পুলিশের ভাষ্যে শেষপর্যন্ত জানা গেল, কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে হনুমান মূর্তির কোলের ওপর কোরান রেখেছিল ইকবাল হোসেন নামের একজন মাদকাসক্ত ভবঘুরে। কে তাকে এ কাজে পাঠিয়েছিল, তা এখন পর্যন্ত প্রশাসন জানায়নি। অথচ, ‘হিন্দুরা কোরান রেখেছে’ — এ অভিযোগে অসংখ্য হিন্দু মন্দির, পূজামণ্ডপ, বাড়িঘর, দোকানপাটে সাম্প্রদায়িক হামলা করেছে কিছু লোক। এর পেছনে স্থানীয়, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ষড়যন্ত্রের কথা বলছেন অনেকে। কিন্তু অন্তরালে যাই থাকুক না কেন — এটা হচ্ছে বাস্তবতা যে, ফেসবুকের প্রচার বা গুজব শুনেই ধর্ম রক্ষার নামে ভিন্ন ধর্মের লোকদের ওপর হামলা চালানোর জন্য শত শত লোক জড়ো হয়ে যায়। একথা সত্যি যে, বেশিরভাগ সাধারণ মুসলিম হামলা-লুটপাটে জড়িত হয়নি। কিন্তু, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকালে বোঝা যায় — ‘কোরান অবমাননা’র ঘটনায় হিন্দুবিদ্বেষ প্রচারকে সমর্থন করেছে অসংখ্য অসচেতন মুসলিম জনসাধারণ। দুস্কৃতকারীদের আক্রমণের বিরুদ্ধে সক্রিয়-পূর্বের তুলনায় এবার কম হয়েছে। সব মিলিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মনে গভীর হতাশা-অনাস্থা-অবিশ্বাসের ক্ষত তৈরি হয়েছে, নিজ দেশে তারা পরবাসী বোধ করেছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগীদের হাতে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। স্বাধীন বাংলাদেশেও তারা সমমর্যাদা ও নিরাপত্তা নিয়ে বসবাসের অধিকার পেল না এখনো!
এবারের ঘটনা প্রথম নয়, বিচ্ছিন্ন ঘটনাও নয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ বছরে এই দেশে ৩৬৮৯ বার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা হয়েছে। গত কয়েক বছরে ফেসবুকে মুসলমানদের ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ দেয়ার অভিযোগে অসংখ্য হামলা হয়েছে হিন্দুদের ওপর। দেশে মূল্যবৃদ্ধি-ঘুষদুর্নীতি-স্বৈরশাসন-বেকারত্ব-দলীয়করণ-মানবাধিকার লঙ্ঘন-ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র হরণ ইত্যাদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদ তেমন দেখা যায় না। কিন্তু ‘ইসলাম অবমাননা’কারীদের শাস্তি দিতে প্রায়ই ‘তৌহিদী’ জনতা মাঠে নামে। কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়, তাহলে তার নিন্দা-সমালোচনা করা যেতে পারে, প্রচলিত আইনে তার বিচারও হতে পারে। কিন্তু অপরাধ প্রমাণের আগেই আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে শাস্তি দেয়া এবং একজন যদি ‘অপরাধ’ করেও থাকে তার জন্য তার সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালানো যায় না। কোন ধর্মই এধরণের সম্প্রদায়গত শাস্তি অনুমোদন করে না, কোন আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ও সভ্য সমাজে এ চলতে পারে না। এধরণের হামলা সবসময় না হলেও সাম্প্রদায়িক ঘৃণা-বৈষম্য-নিরাপত্তাহীনতা ও বিচ্ছিন্নতাবোধের অনুভূতির মধ্যেই বসবাস এদেশের সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষদের। কেন দেশে এভাবে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বাড়ছে? ভিন্ন ধর্ম ও জাতির প্রতি ঘৃণা কারা, কি উদ্দেশ্যে ছড়াচ্ছে? কেন ধর্মীয় অনুভূতি দিনদিন উগ্র হয়ে উঠছে? এ কি শুধু আমাদের দেশেই, নাকি বিশ্বব্যাপী ঘটছে? বাংলায় হাজার বছর ধরে পাশাপাশি বাস করেও হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ, অসহিষ্ণুতা ও অবিশ্বাস কিভাবে এই চেহারা নিল? এর ফলে কারা লাভবান হচ্ছে? সাম্প্রদায়িকতা ও জাতিবিদ্বেষ সমস্যার উৎস ও মোকাবিলার যথার্থ দৃষ্টিভঙ্গি ও পথ কি হতে পারে — তা আলোচনার জন্যই এই লেখা।
এবারের ঘটনার সূত্রপাত — হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজার অষ্টমীর দিন ১৩ অক্টোবর কুমিল্লা শহরের একটি পূজামণ্ডপে হনুমান মূর্তির পায়ের কাছে মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কোরান পাওয়ার মাধ্যমে। প্রচার ছড়িয়ে দেয়া হয় — হিন্দুরা ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতিমার পায়ের কাছে কোরান রেখেছে মুসলমানদের ধর্মকে অপমান করার উদ্দেশ্যে। ফলে কোরান ‘অবমাননা’র এই ‘ঔদ্ধত্যে’র জন্য হিন্দুদের ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে হবে — এই লক্ষ্যে ‘তৌহিদী জনতা’ নামে সংগঠিত হয়ে কিছু লোক হামলা ও ভাংচুর করেছে হিন্দুদের কাছে পবিত্র দেবমূর্তি-পূজামণ্ডপ, আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ও লুট করেছে তাদের ধর্মস্থান মন্দির-আশ্রম-হিন্দু পল্লী-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। ১৩-১৭ অক্টোবর ৫দিনব্যাপী কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, ফেনী, রংপুরসহ দেশের অন্তত ১৬টি জেলায় এসব হামলা হয়েছে। নোয়াখালীর চৌমুহনীতে হামলাকারীরা নৃশংসভাবে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে ২ জন পূজারী বা ভক্তকে, হিন্দু পরিচয় পেলেই মারধর করেছে অনেককে, মূল্যবান সম্পদ লুটপাট করে নিয়ে গেছে। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে হিন্দু মন্দিরে হামলার উদ্দেশ্য সংগঠিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ বেপরোয়া গুলি চালালে মারা গেছে ৪ জন, আহত হয়েছে অনেক। কুমিল্লার একটি মন্দিরে হামলায় আহত একজন হিন্দু ভক্ত পরে মারা গেছেন। এই প্রাণহানি, ধ্বংসযজ্ঞ ও সংখ্যালঘু নির্যাতন ঘটেছে ‘হিন্দুরা কোরান অবমাননা করেছে’ এই ভিত্তিহীন গুজবকে কেন্দ্র করে। অথচ, সহজ বুদ্ধিতেই বোঝা যায় — কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন কোন হিন্দু প্রতিমার পায়ের কাছে কোরান রেখে মুসলিমদের ক্ষুব্ধ করার ঝুঁকি নেবে না। শত শত বছর ধরে এদেশে দুর্গাপূজা হচ্ছে, কোনদিন এধরণের ঘটনা ঘটেনি।
এবারের ঘটনায় কিছু বিষয় লক্ষ্যণীয়। কুমিল্লার পূজামণ্ডপে কোরান রেখেছে যে ইকবাল হোসেন, সে সরকারী দলের স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ঘনিষ্ঠ। কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের দুই নেতার দ্বন্দ্ব-প্রতিযোগিতা এঘটনার পেছনে ভূমিকা রেখেছে কিনা — সে সন্দেহ বিভিন্ন মহল থেকে উচ্চারিত হয়েছে। ১৩ অক্টোবরের ওইদিনই সন্ধ্যায় চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে ‘কোরান অবমাননা’-র প্রতিবাদে বিক্ষোভের ডাক দিয়ে ফেসবুকে প্রথম স্ট্যাটাস দিয়েছিল একজন ছাত্রলীগ কর্মী। সেখানেও ছাত্রলীগের দুই অংশ একে অপরের বিরুদ্ধে মন্দিরে হামলা ও লুটপাটে জড়িত থাকার অভিযোগ তুলেছে। ১৫ অক্টোবর শুক্রবার বিজয়া দশমী ও জুমার দিনে সবচেয়ে বড় হামলা হয়েছে নোয়াখালীর চৌমুহনীতে, যেখানে কয়েকঘন্টা ধরে ১৩টি মন্দিরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, লুটপাট ও হত্যা করা হয়েছে। অথচ আগে থেকে আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন নিরাপত্তার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়নি। হামলা শুরু হওয়ার পরও তারা সময়মত ঘটনাস্থলে যায়নি বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ। দেশের অন্যকিছু স্থানেও ওইদিন সংঘটিত সাম্প্রদায়িক আক্রমণের ঘটনায় পুলিশ ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে নিস্ক্রিয়তার অভিযোগ এসেছে। ইচ্ছাকৃত অবহেলার মাধ্যমে ঘটনা কিছুটা ঘটতে দেয়া হল কি না — এমন সন্দেহ উড়িয়ে দেয়া যায় না। ১৭ অক্টোবর রংপুরের পীরগঞ্জে জনৈক হিন্দু কিশোর কর্তৃক ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগে হিন্দু জেলেপল্লীতে আক্রমণ চালিয়ে ২০-২৫টি বাড়ী পুড়িয়ে দেয়া হয়। এই ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত র্যাবের হাতে আটক হওয়া এসএম সৈকত মণ্ডল রংপুর কারমাইকেল কলেজ ছাত্রলীগের নেতা। তিনি ফেসবুকে মিথ্যা পোস্ট ও উস্কানিমূলক মন্তব্যের মাধ্যমে স্থানীয় লোকজনকে উত্তেজিত ও সংগঠিত করেন। এবার বিভিন্নস্থানে মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলার যেসব ভিডিও পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায় — বেশিরভাগ হামলাকারী আধুনিক পোশাক পরা কিশোর-তরুণ। ফেসবুক-ইউটিউবে ওয়াজসহ নানাভাবে যে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও বিদ্বেষ প্রচার করা হচ্ছে লাগাতারভাবে, এর প্রভাব সমাজে কতটা বিস্তৃত হয়েছে তার প্রমাণ এই ঘটনা। শাসকদলের প্রশ্রয়ে ‘কিশোর গ্যাং’ কালচার ও যুবসমাজের একাংশের দুর্বৃত্তায়নের ফলাফল আজ টের পাওয়া যাচ্ছে।
একটা বিষয় প্রথমেই আলোচনা করা দরকার। আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৩ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে। প্রথমবার ২০০৮ সালে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেও দ্বিতীয়বার ২০১৪ সালে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ক্ষমতাসীন হয়। তৃতীয়বার ২০১৮ সালে নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিরোধী দলগুলোকে অংশগ্রহণ করালেও নির্বাচনের আগের রাতে পুলিশ ও প্রশাসনকে ব্যবহার করে নজিরবিহীন ভোটডাকাতির মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতা দখল করে। এভাবে জনগণের ম্যাণ্ডেট ছাড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক শক্তি বলে দাবি করে। এদেশের হিন্দুসম্প্রদায়ও নিরুপায় হয়ে সাধারণভাবে আওয়ামী লীগকেই ভোট দেয় ও সমর্থন করে। অথচ তাদের এই ১৩ বছরের অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী শাসনামলে হিন্দু-বৌদ্ধসহ ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর অসংখ্য সাম্প্রদায়িক আক্রমণ হয়েছে। কোন ঘটনারই যথার্থ বিচার ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি, সাম্প্রদায়িকতা প্রতিহত করতে প্রশাসনিক-রাজনৈতিক ও আদর্শগত-সাংস্কৃতিক উদ্যোগও শাসকদলের দেখা যায়নি। বরং কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধমন্দির ও পল্লীতে হামলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে, সুনামগঞ্জের শাল্লায় হিন্দুগ্রামে হামলাসহ অনেক ঘটনায় অন্যান্যদের সাথে আওয়ামী-যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাও যুক্ত বলে সংবাদমাধ্যমে এসেছে। দমন-পীড়ন চালিয়ে সারাদেশকে বিরোধীদল শূন্য করে ফেলা হয়েছে, সমাজের সবক্ষেত্রে সরকারদলীয়দের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব। ফলে, দেশে বর্তমানে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতার দায় আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে। এখানেই শেষ নয়, আওয়ামী লীগ সরকার নিজেদের গণবিরোধী ও দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনকে জায়েজ করতে একদিকে যেমন ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ ও ‘উন্নয়ন’-এর বুলি আউড়াচ্ছে, তেমনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে সুড়সুড়ি দিতে ‘ইসলামপসন্দ’ সাজারও চেষ্টা করছে। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি হেফাজতে ইসলামের সাথে আপোষ ও আঁতাত, পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন, ভাস্কর্য সরানো, মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসার ও বাজেট বৃদ্ধি, ওয়াজ মাহফিলের নামে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো। কওমী মাদ্রাসার সনদকে মাস্টার্সের সমমান দেয়া, ইসলামী জঙ্গীদের হাতে ব্লগার-লেখক-প্রকাশক হত্যার জন্য তাদের লেখালেখিকে দায়ী করা, সব উপজেলায় বিপুল ব্যয়ে মডেল মসজিদসহ ইসলামী কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠাসহ এর অনেক উদাহরণ দেয়া যায়। ধর্মকে ব্যবহারের এই রাজনীতির প্রভাব এই দলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে তৃণমূল পর্যন্ত প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে।
আসলে স্বাধীনতার পর থেকে গত ৫০ বছর ধরে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে, সেই আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি-এদের সহযোগী হিসেবে জামাতে ইসলামী — এরা সবাই দেশের আজকের পরিস্থিতির জন্য দায়ী। দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে সাম্প্রদায়িকতার সমস্যাকে বোঝা যাবে না। ১৯৫২-১৯৭০ ধারাবাহিক গণআন্দোলন ও ১৯৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে শোষণমুক্ত সাম্যের সমাজ, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের আকাক্সক্ষা সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরই মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ এসব অঙ্গীকারের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়ে বেপরোয়া লুণ্ঠন-দখলের মাধ্যমে রাতারাতি সম্পদশালী হওয়া ও রাজনৈতিক বিরোধী বামপন্থীদের ওপর দমন-নিপীড়ন চালিয়ে দেশে চূড়ান্ত একনায়কতান্ত্রিক শাসন কায়েম করা হয়। মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও সব ধর্মের সমান প্রচারের নামে বাস্তবে সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্মের প্রাধান্যই প্রতিষ্ঠিত হল। ধর্মীয় রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হলেও ধর্মভিত্তিক মাদ্রাসাশিক্ষা বহাল রাখা হলো, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা ও ওআইসি সম্মেলনে যোগদান করা হল। আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসনের প্রতিক্রিয়ায় জনমনে সৃষ্ট হতাশা ও ক্ষোভকে বামপন্থীরা গণআন্দোলন-গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সঠিক পরিণতিতে পরিচালিত করতে না পারার ফলে দেশে ঘাপটি মেরে থাকা মৌলবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থী শক্তি পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ পেয়ে গেল।
‘মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র’ — ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের এই চেতনার ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও গণভোটে এদেশের মানুষ যুক্ত হয়েছিল। কিন্তু ৫২-৬৯ব্যাপী ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রামসহ ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে সেই সম্প্রদায়গত মনন থেকে বেরিয়ে আসার জমি তৈরি হয়েছিল। গণতান্ত্রিক সংগ্রামে ও শ্রেণী-পেশার আন্দোলনে বামপন্থীরা বহু গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করলেও উদীয়মান জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষাকে তত্ত্বগতভাবে ধরতে না পারায় তারা শেষ পর্যায়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া বা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। ফলে উঠতি বাঙ্গালী বুর্জোয়াদের স্বার্থ ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্বকারী নেতা শেখ মুজিব ও দল আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে আওয়ামী লীগ করলেও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় তারা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে ধারণ করেছেন, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা বা ইহজাগতিকতার মতাদর্শকে দার্শনিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বোঝা বা চর্চা তারা করতে পারেননি। এটি বর্তমান যুগে বুর্জোয়াশ্রেণীর ঐতিহাসিক শ্রেণীগত সীমাবদ্ধতা। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে শুধু সকল ধর্মের সমান অধিকার নয়, রাষ্ট্র পরিচালনা ও সামাজিক কর্মকাণ্ডকে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখা বোঝায়। ফলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের শ্রেণীগত সীমাবদ্ধতা ও বামপন্থীদেরও সঠিক সংগ্রামের ব্যর্থতার কারণে গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন ও পরে স্বাধীনতার দাবিতে রাজনৈতিক আন্দোলনে মানুষ যতটা সামিল হয়েছে, সেই তুলনায় সাংস্কৃতিক আন্দোলন অর্থাৎ সমাজ মানসিকতায় গণতান্ত্রিক চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক মনন ছড়িয়ে দেয়ার কাজ ততটা অগ্রসর হয়নি। ১৯৭১-এ স্বাধীনতার মাধ্যমে এদেশে সীমাবদ্ধতাসহ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়ে বাঙ্গালী জাতীয় বুর্জোয়ারা রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু স্বাধীনতার পরও গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অসমাপ্ত কাজ ভূমিসংস্কার, ধর্মনিরপেক্ষতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, নারীমুক্তি, গণতান্ত্রিক শিক্ষা ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা অর্থাৎ সমাজের সার্বিক গণতান্ত্রিকীকরণের কাজ হয়নি। সাম্রাজ্যবাদের যুগে প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়াশ্রেণী একাজ আর কোথাও করবে না। কারণ তাতে তাদের শোষণ ও শাসনের ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্ক্ষা। ফলে এদেশের সমাজ মননে লাহোর প্রস্তাবের ভাবমানস বা মুসলিম জাতীয়তাবাদের অবশেষ রয়ে গেছে।
১৯৭৫ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারবর্গকে নৃশংসভাবে হত্যার পর ক্ষমতায় আসা মোশতাক সরকার নিজেদের অবৈধ ক্ষমতার পক্ষে সমর্থন আদায় করতে ‘ইসলামী মূল্যবোধ’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ঘোষণা করলো। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান একই পথ অনুসরণ করে সংবিধানের মাথায় ‘বিসমিল্লাহ’ বসালেন, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ছাঁটাই করলেন। তিনি নিজের সামাজিক ভিত্তি মজবুত করতে ‘রুশ-ভারতবিরোধী’ চীনাপন্থী বাম দলগুলোকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি ইসলামী দল ও শক্তিগুলোকে রাজনীতিতে পুনর্বাসন করলেন। এরপর পুনরায় সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করা জেনারেল এরশাদ দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের মাধ্যমে একটি ক্ষুদ্র ধনিকগোষ্ঠীকে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার রাস্তা অবাধ করে দিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি চরম দুর্নীতিগ্রস্ত ও লম্পট প্রকৃতির হলেও মানুষকে ধোকা দিতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা করলেন। ফলে এদেশে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা কার্যত দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হলো। ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক শাসনের পতন হয়ে ভোটের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও রাষ্ট্র ও সমাজ চলতে লাগলো একই ধারায়। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক উন্নয়ন বেশ কিছুটা হওয়ার মাধ্যমে দেশে ধনিকশ্রেণী ফুলেফেঁপে উঠলেও সাধারণ মানুষ বৈষম্য, অভাব, বেকারত্ব, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, গণতান্ত্রিক অধিকারহীনতার মধ্যেই কম-বেশি রয়ে গেল। কূপমণ্ডূক মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপক প্রসার, জামাতে ইসলামী ও কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক অন্যান্য ইসলামী দলসহ ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিস্তারের পাশাপাশি মূলধারার বুর্জোয়া রাজনীতিতেও ধর্মের ব্যবহার বাড়তে থাকলো। অর্থনীতিতে পুঁজিবাদী প্রতিযোগিতা ও বুর্জোয়া সংস্কৃতির বিশ্বায়নের ফলে মানুষের জীবনে অনিশ্চয়তা-ভোগবাদ-আত্মকেন্দ্রিকতা-বিচ্ছিন্নতা-মুল্যবোধহীনতা বাড়তে থাকলো। এর প্রতিক্রিয়ায় জনগণের একাংশের মধ্যে ধর্মাশ্রয়ী মনোভাব, বিশ্বাসনির্ভরতা, যুক্তিহীন অন্ধতা, ধর্মীয় মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরার প্রবণতা তৈরি হতে লাগলো। ব্যক্তিস্বার্থ ও মুনাফাকেন্দ্রিক বুর্জোয়া সংস্কৃতির বিপরীতে বিকল্প উন্নত আদর্শ হতে পারতো সমষ্টি স্বার্থকেন্দ্রিক ও পারস্পরিক সহযোগিতামূলক সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা। কিন্তু ইতিমধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
আশির দশকের শেষদিক থেকে ও নব্বই দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতনের ফলে বিশ্বব্যাপী প্রগতিশীল রাজনীতি দুর্বল হয় ও প্রবল হতাশা ছড়িয়ে পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীদের একাধিপত্য তৈরি হয় বিশ্বরাজনীতিতে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের বিকাশের সময়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদীরা সমাজতন্ত্র ঠেকাতে আদর্শিক প্রতিষেধক হিসেবে দেশে দেশে মৌলবাদী-প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ও সামরিক শাসকদের সমর্থন যোগাতো। এর জ্বলন্ত উদাহরণ আফগানিস্তানে ইসলামী মুজাহিদ বাহিনী ও আল-কায়েদা নেটওয়ার্ককে সৌদি আরব-পাকিস্তানের সমর্থনে মার্কিন অস্ত্র-প্রশিক্ষণ-অর্থসাহায্য প্রদান। ১৯৯১ সালে ইরাক-কুয়েত বিরোধের সুযোগে ইরাকে সামরিক হামলা চালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ এলাকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অনেক আগে থেকেই তারা ফিলিস্তিনীদের উচ্ছেদে ইজরায়েলী জায়নবাদীদের সমর্থন যুগিয়ে আসছিলো। এসবের প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট অবমানিত মুসলিম সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে ‘ইহুদী-নাসারা’বিরোধী শ্লোগান তুলে মুসলিম দেশগুলোতে নেটওয়ার্ক বিস্তার করে আল-কায়েদাসহ বিভিন্ন জিহাদী সংগঠন। মার্কিনীদের একসময়ের বন্ধু এই আল-কায়েদা ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিরাট সন্ত্রাসী হামলা চালায়। একে অজুহাত করে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’-এর নামে প্রথমে আফগানিস্তান, পরে ইরাক দখল করে নেয় মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদীরা। ইরাকে মার্কিন দখলদারিত্বের প্রতিক্রিয়ায় ও লিবিয়া-সিরিয়াকে নিয়ন্ত্রণে আনতে জিহাদী গ্রুপগুলোকে মার্কিন সাহায্যের সুযোগে সংগঠিত হয় চরমপন্থী ইসলামী সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএস। তারা ২০১৩ সালে সিরিয়া-ইরাকের একাংশে ‘ইসলামী খেলাফত’ কায়েম করে।
মার্কিন মদতে সৃষ্ট এই ইসলামী জঙ্গিবাদ দমনের নামে সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের যুদ্ধ অর্থনীতি টিকিয়ে রেখেছে ও বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তার-গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রেখেছে। অন্যদিকে দেশে দেশে খ্রিস্টান-হিন্দু-বৌদ্ধ মৌলবাদও শক্তিশালী হচ্ছে। আমেরিকা-ইউরোপেও অর্থনৈতিক সংকটের জন্য অভিবাসীদের দায়ী করে ও অশ্বেতাঙ্গদের প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে অভিবাসীবিরোধী, বর্ণবাদী, শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী বা নব্য-নাৎসিবাদী রাজনীতি শক্তিশালী হচ্ছে। ভারতে বিজেপি-র হিন্দুত্ববাদী ও মুসলিমবিরোধী রাজনীতি, বাংলাদেশের সাথে ভারতের সাম্রাজ্যবাদী আচরণ এবং অনির্বাচিত আওয়ামী সরকারের পেছনে ভারতের সমর্থন এদেশে ভারতবিরোধী মানসিকতা তৈরি করছে। ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও জাতীয় স্বার্থ-মর্যাদা রক্ষার গণতান্ত্রিক আন্দোলন সঠিক পথে গড়ে তোলা না গেলে এর ফলে হিন্দুবিরোধী সাম্প্রদায়িকতা বাড়াবে।
শোষণমূলক পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে বিশ্বব্যাপী বৈষম্য, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, বেকারত্ব বাড়ছে। অল্প কিছু ধনিকশ্রেণীর সম্পদের পরিমাণ বাড়ছে, অন্যদিকে বেশিরভাগ মানুষ গরীব হচ্ছে। করোনা মহামারীর মধ্যে এ চিত্র আরো প্রকট হয়েছে। এর বিরুদ্ধে দেশে দেশে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ-আন্দোলন মাঝে-মধ্যেই ফেটে পড়ছে। গণবিক্ষোভের কবল থেকে এই অন্যায় ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে ধনিকশ্রেণীর স্বার্থরক্ষাকারী শাসক দলগুলো জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে স্বৈরতান্ত্রিক-কর্তৃত্ববাদী-নিপীড়নমূলক-ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা কায়েম করছে। অন্যদিকে, জনগণের দৃষ্টি মূল সমস্যা থেকে সরিয়ে দিতে ও মানুষকে বিভক্ত করে রাখতে জাতিবিদ্বেষ-ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা-বর্ণবাদ-লিঙ্গগত বৈষম্য ইত্যাদি পশ্চাদপদ ধ্যান-ধারণাকে উস্কে দিচ্ছে। আমেরিকায় ট্রাম্প, ভারতে মোদি, রাশিয়ায় পুতিন, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার শাসনের দিকে তাকালে এ কথার সত্যতা মিলবে। সাম্রাজ্যবাদ তার আধিপত্য বিস্তারের প্রয়োজনে ও যুদ্ধ অর্থনীতি-অস্ত্র বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে বিশ^ব্যাপী যুদ্ধ-সংঘাত বজায় রাখতে চায়। এজন্য তারা ধর্মীয়-জাতিগত বিরোধকে কাজে লাগায়। ফরাসী বিপ্লবের মত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের উন্মেষকালে বুর্জোয়ারা সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার শ্লোগান তুলেছিল। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সংকট ও সাম্রাজ্যবাদের যুগে এসে বুর্জোয়ারা সেই প্রগতিশীলতার ঝাণ্ডা আজ ফেলে দিয়েছে। আজকে তারা জনগণকে কুসংস্কার-অন্ধবিশ্বাস-যুক্তিহীন উগ্র মানসিকতার অন্ধকারে ডুবিয়ে রাখতে চায়, তাতে তাদের শোষণ-শাসনের সুবিধা। এজন্য তারা মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতাকে মদত দিচ্ছে। ইজরায়েলী জায়নবাদীদের মার্কিন সমর্থন, আফগানিস্তানে প্রাধান্য বিস্তার করতে আলকায়েদা-তালেবানদের সাহায্য করা, সিরিয়া-লিবিয়ায় মার্কিনবিরোধী সরকার উৎখাতে মৌলবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া, ভারতের হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকারের সাথে মৈত্রী, সৌদি আরব-আমিরাতের প্রতিক্রিয়াশীল রাজতন্ত্রকে সমর্থন — ইত্যাদি এর উদাহরণ। উন্নত আদর্শ ও নৈতিকতা দিয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষমতা আজ আর বুর্জোয়াদের নেই। কারণ তারা সবাই দুর্নীতি-লুটপাট, সাধারণের সম্পত্তি আত্মসাৎ ও গণবিরোধী শাসনে লিপ্ত। ফলে ভোটের রাজনীতিতে জনগণের পশ্চাদপদ চিন্তাকে সুড়সুড়ি দিয়ে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করা ছাড়া তাদের আর পথ নেই।
এই অবস্থায় সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে হলে — ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের অবসানে ও জনজীবনের সমস্যা সমাধানে ধর্ম-জাতি নির্বিশেষে শোষিত জনসাধারণের ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক আন্দোলন শক্তিশালী করতে হবে এবং তার সাথে সাম্প্রদায়িকতা ও জাতিগত নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনকে মেলাতে হবে। এর সহযোগিতায় প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে সমাজের তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে দিতে হবে। সমাজে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে যে শূন্যতা বিরাজ করছে, তা পূরণে উন্নততর আদর্শের ভিত্তিতে এই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে গড়ে তুলতে হবে। আমরা সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, দেশপ্রেমিক, গণতন্ত্রমনা মানুষকে এই লক্ষ্যে সংগঠিত হওয়া এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আবেদন জানাই।
আশু দাবি
১। সারাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলা, হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটকারী ও তাদের মদদদাতাদের গ্রেফতার ও বিচার করতে হবে। পূর্বে সংঘটিত এ ধরনের সকল ঘটনার বিচার করতে হবে। সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতাদের শনাক্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে সুষ্ঠু তদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে। কোনভাবেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কিংবা নিরীহ মানুষকে হয়রানি করা যাবে না।
২। আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্তদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৩। ধর্মীয় সভা ও অনুষ্ঠানে, ওয়াজ মাহফিলে, ফেসবুক, ইউটিউবে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক প্রচার বন্ধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
৪। সাম্প্রদায়িক সংঘাত বন্ধে এলাকায় এলাকায় গণকমিটি গড়ে তুলতে হবে।
৫। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ধর্মীয় প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে। পাঠ্যপুস্তক থেকে সাম্প্রদায়িক বক্তব্য, লেখাসমূহ সকল উপাদান বাদ দিতে হবে। সর্বজনীন, বৈষম্যহীন, সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক ও একই পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে।
৬। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে। সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতাদের রাজনৈতিক দল থেকে বহিস্কার করতে হবে।
[উৎস: সাম্যবাদ, ৮ম বর্ষ ৬ষ্ঠ সংখ্যা, নভেম্বর ২০২১]