“আমি কৃষকের সন্তান। হাওরের ক্ষয়ক্ষতি আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করি. . . . . . .সুনামগঞ্জ এর মানুষের দুর্ভোগে আমাকে কেউ দাওয়াত করে আনেনি। এ অঞ্চলের দুর্ভোগের কথা উপলব্ধি করে আমি নিজ তাগিদে সুনামগঞ্জ এসেছি। . . . . . .হাওর অঞ্চলের মানুষের ফসল ছাড়া বিকল্প কর্মসংস্থান নেই। তাই বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য হাওর অঞ্চলে ইকোনমিক জোন স্থাপনে আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব করবো।” — রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, (১৮ এপ্রিল ২০১৭)
“হাওরগুলোতে বাঁধ ভেঙ্গে পানি ঢুকেছে এমন নয়। আসলে বাঁধ উপচে পানি ঢুকেছে। উপচেপড়া পানিতে বাঁধগুলো তলিয়ে যাওয়ার পর ভেঙে যায়। বাঁধের উচ্চতা ৬ দশমিক ৫ মিটার। কিন্তু পানিতে উচ্চতা ছিল ৭ দশমিক ১৭ মিটার। যে কারণে বাঁধ পানি আটকাতে পারেনি।” — পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, (২৭ এপ্রিল ২০১৭)
“সুনামগঞ্জকে যারা দূর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন তাদের কোন জ্ঞানই নেই। কিসের দুর্গত এলাকা? একটি ছাগলও মারা যায়নি। খাদ্য গুদামে প্রচুর খাদ্য মজুদ আছে। কোন এলাকাকে দুর্গত ঘোষণা করতে হলে অর্ধেক মানুষকে মরতে হয়।” — দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: শাহ কামাল, (১৬ এপ্রিল ২০১৭)
হাওরবাসীর কষ্ট : সরকারের দায়িত্বশীলদের উপরোক্ত বক্তব্য! পরিহাস করার সামিল
হাওরের প্রকৃতির সাথে মিল রেখে এই অঞ্চলের মানুষের জীবন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। গবেষকদের হিসেবে বাংলাদেশে ৩৭৪ বা ৩৭৬ বা ৪১১টি হাওর থাকলেও প্রকৃতপক্ষে হাওর মাত্র একটি, একক, অবিভাজ্য, অখন্ড, এর মাঝে কোন দেয়াল নেই। পরিষ্কার ভাষায় বলা যায় পৃথিবীতে আর একটিও হাওর নাই। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বঞ্চলের ৭ টি জেলা সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোণা হাওর জেলা হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় এক সপ্তমাংশজুড়ে বিস্তৃত ২১ লক্ষ হেক্টরের এই এলাকায় প্রায় ২ কোটি মানুষের বসবাস। উক্ত ২১ লক্ষ হেক্টরের মধ্যে অধিকতর নিচু প্রায় সাড়ে ৮ লক্ষ হেক্টর এলাকাই হাওর হিসেবে পরিচিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা মাত্র ৪/৫ মিটার। এই এলাকার উত্তরে মেঘালয়, পূর্বে আসাম-মণিপুর, দক্ষিণে ত্রিপুরা-মিজোরাম। বিশ্বের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতময় স্থান চেরাপুঞ্জি টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে। ভারতের সাথে আমাদের যে ৫৪ টি আন্তর্জাতিক নদী রয়েছে তার ২০ টি নদী এ হাওর অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পৃথিবীর সর্বোচ্চ বৃষ্টিপ্রবণ এলাকার বৃষ্টিজল বঙ্গোপসাগরে বয়ে নিয়ে যায়। হাওরের প্রকৃতির সাথে মিল রেখে এখানকার মানুষ কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। দেশের মোট ধানের প্রায় ১৮% হাওর থেকে আসে। প্রাকৃতিক মৎস্যক্ষেত্র থেকে আসা মাছের মধ্যে হাওরের অবদান সবচেয়ে বেশি। একক অবদান ৩৬%। পরিযায়ী পাখিদের বিচরনক্ষেত্র এই হাওর অঞ্চল।
হাওরের পরিস্থিতি সরকারের দায়িত্বহীনতার বহিঃপ্রকাশ
হাওরের মহাবিপর্যয় অংশত প্রাকৃতিক হলেও প্রধানত মনুষ্যসৃষ্ট। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানাচ্ছে এ বছরের মত অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতে ৩৫ বছর আগে ১৯৮১ সালেও একবার হয়েছিল। তখনও হাওরের সিংহভাগ তলিয়ে যায়নি। এর বড়দিক হলো নদীর নাব্যতা। গত ৩৫ বছরের ‘উন্নয়ন’ দিয়ে বিভিন্ন সরকার এই গভীরতা যেমন ভরাট করেছে তেমনি অচল করেছে অনেকের চিন্তাশক্তি। দুর্যোগ ও ত্রাণ সচিব দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবিতে অজ্ঞানতার প্রকাশ বলে উল্লেখ করেছেন। রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ নিজেকে কৃষকের সন্তান দাবি করে সুনামগঞ্জের পরিবেশ প্রকৃতি বিবেচনা না করে কোন যুক্তিতে হাওর অঞ্চলে বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য ইকোনমিক জোন স্থাপনের অনুরোধ করবেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে? এই ইকোনমিক জোন নির্মাণের অনুরোধ কার স্বার্থে?
পানি সম্পদ মন্ত্রী দাবি করলেন তাদের কিছুই করার ছিলনা কারণ বাঁধের উচ্চতার চেয়ে পানির উচ্চতা বেশি ছিল। এ বিষয়গুলোকে খতিয়ে দেখলে বাস্তব পরিস্থিতি বোঝা যাবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ২০০২ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, “অতিবৃষ্টি, বন্যা. . . . ইত্যাদির কারণে আক্রান্ত এলাকার গবাদি পশু পাখি ও মৎস্যসহ জনগোষ্ঠীর জীবন, জীবিকা, স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, সম্পদ, সম্পত্তি ও পরিবেশের এইরূপ ক্ষতিসাধন করে অথবা এইরূপ মাত্রায় ভোগান্তির সৃষ্টি করে, যাহা মোকাবেলায় ঐ জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সম্পদ, সামর্থ্য, ও সক্ষমতা যথেষ্ট নয় এবং যাহা মোকাবেলার জন্য ত্রাণ ও বাহিরের যে কোন প্রকারের সহায়তা প্রয়োজন।”
সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি “স্বীয় বিবেচনায় বা ক্ষেত্রমত, উপধারা (৩) এর অধীনে সুপারিশ প্রাপ্তির পর, যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, দেশের কোন অঞ্চলে দুর্যোগের কোন ঘটিয়াছে যাহা মোকাবেলায় অতিরিক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং অধিকতর ক্ষয়ক্ষতি ও বিপর্যয় রোধে বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করা জরুরি ও আবশ্যক,তাহা হইলে সরকারী গেজেটে বিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলকে দুর্গত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করিতে পারিবেন।”
পানিসম্পদ মন্ত্রী দাবি করছেন ২৯ শে মার্চের পর থেকেই পানি বৃদ্ধি শুরু হয় এবং বাঁধের উচ্চতার চেয়ে পানির উচ্চতা বেশি হয়ে যায়, অথচ বাস্তব ঘটনা হল ফসল তলিয়ে যায় প্রথম ধরমপাশার ছোট হাওর চন্দ্রসোনারতাল ২৩ ফেব্রুয়ারি, জগন্নাথপুরের নলুয়ার হাওর তলিয়ে যায় ২৮ শে মার্চ। যদি মন্ত্রীর কথা সঠিক ধরেও নেয়া হয় তাহলে পানি উপচিয়ে পড়ার কথা বাঁধ ভেঙে পানি ঢোকার ব্যপার হত না। প্রধানমন্ত্রীর শাল্লার সমাবেশের আশ্বাস দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হয়েছে। দায়ী পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা, সরকারি দলের ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
হাওর অঞ্চলের মানুষের পাশে দাঁড়ান
এ বছর হাওরের জমিতে ৩০ লক্ষ মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বোরো ধানের চাষ করা হয়েছিল। প্রায় একমাস ব্যপৃত ঢলের পানিতে ৮০% তলিয়ে গেছে, একমাত্র ফসল বোরো ধানের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ২৪ লক্ষ পরিবারের অন্তত ৯০ লক্ষ কৃষক, তাদের গবাদিপশু, সন্তান সন্ততিরা এক অবর্ণনীয় পরিস্থিতির মাঝে পড়েছে যার নজির নিকট অতীতে নেই। আশংকাজনকভাবে সুনামগঞ্জ জেলায় শিক্ষার্থীর ভর্তি হওয়া ও পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সংখ্যা কমেছে। নীরবে মানুষ এলাকা ছাড়ছে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। হাতে টাকা নেই, ঘরে খাবার নেই, ঋণের চাপ, হাওরে মাছ থাকলেও জলমহালের ইজারা প্রথার কারণে মাছ ধরার অধিকার থেকেও বঞ্চিত। সব মিলিয়ে দূর্বিষহ পরিস্থিতি, মানুষ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব এসব মানুষের পাশে দাঁড়ানো। সামনে ঈদ, সারাদেশের মানুষের ঈদ আনন্দের হলেও হাওরপাড়ের মানুষের কাছে আনন্দ আজ বিষাদময়। এরকম পরিস্থিতিতে এই দায়বোধ থেকে নিম্নোক্ত দাবিতে আমরা স্বাক্ষর সংগ্রহ করছি। সংগৃহীত স্বাক্ষরসহ জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ করা হবে সিলেট বিভাগের ৪ জেলায়। এই কর্মসূচীতে সকলের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি।
দাবিসমূহঃ
১. সুনামগঞ্জসহ ক্ষতিগ্রস্থ হাওর অঞ্চলকে দূর্গত এলাকা ঘোষণা কর
২. সরকারি কৃষি ঋণ মওকুফ কর। এন.জি.ও. ঋণ, মহাজনী ঋণ উত্তোলন ২ বছরের জন্য স্থগিত কর। সকল সুদ মওকুফ কর।
৩. বিনা সুদে, বিনা শর্তে কৃষি ঋণ দাও। শস্য বীমা চালু কর। বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ দিতে হবে।
৪. জলমহালের ইজারা প্রথা বাতিল কর। সকল জেলে, কৃষকদের অবাধে মাছ ধরার অধিকার দাও।
৫. ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের তালিকা প্রকাশ কর, সারা বছর রেশনিং চালু কর। ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতি বন্ধ কর।
৬. গবাদি পশুর খাদ্য সরবরাহ কর।
৭. বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের শিক্ষার্থীদের যে কোন স্তরে ভর্তি ফি, পরীক্ষা ফি, মাসিক বেতন মওকুফ কর। সারাবছর বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ কর।
৮. ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় ওয়ার্ডভিত্তিক সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র চালু কর। বিনামূল্যে ঔষধ সরবরাহ কর।
৯. দ্রুত নদী খননের ব্যবস্থা কর। সংকুচিত নৌপথ সম্প্রসারণ কর।
১০. প্রকৃতি নির্ভরতা কাটানোর লক্ষ্যে হাওর গবেষণা ইনস্টিটিউট চালু কর।
১১. দায়ী পনি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তা, ঠিকাদারদের গ্রেফতার কর, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাও।
১২. হাওরের সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ণ কর।
কর্মসূচী
জুন মাসব্যাপী সিলেট বিভাগের ৪ জেলায় স্বাক্ষর সংগ্রহ
জুলাই মাসে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ
আগস্ট মাসে সিলেটে আঞ্চলিক হাওর কনভেনশন
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)
(সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার)
যোগাযোগঃ রাজা ম্যানশন (৩য় তলা), জিন্দাবাজার, সিলেট। ফোন: ০৮২১-৭২১৭০৩, ০১৭১১-৯৬৬৪৫২,
email: [email protected]