Tuesday, December 24, 2024
Homeফিচারস্বাধীনতার ৪৬ বছর — কী পেল দেশের মানুষ?

স্বাধীনতার ৪৬ বছর — কী পেল দেশের মানুষ?

freedom-fighter2 copy

এবছর স্বাধীনতা যুদ্ধের ৪৬ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। গোটা দেশজুড়ে মহাসমারোহে উদযাপিত হবে বিজয় দিবস। প্রতিবছরই হয়। এবছরও হবে। উন্নয়নের ঢামাঢোল আর মুক্তিযুদ্ধে শাসকদল আওয়ামী লীগের কৃতিত্ব প্রচারে ব্যস্ত রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমসহ সমস্ত গণমাধ্যম। এই প্রচারের জৌলুস এড়িয়ে কেউ চোখ রাখবে কি সত্যিকারের ইতিহাসের দিকে? গত ৪৬ বছরে যারাই ক্ষমতায় এসেছে — নিজেদের মত করে সাজিয়েছে ইতিহাসের বয়ান। তাদের সেই কীর্তিস্তম্ভে চাপা পড়েছে এদেশের শ্রমিক-কৃষকের কণ্ঠস্বর। যে হাড়জিরজিরে কৃষক-শ্রমিক একদিন নেংটি পড়ে জীবন মৃত্যু তুচ্ছ করে ঝাপিয়ে পড়েছিল স্বদেশকে মুক্ত করার ব্রতে, যে ছাত্র একদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর তথাকথিত ভবিষৎ ক্যারিয়ারের স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে জীবন আহুতি দিয়েছিল দেশবাসীর স্বপ্নপূরণে — আজকে বিজয় দিবসের সভায়- স্লোগানে তাদের নাম নেই, তাদের স্বপ্নের কথা সেখানে আর উচ্চারিত হয় না। ঘর-বাড়ি, বাবা-মা, প্রিয়জনের সান্নিধ্য ছেড়ে কোন্ স্বপ্নে তারা জীবন বাজি রেখেছিল?

পাকিস্তানি প্রায়-ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণে প্রাণ ওষ্ঠাগত শ্রমিক চেয়েছিল এমন একটি দেশ — যেখানে মানবিক জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সে সংগ্রহ করতে পারবে এমন মজুরি, কৃষক চেয়েছিল— তার শ্রমে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম সে পাবে, বারো মাস খাবার জুটবে, সন্তানের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারবে। ছাত্ররা চেয়েছিল — একটি মানুষও যেন শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, অর্থের প্রাচীর যেন শিক্ষাগ্রহণের পথে বাধা হয়ে না দাড়ায় — এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা। সর্বোপরি সবাই স্বপ্ন দেখেছিল এমন একটি গণতান্ত্রিক ও মানবিক সমাজের — যেখানে সমস্ত মানুষের মানবিক গুণাবলি বিকাশের সুযোগ অবারিত হবে, ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়-লিঙ্গের প্রভেদ থাকবে না। সবাই স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ পাবে। স্বাধীনতার ৪৬ বছরে তাদের সে স্বপ্ন কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে?

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খা — স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি সেই আকাক্সক্ষার বিপরীতেই দেশ পরিচালিত হয়েছে। সমাজের কোনো স্তরেই গণতান্ত্রিক চেতনার বিস্তার তো হয়ইনি বরং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের শাসক নির্বাচনের যে পদ্ধতি প্রচলিত বর্তমানে আওয়ামী লীগের শাসনামলে তাও ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। ‘কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন’ স্লোগান তুলে আওয়ামী লীগ সরকার পাকিস্তান আমলের আইয়ুবী স্বৈরাচারী ব্যবস্থার নতুন সংস্করণ চালু করেছে। জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনামলেও এই উন্নয়নের স্লোগান আমরা শুনেছি। যে কোনো স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় জনগণকে বিভ্রান্ত ও ভুলিয়ে রাখার মন্ত্র হিসেবে এই উন্নয়নের স্লোগান একটি চটকদার বিজ্ঞাপন মাত্র। এতে বড় বড় তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হয়। আওয়ামী লীগ সরকারও পদ্মাসেতু, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বড় বড় প্রকল্প নিয়ে জনগণকে বোঝাতে চাইছে দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। সত্যিই কি তাই? তাহলে উন্নয়ন বলতে আমরা কী বুঝবো? গণতন্ত্র বিসর্জন দেওয়াও কি উন্নয়নের লক্ষণ?

উন্নয়ন কখনো গণতন্ত্রের বিকল্প হতে পারে না। দীর্ঘ ২৩ বছরের পাকিস্তানি স্বৈরাচারী ব্যবস্থাকে প্রত্যাখান করে এদেশের মানুষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিল। কারণ স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার, চাওয়া-পাওয়ার প্রতিফলন ঘটে না। ক্ষমতার সুবিধাভোগী মুষ্টিমেয়দের স্বার্থ রক্ষিত হয়। সেই ধারাতে পাকিস্তানে গড়ে উঠেছিল ২২ পরিবার। যারা দেশের অর্থনীতি-রাজনীতি সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করত। তাদের রাহুগ্রাস থেকে মুক্তির প্রত্যয়েই জনগণ মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। দেশ স্বাধীন করেছিল। স্বাধীন দেশেও কয়েক দফা সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার আশায়। সেই আকাক্সক্ষার সুযোগ নিয়ে এখন আওয়ামী লীগ সরকার সংসদীয় স্বৈরাচারী ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। ফলে শাসন পদ্ধতির দিক থেকে দেখতে গেলে এটা স্পষ্টতই পশ্চাদপসরণ, অগ্রগমন নয়।

একইভাবে উন্নয়ন মানে একটি দেশের মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে সম্পদের পুঞ্জীভবন ও প্রবৃদ্ধি নয়, দেশের মানুষের সামগ্রিক জীবনমানের ও জীবনযাত্রার উন্নয়ন। সেই নিরিখে এদেশের মানুষের জীবনমানের কতটুকু উন্নতি হয়েছে? পরাধীন দেশে ছিল ২২ পরিবারের রাজত্ব। আর স্বাধীন দেশে তার স্থলে গজিয়েছে ৫০ হাজার কোটিপতি। আয়কর জমা দেয়ার নিরিখে এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব। সম্পদের পরিমাণ গোপনীয় রাখার প্রবণতা হিসাব করলে এই সংখ্যা বাস্তবে আরও বেশি হবে। এদের হাতে কোটি টাকা থেকে শুরু করে হাজার হাজার কোটি টাকা জমা হয়ে আছে। এইভাবে গত ৪৬ বছরে একদিকে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ গড়ে তুলেছে বৈভবের পাহাড়। অন্যদিকে ৪ কোটি মানুষ এখনও দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে। জনসংখ্যার ২৫ ভাগ মানুষ তিনবেলা খেতে পায় না — কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে জীবন ধারণ করছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের থাকার কোনো জায়গা নেই। উদ্বাস্তু হয়ে ঢাকা শহরের ফুটপাতে খোলা আকাশের নীচে রাত্রিযাপন ও মানবেতর জীবনযাপন করছে। এইসব মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সরকারি ‘উন্নয়নে’র পরিসংখ্যানে এইসব মানুষের ঠাঁই নেই। তাহলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার সত্যিকারের চিত্র কী?

নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত সাধারণ আয়ের মানুষ বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ডাল-ভাত জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে। এই অবস্থায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। চালের মূল্য অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এক কেজি মোটা চালও ৫০ থেকে ৬০ টাকায় ক্রয় করতে হচ্ছে। পেঁয়াজের কেজি ১০০ টাকা ছুঁয়েছে। এই সরকারের দু’বারের মেয়াদে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৮ বার। গ্যাসের মূল্য ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বেড়েছে গাড়ি ভাড়া-বাড়ি ভাড়াসহ সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘নাম্বিও’র জীবনযাত্রার একটি সূচক প্রকাশ করেছে। যেখানে দেখা যায় দক্ষিণ এশিয়ায় জীবনযাত্রার খরচ সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত একবছরে পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়েছে শতকরা ১২.১৭ শতাংশ, বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ২২ শতাংশ। কিন্তু মানুষের আয় কি বেড়েছে এই হারে?
অথচ প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, প্রবৃদ্ধি বাড়ছে বলে সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা যে গলা ফাটায় — সেই প্রবৃদ্ধি অর্জনেও এদের ভূমিকাই প্রধান। কিন্তু প্রবৃদ্ধির সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে কি?

সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্রীয় ব্যাংক থেকে গত কয়েক বছরে অর্থ লোপাটের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। শুধু এক বেসিক ব্যাংক থেকেই লুট হয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ বাড়ছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। । মনে আছে — কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করতে না পারায় একজন মুক্তিযোদ্ধাকে কীভাবে লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল? অথচ বড় বড় রাঘব বোয়ালরা যখন নানা অছিলায় ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করছে তখন সরকারের টুঁ শব্দটিও নেই। শুধু খেলাপি ঋণ নয় বাড়ছে জাতীয় ঋণ বা মাথা পিছু ঋণের পরিমাণও। এদেশে একজন শিশু ভূমিষ্ঠ হয় ৪০ হাজার টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে। জাতীয় ঋণের পরিমাণ অর্থবছর শেষে দাঁড়াবে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা। যা মোট জিডিপি’র ৩৪.৫ শতাংশ। আর মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৬ হাজার টাকায়। অনেকের বার্ষিক আয়ের থেকেও যা বেশি। অথচ মাথাপিছু আয় বাড়ছে, দেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছে — এই নিয়ে কত উচ্চবাচ্য সরকারের। কিন্তু আমরা জানি ৪ কোটি মানুষ এখনো দৈনিক ১ ডলারও আয় করতে পারে না।

জনগণের মেহনতের টাকায় হরিলুট তো চলছেই। সেই সাথে চলছে প্রাকৃতিক সম্পদের লুণ্ঠন। খাল-বিল-নদ-নদী-বন সবর্ত্র ভূমিদস্যুদের আগ্রাসন। আর মাটির নীচে যে প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাস-কয়লা — এগুলোও বিদেশি কোম্পানির কাছে ইজারা দিয়ে দেশের সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দিচ্ছে সরকার। সেই গ্যাস আবার বর্ধিত দামে কিনছে। এই কেনা-বেচার প্রক্রিয়ায় জনগণের টাকা চলে যাচ্ছে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী শ্রেণির হাতে। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হচ্ছে বেসরকারি উদ্যোগে। যার উৎপাদন খরচ ৮ থেকে ৯ গুণ বেশি। সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত এক তথ্যে দেখা যায়, দেশে বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর নিট মুনাফার গড় পৃথিবীতে সর্বোচ্চ ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত। যা প্রতিবেশী ভারতে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ পর্যন্ত। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলেও দেশে সরকার তেলের দাম কমাচ্ছে না। রাষ্ট্রীয় কোম্পানি পেট্্েরালিয়াম কর্পোরেশনও এই খাত থেকে লাভ করছে। গত বছরেই লাভ করেছে ৭ হাজার ৩৩৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা।
লুটপাট-চুরি-দুর্নীতি বিভিন্ন পন্থায় ৪৬ বছরে এক শ্রেণির মানুষ বিপুল বৈভবের মালিক হয়েছে। কিন্তু দেশে শিল্পায়ন হচ্ছে না। দেশে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমাগত কমতে থাকায় মালিকরা শিল্পে বিনোয়োগে উৎসাহী নয়। ফলে মালিকের স্বার্থরক্ষক সরকার মানুষের মৌলিক অধিকার শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ সেবাখাতে বিনিয়োগের সুযোগ করে দিচ্ছে। তাই শিক্ষা-স্বাস্থ্যও আজ কেনা-বেচার পণ্যে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতার এত বছরেও সর্বজনীন শিক্ষার ধারণা একটা ফাঁকা বুলি হয়ে আছে মাত্র। ইউনেস্কোর তথ্যমতে, দেশে শিক্ষার হার এখনো ৪৭.৫০ শতাংশ। যারা শিক্ষাঙ্গনে যাবার সুযোগ পায় অর্থের অভাবে বড় একটা অংশ নানা স্তরে ঝরে যায়। ঝরে পড়ার হার রোধে সরকারের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। বর্তমানে বাজেটের আকার বাড়লেও বরাদ্দ কমতে কমতে দাড়িয়েছে ৫.৭৮ ভাগ। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও অনুরূপ অবস্থা। দেশে ৫০ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা সুবিধা বঞ্চিত। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করতে না পেরে ধুঁকে ধুঁকে জীবনের পথ চলছে। চিকিৎসার কামনা করতে পারে না বরং মৃত্যুকে কামনা করে। অন্যদিকে এই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে চলছে রমরমা ব্যবসা। একের পর এক গড়ে উঠছে বেসরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও ক্লিনিক। গাইড বই ও কোচিং ব্যবসাও জমজমাট। এই প্রক্রিয়ায় ফুলে ফেঁপে উঠছে ব্যবসায়ী শ্রেণি।

শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও অবনমন ঘটছে। ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচনে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনের প্রকোপ বেড়েছে। সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিয়ে ফ্যাসিবাদী শাসনের ভিত মজবুত করছে। ক্রমাগত বেড়েছে দলীয়করণ। প্রশাসনসহ সর্বক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপ বেড়েছে। বিশেষত সম্প্রতি ষোড়শ সংশোধনীর রায়কে কেন্দ্র করে প্রধান বিচারপতিকে যেভাবে অপদস্থ ও হেনস্তা করে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে তা শুধু বাংলাদেশে নয়, পুরো বিশ্বেই নজিরবিহীন। কোনো সমালোচনা, কোনো বিরোধী মত সরকার সহ্য করতে পারছে না। তাই সরকারের অপকর্মের বিরুদ্ধে মানুষের কণ্ঠরোধ করার জন্য তথ্য প্রযুক্তি আইনে ৫৭ ধারাসহ একের পর এক কালো আইন তৈরি করছে। পাস করেছে ‘দায় মুক্তি আইন ২০১০’। রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎখাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের অনিয়মের বিরুদ্ধে কেউ যাতে আদালতের আশ্রয় নিতে না পারে সেজন্য। এই হলো ‘গণতান্ত্রিক’ সরকারের গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের নমুনা। এই হলো মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধে চেতনা!
সরকারের দমনমূলক-কর্তৃত্বমূলক শাসনের ফলে সামাজিক সাংস্কৃতিক জীবনে তার প্রভাব পড়ছে। সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। বাড়ছে গুম-খুনের ঘটনা। সম্প্রতি জঙ্গিবাদ বিষয়ক গবেষণারত নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোবাশ্বার হাসান সিজার নিখোঁজ হয়েছেন। এখনো তার সন্ধান মেলেনি। তার মধ্যেই খবর এসেছে সাবেক একজন রাষ্ট্রদূত নিখোঁজ হয়েছেন। এইচ আর ডব্লিউ বলছে, ২০১৭ সালের প্রথম পাঁচ মাসেই এরকম ৫৭ জন ব্যক্তি গুমের শিকার হয়েছেন।গুম-খুন-অপহরণ-শিশু নির্যাতন-নারী নির্যাতন — এসব নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানীতে কয়েকদিন আগে পরপর জোড়া খুনের ঘটনা ঘটল। এসব ঘটনায় দেখা যায়, পারিবারিক কলহ-দাম্পত্য কলহ বাড়ছে। বাড়ছে নারী নির্যাতন। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচির আওতায় তৈরি এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৬ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৮২৫টি। আর ২০১৭ সালের একই সময়ে ৯ হাজার ১৯৫টি নারী নির্যাতনের ঘটনা। যা শতাংশের হিসাবে ৫৮ ভাগ বেশি।

এই তো স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর আমাদের দেশের পরিস্থিতি। উন্নতির চিত্র! রাস্তায় চলতে ফিরতে বিলবোর্ডে কিংবা সরকারি বিজ্ঞাপনে যে উন্নয়নের চিত্র আমাদের দেখানো হয় তার সাথে বাস্তব চিত্রের কোনো মিল নেই। কিন্তু কেন নেই? কেন দেশের আজ এই পরিস্থিতি তার সঠিক কারণটা কি আমরা কখনো বোঝার চেষ্টা করেছি?

মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র অকাতরে প্রাণ দিলেও, জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করলেও সে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল এদেশের উঠতি ধনিকশ্রেণির দল আওয়ামী লীগ। স্বাধীনতার পর তাদের নেতৃত্বে সেই ধনিক শ্রেণির স্বার্থরক্ষার জন্য পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। আর পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল নিয়মই হলো শোষণ। শোষণ করেই মালিকের মুনাফা বাড়ে। তাই মালিক শ্রেণির দল হিসেবে ক্ষমতায় এসে বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলো মালিকদেরই স্বার্থ রক্ষা করে, মালিকদেরই উন্নয়ন হয়। তাই এদেশে আজ ২ জন কোটিপতির জায়গায় ৫০ হাজার কোটিপতি তৈরি হয়। অন্যদিকে দারিদ্র্য বাড়ে, বৈষম্য বাড়ে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের ৪৬ বছর পর প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির খতিয়ান মেলাতে চাইলে আমাদের একথা বুঝতে হবে — শোষণমুক্ত মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে হলে শোষণের বৃষবৃক্ষ যে পুঁজিবাদ — তাকে উপড়ে ফেলতে হবে। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। না হলে শোষণমুক্তির স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments