Tuesday, December 24, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - জুলাই ২০১৮স্যাটেলাইটের ভাবমূর্তি ও হিসাবের অতি-স্বচ্ছতা

স্যাটেলাইটের ভাবমূর্তি ও হিসাবের অতি-স্বচ্ছতা

Bangabandhu-1
গত ১২ মে মহা আড়ম্বরের সাথে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে দেশের প্রথম স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু-১’। আগামী ৩ মাসের মধ্যে স্যাটেলাইটটি সেবা দেয়া শুরু করবে। স্যাটেলাইটটির জীবনকাল ১৫ বছর। নিজস্ব স্যাটেলাইটের অধিকারী বিশ্বের ৫৭তম দেশ বাংলাদেশ।

গত ১৬ মে এক অনুষ্ঠানে সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জানিয়েছেন, এই স্যাটেলাইট নির্মাণ ও উৎক্ষেপণের জন্যে যত ব্যয় ধরা হয়েছিল তার চেয়ে ২০০ কোটি টাকা কম হয়েছে। প্রকল্পের শুরুতে এর মোট খরচ ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৯৬৭ কোটি ৯৫ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। স্যাটেলাইটের কাঠামো, উৎক্ষেপণ-ব্যবস্থা, ভূমি ও মহাকাশের নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা, ভূ-স্তরে দুটি স্টেশন পরিচালনা ও ঋণের ব্যবস্থা করেছে ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠান থ্যালেস এলেনিয়া স্পেস। যদিও এই নির্মাণ ব্যয় সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট তথ্য সংবাদমাধ্যমগুলোতে পাওয়া যায়নি।

সরকারের পক্ষ থেকে প্রদত্ত তথ্যে আরো জানা গেছে, স্যাটেলাইটটিতে ৪০টি ট্রান্সপন্ডার থাকবে। ২০টি ট্রান্সপন্ডার বাংলাদেশের ব্যবহারের জন্য এবং বাকি ২০টি ট্রান্সপন্ডার বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দেয়া হবে। ডিটিএইচ (ডাইরেক্ট টু হোম) সেবা, স্যাটেলাইট টেলিভিশনের সম্প্রচার এবং ইন্টারনেট সুবিধাসহ ৪০ ধরনের সেবা পাওয়া যাবে এই স্যাটেলাইট থেকে। বর্তমানে বিদেশি স্যাটেলাইটের ভাড়া বাবদ প্রতিবছর ১ কোটি ৪০ লাখ ডলার খরচ হয়। (১২ নভেম্বর ২০১৫, প্রথম আলো) সরকার আশা করছে, স্যাটেলাইট ভাড়া বাবদ ব্যয় হওয়া এ অর্থ সাশ্রয় হবে। (মে ১৬ ২০১৮)

‘বঙ্গবন্ধু-১’ একটি জিও-স্টেশনারি স্যাটেলাইট বা ভূ-স্থির উপগ্রহ। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কক্ষপথে পৃথিবীর সাথে একই গতিতে ঘুরবে। ৩৬ হাজার কি.মি. উপর থেকে এটা পৃথিবীর সাথে সাথে ঘুরবে। এর ওজন প্রায় ৩৬০০ কেজি।
আমরা স্যাটেলাইটের জটিল কারিগরি নানা দিক নিয়ে আলোচনা করে পাঠকদের ভারাক্রান্ত করতে চাই না। যে দু-চারটি তথ্য সংবাদমাধ্যমে এসেছে সেগুলো ধরে কিছু বিষয় তুলে ধরতে চাই।

ছয়বার উৎক্ষেপণের তারিখ পরিবর্তনের পর ৭ম তারিখে প্রথম দফায় ব্যর্থতার পর দ্বিতীয় দফায় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়। এছাড়া স্যাটেলাইটটি ফ্রান্স থেকে আমেরিকার ফ্লোরিডায় নেওয়ার পর প্রথম পরীক্ষাতেই তাতে ত্রুটি ধরা পড়ে। আবহাওয়া জনিত সমস্যায় কিছু করার থাকে না। কিন্তু কেউ যদি পুরো ঘটনাবলী খেয়াল করেন তাহলে দেখতে পাবেন যে বিষয়টি সম্পর্কে সরকারের মন্ত্রী-আমলাদের অজ্ঞতা এবং রাজনৈতিক প্রচারণার তাগাদা বিষয়টিকে জটিল করেছে। ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে – এত বিপুল ব্যয়ে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ দেশের কি কাজে লাগবে? এতে কার লাভ হবে?

ব্যয় ও মালিকানা
সরকারের পক্ষ থেকে জোর গলায় দাবি করা হয়েছে যে এর ব্যয় ও মালিকানায় কোনো অস্বচ্ছতা নেই। কিন্তু সরকারের দাবি মেনে নেয়া সত্যিই কঠিন।

(১) ৪ মার্চ দৈনিক প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, “বেক্সিমকো গ্রুপ এবং বায়ার মিডিয়া এই পুরো টিভি চ্যানেল ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দ এবং সিগন্যাল বিকিকিনির পুরো ব্যবসায়িক দিকটি উপভোগ করবে। এদের ছাড়া অন্য কোনো কোম্পানি এখানে ডিটিএস প্রযুক্তির ব্যবসায় নামতে পারবে না বলে জানানো হয়েছে।” ওই সংবাদে আরো বলা হয়েছে – “কোন্ পন্থায় মাত্র দুটি কোম্পানিকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান বিটিআরসির চেয়ারম্যান। তিনি জানান, ‘এটি তথ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত। এটা স্পর্শকাতর একটি বিষয়, আমার কাছে সঠিক উত্তর নেই’।”

(২) ব্যয়ের ক্ষেত্রেও কিছু অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। স্যাটেলাইটের নির্মাণ ও উৎক্ষেপণে সরকারের তহবিল থেকে দেয়া হচ্ছে ১ হাজার কোটি টাকা। আর ঋণ হিসাবে এইচএসবিসি ব্যাংক থেকে বাকি ১ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা নেয়া হয়েছে। এই যে ঋণ নেয়া হল, তার সুদ কত? সেটা কি ব্যয়ের হিসাবে ধরা হয়েছে? সম্ভবত না।

(৩) একই সাথে এই স্যাটেলাইট পরিচালনার জন্যে গাজীপুর ও রাঙামাটিতে যে দুটি গ্রাউন্ড স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলোর ব্যয় কি স্যাটেলাইটের মোট ব্যয়ের সাথে দেখানো হয়েছে? ১৫ বছর পর যখন ‘বঙ্গবন্ধু-১’ অকেজো হয়ে যাবে তখন গাজীপুর ও রাঙামাটির গ্রাউন্ড স্টেশন দুটি কি কাজে লাগবে সেটা কি সরকারের পরিকল্পনায় আছে? স্যাটেলাইটের প্রতিবছর পরিচালনা ব্যয়, মন্ত্রী-আমলাদের বিদেশ ভ্রমণ ব্যয় কোন্ হিসাবে যুক্ত হবে?

(৪) মোটামুটি একই ধরনের একটি স্যাটালাইট বানাতে ভারতের মোট ব্যয় হয়েছে ৬৯ মিলিয়ন ডলার। আর আমাদের ব্যয় হয়েছে ২৩০ মিলিয়ন ডলার। এই বিরাট তারতম্য কেন?

স্যাটেলাইট ভাড়া বাবদ ব্যয় হওয়া অর্থ সাশ্রয়
বলা হচ্ছে যে, এখন দেশীয় টিভি চ্যানেলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিদেশী সংস্থার কাছে স্যাটেলাইটের ক্যাপাসিটি ভাড়া দিয়ে আমাদের আয় হবে। যে টাকা এখন আমরা বিদেশীদের দেই তা সাশ্রয় হবে। আসুন এ দাবিটা একটু যাচাই-বাছাই করে দেখি।
মিয়ানমার সরকার ২০১৯ সালে একটি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করবে। মিয়ানমার ইতোমধ্যেই দুটি কোম্পানির সাথে ক্যাপাসিটি বুক করে ফেলেছে। অর্থাৎ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের আগেই ক্যাপাসিটি বিক্রি শুরু হয়েছে। পাকিস্তান ২০১১ সালে একটি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে যার ৬০% ট্রান্সপন্ডার ক্যাপাসিটি আগেই চুক্তি করা হয়েছিল। আর আমরা এমন কোনো চুক্তি করেছি বলে জানা নেই। অথচ ইতোমধ্যে ১৫ বছরের জন্যে ৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়ে গেছে!

বলা হচ্ছে যে, দেশীয় অপারেটরদের কাছে স্যাটেলাইট সুবিধা বিক্রি করা হবে। অথচ বেসরকারি টেলিভিশন মালিকরা জানিয়েছেন যে, তাদের জন্যে বর্তমানের ৯০ ডিগ্রি বা ৮৯ ডিগ্রিতে স্থাপিত সিঙ্গাপুর বা চায়নার বাণিজ্যিক স্যাটেলাইটগুলোই সুবিধাজনক। কারণ এগুলো যে কৌণিক অবস্থানে আছে তাতে ভালো ট্রান্সমিশান পাওয়া যাবে, যেটা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে পাওয়া যাবে না। আর তাছাড়া দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলি নিশ্চয়ই কোনো না কোনো স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সেবা নিচ্ছে এবং তাদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ। চাইলেও কেউ একটা চুক্তি থেকে সরে আসতে পারে কি? বিদেশী অপারেটর দূরে থাক, এখনো দেশীয় কোনো অপারেটরই এই স্যাটেলাইটের সুবিধা কিনতে রাজি হচ্ছে না।

বলে রাখা ভালো যে ভারত ‘সাউথ এশিয়ান স্যাটেলাইট’ নামের একটি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে যে স্যাটেলাইটে তারা ফ্রি সার্ভিস দিচ্ছে। এই সার্ভিস নিতে ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী নিজেই চুক্তি স্বাক্ষর করে এসেছেন। এরকম ফ্রি সার্ভিসের সুবিধা শ্রীলঙ্কা নেপালের জন্যেও রাখা আছে। আবার শ্রীলঙ্কার নিজেরই স্যাটেলাইট আছে। তাহলে কিনবে কে? এমনকি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের জিওস্টেশনারি লোকেশনের মধ্যে থাকা ইন্দোনেশিয়া এবং মালেশিয়ারও নিজস্ব স্যাটেলাইট আছে। তাহলে আমাদের স্যাটেলাইটের সুবিধা কে কিনতে আসবে? কিসের ভিত্তিতে বলা হচ্ছে বেদেশি কোম্পানি আমাদের সেবা কিনবে এবং আমাদের আয় হবে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে ?

দুর্গম জায়গায় ইন্টারনেট সংযোগ
বলা হচ্ছে যে বাংলাদেশের দুর্গম অঞ্চলে, ১৮০টি উপজেলায় ফাইবারের কানেকশান নেই। এসব জায়গায় স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া হবে।

প্রশ্ন হল, এসব দুর্গম জায়গায় স্যাটেলাইটের কানেক্টিভিটি রিসিভ করার জন্যে ভিস্যাট যন্ত্র কারা বসাবে? সেই রিমোট জায়গায় ভিস্যাটের বিদ্যুৎ সংযোগ কোথা থেকে আসবে? সেখানে ইন্টারনেট সেবার গ্রাহক কারা হবে? এসব প্রশ্নের কোনো যথাযথ উত্তর নেই, কোনো তথ্য-উপাত্তও নেই।

ভূপৃষ্ঠ থেকে স্যাটেলাইটের দূরত্ব হল ৩৬ হাজার কিলোমিটার। এই দূরত্বের কারণে সিগন্যাল যেতে আসতে প্রচুর সময় লাগবে। স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের কানেকশান খুবই দুর্বল হবে। ফলে স্যাটেলাইটের কারণে আমাদের মোবাইলের থ্রিজি ফোরজি সুবিধা বাড়বে – এটাও একটা হাস্যকর তথ্য।

প্রাকৃতিক দুর্যোগে সহযোগিতা পাওয়া
কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমে এমন কথাও আলোচনা হয়েছে যে এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগে সহযোগিতা পাব। অথচ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট একটা কমিউনিকেশান স্যাটেলাইট (অর্থাৎ যোগাযোগের জন্য নির্মিত) এবং এটাতে কোনো ধরনের ইমেজিং, রিমোট সেন্সিং বা ক্যামেরা রাখা হয়নি। ফলে এই স্যাটেলাইট দিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে সহযোগিতা পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

ভাবমূর্তি নাকি বিশেষ গোষ্ঠীর ব্যবসা?
স্যাটেলাইটের কিছু সাধারণ দিক আমরা আলোচনা করলাম। এসব সমালোচনার মুখে কেউ কেউ একটু অভিমানের সুরে বলার চেষ্টা করেন যে, এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে দেশের যে ভাবমূর্তি উপরে উঠেছে’ সেটা কেউ খেয়াল করছে না।
আসলে বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীকে ব্যবসা-বাণিজ্যে সুবিধা করে দেয়ার জন্যে দেশের মানুষের হাজার কোটি টাকা লুট করে এই ‘অশ্বডিম্ব’ ভাবমূর্তি কারা চায়?

সাম্যবাদ জুলাই-আগষ্ট ২০১৮

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments