শ্রমজীবী মানুষের জীবনে অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্যে মে দিবস পালিত হলো। শ্রমিকের রক্তে রাঙ্গানো ঐতিহাসিক মে দিবসে একদিন পুঁজিবাদী শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে শ্রমিকের আত্মদানের চেতনায় ভাস্বর সাহসী সংগ্রাম রচিত হয়েছিল, আজও এরই প্রেরণায় দুনিয়ার দেশে দেশে শ্রমিক লড়াইয়ের বলিষ্ঠ হাত তোলে। ইতিহাসে শ্রমিক শ্রেণির জন্মের সাথে সাথে যে ব্যবস্থা তার বুকে শোষণের ভার চাপিয়ে দিয়েছিল বেঁচে থাকার জন্য লড়াই ছাড়া ভিন্ন আর কোন পথ খোলা ছিল না। ১৯১৭ সালের রক্ত ঝরানো পথ পেরিয়ে রাশিয়ার বুকে প্রথম শ্রমিক শ্রেণি পেয়েছিল শোষণমুক্তির আস্বাদ। পুঁজিপতি শ্রেণির সকল শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে দুনিয়ার প্রথম শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মে দিবসের যথার্থ চেতনা প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকার পূর্ণতার রূপদানে এ রাষ্ট্র তার ঐতিহাসিক কর্তব্য পালনে ভূমিকা নিয়েছিল। তাই আজ মহান নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষের পটভূমিতে মে দিবসের তাৎপর্য্য বোঝা প্রয়োজন।
বাতাসে কান পাতলে শোনা যায় সর্বত্র শ্রমিকের কান্না। কাজ-না-পাওয়া, কাজ-হারানো আর কাজে-থাকা শ্রমিক কারও জীবনে শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। যাদের কাজ নেই তারা কাজের সন্ধানে পাগলের মত ছুটছে গ্রাম থেকে শহরে, এ শহর থেকে ও শহরে, দেশান্তরী হচ্ছে অজানা গন্তব্যে। পাড়ি দিচ্ছে বিপদসংকুল উত্তাল সমুদ্র আর গহীন জঙ্গল। প্রলোভন দেখিয়ে কখনো অসাধু চক্র কেড়ে নিচ্ছে সামান্য অবলম্বনটুকু পর্যন্ত। তাড়া খাওয়া বোধহীন জন্তুর মত যেন অবস্থা তার! আর যারা মালিকের সর্বোচ্চ মুনাফা যোগানোর যন্ত্রবিশেষ কর্মরত সেই শ্রমিককে প্রতি মূহুর্তে তাড়িয়ে বেড়ায় ছাঁটাই এর আতঙ্ক। একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চলছে লে-অফ, লক-আউট, ছাঁটাই। শ্রমিকের বেতন, বকেয়া পাওনা পরিশোধে নানা তালবাহানা মালিকের। পেনসন, গ্র্যাচুইটি পেতে ভোগান্তির কোন শেষ থাকে না। আর বেকার শ্রমিকের নেই রাষ্ট্র্রীয় বেকার ভাতা। জাতীয় ন্যূনতম মজুরীর ব্যবস্থা নেই। কোন কোন সেক্টরে ন্যূনতম মজুরীর যে ব্যবস্থা আছে তাতে মানুষের মত বেঁচে থাকা চলে না। এটা দিতেও মালিকের কুণ্ঠা, ছল-চাতুরীর আশ্রয় নেয়। শ্রম আইন মানার কোন বালাই নেই। শ্রম দপ্তরগুলো যেন একেকটা মালিকের নিরাপদ দূর্গ! মাথা খুঁড়লেও সেখানে শ্রমিকের প্রতিকারের উপায় থাকে না। শ্রমিকের স্থায়ী নিয়োগ নেই, নেই নিয়োগের স্থায়ীত্ব। স্বল্পমেয়াদী, কনট্রাকটরের অধীনে নিয়োগ, চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ ‘হায়ার এ্যন্ড ফায়ারে’র নীতি। চাকুরির নিরাপত্তা নেই। বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে সবচে’ অনিরাপদ থাকে শ্রমিক। নেই কোন সামাজিক সুরক্ষা যেমন পেনসন, বীমা ইত্যাদি। নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র পাবার অধিকারের কথা তো দুস্কর। ফলে তাড়িয়ে দিলেও মালিক থাকে ধরা ছোয়ার বাইরে। পুরানো শিল্পাঞ্চলগুলোতে কবরের নীরবতা নামিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে আলো-ঝলমল-করা নতুন শিল্পাঞ্চল। প্রথমে কয়েক দশক ই পি জেড চালু করার পর এখন গড়ে তোলা হচ্ছে এস ই জেড বা স্পেশাল ইকোনমিক জোন। কৃষি জমি ধ্বংস করে, বসত ভিটা উচ্ছেদ করে দেশী-বিদেশী মালিকদের মুনাফা লোটার নতুন মৃগয়া ক্ষেত্র। সেখানে শ্রমিক অধিকার রক্ষায় প্রচলিত শ্রম আইন কাজ করে না। নেই সংগঠিত হবার অধিকার। যে কোন বাদ প্রতিবাদ টুঁটি চেপে ধরার জন্য শিল্প পুলিশের পাহারার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। শ্রমিকের কাজের ন্যূনতম সময়সীমা নেই। অসংগঠিত ক্ষেত্রের তো হিসেব নেয়াই চলে না, সংগঠিত সেক্টরেও ১০/১২ ঘন্টা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। বেশির ভাগ কারখানায় কাজের পরিবেশ চূড়ান্তভাবে অস্বাস্থ্যকর। নারী ও শিশুদের কম মজুরীতে খাটানোর এ এক অমানুষিক বর্র্বরতা। তাদের সুবিধা-অসুবিধা দেখবে কে? শ্রমিকের প্রাণের মূল্য মালিকের কাছে নিতান্তই তুচ্ছ। রানা প্লাজায় মর্মান্তিক ঘটনা এর জীবন্ত স্বাক্ষ্য দেয়। ফাটল ধরা কারখানার কাজে অনীহা জানালেও মালিক সে আপত্তি কানে তোলেনি। ভবন ধ্বসে প্রাণ হারিয়েছিল ১১৩৫ জন শ্রমিক। নিখোঁজ, আহত ও পঙ্গু হয়েছিল ততোধিক। মালিকের কোন বিচার হয়নি। আগুনে পুড়ে, বয়লার বিস্ফোরণে শ্রমিক মৃত্যু সংবাদপত্রের প্রতিদিনের খবর। শ্রমিকের নেই পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা। শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট শ্রমিকের এমন সরব মৃত্যু আর তিল তিল করে নীরব হত্যায় ঘটে চলছে পুঁজিবাদের তথাকথিত উন্নয়নের উৎসব! আর চাকচিক্য-ঝলসানো আলোর নীচে শ্রমিকের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার।
সমাজ বিকাশের ধারায় সামন্তী সমাজের অবসান ঘটিয়ে বুর্জোয়া বিপ্লব হল। পুঁজিবাদের বিকাশের সেই কালে কল-কারখানা গড়ে উঠল। ভূমিদাসত্ব থেকে মুক্ত খেটে খাওয়া মানুষ সেদিন কারখানায় কাজ নিল। সামন্তী শোষণের অবসান হলেও নতুন এ শ্রমিক শ্রেণির উপর নতুন ধরনের শোষণের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। মালিকের লাভের ব্যবস্থা করার জন্য শুরু থেকেই শ্রমিকের থেকে যত সম্ভব খাটুনি আদায় করা হত। নির্দ্দিষ্ট সময়সীমা বলে কিছু ছিল না। ১২ থেকে ১৬ ঘন্টা শ্রম করা ছিল বাধ্যতামূলক। উনিশ শতক জুড়ে চলা এ পরিস্থিতির বিরুদ্ধে ১৮৬৬ সালে প্রথম আমেরিকায় শ্রমিক ইউনিয়ন ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন ৮ ঘন্টা শ্রমের দাবী তোলে। কার্ল মার্কসের নেতৃত্বে গঠিত প্রথম আন্তজার্তিক এ দাবিকে সমর্থন জানিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানায়। তীব্র আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৮৬৬ সালের ১ মে ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। শিকাগো শহরে এ ধর্মঘট ব্যাপকভাবে পালিত হয়। ৩ মে মার্কিন সরকারের পুলিশ বাহিনী শ্রমিকদের উপর হামলা চালায়। প্রতিবাদে পরদিন ৪ মে শিকাগোর হে মার্কেটের সভায় নৃশংস হামলায় শ্রমিক প্রাণ হারায়। ব্যাপক ধরপাকড় করা হয়। এমনকি প্রবল জনমত উপেক্ষা করে শ্রমিক নেতা পার্সন, ফিসার, স্পাইজ,এঙ্গেলকে ফাঁসি দেয়া হয়। কিন্তু তাতেও আন্দোলন দমানো যায়নি। এর ৩ বছর পর দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের নেতা মহামতি এঙ্গেলসের আহ্বানে সারা দুনিয়ায় মে দিবস হয়ে উঠে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস। এক সময় অন্দোলনের চাপে এ মে দিবস যেমন স্বীকৃতি পায় তেমনি ৮ ঘন্টা শ্রম দিবস মেনে নিতে বাধ্য হয় সমস্ত পুঁজিবাদী দেশ। এ আন্দোলনের ধারায় দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণি আরও বহু অধিকার অর্জন করে।
সর্বহারার মহান নেতা লেনিন ও তার সুযোগ্য উত্তরসূরী স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সঠিক আদর্শ ও রাজনৈতিক লক্ষ্য সামনে রেখে ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা উচ্ছেদ করে প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র। মালিকী শোষণের অবসান হয়। এ ঘটনা শ্রমিকদের শুধু অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের পথে এগিয়ে নেয়নি, প্রভূত রাজনৈতিক সামাজিক অধিকার ও উন্নত সাংস্কৃতিক জীবনের সন্ধান দেয়। সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করে মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছিল। কাজের অধিকার, সংগঠিত হওয়ার অধিকার, চাকুরির নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা যেমন- পেনসন, সামাজিক বীমা, ন্যূনতম মজুরী, কাজের ঘন্টা হ্রাস, মাতৃত্বকালীন দীর্ঘমেয়াদী ছুটির অধিকারসহ বিনোদন-বিশ্রামের সব রকম অধিকার নিশ্চিত করেছিল। এটা ১৯৩৬ সালে দুনিয়ার সবচে প্রগতিশীল সংবিধান হিসেবে স্বীকৃত সংবিধানে আইনীভাবে গৃহিত হয়েছিল। ১৯১৭ সালের বিপ্লবের মাত্র ১৩ বৎসর পরে তারা এটা সম্ভব করতে পেরেছিল। বেকারত্ব কী উন্নত কী অনুন্নত সমস্ত পুঁজিবাদী দেশের সমাজের একটা দুষ্ট ক্ষত হিসেবে যা ক্রমাগত বেড়ে চলছিল কীসের জোরে তার উচ্ছেদই শুধু করেনি বরং কাজের প্রয়োজনে রাশিয়ায় শ্রমিক পাওয়া ও অনেক সময় দুরূহ হয়ে উঠেছিল? এটা সম্ভব হয়েছিল এমন একটা সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য যেখানে শোষণ চলে না, ভাড়ায় খাটানো শ্রমিক বলে কারও অস্তিত্ব থাকে না। সবাই সমাজের জন্য শ্রমদানে স্বেচ্ছাসেবী আত্মত্যাগী মনোভাব লালন করে যে শ্রম ক্রিয়াকলাপের পরিস্থিতি তৈরী করে তারই অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ এটা ঘটে। এটা সমাজতন্ত্রের মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ শ্রমিক শ্রেণির এক ঐক্যবদ্ধ বিশাল বাহিনীর যথার্থ শ্রেণি চেতনার শক্তির জোরে ঘটতে পেরেছে। পরবর্তীতে স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর সংশোধনবাদীরা রাষ্ট্র ও পার্টির নেতৃত্ব দখল করে প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের পতন ঘটায়। ফলে একদিকে যেমন তারা সমস্ত অর্জিত অধিকার হারায় এবং পুঁজিবাদী করাল গ্রাস সমাজ জীবনে আবারো অধঃপতন ডেকে আনে। এ অভিজ্ঞতা রাশিয়ার শ্রমিকের মত দুনিয়ার সমস্ত শ্রমজীবী মানুষ মহান নভেম্বর বিপ্লবে যে পথ আঁকা হয়েছিল, যে পথে এগিয়ে যাবার প্রেরণা বহন করে। এ পথেই আজ শ্রমিক শ্রেণির মুক্তিপথের সন্ধান মিলবে। এ পথেই এ দেশেরও ভবিষ্যত- মে দিবস বারে বারে আজ সে কথা বলে যায়।