বর্তমান প্রজন্মের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কোনো শিক্ষার্থী বন্ধুকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়- ‘১৪ ফেব্রুয়ারি কী দিবস?’ চটজলদি উত্তরে সে বলবে- ‘কেন, ভালোবাসা দিবস।’ যদি আবারো বলা হয়- ‘১৪ ফেব্রুয়ারি আমাদের দেশের শিক্ষা বা রাজনৈতিক আন্দোলনে কেন তাৎপর্যপূর্ণ?’ বেশিরভাগ শিক্ষার্থী হয়তো ইতস্তত ভঙ্গিতে বলবে-‘জানি না তো’। এই ১৪ ফেব্রুয়ারিতেই সংগঠিত হয় বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছাত্র-গণআন্দোলন। জাফর-জয়নাল-দীপালী সাহার জীবনের দামে বাতিল হয়েছিলো স্বৈরাচারী এরশাদের কুখ্যাত মজিদ খান শিক্ষানীতি। এই আন্দোলনের ইস্পাতদৃঢ় পদভার ফাটল ধরিয়েছিলো এরশাদশাহীর দীর্ঘ নয় বছরের স্বৈরসিংহাসনের। ইতিহাসের সংগ্রামী শিক্ষা মানুষকে বর্তমানের অচলায়তন ভাঙ্গার শক্তি জোগায়। ইতিহাসের এই চেতনা উৎসারিত লড়াকু অধ্যায় ভুলিয়ে দিতে চায় আমাদের শাসকেরা। যারা এখনও তাদের স্বার্থের শিক্ষা আর রাজনৈতিক মতাদর্শ আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়। তবে নির্মোহ সত্য এটাও যে, ইতিহাসের সংগ্রামী চেতনা কখনও হারায় না।
তিরাশির আগুন জ্বালা ফাগুন!
আমাদের দেশে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বৃহৎ গণআন্দোলন সংগঠিত হয় ৯০-এর দশকে। যার সূচনা ঘটে ছাত্রআন্দোলনের হাত ধরে। দেশ স্বাধীনের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয় ক্ষমতা দখলের অন্তর্ঘাত। এর সুযোগ নেয় সামরিক জেনারেলরা। শুরু হয় ক্যু-পাল্টা ক্যু। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ। এরশাদের ঘোষণা— “আমি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ, সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাহায্য ও করুণায় এবং আমাদের মহান দেশপ্রেমিক জনগণের দোয়ায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বুধবার থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সকল ও পূর্ণ ক্ষমতা গ্রহণ করছি এবং ঘোষণা করছি যে, গোটা বাংলাদেশ অবিলম্বে সামরিক আইনের আওতায় আসবে।” এই ঘোষণার সাথে সাথে নিষিদ্ধ হলো দেশের সংবিধান। নিষিদ্ধ হলো প্রকাশ্য রাজনীতি। সামরিক শাসনের সমালোচনা মানেই সাত বছরের কারাদন্ড। দেশ চলবে স্বৈরশাসক এরশাদের একচ্ছত্র হুকুমে! দেশের এই রকম একটা চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক আর দমবন্ধ পরিস্থিতিতে রাস্তায় নেমে প্রথম প্রতিবাদধ্বনি উচ্চারণ করে ছাত্ররাই। প্রথম দিনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় বিক্ষোভ মিছিল। পোস্টার লাগাতে গিয়ে গ্রেফতার হন বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর নেতা শিবলী কাইয়ুম, হাবিবুর রহমান, আব্দুল আলী। সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে তাদের সাত বছরের কারাদন্ড হয়। ২৬ মার্চ সাভারে স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে গিয়েই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে উচ্চারিত হয় শ্লোগান। খবর শুনে সাভার ক্যান্টনমেন্ট থেকে সেনাবাহিনীর গাড়িবহর হাজির। চালায় অকথ্য নির্যাতন। প্রতিবাদে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেয়ালে দেয়ালে লাল-কালো অক্ষরে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে উৎকীর্ণ হয়— ‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’। পুলিশ যতই দেয়াললিখন মুছে ফেলে, ছাত্ররা ততই গভীর রাতে ‘চিকামারা’ ছদ্মনামে সংগঠিত হয়ে দেয়াললিখন চালিয়ে যেতে থাকে। সেপ্টেম্বরে এরশাদ কুখ্যাত মজিদ খান শিক্ষানীতি প্রণয়ন করলে, ছাত্রসংগঠনগুলো প্রত্যাখান করে বিবৃতি প্রদান করে। মহান শিক্ষাদিবসকে (১৭ সেপ্টেম্বর) সামনে রেখে ছাত্রসংগঠনগুলো মজিদ খান শিক্ষানীতি বাতিলের পক্ষে একমত হয়। ছাত্রসমাজ এই শিক্ষানীতিকে পরাধীন দেশের স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের শরীফ শিক্ষাকমিশনের (১৯৬২) নব্য-সংস্করণ হিসেবে আখ্যা দেন। ২১ নভেম্বর গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। সারা দেশে শুরু হয় গণস্বাক্ষর সংগ্রহ। শুরু হয় সংগঠিত আন্দোলন। পুলিশ গ্রেফতার করে ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি খন্দকার মোহাম্মদ ফারুকসহ আরও অনেককে। গ্রেফতার-ধরপাকড়-হামলার প্রতিবাদে ৮৩’র ২৭-২৮ জানুয়ারি পালন করা হয় সর্বাত্মক ছাত্রধর্মঘট। দাবি মেনে না নিলে ধর্মঘটের পর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৪ ফেব্রুয়ারি সচিবালয় ঘেরাওয়ের কর্মসূচি ঘোষণা দেয়। আন্দোলন নেয় নতুন মোড়, নতুন মুহূর্ত সৃষ্টির অপেক্ষামাত্র।
ঐতিহাসিক ১৪ ফেব্রুয়ারি— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হয় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। তাদের রক্ত প্রবাহে স্বৈরাচারবিরোধী ঘৃণার শিহরণ! দৃপ্ত পদভার, বজ্রমুষ্ঠি আর উচ্চকিত শ্লোগানে ধাবমান স্পর্ধিত মিছিল এগিয়ে চলে সচিবালয় অভিমুখে। এ দিকে কাঁটাতারের ব্যারিকেড দিয়ে সাজোয়া যান, জলকামান আর বুলেটভর্তি ভারি বন্দুকে উদ্ধত স্বৈরাচারী এরশাদের হিংস্র পুলিশ। মিছিল কার্জন হল গেট পার হয়ে হাইকোর্টের দক্ষিণ গেটের সামনে পুলিশি ব্যারিকেডের সামনে আসতে না আসতেই হিংস্রতার নগ্নমূর্তি ধারণ করে এরশাদী পুলিশ। নির্বিচারে চলে গুলিবর্ষণ। গুলিতে বিদীর্ণ হয় জাফর-জয়নালের তাজা প্রাণ। জয়নালের গুলিবিদ্ধ শরীর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা নিশ্চিত করে স্বৈরাচারের ঘাতক পুলিশ। শিশু একাডেমির অনুষ্ঠানে আসা শিশু দীপালী সাহার কোমল প্রাণ কেড়ে নেয় ঘাতক বুলেট। রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। দীপালী সাহার লাশ গুম করে পুলিশ। অভিযান চালিয়ে শতশত ছাত্রের হাত-পা ভেঙ্গে গ্রেফতার করে ট্রাকে তোলা হয়। অনির্দিষ্টকাল বন্ধ ঘোষণা করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সারা ঢাকায় জারি করা হয় কারফিউ। ছাত্র নিপীড়নের বর্বর তা-বের সংবাদ দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবাদের আগুন জ্বলে ওঠে। অগ্নিস্ফূলিঙ্গ দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। ১৫ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে হরতাল আহ্বান করা হয়। প্রতিবাদী হরতালে ঢাকার রাজপথে শহীদ হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আইয়ুব, চট্টগ্রামে শহীদ হন কাঞ্চন। পুলিশ ও সেনা নির্যাতনে নিহত হন নাম না জানা আরও অনেকে। গ্রেফতার করা হয় হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে। সরকারি হিসেব মতেই এক হাজার তিনশ একত্রিশ জন গ্রেফতার হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মধ্য ফেব্রুয়ারির এই ঘটনাপ্রবাহ আন্দোলনের আগুনে আরও ঘি ঢালে। একদিনের মাথায় ১৭ ফেব্রুয়ারি এরশাদ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়- ‘জনগণের রায় ছাড়া শিক্ষা সম্পর্কে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে না’। এরপর সেই ছাত্রআন্দোলন রূপ নেয় গণআন্দোলনে। ’৮৩-র ১৪ ফেব্রুয়ারিতেই মূলত স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের সূত্রপাত। যার পরিণতিতে স্বৈরাচারের পতন ঘটে। যার সূচনা করেছিলো ছাত্রসমাজ।
শিক্ষা-সংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিমূলেই আঘাত করেছিলো স্বৈরাচারী এরশাদ
‘শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড’ – শাসকরা এটা ভালো করেই জানে। এই ‘মেরুদন্ড’— নৈতিক মননের, চিন্তার, দৃষ্টিভঙ্গির। শোষণমূলক সমাজে শাসকেরা সব সময়ই এই মেরুদন্ডটাকেই ভেঙ্গে দিতে চায়। স্বৈরাচারী এরশাদ ক্ষমতায় এসেই ১৬ জুলাই বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের এক সভায় ঘোষণা দেন- তার সরকার দ্রুতই একটি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করবে। যা দেশের শিক্ষার উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ বংশধরদের চরিত্র গড়ে তোলার জন্য অপরিহার্য (?)। সেই সভাতেই তিনি শিক্ষার মানোন্নয়নে নিজেই নেতৃত্ব দেয়ার প্রস্তাব করেন। এবং শিক্ষক না হয়ে শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি হবার হাস্যকর নজির তৈরি করেন। তার আজ্ঞাবহ শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খান সাম্প্রদায়িকতা, বাণিজ্যিকীকরণ আর সংকোচন নীতির ভিত্তিতে প্রণয়ন করেন এক কুখ্যাত শিক্ষানীতি। বাধ্যতামূলক শিক্ষা হিসেবে প্রথম শ্রেণি থেকেই চালু করেন আরবি শিক্ষাকে। উচ্চশিক্ষা লাভের মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয় পঞ্চাশ ভাগ ব্যয়ভার বহনের সক্ষমতা! খর্ব করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন।
ইতিহাসে আমরা দেখেছি, স্বৈরাচারী শাসকেরা তাদের অন্যায়-জবরদস্তির শাসনকে বৈধ করার জন্য আশ্রয় নেয় ধর্মের। বাংলাদেশেও একই ঘটনা ঘটেছে। মহান ভাষা আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সামরিক বুটের তলায় পিষ্ট করার চেষ্টা করেছেন জেনারেল এরশাদ। বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদাররেসিন আয়োজিত আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে এরশাদ বলেন, “বাংলাদেশ মুসলমানদের দেশ। বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র করার জন্যই আমাদের সংগ্রাম। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিলো শহীদ মিনার। কিন্তু সেখানে আলপনা আঁকা হয়। এ কাজ ইসলামবিরোধী। শহীদ আবুল বরকত আল্লাহর বান্দা। তার জন্য আলপনা কেন, হবে কোরানখানি।” কি উদ্ধত বক্তব্য! একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে ধর্মভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানকে প্রত্যাখান করেছে এ দেশের মানুষ, তারই পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস? এরশাদ তাই করেছিলেন— সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ‘ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বন্ধ করেছিলেন একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরী! চালু করেছিলেন দোয়া মাহফিল ও ধূপকাঠি জ্বালানোর সংস্কৃতি!
১৪ ফেব্রুয়ারির সংগ্রামী চেতনাকে ভুলিয়ে দিতে আমদানি করা হয়েছে কথিত ‘ভালোবাসা দিবস’
ভালোবাসা দিবস বা ভ্যালেন্টাইনস ডে-র ইতিহাস নিয়ে তিন চার রকমের গল্প শোনা যায়। কথিত আছে যে, যুদ্ধবাজ রোমান স¤্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস ২৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমান তরুণ-যুবকদের যুদ্ধে মনোযোগী করতে সকল বিয়ে ও বাগদানকে বেআইনি ও বাতিল ঘোষণা করেন। স¤্রাটের এই স্বৈরতান্ত্রিক-নিপীড়নমূলক আইনের বিরুদ্ধাচরণ করায় ১৪ ফেব্রুয়ারি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয় সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে। আরেকটি গল্পে আছে, কারারুদ্ধ অবস্থায় ভ্যালেন্টাইনের সাথে কারারক্ষীর অন্ধ মেয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ভ্যালেন্টাইনের আধ্যাত্মিক ক্ষমতায় মেয়েটি আবার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়। অবশেষে ২৬৯ খ্রিস্টাব্দে তাকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়। আরেকটি গল্পে শোনা যায় যে, রোমানদের মধ্যে খ্রিস্টান ধর্মের প্রচারের জন্য তাদের একটি প্রচলিত অনুষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের নামে নামকরণ করা হয়। দিবসটির ঐতিহাসিক সত্যতা সম্পর্কেও নিশ্চিতভাবে কেউ কিছু বলতে পারে না। অথচ, ব্যবসায়িক স্বার্থে এ দিবসকে কাজে লাগাচ্ছে সা¤্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীগুলো। আমাদের দেশে স্বৈরাচার পতনের তিন বছরের মাথায় ১৯৯৩ সালে সাংবাদিক শফিক রেহমান তার সাপ্তাহিক যায় যায় দিন পত্রিকার মাধ্যমে আমাদের দেশে ভ্যালেন্টাইন দিবসের আবির্ভাব ঘটান। তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের এই যুগে গত ২৪ বছরে দিবসটি এখন প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত গড়িয়েছে। প্রেম-ভালোবাসার মতো স্বাভাবিক বিষয়কে বিশেষ এক দিনের আনুষ্ঠানিকতার ফ্রেমে বন্দি করে ফেলা হয়েছে।
এমন এক সময় ছিলো যখন নর-নারীর পছন্দ-অপছন্দ বলতেই কিছু ছিলো না। সবকিছুই নিয়তি নির্ভর বা গোষ্ঠী প্রধান বা অঞ্চল প্রধানের বিবেচ্য বিষয় বলে মনে করা হতো। সেদিন মানুষের সংগ্রাম ছিলো এ জবরদস্তির অবসান ঘটানো। প্রচলিত সকল চিন্তা-চেতনার গন্ডি থেকে বেরিয়ে এসে পছন্দের স্বাধীনতা, ভালোবাসার স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠা করা। জাত-পাত, ধনী-গরীব, বংশমর্যাদা এসবের ঊর্ধ্বে ভালোবাসার সামাজিক আকাঙ্ক্ষা সেদিন বড় হয়ে ওঠেছিলো। সামন্তসমাজের চিন্তা-রুচি-সংস্কৃতির বন্ধ্যাদশার বিপরীতে বুর্জোয়া বিপ্লবের উন্নততর গণতান্ত্রিক বোধের প্রকাশের অংশ হিসেবে নর-নারীর নিজস্ব পছন্দের ও স্বাধীন সম্পর্কের ধারণা আসে। ভালোবাসার সামাজিক স্বীকৃতির পিছনে ভূমিকা রেখেছে শেক্সপিয়রের রোমিও-জুলিয়েটের বিয়োগাত্মক পরিণতি। জাত-পাত আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ভালোবাসার লড়াইয়ে আকুতি তৈরি করেছিলো শরৎচন্দ্রের ‘বিলাসী’ গল্পের বিলাসী-মৃত্যুঞ্জয়।
প্রেম-ভালোবাসা মানব মনের সবচেয়ে গভীর মানবিক অনুভূতির প্রকাশ। দু’জন মানুষের মত-চিন্তার ঘনিষ্ঠতার ভিত্তিতে তৈরি হয় মনের ঘনিষ্ঠতা। এর সাথে যুক্ত থাকে তাদের পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ। দুইজন স্বাধীন মানুষ এভাবে ভালোবাসার চর্চা করতে পারেন। কিন্তু আজ আমাদের চারপাশের ছবি কী? সমাজব্যাপী চলছে ভালোবাসার নামে উন্মাদনা আর প্রবৃত্তিকে উসকে দেবার বাহারি আয়োজন। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের বদলে আছে অবিশ্বাস, হিংস্রতা আর সন্দেহ। মানবিক সম্পর্ক আর হৃদয়বৃত্তি চাপা পড়ছে যৌনতার উন্মাদ আকাঙ্ক্ষার নীচে। আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর, সমাজবিচ্ছিন্ন প্রেম-ভালোবাসা পারস্পরিক সম্পর্ককে শুধুমাত্র ‘তুমি আর আমি’তে নিয়ে গিয়ে ঠেকিয়েছে। তাই ভালোবাসা উদ্যাপন করার দিনটিও পরিণত হয়েছে পণ্য বিকিকিনির উৎসবে। ভালোবাসা নয়, বাস্তবে বিনিময় হয় পণ্যের। কে কাকে কত বেশি মূল্যের পণ্য উপহার দিলো তার মাপকাঠিতে নির্ধারিত হয় ভালোবাসার মূল্য। সমস্ত কর্পোরেট কোম্পানি তাদের পণ্যের পসরা নিয়ে হাজির হয় ‘ভালোবাসা’র দিনে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে ভ্যালেনটাইনস ডে উপলক্ষে কেবল ফুলের ব্যবসা হয়েছে প্রায় ৮.৯ কোটি টাকা। (সূত্র : দৈনিক প্রথম আলো) National Retail Federation – এর তথ্য মতে, ২০১৬ সালে ১৪ ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বাণিজ্য হয়েছে ১৮.২ বিলিয়ন ডলার। এভাবে আর্চিস-হলমার্কসহ ব্যবসায়ী-কর্পোরেট কোম্পানিগুলো একদিনের কৃত্রিম ও কর্পোরেট ভালোবাসার ফাঁদ পেতে হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা। এ সমস্ত আয়োজনে তরুণ-যুবকরা আচ্ছন্ন হয়ে থাকলে ব্যবসায়ী আর শাসকশ্রেণির লাভ। শাসকেরা চাইবেই সমাজের সবচেয়ে লড়াকু প্রাণবন্ত প্রতিবাদের শক্তি যুবসমাজকে মুক্তির লড়াই থেকে বিচ্ছিন্ন করতে।
১৪ ফেব্রুয়ারির স্বৈরাচারবিরোধী চেতনা আজ আরও বেশি প্রাসঙ্গিক
গোটা নব্বইয়ের দশক জুড়ে এ দিনটি ‘স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালিত হতো। কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর পরিকল্পনায় আর ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যের মহোৎসবে রক্তে লেখা সেই দিনকে ছাত্রসমাজ প্রায় ভুলে যেতে বসেছে। স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের অগ্নিগর্ভ থেকেই রচিত হয়েছিলো ছাত্রদের ঐতিহাসিক দশ দফা। ঘোষিত হয়েছিলো— সর্বজনীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, বৈষম্যহীন, একই পদ্ধতির শিক্ষার কথা। আন্দোলনের সাথে যুক্ত সকল রাজনৈতিক দল সে সময় অঙ্গীকার করেছিলো স্বৈরাচারের পতনের পর যারাই ক্ষমতায় আসবে তারাই এই দশ দফার আলোকে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করবে। কিন্তু এরপর উল্টো রথেই চলেছে দেশ ও দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষার ধারাবাহিক বাণিজ্যিকীকরণ, বেসরকারিকরণ আর সাম্প্রদায়িকীকরণের কারণে গোটা শিক্ষাব্যবস্থা আজ জরাগ্রস্ত। সাথে প্রশ্নপত্র ফাঁস, কোচিং, গাইড বই, পিইসি-জেএসসি পরীক্ষা শিক্ষার নৈতিক মেরুদ-কেই ক্ষয়ে দিচ্ছে।
বর্তমানে সামরিক পোশাকে স্বৈরশাসন নেই বটে কিন্তু চলছে স্বৈরশাসনই। এটা গণতন্ত্রের লেবাসে আরো ভয়ঙ্কর জিনিস। সংবিধান আর মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে চলছে ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন। হত্যা-খুন-গুমের বহু ঘটনা ঘটেই চলেছে। একটা ঘটনা আরেকটায় চাপা পড়ছে। চাপাতির কোপে বলি হচ্ছেন মুক্তচিন্তার মানুষ। বাংলা একাডেমির বই মেলাতে নিষিদ্ধ হচ্ছে প্রকাশনী সংস্থা। ঘটেছে বহু সাম্প্রদায়িক হামলা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সন্ত্রাস-দখলদারিত্বের অভয়ারণ্যে পরিণত করা হয়েছে। পপুলার বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে প্রগতিশীল তকমা এঁটে প্রণয়ন করা হয়েছে শিক্ষানীতি। অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ, সিসি ক্যামেরা স্থাপন, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে নিষেধাজ্ঞা-খবরদারি ইত্যাদির মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। ছাত্রসংসদ নির্বাচন বন্ধ, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের উপর সরকার খড়গহস্ত। নির্বাচন ছাড়াই সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট ব্যক্তি নিয়োগ পান উপাচার্য হিসেবে। স্বৈরাচারী শাসনের মতোই বৃদ্ধি করা হচ্ছে আর্মি-পুলিশ-আমলাসহ সমস্ত সরকারি বাহিনীর সুযোগ-সুবিধা-ক্ষমতা। সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে আপোষ করে, হেফাজতে ইসলামের দাবি মেনে প্রণয়ন করেছে প্রথম থেকে দশম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক। ‘হিন্দু-বিধর্মী-নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে বাদ দেয়া হয়েছে প্রগতিশীল লেখকদের লেখা। এসব স্বৈরাচারী শাসনেরই বৈশিষ্ট্য।
ইতিহাসের সংগ্রামী চেতনা হারায় না
ইতিহাসের ন্যায়-অন্যায়ের লড়াই নির্মাণ করে ভবিষ্যতের পথ। ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দ্রোহের সংগ্রামী চেতনায় শাণিত জ্বলজ্বলে একটি দিন। ফাগুনের সেই অগ্নিঝরা দিনের সাথে মিশে আছে জাফর, জয়নাল, দীপালী সাহা, আইয়ুব, কাঞ্চনের টকটকে তাজা রক্ত! মানুষের জন্য, দেশের জন্য শহীদী আত্মদানে ভাস্বর সেই সব নাম আমাদের আগামীর পথ চলার পাথেয়। তাই প্রশ্ন, ১৪ ফেব্রুয়ারি আমরা কোন্ চেতনাকে ঊর্দ্ধে তুলে ধরবো — জনগণের সংগ্রামের চেতনা, সমাজ-দেশ-মানুষকে ভালোবাসার চেতনা; নাকি সেই চেতনাকে আড়াল করার জন্য উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে প্রতিষ্ঠিত আনুষ্ঠানিকতাসর্বস্ব ভালোবাসার চেতনা?
তথ্যসূত্র:
১. গণআন্দোলন, ১৯৮২-৯০, সৈয়দ আবুল মকসুদ
২. সচলায়তন ও সামহোয়্যারইন ব্লগ
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট মুখপত্র — অনুশীলন ফেব্রুয়ারি ২০১৭