জানুয়ারি মানেই তো শিশু কিশোরদের নতুন ক্লাস, নতুন বই। নতুন ক্লাসে ওঠা আর নতুন বইয়ের গন্ধ সবারই স্বপ্ন। আমাদের দেশে এই স্বপ্ন এখন অভিভাবকের দুঃস্বপ্ন। স্কুলের বিপুল ভর্তি ফি, উচ্চ বেতন, কোচিং-গাইডের খরচের দৌরাত্ম্যে সাধারণ মানুষের কাছে শিক্ষা সোনার হরিণে পরিণত হচ্ছে। কায়েম করা হয়েছে ‘টাকা যার শিক্ষা তার’ নীতি। এই নীতির বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করছে। তারই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামে সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তুকি কমিয়ে বেতন-ফি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন পরিচালনা করে ছাত্র ফ্রন্ট।
‘এক টাকাও বাড়তি ফি ছাত্র সমাজ দেবে না’ এ স্লোগান আজ সারাদেশেই উঠেছে। শুরুটা হয়েছে সূর্যসেন আর প্রীতিলতার চট্টগ্রামে। চসিকের নতুন মেয়র তার আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব নেয়ার আগেই আক্রমণ করে বসলেন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতকে। ২০ মে ’১৫ তারিখে ঘোষণা দিলেন চসিক পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তুকি কমিয়ে বেতন-ফি বাড়ানো হবে। এই অযৌক্তিক অগণতান্ত্রিক প্রস্তাব প্রত্যাহারের দাবিতে ছাত্র ফ্রন্ট লাগাতার আন্দোলনের ঘোষণা দেয়। তারই অংশ হিসেবে চট্টগ্রামে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ, মতামত সংগ্রহ, বিশিষ্টজনদের বিবৃতি প্রদান, পথসভা, মেয়রকে স্মারকলিপি প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী জনস্বার্থ বিরোধী কথার হেরফের করে না। তাই জনগণের কোনো মতামতকে তোয়াক্কা না করে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন ধ্বংসের মুখে ফেলে ৬ ডিসেম্বর ’১৫ তারিখে চসিকের প্রথম সাধারণ সভায় ভর্তি ফি ও বেতন শতভাগ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
স্বাধীনতার পরবর্তিতে চট্টগ্রামে কোনো সরকারি মাধ্যমিক স্কুল নির্মিত হয়নি। বিশাল সংখ্যার শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র ৯টি সরকারি স্কুল আছে। উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ আছে মাত্র ৬টি। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে চসিকের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায় ৯০ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করে। এই বর্ধিত ফি বাতিল না হলে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
এই সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে চট্টগ্রামের ৩২ জন বিশিষ্ট নাগরিক বিবৃতি প্রদান করেন। আইনজীবী, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ প্রায় ১০ সহস্রাধিক মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে শতশত শিক্ষার্থী অভিভাবকবৃন্দসহ মেয়র বরাবর দুই দুই বার স্মারকলিপি পেশ করা হয়। গত ৬ জানুয়ারি স্মারকলিপি পেশকালে আন্দরকিল্লার ব্যস্ততম সড়ক দু’ঘণ্টার জন্য অবরোধ করা হয়। প্রতিটি সংবাদপত্রে এ আন্দোলন কর্মসূচিগুলো গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হয়েছে। আন্দোলনের পক্ষে সংবাদপত্রে বিশেষ প্রতিবেদন, কলাম এবং চট্টগ্রামের ৩২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিবৃতিসহ অভিভাবকদের চিঠি প্রকাশ করা হয়। গণমানুষের মতামত বেতন-ফি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে হলেও এবং শিক্ষার্থী অভিবাবকরা টানা কর্মসূচি পালন করলেও মেয়র তার অবস্থানে অনড়। এই দাবিতে পাড়ায় পাড়ায় শিক্ষার্থী অভিভাবকদের নিয়ে গণ কমিটি তৈরির ভিত্তিতে বর্তমানে ‘চসিক পরিচালিত শিক্ষার্থী অভিভাবকবৃন্দে’র ব্যানারে আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে। গত ১০ জানুয়ারি এই ব্যানারে মেয়র বরাবর স্মারকলিপি পেশ কর্মসূচিতে মেয়র অভিভাবকদের সাথে আলোচনায় না এসে অগণতান্ত্রিক, ফ্যাসিস্ট কায়দায় পুলিশ দিয়ে হামলা চালায়। অভিভাবকরা সেদিন ভয়ভীতি উপেক্ষা করে তাদের প্রাণের দাবিতে আরো সংগঠিত হয়।
১২ জানুয়ারি সংহতি সমাবেশ এবং ১৯ জানুয়ারি অভিভাবক শিক্ষার্থীরা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে শিক্ষামন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত চালিয়ে যাবেন বলে ঘোষণা করেন।
সারাদেশের বেসরকারি স্কুলে বিশেষত ঢাকা ও চট্টগ্রামের স্কুলগুলোতে অস্বাভাবিক হারে বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল, উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল, মিরপুরের শহীদ পুলিশ স্মৃতি স্কুল, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং বাংলাদেশ ব্যাংক আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়, রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বিয়াম স্কুল, সেন্ট যোসেফ স্কুলে ৫০ থেকে ১০০ ভাগ বেতন বাড়ানো হয়েছে। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে শ্রেণিভেদে কমপক্ষে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা বেতন বাড়ানো হয়েছে। প্রিপারেটরিতে ভর্তি ফি এ বছর দ্বিগুণ বাড়িয়ে ৫ হাজার টাকার বদলে আদায় করা হচ্ছে ১০ হাজার টাকা। মিরপুরের শহীদ পুলিশ স্কুলে বেতন বেড়েছে ৪ হাজার ৭৬৫ টাকা।
এই অস্বাভাবিক বেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদে ছাত্র ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে ১৭ জানুয়ারি দুপুর ১২টায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। মিছিলটি পুরাতন ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে শুরু হয়ে কলেজিয়েট স্কুল, লক্ষ্মীবাজার ঘুরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে সমাবেশে মিলিত হয়। করেন সংগঠনের ঢাকা নগর শাখার সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নাঈমা খালেদ মনিকার সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ছাত্রনেতা মলয় সরকার, রাশেদ শাহরিয়ার, ইভা মজুমদার, মেহরাব আজাদ। পরে একটি প্রতিনিধি দল জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি পেশ করে।
সভাপতির বক্তব্যে নাঈমা খালেদ মনিকা বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালায় বলা আছে, ঢাকা মেট্্েরাপলিটন এলাকায় নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থী ভর্তির সময় মাসিক বেতন, সেশন চার্জ, উন্নয়ন ফিসহ বাংলা মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকা এবং ইংরেজি মাধ্যমে (ভার্সন) সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা নেয়া যাবে। অথচ বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই বেতন বাড়িয়েছে ৪০ থেকে ১০০ ভাগ পর্যন্ত। ইতোমধ্যেই উচ্চ আদালতের রায়ে সরকারি ভর্তি নীতিমালার বাইরে ফি গ্রহণের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এই নীতিমালা মেনে চলবে এবং শিক্ষা মন্ত্রলালয় এই ফি গ্রহণের ব্যাপারট্ িপর্যবেক্ষণ করবে বলেও এই আদেশে বলা হয়েছে। অথচ কোনো দিক থেকেই এই নিয়মের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। যেসব স্কুল বেতন বাড়িয়েছে তাদের বিরুদ্ধে এখনও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। শিক্ষাকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করার এই অশুভ চক্রান্তের বিরুদ্ধে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’ নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে ফি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য জেলা প্রশাসকের প্রতি আহ্বান জানান।
একইদিন বিকাল ৪টায় মিরপুর সাড়ে ১১ নম্বরে রংধনু মার্কেটের সামনে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচি পালিত হয়।