ভোরের আলো ফোটার আগেই যারা নগর জীবনকে সৌন্দর্য্যমন্ডিত করেন, সেই হরিজন সম্প্রদায়ের জীবনে আজো আলো ফোটে নি। বৈষম্যমূলক এই সমাজের অল্প কিছু লোকের ভোগ বিলাসের যোগান দিতে গিয়ে নিঃস্ব রিক্ত হয় বেশিরভাগ মানুষ। ধনীর সম্পদের নিচে সকল মানুষের সুখ-স্বপ্ন চাপা পড়বে এ যেন নিশ্চিত নিয়তি। তার সাক্ষ্য বহন করে আজো কোনরকমে টিকে আছেন হরিজন সম্প্রদায়।
১৭০৬ সাল হতে ১৭১০ সালের মধ্যে পূর্ববাংলায় নগর সভ্যতা শুরু হলেও তা পূর্ণতা পায় মূলত ইংরেজ শাসনামলে। বৃটিশ শাসনামলের মাঝামাঝি (১৮৩৮-১৮৫০) বিভিন্ন সময়ে পূর্ববঙ্গে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কর্মী, জঙ্গল কাটা, পয়ঃনিষ্কাশন প্রভৃতি কাজের জন্য ভারতের উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, বিহার, উড়িষ্যা, কোচবিহার, রাচি ও আসাম থেকে হিন্দি, উড়িষ্যা, দেলওয়ালি ও তেলেগু ভাষাভাষি মানুষদের নিয়ে আসা হয়েছিল এ অঞ্চলে। এই সম্প্রদায়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: হেলা, মুচি, ডোম, বাল্মিকী, রবিদাস, ডোমার, ভালু, মালা, মাদিকা, চাকালি, সাচ্চারি, কাপুলু, নায়েক, বাঁশফোর, বাউরি, লালবেগি, টাক ইত্যাদি।
নগর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও নাগরিকদের স্বাচ্ছন্দ নিশ্চিত করার জন্য প্রথমে ঝাড়ুদার নিয়োগ এবং পরর্বতীতে পয়ঃনিষ্কাশন, ড্রেন, ডাস্টবিন ইত্যাদি পরিষ্কারের জন্য সুইপারদের নিয়োগ করে। অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব এই মানুষগুলোকে জীবনের সকল সুখ-সাচ্ছন্দ্য এবং মানবিক বোধ থেকে বিচ্ছিন্ন করে এই অমানবিক কাজে যুক্ত করা হয়। সুচতুর বৃটিশ সরকার এই বিশাল জনগোষ্ঠিকে এমন ভাবে তৈরি করলো যে তারা শুধু পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজেই নিয়োজিত থাকবে, কিন্তু জীবনের কোন বিষয় নিয়ে ভাবতে পারবে না।
আজ ইংরেজ নাই, পাকিস্তান নাই, কিন্তু স্বাধীন দেশেও সেই একই অবস্থার মধ্যেই দিনাতিপাত করছেন গোটা হরিজন সম্প্রদায়। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে তারা চরম বঞ্চনার শিকার। বর্তমান বাংলাদেশে প্রায় ১৬ লক্ষ হরিজনের বসবাস। ভূমিহীন ও নিজস্ব বসতভিটাহীন এসব সম্প্রদায় বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় সরকার কতৃক প্রদত্ত জমি-রেলষ্টেশন সহ সরকারি খাস জমিতে বসবাস শুরু করেন। ভূমির উপর নিজেদের কোন অধিকার না থাকায় কখনো সরকারের নানা প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় কাজে, কখনও প্রভাবশালীদের ভূমি দখলের ফলে অনেকটা যাযাবর জীবন যাপন করতে হয়। প্রতিটি এলাকাতে তাদের জীবন দুর্বিষহ। তাদের নিজস্ব কোন জমি নেই, ছোট ছোট খুপরি ঘরে বসবাস করেন। যেমন সিলেটের কাষ্টঘরে একটি বিল্ডিংয়ে ৩০টি ছোট ছোট রুমে এবং এর পাশে টিনশেডে গাদাগাদি করে থাকেন ৪০০ জন। যেখানে বিশুদ্ধ খাবার পানি, রান্না ও গোসল করার জন্যে পর্যাপ্ত আয়োজন পর্যন্ত নেই। এমনকি একটি টিউবওয়েল যাও আছে সেটাও নষ্ট। ফলে পানি ক্রয় করে প্রয়োজনীয় কাজ সম্পাদন করতে হয়। বিশুদ্ধ পানির অভাবে হরিজনদের প্রায় ৬০-৭০ ভাগ জন্ডিস, আমাশয়, ডাইরিয়া, টাইফয়েড ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত থাকে নিয়মিত। সিটি কর্পোরেশনে সকল জায়গায় গ্যাস সংযোগ থাকলেও হরিজনরা সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন বলে তাদের বিল্ডিংয়ে কোন গ্যাস সংযোগ নেই। পানি এবং জ্বালানি বাবদ প্রতি বছরে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়। আবার সিটি কর্পোরেশন থেকে যে বেতন দেওয়া হয় তা একেবারে নগণ্য। ফলে স্বাভাবিকভাবে তাদের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। অন্যদিকে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজের ক্ষেত্রে হরিজনদের ৮০ ভাগ কোটা থাকলেও বাস্তবে তা কার্যকর নয়। এই রকম পরিস্থিতিতে গোটা হরিজন সম্প্রদায় শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ সকল রকম মৌল মানবিক অধিকার থেকে আজ বঞ্চিত। জীবনের এই দীনতা, অবমাননা ভুলে থাকার জন্যে আছে সস্তা মদের ব্যাপক আয়োজন। ফলে নগর জীবনের সকল ক্লেদ দূর করতে করতেই একদিন হরিজনদের জীবন তলিয়ে যায় ক্লেদের গভীরতর অতলে।
শুধু দেশের পরিছন্নতা নয়, দেশ গঠনের ক্ষেত্রেও হরিজনদের ভূমিকা ছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁরা যুদ্ধ করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে তারা খাবার দিয়েছেন। অস্ত্র রাখার মতোও কাজ করেছে। মিরনজিল্লা হরিজন কলোনিতে ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর মধ্য রাতে হরিজন সম্প্রদায়ের ১০ সমাজসেবককে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা ধরে নিয়ে যায়। তাদের অপরাধ ছিল তারা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহায্য করতেন। কলোনির প্রধান সামুন্দসহ ১০ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে ধরে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো – হরিজন বীর শহীদ ও হরিজন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কোন মর্যাদা দেওয়া হয়নি।
বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে সকল ধর্ম-বর্ণ ও জাতের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিকে উচ্ছেদ করে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই শুরু হয়। কিন্তু ১৯৪৭ সালে বৃটিশের হাত থেকে ভারতবর্ষ মুক্তি পেলেও গণমানুষের মুক্তি না হওয়ায় সাথে নিম্ন বর্ণের এই সম্প্রদায়ের মুক্তি আসেনি। পাকিস্তানের শাসন আমলেও অন্যান্য জাতিসত্ত্বা ও সম্প্রদায়ের গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়। সেদিন স্বপ্ন ছিল দেশ স্বাধীন হলে সবাই সমান সুযোগ নিয়ে বেড়ে উঠবে। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও গরীব মানুষের মুক্তি আসেনি, বরং বিদেশী শোষকের পরিবর্তে দেশীয় শোষকরা ক্ষমতায় গিয়েছে। তাই হরিজন সম্প্রদায়ের জীবনেও মুক্তি আসে নি। আজ সকল মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ সমাজ থেকে সকল নিপীড়ন, শোষণের মূলোৎপাটন। সত্যিকার অর্থে সকল ধরণের শোষণের বিরুদ্ধে কার্যকর আন্দোলন একমাত্র শ্রমিক শ্রেণীই সংগঠিত করতে পারে। তাই শ্রমিক শ্রেণীর বৈপ্লবিক সংগ্রাম বিকাশের উপর নির্ভর করছে হরিজন সম্প্রদায়সহ সকল শ্রমজীবি মানুষের ভাগ্য। হরিজনরা অন্যায় অত্যাচারকে যত মুখ বুঁজে মেনে নিয়েছেন, ততই বেড়েছে অত্যাচারের মাত্রা। গোটা হরিজন সম্প্রদায় আজ এত নিঃস্ব-রিক্ত যে জীবনে হারাবার আর কিছু নেই। তাই শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তি সংগ্রামের সামনের কাতারে দাঁড়িয়েই সংগঠিত করতে হবে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ। জীবনের সব বঞ্চণার বিরুদ্ধে এই লড়াই তাই শোষণমুক্তির লড়াই, মর্যাদাপূর্ণ জীবন প্রতিষ্ঠার লড়াই।
শ্রমিক বার্তা ২য় বর্ষ, ৩য় সংখ্যা প্রকাশকাল : জানুয়ারি ২০১৭