
গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার আন্দোলন অপরাপর শ্রমিক সংগঠনকে সাথে নিয়ে ২০১৬ সালের মে মাস থেকে বেসিক ১০ হাজার এবং মোট মজুরি ১৬ হাজার টাকার দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি পুনঃনিধারণের দাবিতে মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়। ইতিমধ্যে ৮ মাস অতিবাহিত হলেও এ মজুরি বোর্ড মাত্র ৪টি সভা করতে সক্ষম হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত মালিক ও শ্রমিক পক্ষের অযৌক্তিক প্রস্তাবনা (মালিক পক্ষ ৬,৩৬০ টাকা এবং শ্রমিক পক্ষ ১২,০২০ টাকা) ছাড়া আর কোন অগ্রগতি হয় নি। গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে এই দীর্ঘসূত্রিতা বন্ধ, অবিলম্বে ১৬ হাজার টাকা মজুরি কার্যকর করা এবং “শ্রমিকের জীবন, মর্যাদা এবং বাঁচার লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ হোন” এই ডাককে সামনে নিয়ে ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, শুক্রবার সকাল ১১ টায় জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে এক শ্রমিক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়।
গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের বর্তমান সমন্বয়ক এ্যাড. মাহবুবুর রহমান ইসমাইলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ কনভেনশন উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমিরেটাস সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। উদ্বোধনী বক্তব্য দেন কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক মোশরেফা মিশু।
কনভেনশনে বক্তব্য দেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মুবিনুল হায়দার চৌধুরী, সাইফুল হক এবং মোশাররফ হোসেন নান্নু। ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শহীদুল্লাহ চৌধুরী, শাহ আতিউল ইসলাম, চৌধুরী আশিকুল আলম পটল। গার্মেন্টস শ্রমিক নেতাদের মধ্যে বক্তব্য দেন তাসলিমা আখতার, মোহাম্মদ ইয়াসিন, আ ক ম জহিরুল ইসলাম, জুলহাসনাইন বাবু, শামীম ইমাম, অরবিন্দু ব্যাপারী, বিপ্লব ভট্টাচার্য এবং সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন রুহুল আমীন এবং আহসান হাবিব বুলবুল।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর উদ্বোধনী বক্তৃতায় বলেন, বর্তমান বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে দাঁড়িয়ে আছে অন্যায় ও অন্যয্যতার ওপর। এই অন্যায় ও অন্যায্যতার প্রতিবাদ করতে স্কুলের শিশুরাও রাস্তায় নেমে এসেছিলেন শ্রেণিকক্ষ ছেড়ে। কিন্তু সে আন্দোলনও আমরা দেখলাম দমন করা হলো কি অন্যায়ভাবে। অন্যায়ের শিকার হলে বিচার পাবার অধিকারও আমরা হারিয়ে ফেলছি। আপনারা শ্রমিক, কাজ করছেন, দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখছেন, বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন করছেন কিন্তু ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আপনারা ১৬ হাজার টাকার দাবিতে আন্দোলণ করছেন। মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য এটা অতি সামান্য চাওয়া। কিন্তু সেটা পূরণ করার জন্যও আন্দোলন করতে হচ্ছে। এই আন্দোলনকে শুধু অর্থনৈতিক দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে চলবে না রাষ্ট্রের আমূল পরিবর্তনের দিকে ধাবিত করতে হবে।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ তার বক্তৃতায় বলেন, আমাদের দেশের গার্মেন্টস মালিকরা শ্রমিক আন্দোলন দমনের সময় ঐক্যবদ্ধ কিন্তু বায়ার বা ব্র্যান্ডের সাথে দরকষাকষির সময় তাদের মধ্যে কোন ঐক্য নাই। কাজ পওয়ার জন্য তারা পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতা করে, স্বার্থ বিকিয়ে দেয়। কিন্তু হওয়া উচিত তার বিপরীত। তিনি আরো বলেন, মজুরি হতে হবে পরিবারের ১ জনের ৮ ঘণ্টা শ্রমেই পুরো পরিবার চলতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই পরিবারের ২/৩ জনকে কাজ করতে হয়, ১০/১২ ঘণ্টা পরিশ্রম করেও দারিদ্রসীমার নিচে বাস করতে হচ্ছে। এবার মজুরি নির্ধারণে এই অবস্থার পরিবর্তন হতে হবে।
কনভেনশনে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, স্বাধীনতার পরে ৪৭ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আজ পর্যন্ত আমাদের জাতীয় ন্যূনতম মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করা যায় নাই। বর্তমান সরকার উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় রপ্তানীখাত গার্মেন্ট খাতের শ্রমিকদের মজুরির প্রশ্ন আসলে সরকার ও মালিকপক্ষ দিশেহারা হয়ে যায়। ভারতের কৃষক-শ্রমিকরা ১৮ হাজার রুপি দাবি করেছে বাংলাদেশে যেটা দাঁড়ায় ২১ হাজার টাকা। অথচ গার্মেন্টস শ্রমিকরা দাবি করেছেন ১৬ হাজার টাকা। দেরি না করে এখনি ১৬ হাজার টাকা মজুরি ঘোষণা করেন, অন্যথায় দাবি আরো বৃদ্ধি পাবে।
সাইফুল হক বলেন, মালিকদের আশ্বাসে শ্রমিকরা আর আস্থা রাখতে পারছে না। মালিকদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, এমন এক শিল্প গড়ে তুলেছেন যেখানে শিল্পের এক পক্ষ অন্য পক্ষকে বিশ্বাস করতে পারে না। এই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব আপনাদের। তিনি দাবি করেন, জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই মজুরি নির্ধারণ করতে হবে।
চৌধুরী আশিকুল আলম পটল বলেন, বেতন কমিশন করে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন বাড়িয়েছেন ১০০ ভাগ। এ বছর জুলাই মাসে রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্প শ্রমিকদের মজুরিও বৃদ্ধি করা হয়েছে ৭০ ভাগ। তাহলে সবচেয়ে বড় রপ্তানী খাত গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে এত দীর্ঘসূত্রিতা এবং টালবাহানা কেন। অবিলম্বে ১৬ হাজার টাকা মজুরি নির্ধারনের আহ্বানা জানান তিনি। শ্রম আইনের সংশোধন বিষয়ে তিনি বলেন, শ্রমিকদেরকে আরো শক্ত শেকলে হাত পা বেঁধে ফেলার আয়োজন চলছে।
মোশরেফা মিশু বলেন, ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে জিনিস পত্রের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় শ্রমিকর আন্দোলন করেছিল। এরজন্য ১৮ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা করা হয়েছিল। ২০০০ শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে এসে মজুরি নির্ধারণ নিয়ে যে দীর্ঘসূত্রিতা আপনারা করছেন তার জবাব দেওয়া হবে। ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মজুরি নির্ধারণ করা না হলে কঠোর আন্দোলন হবে এমনকি ধর্মঘট পর্যন্ত করতে আমরা বাধ্য হবো।
কনভেনশনের শুরুতেই এ্যাড. মাহবুবুর রহমান ইসমাইল কনভেনশনের লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন।