৮ জানুয়ারি ১৬৪২, সৌরজগতের ধারণাকে আমূল পাল্টে দেয়া বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি এদিন মৃত্যুবরণ করেন। তার ঠিক তিন শতক পরে ১৯৪২ সালের ৮ই জানুয়ারিতে অক্সফোর্ডে জন্ম হয় আরেক প্রথিতযশা বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং-এর; যিনি পুনর্বার আমাদের সামনে মহাকাশের গঠন এবং বিকাশের রহস্যকে অনেকটাই উন্মোচিত করে তাকে শক্ত বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছেন।
ছোটবেলা থেকেই নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেধাবী হিসেবে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন হকিং। নির্ধারিত সময়ের এক বছর আগেই কলেজের গন্ডি পেরোন তিনি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে পাস করে পিএইচডি করতে চলে যান কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে এসেই তাঁর মোটর নিউরনের জটিল রোগ ধরা পরে। তরুণ স্টিফেনের বয়স তখন মাত্র ২১ বছর। আর দু’টো বছর বাঁচবেন কিনা এই নিয়ে তাঁর চিকিৎসকরা যখন সন্দিহান জীবনের এমন কঠিন মুহুর্তে তাঁর পাশে দাঁড়ান জেইন ওয়াইল্ড। জেইনের সার্বক্ষণিক সহযোগিতা তাঁকে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে অনুপ্রাণিত করে।
মারাত্মক শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়েও সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের বৈশিষ্ট্য নিয়ে তিনি সফলভাবে তাঁর গবেষণা কাজ শেষ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সৃষ্টিতত্ত্বে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সম্প্রসারিত প্রয়োগ নিয়ে গবেষণা করেন এবং পরবর্তীতে কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। তিনিই প্রথম দেখান যে কৃষ্ণগহ্বর অতল ঝুড়ির মতো সমস্ত কিছু (এমন কী আলো পর্যন্ত) কেবল শুষেই নেয় এমন নয়, এখান থেকে বিকিরণ বের হবার ঘটনাও ঘটে। বৃহদাকার বস্তুদের রাজ্যে অদ্বিতীয় তত্ত্ব আপেক্ষিকতা আর অতি ক্ষুদ্রদের ধর্ম অব্যর্থভাবে বর্ণনাকারী কোয়ান্টাম তত্ত্বের মেলবন্ধন ঘটিয়ে তিনি ‘সৃষ্টিতত্ত্ব’ এবং ‘কৃষ্ণগহ্বরের’ তাত্ত্বিক ভিত্তি দাঁড় করান, যাতে একই সাথে প্রায় অসীম ভর এবং খুবই ক্ষুদ্র আয়তনকে বিবেচনায় আনতে হয়।
বিজ্ঞানচিন্তায় নিবেদিত প্রাণ হকিং সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর অর্জিত জ্ঞান পৌঁছে দেয়া নিয়েও সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। মানুষ যাতে সহজে সৃষ্টিতত্ত্ব বুঝতে পারে সেই ভাবনা থেকেই ১৯৮২ সালে কালজয়ী গ্রন্থ ‘A Brief History of Time’ রচনার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ১৯৮৪ সালে বাকশক্তি হারিয়ে শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয়ে কোমাতেও চলে যান তিনি। তবু তাঁর অদম্য ইচ্ছাশক্তির বলে শেষপর্যন্ত ১৯৮৮ সালে বইটি প্রকাশিত হয়।
নিজের শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে এভাবেই প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ করেছেন তিনি আজীবন। এবং অনেক সুস্থ স্বাভাবিক তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের ক্ষেত্রেও যা বিরল, একটি হুইল চেয়ারে শারীরিকভাবে বন্দী থাকা সত্ত্বেও মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সপক্ষে সর্বদা সোচ্চার ছিলেন তিনি। ছোট বয়সেই মার সাথে অংশ নিয়েছিলেন ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। ইরাক আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও একই ভূমিকায় আমরা তাকে দেখতে পেয়েছি বারবার। ফিলিস্তিনের জনগণের উপর ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদস্বরূপ ইসরায়েল বয়কট আন্দোলনেও অংশ নিয়েছেন তিনি। স্বাস্থ্যসেবাকে সাধারণ মানুষের আওতায় নিয়ে আসার জন্যে অনেক গণশুনানি, সেমিনারে তিনি তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। পুঁজিবাদের কঠোর সমালোচক এই বিজ্ঞানীকে যখন যন্ত্রনির্ভর ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে মানুষের জন্যে শঙ্কার কারণ মনে করেন কিনা — এমন প্রশ্ন করা হলে বলেন, বরং এর চেয়ে পুঁজিবাদের বিপদকে বড় করে ভাবেন বলে জানিয়েছেন। তাঁর মতে যন্ত্র দ্বারা আমাদের সমস্ত কিছু উৎপাদিত হলেও তাঁর ফলাফল মূলত নির্ভর করবে বন্টন ব্যবস্থার উপর। যদি তাতে আমাদের সকলের সমান অংশীদারিত্ব থাকে তবেই কেবল আমাদের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধ হবার আশা করা যায়। কিন্তু যদি যন্ত্রের মালিকরা তার একচ্ছত্র দখল নেয়, তবে তাঁর আশঙ্কা ছিল, তাতে করে বৈষম্য বরং আরও বাড়বে। জ্ঞানবিজ্ঞানের অবাধ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী এই বিজ্ঞানী কপিরাইটের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান জানাতে নিজের পিএইচডি থিসিসকে সকলের জন্যে উন্মুক্ত করে গেছেন। গ্যালিলিওর মৃত্যু তিথিতে জন্ম নেয়া মহৎপ্রাণ অনুসরণীয় মানুষটির মৃত্যু ঘটে এ বছরের ১৪ মার্চ, বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের জন্মদিনে, যার নামে তাঁকে তাঁর বন্ধুরা কলেজ ভার্সিটিতে ডাকত!