাজধানী ঢাকার মানুষের নিত্যদিনের হাহাকার হচ্ছে বাসা বাড়িতে ব্যবহারের জন্য পানি পাওয়া যায়না। অন্যদিকে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল হাওরের চিত্র তার বিপরীত। হাওরের বিস্তীর্ণ জনপদ পানিতে থৈ থৈ। পানির অপর নাম জীবন হলেও হাওরবাসীর জন্য তা এখন মরণদশা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিঠা পানির দেশের মানুষের জীবন আজ বিপর্যস্ত এই পানি নিয়ে; যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্র নির্বিকার। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেন, আবার বন্যার পদধ্বনি শোনা যচ্ছে। কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া এই মিঠা পানিকে সম্পদে রূপান্তর করে তার সঠিক ব্যবহার করার কোন পরিকল্পনা নেই সরকারের।
২৬ জুন ২০১৭ সুনামগঞ্জ হাওরের চিত্র হচ্ছে গায়ে পুরনো কাপড়, ঘরে ফিরনি সেমাইয়ের বদলে আটার রুটি, অনেক চুলায় আগুন জ্বলেনি। এমন অর্ধাহার-অনাহার আর হাহাকার নিয়ে ঈদুল ফিতর পালন করেছেন হাওরবাসী। সামনে ঈদুল আযহা! কিন্তু হাওর অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলছে। তার থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নামেমাত্র ত্রাণ দিয়ে বলা হচ্ছে যে, সহযোগিতা করা হচ্ছে। খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণের খাদ্য রয়েছে। ত্রাণ মন্ত্রণালয় যদি আমাদের কাছে আরো খাদ্য চায়, আমরা সরবরাহ করতে পারবো। তাদের চাইতে হবে।” সত্যি আজব এই রাষ্ট্রীয় নিয়ম। নতুন করে সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলা বন্যা কবলিত হয়েছে। ভারত কর্তৃক উজানের নদ -নদীর বাঁধের গেইট খুলে দেওয়াতে তলিয়ে গেছে বিশাল এলাকার জনবসতি। মানুষ আশ্রয় নিয়েছে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে কিংবা উচু বাঁধের খোলা আকাশের নিচে। এই অবস্থায় ত্রাণ নিয়েও হচ্ছে দলীয় দুর্নীতি। দুনীতি ও অনিয়মের কারণে পর্যাপ্ত ত্রাণ পাচ্ছেনা হাওর অঞ্চলের বিপুল জনগণ। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের সবাই বলেছেন পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ আছে। কিন্তু আমরা জানি গরীবের খাবার মোটা চালের দাম সবচেয়ে বেশি আমাদের দেশে। তাহলে এই খাদ্য মজুদ কার স্বার্থে ?
জানা যায়, হাওরবাসীর পরিবারে গড়ে ৫ থেকে ৬ জন করে সদস্য রয়েছে। প্রতিদিনের তিনবেলার খাদ্য চাহিদা পূরণে তাদের প্রয়োজন কমপক্ষে ৫ কেজি চাল। সরকার ১১০ জন জেলা ডিলারের মাধ্যমে প্রতিদিন ১ টন করে প্রতি কেজি ১৫ টাকা দরে চাল বিক্রি করছে। ১টন চাল ২০০ জন মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারে? বাকী জনগোষ্ঠীর সবাই খাদ্য নিরাপত্তার বাইরে রয়েছে। যত দিন বাড়ছে অভাবের তাড়না তত বাড়ছে। হাওরের পানিতে মাছ ধরার সুযোগ না পেয়ে আরও অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে মানুষজন।
ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও সরকারের অবস্থান
অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে হাওরের একমাত্র ফসল বোরো ধান তলিয়ে যাওয়ায় হাওর অঞ্চলের প্রায় ৯০ লক্ষ মানুষ খাদ্য সংকটের ঝুঁকির মুখে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে হাওর অঞ্চলের মোট ৪ লাখ ১ হাজার ৮ শত ৪২ হেক্টর জমিতে ফসলের প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমির ফসল পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে। এতে হাওরের ৭ জেলার ৪৭ টি উপজেলার ৫ লাখ ৭ হাজার ৩শত ১৮ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছ। এছাড়া গবাদি পশুর সারা বছরের খাবার ঘাস, খড় ও অন্যান্য খাদ্যও বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে এ অবস্থায় কৃষকরা গবাদি পশু বিক্রী করে দিয়েও ঋণের ভারে নিমজ্জিত। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোন ঋণ মওকুফ এবং নগদ সহায়তা দেওয়ার কোন উদ্যোগ নেই।
শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন বলতে আর কিছু নেই এই অঞ্চলে। চিকিৎসার জন্য ডাক্তার দেখানোর কথা ভাবতেই পারছেনা কৃষকরা। এই চাপ সইতে না পেরে এলাকা ছাড়ছেন অনেকে, অথচ সরকার নীরব।
সরকারি নিয়ম অনুসারে ২৫ শে ডিসেম্বর থেকে ২৮ শে ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাঁধ নির্মাণ শেষ করার কথা (যদিও কৃষকদের দাবি নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে) সেটা না করে মার্চ মাসে করার ফলে বাঁধ দেওয়ার সাথে সাথে কিংবা পূর্বেই পানি বেড়ে বাঁধ ভেঙে যায়। এই পরিস্থিতির জন্য সরকারি দলের লুটপাট পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তা ও ঠিকাদাররা সবাই দায়ী ।
হাওরের সংগ্রামী মানুষের পাশে ঐক্যবদ্ধ হোন
প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই পরামর্শ দেন শহরের ছেলেমেয়েদের কৃষকদের কাছে যাওয়ার জন্য। তা না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নাকি কীভাবে ফসল উৎপাদন হয় বলতে পারবে না। কিন্তু ঐ কৃষকদের দুঃখ স্থায়ীভাবে দূর করার জন্যে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নেই পরিকল্পিত কোন উদ্যোগ। তাই হাওরের স্থায়ী সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে এখানকার ইকো-সিস্টেম রক্ষা করা, নদী খনন ও সংকুচিত নৌপথ সম্প্রসারিত করা, প্রাকৃতিক সম্পদ, মাছের প্রজনন কিভাবে বৃদ্ধি করা সম্ভব সে নিয়ে গবেষণার লক্ষ্যে হাওর গবেষণা ইনস্টিটিউট চালু করা প্রয়োজন। হাওর অঞ্চলে কৃষকদের নিরানন্দ, বিষাদগ্রস্থ জীবনের এবং প্রকৃতি ও মানবসৃষ্ট সংকটের বিরুদ্ধে প্রতি নিয়ত সংগ্রামমুখর বেঁচে থাকার প্রচেষ্ঠায় রত; এই সংগ্রামী মানুষের পাশে থাকা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এই দায়িত্ববোধ থেকে নিম্নোক্ত ১২ দফার ভিত্তিতে আগামী ২৫শে আগস্ট ২০১৭ অনুষ্ঠিত হবে হাওর কনভেনশন।
দাবিসমূহঃ
১. সুনামগঞ্জসহ ক্ষতিগ্রস্থ হাওর অঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা কর
২. সরকারি কৃষি ঋণ মওকুফ কর। এন.জি.ও. ঋণ, মহাজনী ঋণ উত্তোলন ২ বছরের জন্যে স্থগিত কর। সকল সুদ মওকুফ কর।
৩. বিনা সুদে, বিনা শর্তে কৃষি ঋণ দাও। শস্য বীমা চালু কর। বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ দিতে হবে।
৪. জলমহালের ইজারা প্রথা বাতিল কর। সকল জেলে, কৃষকদের অবাধে মাছ ধরার অধিকার দাও। প্রশাসনিক হয়রানী বন্ধ কর।
৫. ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের তালিকা প্রকাশ কর, সারা বছর রেশনিং চালু কর। ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতি বন্ধ কর।
৬. গবাদি পশুর খাদ্য সরবরাহ কর।
৭. বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের শিক্ষার্থীদের সকল স্তরে ভর্তি ফি, পরীক্ষা ফি, মাসিক বেতন মওকুফ কর। সারাবছর বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ কর।
৮. ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় ওয়ার্ডভিত্তিক সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র চালু কর। বিনামূল্যে ঔষধ সরবরাহ কর।
৯. দ্রুত নদী খননের ব্যবস্থা কর। সংকুচিত নৌপথ সম্প্রসারণ কর।
১০. প্রকৃতি নির্ভরতা কাটানোর লক্ষ্যে হাওর গবেষণা ইনস্টিটিউট চালু কর।
১১. দায়ী পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তা, ঠিকাদারদের গ্রেফতার কর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাও।
১২. হাওরের সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ণ কর।
আঞ্চলিক হাওর কনভেনশন
স্থান – শহীদ আবুল হোসেন মিলনায়তন, সুনামগঞ্জ
২৫শে আগষ্ট ২০১৭ শুক্রবার, সকাল ১১টা
আলোচক:
কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্তী
সদস্য, বাসদ (মার্কসবাদী), কেন্দ্রীয় কার্যপরিচালনা কমিটি
প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক
চেয়ারম্যান, জল ও পরিবেশ গবেষণা ইন্সটিটিউট
কমরেড আহসানুল হাবিব সাইদ
সাংগঠনিক সম্পাদক, সমাজতান্ত্রিক ক্ষেতমজুর ও কৃষক ফ্রন্ট, কেন্দ্রীয় কমিটি।
স্থানীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দ
সভাপতিত্ব করবেন : কমরেড উজ্জল রায়
আহ্বায়ক, বাসদ (মার্কসবাদী), সিলেট জেলা।