[বিধান রিবেরু। লেখক ও চলচ্চিত্র সমালোচক। বাসদ (মার্কসবাদী)’র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, এদেশের অনন্যসাধারণ কমিউনিস্ট বিপ্লবী কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী গত ৬ জুলাই ২০২১ তারিখে প্রয়াণের পর ২৪ জুলাই ২০২১ চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র-এর উদ্যোগে অনলাইনে আয়োজিত ‘সংশপ্তক বহমান’ শীর্ষক স্মরণসভায় বিধান রিবেরু বক্তব্য রাখেন। তাঁর বক্তব্যটি পরবর্তীতে সম্পাদিতরূপে ‘কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী স্মারকগ্রন্থ’-এ সংকলিত হয়। কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর ১ম মৃত্যুবার্ষিকীতে বক্তব্যটি এখানে তুলে ধরা হলো]
ধন্যবাদ। সবাইকে শুভসন্ধ্যা! এই আয়োজনটি তো আসলে অনুমেয়ই ছিল যে হবে। কারণ হায়দার ভাই (মুবিনুল হায়দার চৌধুরী) এমনই এক চরিত্র, এমনই একজন মানুষ। এই কোভিডের সময় বলে অনুষ্ঠানটি অনলাইনে করতে হচ্ছে, না হলে সশরীরে অনুষ্ঠানটি করা যেত, তাতে যে বাড়তি যোগটা হতো, তা হচ্ছে হায়দার ভাইয়ের উছিলায় আমরা যারা একসময় বাসদ রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলাম, তাদের আবার দেখা হতো। স্মৃতি রোমন্থন হতো। স্মৃতি রোমন্থনের ইংরেজি হচ্ছে nostalgia, এর মানে তো বাড়ি ফেরার বেদনা। তাই না? বেদনা জাগানিয়া স্মৃতি। স্মৃতি ফিরে এলে তা বেদনাও জাগাতে পারে মানুষের মনে। তো সেই বেদনাই জাগ্রত হচ্ছে আজকের আলোচনায়। স্মৃতিকাতরতা নিয়ে বলতে চাই, আমি বাসদ-এর ছাত্র সংগঠন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাথে যুক্ত ছিলাম। আমি যখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র, বিজ্ঞান কলেজে পড়ি, তখন আমার বন্ধু তাহসিন (তাহসিনুর রহমান নিকো), মূলত তার বড় বোন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ফ্রন্টের সাথে যুক্ত ছিল। সেই সুবাদে তাহসিন প্রথমে, তার পরপরই আমি রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়ি। স্কুলের বন্ধুদের ভেতর কাজ শুরু করি।
নব্বই দশকের শুরুর দিকে তখন কচি ভাই (জহিরুল ইসলাম কচি) বিজ্ঞান কলেজে কাজ করতেন। মানে আমরা যারা বাম রাজনীতি করি, রিক্রুটমেন্ট বলি, সেই রিক্রুটমেন্টের দায়িত্বে প্রধানত কচি ভাই ছিলেন। তার সাথে ধীরে ধীরে আমাদের দেখভালের দায়িত্ব পান চিশতী ভ্রাতৃদ্বয় (হাসান চিশতী ও হোসেন চিশতী), নাঈম ভাই (আলী মো. আবু নাঈম)। তো বিজ্ঞান কলেজে তাদের যাতায়াত ছিল। তাহসিন ও আমি মিলে তখন দেয়ালিকা বের করি-‘ডাক দিয়ে যাই‘। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলাম আমি। হাতে লেখা গল্প-কবিতা-নিবন্ধ ছেপেছিলাম। বিজ্ঞান কলেজে তখন বলা যায়, নিয়মিত রাজনীতি শুরু হয়। তাহসিনের হাত ধরেই স্কুলে ভ্যানগার্ড পত্রিকাটি প্রবেশ করে। আমরা দুজনে মিলে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে মিছিল-মিটিং করি। পারলে অন্য বন্ধুদেরও নিয়ে যাই। তখন আমরা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। আপনারা বলতে পারেন, ইঁচড়ে পাকা!
আপনারা জানেন, কিশোর বয়সে প্রত্যেকটা মানুষের জীবনেই কিন্তু একজন নায়কের দরকার হয়। এখন যেমন মারভেল কমিক্সের নায়করা সামনে আসেন: সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান ইত্যাদি। আমাদের বাচ্চা বয়সে, আরও যখন ছোট ছিলাম তখন ‘হি-ম্যান’ ছিল। তো হি-ম্যান হোক বা শি-ম্যান হোক, কিশোর বয়সে যখন আমরা আসি তখন ছাত্র ফ্রন্টের মধ্য দিয়ে ক্ষুদিরামের কথা জানতে পারি। ক্ষুদিরামের যে ত্যাগ-তিতিক্ষা, সেটার কথা জানতে পারি। এবং হায়দার ভাইয়ের সাথে পরিচয় হওয়ার পর আরও ভালো করে ক্ষুদিরামকে বুঝতে পারি। হায়দার ভাই হয়ে ওঠেন আমাদের রিয়েল টাইম হিরো। সত্যিকারের নায়ক সামনে উপস্থিত থাকলে একটা দিক-নির্দেশনা পাওয়া যায়, সেটার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হায়দার ভাই।
আমরা জানি, ১৯৮০ সালে বাসদ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। শুধুমাত্র মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর মাধ্যমে নয়, সেখানে খালেকুজ্জামান এবং আরও অন্য নেতারাও ছিলেন। জামান ভাইয়ের বিষয়টা বলি, আমরা যখন পার্টি অফিসে যেতাম তোপখানা রোডে, তখন সেখানে জামান ভাইয়ের কথা শুনতাম। কিন্তু জামান ভাইয়ের প্রতি ভয়মিশ্রিত, শ্রদ্ধামিশ্রিত একটা ফারাক থাকত সবসময়। উঁনি যে কক্ষে থাকতেন, আমরা আসলে ওইদিকটা মাড়াতাম না। বুঝতেই পারছেন, সেসময় কিশোর বয়সে ছিলাম। কিন্তু অদ্ভুত বিষয়, সেসময় সম্ভবত হায়দার ভাইয়ের বয়স ছিল ষাটোর্ধ্ব, তারপরও হায়দার ভাইয়ের সাথে যে বন্ধুত্বটা হলো, আমি বন্ধুত্ব বলব এই কারণে যে তিনি বন্ধুর মতোই আমাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করতেন। অষ্টম শ্রেণি থেকে স্কুলের সক্রিয় তিন বছর, এরপর নটর ডেম কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠা পর্যন্ত, প্রায় ৬-৭ বছর ধরে যখন আমি ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলাম, সেই দিনগুলোতে একটা বিষয় হায়দার ভাই নিয়মিত করে যেতেন, সেটা হলো পাঠচক্র। আমি প্রত্যেকটা পাঠচক্রে উপস্থিত থাকতাম, ব্যতিক্রমহীনভাবে। আমরা একেকটি বই ধরে ধরে পাঠচক্র করতাম। আমার মনে আছে, আমি সেসময় ক্লাস নাইনে। গিটার বাজাতাম, গানটান গাইতাম। হায়দার ভাই খুব ইন্সপায়ার করতেন। আমার মনে আছে একবার ঈদের সময়, পাঠচক্রে আগেই বলে দিয়েছিলেন, ‘তুমি কিন্তু গিটার নিয়ে আসবে।‘ তো আমি গিটার নিয়ে গেলাম। উঁনি বলেন যে একটা গান শোনাও। মনে আছে, আমি সুমন চট্টোপাধ্যায়ের ‘পাগল‘ গানটা গেয়ে শুনিয়েছিলাম। লালনের গান শুনিয়েছিলাম। গিটার বাজিয়ে রবীন্দ্রসংগীতও গেয়েছিলাম। তখন তিনি বলেছিলেন যে, ‘খুব ভালো লাগল তোমার গান।‘
হায়দার ভাই সম্পর্কে আরও টুকরো টুকরো স্মৃতি যদি বলি, সেটা হচ্ছে যে ক্লাস টেনে তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছি, ফাঁকা সময়। তো এতগুলো ছেলেমেয়ে আমরা একসাথে যুক্ত হয়েছি। প্রায় ২৬ জন ছেলেমেয়ে একই ব্যাচের। আসলে আমাদের দিয়ে কী করানো যায়! সেসময় ঝুম্পাদি’রা (রুছেলী খান ঝুম্পা) ছিলেন। আমাদের একটা পাঠাগার ছিল নাখালপাড়ায়–‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি পাঠাগার’। সেটাতে আমরা যুক্ত ছিলাম। আমরা ক্ষুদিরামের উপর একটা নাটক করলাম। নাটক লিখেছিলেন নাঈম ভাই। নির্দেশনায় ঝুম্পাদি। নাটকে আমার চরিত্রটা ছিল হেমচন্দ্রের। অর্থাৎ ক্ষুদিরামকে যে রিক্রুট করে। পাঠাগারে করা রিহার্সালও কিন্তু হায়দার ভাই দেখিয়ে দিয়েছিলেন। উঁনি বলছিলেন যে, ‘তুমি এরকম করে আসতে পার, বা ওরকম করে আসতে পার।’
হায়দার ভাই নানা ধরনের ইনভলভ্মেন্টের মধ্যে দিয়ে আমাদের সাথে যুক্ত ছিলেন। বাসদ নেতাদের ভেতর হায়দার ভাই-ই ছিলেন আমার চিন্তা পেশ করা এবং চিন্তা গ্রহণ করার জায়গা। যেহেতু ৬-৭ বছর নিরন্তরভাবে আমি পাঠচক্রটি করেছি এবং হায়দার ভাইয়ের যে মেস ছিল নাখালপাড়ায়, সেখানেও আমার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে বহুবার। যেটা কচি ভাই বলছিলেন, উঁনি ক্লাসিক্যাল মিউজিক পছন্দ করতেন। স্পষ্ট মনে আছে, তিনি আমাকে ব্যাখ্যা করছিলেন যে, ‘দেখ, ধ্রুপদী সংগীত কোত্থেকে এসেছে? ধ্রুপদী সংগীত তো আসলে প্রকৃতির সংগীত। প্রকৃতিতে এই যে গাছের শরশর শব্দ, নদীর কুলকুল শব্দ–এখান থেকেই কিন্তু মানুষ একটা আর্টিকুলেট করে সংগীতকে ধরার চেষ্টা করে। এবং সেটাই কিন্তু ক্লাসিক্যাল মিউজিকে রূপান্তর হয়।’ এই যে ধ্রুপদী সংগীত শোনার সূত্রটা ধরিয়ে দেওয়া–এটা কিন্তু উঁনার কাছ থেকে পাওয়া। তারপর অজয় চক্রবর্তী শোনা, উঁনার কাছ থেকে পাওয়া। এইচএমভির ভিন্টেইজ বলে একটা সিরিজ বের হতো সেসময়, খুব দামি কালেকশন। একটা বাক্সের ভেতরে চারটা করে ক্যাসেট থাকত। উঁনি শুনতেন। ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীত এবং পশ্চিমা ধ্রুপদী সংগীত যেমন মোৎজার্ট বা বিটোফেন, এই ধরনের জার্মান বা ইউরোপিয়ান যে মিউজিকগুলো রয়েছে, সেগুলো উঁনি শুনতেন এবং আমাকেও শুনতে দিতেন পার্সোনালি। যাওয়ার সময় বলতেন, ‘এই ফেরত দেবে কিন্তু।’
আমি শুনতাম, পরে হায়দার ভাইকে ফেরত দিয়ে আসতাম। আবার কখনও কখনও আমি নিজে রেকর্ড করে রাখতাম। সেসময় ক্যাসেট ছিল আপনারা জানেন। ৩৫ টাকা করে ক্যাসেট পাওয়া যেত। আমি অনেকসময় রেকর্ড করে রাখতাম। হায়দার ভাইয়ের সাথে সেসময় আমি হাঁটতেও বের হতাম। বৈকালিক যে ভ্রমণে যেতেন জাহাঙ্গীর গেট পর্যন্ত, আমিও উঁনার সাথে হাঁটতে গিয়েছি কয়েকদিন। ওখানে ‘বুকওয়র্ম’ বলে একটা বইয়ের দোকান আছে। বইয়ের দোকানের পাশে ছোট্ট একটা খাবারের দোকান আছে। সে খাবারের দোকানে নাখালপাড়া থেকে হেঁটে আমরা যেতাম। আমরা বসতাম। আমি একটা চিকেন পেটিস খেতাম, উঁনিও একটা খেতেন। উঁনি একটা কফি খেতেন। আমিও একটা কফি নিতাম। খেতে খেতে গল্প করতাম। সেই গল্পের বিষয় বিচিত্র। কিন্তু হার্ডকোর যে পলিটিক্স, ওটা বোঝার বয়স তখনও আমার হয়নি। আমার বয়স ১৮ বছরও হয়নি সেসময় বলতে গেলে। তিনি শরৎচন্দ্র নিয়ে যেমন আলাপ করতেন, তেমনি শিবদাস ঘোষের লেখাপত্র, তখন মাত্র পড়া শুরু করেছি, সেগুলো নিয়েও কথা বলতেন। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে পড়া শুরু করেছি সেসময়। হুমায়ূন আহমেদ নিয়ে কথা হতো, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিয়ে কথা হতো। হায়দার ভাই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং সমরেশ মজুমদার ঘরানার লেখকদের গুরুত্ব দিতেন না। উঁনি মনে করতেন যে, এরা একেবারেই বাজারি লেখক। বলতেন, ‘এদের লেখা তুমি পড়বে না। এদের লেখা পড়া মানে সময় নষ্ট করা।’ আমি তখন বলতাম, ‘আমি যদি না-ই পড়ি তাহলে বুঝব কী করে এটা পচা লেখা! অন্যের মুখে ঝাল খাওয়ার দরকার কী! নিজেই একটু ঝাল খেয়ে দেখি!’ তো এসব নিয়ে কথা হতো।
বই পড়ার ক্ষেত্রে, কোনো উপন্যাস যেমন ধরুন ‘পথের দাবী’র ক্যারেক্টারগুলো বা শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’র যে ক্যারেক্টার, সে ক্যারেক্টার বিশ্লেষণ করতেন। আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর তিনি ধৈর্য সহকারে দিতেন। আমরা কথা বলতাম রবীন্দ্রনাথ নিয়ে। একবার আমরা সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র ‘হীরক রাজার দেশে’ দেখলাম। টিএসসি মিলনায়তনে, শিক্ষা সম্মেলনের এক সন্ধ্যায় ছবিটি বড় পর্দায় দেখানো হলো। পরে ছবিটি নিয়ে অনেক আলোচনা হলো। সেই ছবিটাকে যদিও পরবর্তীকালে, ভিন্নভাবে পাঠ করার প্রয়াস হয়েছে আমার, ‘সত্যজিতের কলকাতা ত্রয়ী’ বইতে সেটা আপনারা দেখতে পাবেন। কিন্তু সেসময় একধরনের পাঠের মধ্য দিয়ে আমরা গিয়েছি। এবং সেই পাঠের দিকটি আসলে তুলে ধরেছিলেন হায়দার ভাই।
আমি আলোচনা বেশি দীর্ঘ করব না। যেটুকু বলতে চাই, সেটা হচ্ছে যে বাম সংস্কৃতির ভেতরে, মানে বাম রাজনীতিকে যে কারণে মানুষ, আপামর জনতা শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে, সেটার প্রতিভূ হয়তো বা হায়দার ভাইকেই ধরা যায়। বাম রাজনীতি যারা করেন না, তারা ভালো করেই জানেন যে, যারা বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকেন তারা সিলেবাস করে লেখাপড়া করেন। আমাদের ১৯-২০টার মতো বইয়ের একটা সিলেবাস ছিল। সেটার মধ্যে ‘গোরা’ উপন্যাস ছিল, শরৎচন্দ্রের কিছু উপন্যাস ছিল, শিবদাস ঘোষের কিছু বই ছিল, জামান ভাইয়ের বইও ছিল একটা। আমরা সিলেবাস করে বই পড়তাম। কাজেই যারা বাম রাজনীতি করে না, তারা কিন্তু জানতেন যে এরা লেখাপড়া করে, এরা সিলেবাস ধরে ধরে পড়াশোনা করে এবং সেটা ধরে ধরে এরা আলাপও করে। কাজেই এই যে একটা সংস্কৃতি, এ সংস্কৃতির ধারক আমি একমাত্র বাসদের ভেতরে হায়দার ভাইকে পেয়েছি। মনে হয় এটার একটা কারণ, পাঠচক্রটা উঁনি পরিচালনা করতেন। নিশ্চয়ই অন্যরা, শুভ্রাংশুদারাও (শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী) লেখাপড়ার মধ্যেই থাকতেন। কারণ তাদেরও এক ধরনের চর্চা অবশ্যই ছিল। জামান ভাইয়েরও ছিল।
যেটা বলছিলাম, যেহেতু হায়দার ভাইয়ের সাথে আমার সেই যোগাযোগটা স্থাপন হয়ে গিয়েছিল, উঁনি বয়সে এত বড়, কিন্তু বন্ধুত্বটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল, তাই বয়সের দিক থেকে অসম হলেও, উঁনি সেটা কখনোই বুঝতে দেননি। এটা একটা বিরাট যোগ্যতা আমি মনে করি। একজন ষাটোর্ধ্ব মানুষ ১৯-২০ বছরের এক ছেলের সাথে, কিশোরোত্তীর্ণ তরুণের সাথে মিশছেন বন্ধুর মতো, তর্ক-বিতর্ক করছেন। ব্যাখ্যা করছেন উপন্যাস নিয়ে, চলচ্চিত্র নিয়ে। এর ভেতর দিয়ে রাজনৈতিক যে দর্শন সেটাকে তিনি পরিচালিত করছেন ধীরে ধীরে। এই যে শিল্প-সাহিত্যের ভেতর দিয়ে রাজনৈতিক বোধ, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া, এটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। যেমন ধরুন ‘ইস্পাত’ উপন্যাসটি নিয়ে কথা হতো অনেক, উপন্যাসের পাভেল করচাগিন চরিত্রটি নিয়ে আলাপ করতেন তিনি। এই যে বোধের ভেতরে আদর্শ জারিত করা, সেটাই করতেন তিনি। একটা প্রশ্ন তো আছেই আসলে যে, সাহিত্যিকরা কী করেন? সাহিত্যিকরা মননের নির্মাণ করেন। হায়দার ভাইও সেটাই করেছেন, আমার মননের নির্মাণে অনেকাংশে ভূমিকা রেখেছেন। সেটা সাহিত্যালোচনার মধ্য দিয়ে, শিল্পসংস্কৃতির আলোচনার মধ্য দিয়ে। সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির যে মহান আদর্শ, ১৯৮০ সালে যে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ভিত্তিতে বাসদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই ভাবাদর্শের বোধটা আসলে এই সকল কিছুর ভেতর দিয়ে তিনি জারিত করে দিতেন। সে কারণে এটা আমার কাছে মেকানিকাল বা যান্ত্রিক মনে হতো না। আমার কাছে মনে হতো সেই ঋত্বিক ঘটকের সিনেমার মতোই ‘অযান্ত্রিক’, যন্ত্রের ভেতরেও প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা।
আমি এটুকু বলে শেষ করছি যে, হায়দার ভাইকে নিয়ে আরও অনেক কথা বলা যায়। ধরে ধরে টুকরো টুকরো স্মৃতি বলা যাবে। যেহেতু আজকে অনেকক্ষণ ধরে আলোচনা চলছে এবং চলবে। যদি কখনও সশরীরে দেখা হয় আরও কথা হবে নিশ্চয়ই। আজকে এ পর্যন্ত বলেই শেষ করছি। হায়দার ভাইয়ের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও আপনাদের ধন্যবাদ, শুভরাত্রি জানিয়ে শেষ করছি। ধন্যবাদ।