অনেক ঘটা করে আরেকদফা ভোটাধিকার হরণের মহোৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল গত ৭ জানুয়ারি। নির্ধারিত অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে জাতীয় পার্টি ও ‘বিএনএম’ এর প্রার্থীদের সরে দাঁড়ানো, সংবাদ সম্মেলন- এসবের মাধ্যমে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে যারা অংশ নেবেন, তাদের যে ভাড়া করা হয়েছে, সেটা নগ্নভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। যারা নির্লজ্জের মতো এসব সংবাদ সম্মেলন করেছেন, তারা নিশ্চয় ভেবেছেন- যে লোক এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে বলে মনোনয়ন তুলেছে তার আবার লজ্জা কিসের?
অনেকেই শেখ হাসিনার কাছে বিচার চেয়েছেন। তার দরবারে নালিশ ঠুকেছেন। ‘বিএনএম’-এর নেতাদের বক্তব্য শুনে বোঝা গেল, ১০০ আসন দিয়ে তাদের বিরোধী দল করার স্বপ্ন দেখানো হয়েছিলো। নেতাদের দোষে তাদের আজ এই দশা। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের নেতা এ কে আজাদ বলেছেন, নেত্রী চাইলে তিনি বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে একটি বিরোধী দল গঠন করবেন।
এ এক অপূর্ব সংসদ! এখানে সরকারি দল তথা সংসদ নেত্রী শেখ হাসিনা, তিনিই আবার ঠিক করে দেবেন তার বিরোধীতা কে করবে। তিনি রবি ঠাকুরের কবিতার সেই তালবৃক্ষের মতো একপায় দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে আকাশে উঁকি মারছেন। আর বাকি সব তৃণলতা জড়াজড়ি করে পদতলে লেপ্টে আছেন আগাছার মতো। এর নাম মহান জাতীয় সংসদ! মহান গণতন্ত্র! এই দাস্যবৃত্তির জন্য তারা মুষ্টিবদ্ধ হাতে শপথও নিয়েছেন।
এসব দেখে দেশের মানুষের মনের অবস্থা কী হতে পারে? একদিকে ভোটাধিকার হারানোর ব্যথা, অন্যায় রুখতে না পারার জ্বালা- অন্যদিকে কৌতুককেও হার মানানোর মতো নির্লজ্জ আচরণ। কেন এবারও এভাবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে পারলো, কেন এত ত্যাগ স্বীকার করার পরও আন্দোলন সফল হলো না- ইত্যাদি প্রশ্ন থেমে থেমেই উঁকি দিচ্ছে মানুষের মনে।
নির্বাচন কেমন হলো
নির্বাচনের দিন বিকাল ৩টায় নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হলো ভোট পড়েছে ২৬.৩৭ শতাংশ। নির্বাচনের পরেরদিন সংবাদ সম্মেলনে জানানো হলো ভোট দেয়ার হার ৪১.৮ শতাংশ। ভোট হয়েছে বিকাল ৪টা পর্যন্ত, অর্থাৎ সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৩টা এই ৭ ঘন্টায় ভোট পড়েছে ২৬.৩৭ শতাংশ। আর শেষের ১ ঘন্টায় ভোট পড়েছে এই ৭ ঘন্টায় দেয়া ভোটের অর্ধেকেরও বেশি অর্থাৎ ১৪.৪৩ শতাংশ। তথ্য অনুসারে সারাদেশে শেষ ১ ঘন্টায় ভোট পড়েছে ১ কোটি ৭২ লক্ষ ৪৪ হাজার ৭৮টি। এ এক গোল্ডেন আওয়ার! গোটা দেশের প্রায় পৌনে ২ কোটি মানুষ যেন ১ ঘন্টার সেই মাহেন্দ্রক্ষণকে উপলক্ষ্য করে ঘরে বসেছিলেন!
বিদেশী মিডিয়াকে দেখানোর জন্য ভোটার নয় এরকম লোক দিয়ে বুথ জ্যাম করে রাখা হয়েছিল। জাল ভোট, কেন্দ্র দখল- এসবকিছু করেও ৩টা পর্যন্ত ভোট প্রদানের হার ২৬.৩৭ শতাংশর বেশি দেখানো যায়নি। রাত ৯টায় নির্বাচন কমিশনের ড্যাশবোর্ডে দেয়া তথ্য অনুসারে এই হার ২৮ শতাংশের বেশি নয়। এই ধরনের একটা কঠিন পরিস্থিতির মুখে নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা সম্পূর্ণ ফলাফল ঘোষণা না করে মধ্যরাতেই নির্বাচন কমিশন ত্যাগ করেন। আর সে সময়ই উদভ্রান্ত হয়ে নির্বাচন কমিশনে নালিশ জানানোর জন্য প্রবেশ করেন ঢাকা-৫ আসনের একজন প্রার্থী, যিনি সন্ধ্যা পর্যন্ত টেলিভিশনে দেখছিলেন তিনি বিজয়ী হয়েছেন, পরবর্তীতে নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ফলাফলে দেখেন তিনি হেরে গেছেন। তার হাতে সকল কেন্দ্রের প্রাপ্ত ভোটের তালিকা। তার যোগ, নির্বাচন কমিশনের যোগের সাথে মিলছে না। নির্বাচন কমিশন কোন নিয়মে যোগ করেছেন, তা তিনি বুঝে উঠতে পারেননি।
এভাবেই অংকের নতুন নিয়মে এই নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। এই অংক বইয়ের নিয়ম মেনে চলে না। ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ’ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংগৃহিত মাঠ পর্যায়ের তথ্যগুলো প্রকাশ করছে। তাতে দেখা যায়, ‘নমুনা হিসেবে অন্তর্ভূক্ত ৫০টি আসনে শতভাগ ক্ষেত্রেই কোনো না কোনো নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী লীগ মনোনীত শতভাগ প্রার্থী কর্তৃক ন্যূনতম একবার হলেও কোনো না কোনো নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করেছেন। স্বতন্ত্র (আওয়ামী লীগ) প্রার্থীর ৯৭.৩ শতাংশ, অন্যান্য স্বতন্ত্র প্রার্থীর ৮৭.৫ শতাংশ, জাতীয় পার্টির প্রার্থীর ৮৪.৯ শতাংশ, অন্যান্য দলের প্রার্থীর ৮০ শতাংশ ও তৃণমূল বিএনপির প্রার্থীর ৭৫ শতাংশ নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করেছেন।…৫০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য ক্ষমতাসীন দল বিভিন্নভাবে বলপ্রয়োগ করেছে।’
ভোট দিতে না আসলে সামাজিক সুরক্ষা খাতের সুবিধাভোগীদের ভাতা বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়ে, অনেককে ব্যক্তিগতভাবে হুমকি দিয়ে, বাসাবাড়িতে হামলা করেও নির্বাচনে ভোটার আনা যায়নি। যাদের জোর করে ভোটকেন্দ্রে নেয়া হয়েছে তাদের মধ্যেও কী ধরনের বিক্ষোভ ছিল সেটা বোঝা যাবে খুলনার ঘটনায়। খুলনার ৬টি আসনে ২৩ জন প্রার্থী মিলে মোট ভোট পেয়েছেন ৩০ হাজার ৬৭১টি। আর এসকল কেন্দ্রগুলোতে ভোট বাতিল হয় ২৭ হাজার ৩৩৫টি। এই পরিমাণ ভোট বাতিল দেখে বোঝা যায়, জোর করে কেন্দ্রে নেয়া অনেকেই ভোট নষ্ট করেছেন। বিদেশি পর্যবেক্ষকদের মতে, ভোটার উপস্থিতি ১০ থেকে ১৫ শতাংশের বেশি হবে না। অর্থাৎ জনগণ এই নির্বাচনকে সামগ্রিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। নির্বাচনের দিন বিকেলে যারা রাস্তাঘাট পর্যবেক্ষণ করেছেন তারা জানেন, সেদিন আর দশটা সাধারণ ছুটির দিনের মতোই ছিল চারপাশ। জয়ের উল্লাস করার শক্তিও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ছিল না।
এটা কাদের নির্বাচন, কে জিতলো
এবারের সংসদে এদেশের দরিদ্র জনগণের প্রতিনিধিত্ব করবেন বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন ‘বিটিএমএ’-এর সাবেক সভাপতি ও বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান ফজলুর রহমান, পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন ‘বিজিএমইএ’-এর সাবেক সভাপতি ও সেপাল গ্রুপের কর্ণধার টিপু মুনশি, আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘রিহ্যাব’-এর সাবেক সভাপতি ও হামিদ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা নসরুল হামিদ, ‘এফবিসিসিআই’-এর সাবেক সভাপতি ও দেশের শীর্ষস্থানীয় তৈরি পোশাক রপ্তানীকারক প্রতিষ্ঠান হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ, ‘বিকেএমইএ’-এর বর্তমান সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমান, ‘বিজিএমইএ’-এর সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী প্রমুখ! এছাড়াও আছেন পোশাক খাতের জায়ান্টরা, যেমন- রেনেসাঁস গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মো. শাহরিয়ার আলম, ওয়েল গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম, শাশা ডেনিমের চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মণ্ডল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মমিন মণ্ডল, নিপা গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. খসরু চৌধুরী, তুসুকা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফয়জুর রহমান, ফেবিয়ান গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা তাজুল ইসলাম, স্প্যারো গ্রুপের চেয়ারম্যান চয়ন ইসলাম, স্মার্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুজিবুর রহমান। আছেন বৃহৎ ব্যবসায়ী গাজী গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম দস্তগীর গাজী, সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবু জাফর মোহাম্মদ শফি উদ্দিন, আফিল গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আফিল উদ্দিন, জেমকন গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান কাজী নাবিল আহমেদ প্রমুখ। সামিট গ্রুপের কর্ণধার আজিজ খানের ভাই ফারুক খান আছেন এই সংসদে।
নির্বাচন কমিশনে দেয়া হিসাব অনুসারে (প্রকৃত হিসাব যার থেকে অনেক অনেক গুণ বেশি) আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ৯২ দশমিক ৮৩ শতাংশই কোটিপতি। এর ৬৪.১৫ শতাংশই (১৭০ জন) পেশায় ব্যবসায়ী। এদের মধ্যে ১৬ জনের ১০০ কোটি টাকার বেশি স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। দলটির ২৬৫ প্রার্থীর বার্ষিক গড় আয় ২ কোটি ১৪ লাখ টাকা। গড় সম্পদমূল্য সাড়ে ২৮ কোটি টাকার বেশি।
এরাই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছে ও আনছে, আর ক্ষমতায় গিয়ে আওয়ামী লীগ এই বৃহৎ ব্যবসায়ীদের স্বার্থে দেশ পরিচালনা করছে। দেশের স্বার্থ ও বৃহৎ ব্যবসায়ীদের স্বার্থ এখন মিলেমিশে একাকার। ২০২৩ সালে গোটা বিশ্বে যখন খাদ্যের মূল্য কমেছে গড়ে প্রায় ১৪ শতাংশ, ভোজ্যতেলের মূল্য কমেছে ৩২.৭ শতাংশ (দৈনিক বণিক বার্তা, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৪)- সেখানে বাংলাদেশে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি কখনও ১০ শতাংশও ছাড়িয়ে গেছে, গড়ে তা সাড়ে ৯ শতাংশ। এতে কাদের লাভ হচ্ছে? লাভ হচ্ছে এই বৃহৎ ব্যবসায়ীদের, যারা সিন্ডিকেট করে খাদ্যের মূল্য বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা করেছেন। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি শীর্ষ ব্যয়ের তালিকার উপরে থাকা সাতটির মধ্যে পাঁচটি প্রকল্পই বাংলাদেশের। ফ্লাইওভার, মেট্রো রেল কোন প্রকল্পে আমরা ব্যয়ের শীর্ষে নেই? এই শীর্ষ ব্যয়ের অতিরিক্ত খরচ হয় জনগণের তহবিল থেকে, আর অতিরিক্ত মুনাফা করেন এই বৃহৎ ব্যবসায়ীরা, যারা এই সংসদে ও সংসদের বাইরে বসে দেশ চালাচ্ছেন।
তাদের এই মুনাফা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। ব্যাংক, খাস জমি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, নদী, জলাধার, বন- সবকিছুই তাদের জন্য উন্মুক্ত। তারা অবাধে সুন্দরবন কেটে বিদ্যুৎকেন্দ্র করছেন, গত ১৫ বছরে ব্যাংক থেকে ৯২ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন, গত ১০ বছরে প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। এভাবে দেশে তৈরি হয়েছে বৃহৎ ব্যবসায়ীদের একটি শ্রেণি। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে প্রায় ২৩টি বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী আছে দেশে, সবমিলিয়ে আছে ১০০টি পরিবার- যাদের উপর দেশের অর্থনীতি নির্ভরশীল। তাদের নির্দেশেই দেশ চলে, তারা যা বলেন তাই আইন। তারা এখন নিজেরাই সংসদে। নিজেদের পক্ষে তারা আইন পাশ করান, মানুষের ন্যূনতম প্রতিবাদের রাস্তা বন্ধ করেন। তাদের মুনাফার থলির ঝংকারে সংসদ প্রকম্পিত হয়। এই শব্দের মাঝে হারিয়ে যায় অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষের দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ।
টিভি মিডিয়াগুলোর নির্লজ্জ সমর্থন ও মিডিয়ার চরিত্র
আমরা দেখেছি, নির্বাচনের দিন সকাল থেকেই টিভি মিডিয়াগুলো কী নির্লজ্জভাবে নির্বাচনের সমর্থনে প্রচার করেছে! নির্বাচনের আগেও সরকারকে সমর্থন করে, বিরোধীদের আন্দোলনকে ষড়যন্ত্র ও নাশকতা বলে চিহ্নিত করে এবং টানা সরকারের বক্তব্যকে সমর্থন করে সংবাদ প্রকাশ ছিল দেশের বড় বড় টিভি মিডিয়াগুলোর নীতিগত অবস্থান। নির্বাচনের দিন এই মিথ্যা প্রচার চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছায়। একদিকে সরকারি মিডিয়াগুলোর খবর শুনছিলেন মানুষ আর অন্যদিকে চোখের সামনে দেখছিলেন তার এলাকার শূণ্য ভোটকেন্দ্র। মিডিয়ার এই নির্জলা মিথ্যা পরিবেশন করার কারণ হলো- দেশের মিডিয়াগুলো সম্পূর্ণভাবে এদেশের পুঁজিপতি শ্রেণির নিয়ন্ত্রণে। সাজানো এই নির্বাচনে অনেক মিডিয়া মালিক অংশগ্রহণও করেছেন। দৈনিক ইত্তেফাকের কর্ণধার আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, দৈনিক সমকাল ও চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের কর্ণধার শিল্পপতি একে আজাদ, দৈনিক যুগান্তর ও যমুনা টেলিভিশনের কর্ণধার সালমা ইসলাম, ইন্ডিপেনডেন্ট টিভির কর্ণধার সালমান এফ রহমান, আরটিভির কর্ণধার মোর্শেদ আলম, বাংলা ট্রিবিউন ও ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকার কর্ণধার কাজী নাবিল আহমেদ, দৈনিক সংবাদের আলতামাস কবীর, সময় টিভির অন্যতম অংশীদার এডভোকেট কামরুল ইসলাম, দৈনিক ভোরের কাগজের সাবের হোসেন চৌধুরী, দৈনিক কালবেলার কর্ণধার নজরুল ইসলাম, গাজী টিভি ও অনলাইন সারা বাংলার কর্ণধার গোলাম দস্তগীর গাজী, মোহনা টেলিভিশনের কর্ণধার কামাল আহমেদ মজুমদার, দৈনিক ও অনলাইন ঢাকা টাইমসের কর্ণধার আনিফুর রহমান দোলন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন।
এর বাইরে বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকাধীন কালের কন্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, নিউজ টোয়েন্টিফোর ও ডেইলি সানের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত নঈম নিজাম কুমিল্লা থেকে নৌকার দলীয় মনোনয়ন তুলেছিলেন, কিন্তু পাননি। বসুন্ধরা গ্রুপ এ সরকারের আমলে অন্যতম সুবিধাভোগী। ভোজ্য তেলের সিন্ডিকেটের অন্যতম নিয়ন্ত্রক সিটি গ্রুপ সময় টিভির সবচেয়ে বড় অংশীদার।
জনগণ কেমন আছেন
জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি এমন যে, নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক জিনিসের দাম এখন মানুষের নাগালের মধ্যে নেই শুধু নয়, অনেক ক্ষেত্রে কল্পনার মধ্যেও নেই। বর্তমানে দেশের ৩৬ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীন আর ৭১ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তারা জানেন না, কাল তাদের খাবার জুটবে কি না। দেশের জিডিপি, ফসলের বাম্পার ফলন- কোন পরিসংখ্যানই এই সত্যকে অগ্রাহ্য করতে পারে না। চাল, আটা, পেঁয়াজ, আলু, ভোজ্য তেল, সব্জী, মাংস, মাছ- কোন জিনিস নিয়ে সিন্ডিকেট হয়নি, মানুষের সর্বোচ্চটা নিংড়ে নিয়ে বড় ব্যবসায়ীরা লাভের পাহাড় তৈরি করেনি? ছোট এমনকি মাঝারি ব্যবসায়ীরা আজ পথে বসেছেন। বিদ্যুৎ, জ¦ালানী তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। দেশের গ্যাস অনুসন্ধান না করে, নবায়নযোগ্য জ¦ালানীর বিকাশ না ঘটিয়ে, বাইরে থেকে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। এলএনজি সরবরাহ নিয়ে বড় চুক্তি করা হয়েছে সামিট গ্রুপের সাথে। বিদ্যুৎক্ষেত্রে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে সামিট, ইউনাইটেডের মতো গ্রুপগুলো।
অতিধনীদের মুনাফা বাড়ছেই। বাজার নেই, বাজার নেই বলে চিৎকার করছেন গার্মেন্টস মালিকরা। কিন্তু বাস্তবে তাদের ব্যবসা কমেনি। এ খাতে এই জানুয়ারি মাসেও প্রবৃদ্ধি ১.৭৩%। অথচ শ্রমিকদের বেঁচে থাকার মতো মজুরিও তারা দেবেন না। সম্প্রতি নিম্নতম মজুরি বোর্ডে গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ঘোষণা করলো সাড়ে ১২ হাজার টাকা। অথচ তাদের দাবি ছিল ২৫ হাজার টাকা। কথা ছিল ডিসেম্বর মাস থেকে এই বেতন কার্যকর হবে। অনেক কারখানায়ই সেটা করা হয়নি। জানুয়ারি মাসের বেতন না পেয়ে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছে চট্টগ্রাম ইপিজেড, টঙ্গি ও গাজীপুরে। গ্রেডেশনের মাধ্যমেও শ্রমিকদের ঠকানো হয়েছে। অথচ এই শ্রমিকদের দাবিকে তোয়াক্কা না করে সরকার তাদের বুকেই গুলি চালাচ্ছে। নভেম্বরের আন্দোলনে ৪ জন শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কারণ এ সরকার মালিকদের সরকার। গার্মেন্টস সেক্টরের ১৫ জন বৃহৎ ব্যবসায়ী এ সরকারের সাথে সরাসরি যুক্ত। তবে এও ঠিক দমন-পীড়নের মাধ্যমে এই আন্দোলন নিভিয়ে দেয়া যাবে না। নিম্নতম ২৫ হাজার টাকা মজুরি না দিলে শ্রমিকরা ঘরে ফিরবে না। আমরা অবিলম্বে নিম্নতম ২৫ হাজার টাকা মজুরির দাবি মেনে নেয়ার আহবান জানাই।
একদিকে অর্থনৈতিক শোষণ তীব্র হচ্ছে, অন্যদিকে এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শক্তিকে থামিয়ে দেয়ার জন্য শিক্ষার উপর আক্রমণ চালানো হচ্ছে। সরকার অগণতান্ত্রিকভাবে, প্রচণ্ড তাড়াহুড়ো করে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১’ প্রণয়ন করেছে। অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সংকটের ডামাডোলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন করছে। এর মাধ্যমে ধারাবাহিক মূল্যায়নের নামে মূল্যায়ন পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন করা হয়েছে, ১ম থেকে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা তুলে দেয়া হয়েছে। বিজ্ঞান শিক্ষাকে সংকুচিত করা হয়েছে, সাধারণ শিক্ষাকে কারিগরি শিক্ষার মানে নামিয়ে আনা হয়েছে। সম্পূর্ণ আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এ কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয়েছে। যার কুফলগুলো ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। দেশের সচেতন শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী ও অভিভাবকবৃন্দ এর প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। প্রতিবাদ করায় আন্দোলনকারী কয়েকজন অভিভাবককে সাইবার সিকিউরিটি আইনে গ্রেফতার পর্যন্ত করা হয়েছে। তারা এখনও জেলে। আমরা মনে করি, এই শিক্ষাক্রম শিক্ষাকে আরও বাণিজ্যিক করবে, শিক্ষার ব্যয় বাড়বে, শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য বৃদ্ধি করবে। সর্বোপরি যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা একজন শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ জীবনের ভিত তৈরি করে তা পুরোপুরি ধ্বংস করবে। আমাদের দাবি, ফ্যাসিবাদী শাসনের উপযোগী করে তৈরি এ শিক্ষাক্রম অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।
এই বিশাল গণআন্দোলন তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারলো না কেন
এই গণআন্দোলন জনগণের বহু আত্মত্যাগ সত্ত্বেও বাস্তবে তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছালো না, নির্বাচন প্রতিরোধ করা গেল না। এই দীর্ঘ আন্দোলনে বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে সরকার গ্রেফতার করেছে। তারা আজও কারারুদ্ধ। আমরা অবিলম্বে এই নেতাকর্মীদের উপর থেকে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও তাদের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছি। সাথে সাথে একথাও আমরা না বলে পারছিনা যে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার তাদের শাসনকালে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষা করার কোন চেষ্টা করেনি, তারা দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছিল- এও ঐতিহাসিকভাবে সত্য। দেশের গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও অন্যতম বৃহৎ বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী নির্ভর করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যাতে বিরক্ত না হয় সেজন্য তারা ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচিতেও প্রায় নিরব ছিলেন। দেশে দেশে গণতন্ত্র হরণকারী, খুনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেবে, নেতারা তাদের কর্মী-সমর্থকদের এই আশা দেখিয়েছেন। ফলে কর্মীরা জেল-জুলুম সহ্য করলেও, প্রাণত্যাগ করলেও- তা সংগঠনকে শক্তিশালী করেনি। সে কারণে স্বাভাবিকভাবেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা, সাহস ও লড়াইয়ের তেজ নিয়ে তাদের দল দাঁড়াতে পারেনি। এই ত্যাগ ও লড়াইয়ের উপরে তাদের ততটা বিশ্বাস ছিল না, যতটা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের উপর। তাই এদের নেতৃত্বে এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ভারত-চীন-রাশিয়াসহ সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর সমর্থন আদায় করেছে। ভারত আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়েছে। শেখ হাসিনা উঠতে-বসতে ভারতের প্রশংসা করছেন। আওয়ামী লীগের পেছনে ভারতের এ ধরনের সমর্থনের প্রতিক্রিয়ায় দেশের জনগণের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই প্রচণ্ড ভারতবিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছে। এর সবটা সচেতনভাবে ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নয়। ভারতের জনগণও তাদের শাসকদের উপর ক্ষুব্ধ, যেমন বাংলাদেশের জনগণ আওয়ামী লীগ সরকারের উপর ক্ষুব্ধ। বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর আচরণের সাথে যেমন এদেশের জনগণকে এক করে দেখা যাবে না, তেমনি ভারতের শাসকগোষ্ঠীর আচরণের সাথে তার জনগণকে মেলালে ভুল হবে। তাদের দেশের সকল গণতান্ত্রিক মনোভাবপন্ন মানুষ ভারতের সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকার বিরুদ্ধে। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরের ভারতবিরোধী এই মনোভাবকে এদেশের সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো ভিন্নভাবে ব্যবহার করছে। তারা জনগণের সাম্প্রদায়িক চিন্তার মধ্যে উস্কানি দিচ্ছে। দেশে যে রাজনৈতিক শূণ্যতা তৈরি হয়েছে, গণতান্ত্রিক লড়াই শক্তিশালী না হলে, এর সুযোগে অদূর ভবিষ্যতে এই শক্তিগুলোর সামনে আসার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যাবে না।
আওয়ামী লীগের প্রতি চীন ও রাশিয়ার সমর্থনও প্রকাশ্য। অপরদিকে বিশ^ সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের বিবাদমান গোষ্ঠীগুলোও নিজ নিজ স্বার্থে কেউ বর্তমান সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে আবার কেউ কেউ বিরোধিতা করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একদিকে বিরোধীতা করছে আবার তাদের রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দেখা করে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কারণ বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে তাদের মুনাফার অনেক হিসাব-নিকাশ আছে। তারা মধ্যপ্্রাচ্যে ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া ধ্বংস করেছে, ফিলিস্তিনকে ধ্বংস করে কবরস্থান বানিয়েছে। তাদের মুখে গণতন্ত্র মানে নতুন ব্যবসা, নতুন স্বার্থ। আর আওয়ামী লীগ তাদের সবকিছুই দিতে প্রস্তুত। যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু জাপান নির্বাচনের পরদিনই ভারত-চীন-রাশিয়ার সাথে রীতিমতো পাল্লা দিয়ে শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। আমাদের দল বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমাদের দেশের উপর এ সকল সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর হস্তক্ষেপ, যা এদেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন করছেÑ আমরা তার তীব্র বিরোধীতা করছি।
হতাশা নয়, বরং আগামীদিনের নতুন লড়াইয়ের জন্য একতাবদ্ধ হোন
এই পরিস্থিতিতে দেশের জনগণের একাংশের মধ্যে হতাশা ও নিষ্ক্রিয়তা দানা বাঁধছে। কেউ কেউ মনে করছেন আন্দোলন করে কিছু হবে না। আমরা এই পরিস্থিতিতে আমরা দেশের সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিককে বলতে চাই যে- সঠিক নেতৃত্বে সমগ্র জনগণকে যুক্ত করে একটা সচেতন, দীর্ঘস্থায়ী ধারাবাহিক এবং সংগঠিত আন্দোলনই পারে স্বেচ্ছাচারী, ফ্যাসিস্ট শক্তির কাছ থেকে দাবি আদায় করতে। আওয়ামী লীগ নির্বাচন করেনি, প্রকৃতপক্ষে, নির্বাচনের নামে আওয়ামী লীগ জোর করে রাষ্ট্রক্ষমতার দখল বজায় রেখেছে। এটা চিরস্থায়ী নয়। আর এটা আওয়ামী লীগের বিজয়ও নয়। আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নৈতিকভাবে পরাজিত হয়েছে, সাংগঠনিকভাবে আরও দুর্বল হয়েছে। তাদের দল বলে এখন আর কিছু নেই। এটা একটা পাইয়ে দেবার দলে পরিণত হয়েছে। কোনকিছু পাওয়ার জন্য সবাই এই দলে আসে। তাদের যারা ত্যাগী নেতাকর্মী ছিলেন, তারা দলে এখন অগুরুত্বপূর্ণ, অপ্রাসঙ্গিক। আওয়ামী লীগ সরকার দাঁড়িয়ে আছে সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রীয় শক্তির উপর। এক্ষেত্রে আমরা মনে করি, একটা যথার্থ বিপ্লবী দলের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ বাম গণতান্ত্রিক শক্তিই একমাত্র বিকল্প হতে পারে।
মনে রাখা দরকার, পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন চাই এ যেমন সত্যি, তেমনি ভুল নেতৃত্বের পেছনে জড়ো হলে শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের শক্তিবৃদ্ধি ঘটে না। বরং নেতৃত্বের ভুলের জন্য আন্দোলনের সাময়িক পরাজয়ে হতাশা নেমে আসে, যা আন্দোলন গড়ে তোলার পথেই বাঁধা তৈরি করে। আন্দোলনের শক্তি ও ঐক্যকেই দুর্বল করে। তাই আমাদের আবেদন, যারা সত্যি দেশে আন্দোলন গড়ে উঠুক এটা চান, তাদের আন্দোলনের সঠিক নেতৃত্বকে চিনে নিতে হবে। আজকের দিনে বাম গণতান্ত্রিক শক্তিই সেই নেতৃত্ব। আমরা দেশের মানুষকে আহবান করব, বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতৃত্বে আগামীদিনের গণআন্দোলন গড়ে তুলুন।