Monday, December 23, 2024
Homeফিচার২০১৮ সাল হোক সমাজের সকল অন্যায়কে প্রতিরোধ করার বছর

২০১৮ সাল হোক সমাজের সকল অন্যায়কে প্রতিরোধ করার বছর

104788_129

ক্যালেন্ডারের পাতা ওল্টালেই নতুন বছর। আরেকটি রাত পেড়িয়ে দিন। বাহ্যত খুব বেশি পার্থক্য চোখে পড়বে না। কিন্তু তবুও মানুষ নতুন বছর শুরু করে নতুন স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। আর করে পেড়িয়ে যাওয়া সময়ের হিসাব-নিকাশ। কী পেলাম আমরা পুরনো বছরে? ২০১৭ সাল ছিল বহু ঘটনায় আলোচিত। আসলে ঘটনা নয়, দুর্ঘটনায়। একটির তাৎপর্য ছাড়িয়ে গেছে আরেকটিকে। কেবল সংখ্যার ক্ষেত্রে নয়, মাত্রার ক্ষেত্রেও। খুন-ধর্ষণ-গুম কী হয়নি? শুধু মানুষের উপর নির্যাতন নয়, প্রকৃতি-পরিবেশও ছিল এর শিকার। মোটা চালের দামবৃদ্ধি অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভেঙেছে। সমাজে বেপরোয়া ছিল সমাজ বিরোধীরা, সড়কে ছিল চালকেরা। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিনই গড়ে প্রাণ হারিয়েছে ১২ জন মানুষ। কোনো শ্রমিক হত্যারই বিচার হয়নি। কৃষকের চোখের জল মোছেনি, পায়নি তারা ফসলের ন্যায্য দাম। এমন পরিস্থিতিতে কেমন যাবে ২০১৮ সাল?

মানুষ যখন সংকটের উৎস খুঁজে পায় না, করণীয় নির্ধারণ করতে পারে না, তখন বেছে নেয় আত্মহননের পথ। গত বছরের শুরুতেই তেমনই একটি ঘটনা এসেছিল সবগুলো প্রচার মাধ্যমে। ঢাকা শহরের একটি নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটিয়েছিল। হত্যা করেছিল নিজেকে, তারও আগের নিজের দুই সন্তানকে। মেয়েটি ছিল অন্তসত্ত্বা, তাই প্রাণ গেছে আরও একজনের। স্বামীর কাছ থেকে নিত্যদিনের শারীরিক নির্যাতন, মানসিক খোটা সহ্য করতে পারেনি মেয়েটি।আত্মবিনাশের পথে খুঁজে নিয়েছিল সমাধানের পথ। মেয়েটির ছিল না বেঁচে থাকার সহনীয় পরিবেশ, কেননা তার স্বামী বাড়ি থেকেই বের হয়ে যেতে বলেছিল। লম্পট স্বামীর হাত থেকে বাঁচার জন্য একাই যে লড়বে তারও উপায় ছিল না, কেননা সে ছিল এক দরিদ্র ঘরের সন্তান। এমন দুঃখের মহাসমুদ্রে একা একা ভেসে থাকা যায় না। তাই তো নিজেকেই শেষ করে দিয়েছে সে। তবু একটি প্রশ্ন না এসে পারে না — এটি কি আত্মহত্যা নাকি হত্যা? এই পঁচে যাওয়া সমাজ কি তাকে সেই পথে ঠেলে দেয়নি? বেঁচে থাকার সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে সমাজই কি তাকে হত্যা করেনি?

এমন করুণ পরিণতি কেবল দরিদ্র মেয়েটির নয়, পথে-ঘাটে-বস্তি-দালানে, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কারখানা-অফিস-আদালত সব জায়গায়। কোথাও মেয়েরা নিরাপদে নেই। অহরহ ঘটছে শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের ঘটনা। ধর্ষণ-গণধর্ষণ তো বটেই, বিকৃত যৌন নির্যাতনের বর্ণনা ভাষা প্রকাশ অসম্ভব। চার বছরের শিশু কন্যা থেকে ষাট বছরের বৃদ্ধা — কেউই এই নির্মমতার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। স্বাধীন দেশে এত এত ঘটনা ভাবাটাই কঠিন। পত্রিকায় এসেছে, ‘গণধর্ষণের বিচার চাইলেন মুক্তিযোদ্ধা কন্যা’। খবরের ভিতরে বাবার আক্ষেপ, ‘আমি দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। আজ দেশ আমাকে এই মহৎ পুরস্কার দিল।’ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে হলে মেয়েটির হয়তো পাকিস্তানিদের হাতে নির্যাতিত হবার ভয় থাকত। জন্ম নিয়েছে সে স্বাধীন দেশে, নির্যাতিত হলো সেই দেশের একদল পাষ-দের কাছে।

মানুষকে রক্ষা করবে কে? আইন শৃঙ্খলা বাহিনী? পুলিশ- র‍্যাব? তারা নিজেরাই তো অপকর্মের হোতা। পত্রিকায় খবর এসেছে (১৯ মে ’১৭, ডেইলি স্টার) পুলিশ বাহিনীর মহিলা সদস্যদের উপর ওই বাহিনীর পুরুষ সদস্যদের যৌন হয়রানি এখন বেশ সাধারণ ঘটনা। প্রতিবেদনে এসেছে হালিমা নামের একজন মহিলা কনস্টেবলের কথা যে একই থানার সাব ইন্সপেক্টরের দ্বারা একাধিকবার ধর্ষিত হয়েছে। ঊর্দ্ধতন পুলিশ অফিসারকে বারবার জানালেও বিচার পায়নি সে। কোনো পথ না পেয়ে অপমানের জ্বালায় কাপড়ে কেরোসিন ঢেলে নিজেকে পুড়িয়ে মেরেছে। যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজেদের মধ্যে ঘটে যাওয়ার নিপীড়নের শাস্তির বিধান করতে পারে না তারা দেশের অপরাধীদের বিচার কীভাবে করবে?

পরিসংখ্যান বলছে গত ১৬ বছরে ৪৫৪১টি ধর্ষণের মামলা হলেও মাত্র ৬০টি ঘটনায় দোষীদের শাস্তি হয়েছে। (১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, দৈনিক প্রথম আলো) এই হিসাব কেবল কাগজে কলমে বা প্রচার মাধ্যমে সামান্যই এসেছে। এর বাইরেও যে কত ঘটনা ঘটে তার কি কোনো ইয়ত্তা আছে?

শুধু নারী নির্যাতন নয়, হত্যা-খুন-গুম মাত্রা ছাড়িয়েছে। এসবের সাথে যুক্ত আছে স্বয়ং রাষ্ট্রীয় বাহিনী। আমরা নারায়ণগঞ্জের ঘটনা বিস্মৃত হইনি। প্রমাণ পাওয়া গেছে, নারায়ণগঞ্জে র‍্যাবের একটি ইউনিট একসাথে সাতজনকে খুন করে নদীতে ফেলে দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় একটি বাহিনী পরিণত হয়েছে ভাড়া খাটা খুনীতে। ক্রসফায়ার-এর নামে মানুষ হত্যা পরিণত হয়েছে নিত্যদিনের ঘটনায়। প্রতিটি হত্যার পিছনে একই গল্পের মঞ্চায়ন একঘেয়েমি তৈরি করলেও রাষ্ট্রীয় এই বাহিনীটির বেপোরোয়া মনোভাবের ব্যাপারে লুকানোর কিছুই নেই। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জেই ফুটফুটে কিশোর তানভীর মুহম্মদ ত্বকীকে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। কারা ঘটালো তাও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু আজও প্রকৃত খুনীরা ধরা পড়ল না, শাস্তি তো দূরের কথা। আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার কয়েক বছর অতিক্রান্ত হলো। হত্যাকান্ডের পরপরই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘৪৮ ঘন্টার মধ্যে সাগর-রুনী হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করা হবে।’ আজও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। এই দম্পত্তির একমাত্র সন্তানটির নিটোল চোখের করুণ আবেগ দেখে চোখে পানি ধরে রাখা কঠিন হলেও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের তাতে কিছুই যায় আসে না। এমন আরও বহু ঘটনা আছে। কলেজ ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু কুমিল্লার সবচেয়ে ‘নিরাপদ’ জায়গা ক্যান্টনমেন্টে নৃশংসভাবে খুন হলো। তনুর মা স্পষ্টভাবে খুনীদের নাম বললেন, যারা সেনাবাহিনীরও সদস্য। কিন্তু কেউ ধরা পড়ল না।

অথচ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যখন সরকারের নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে, তখন দেখা যায় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর শক্তির মহড়া। যেমন- সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন, গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষার আন্দোলন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনবিরোধী আন্দোলন ইত্যাদিতে কীভাবে পদে পদে বাধা দেয়া যায়, বিক্ষোভ তীব্র হবার লক্ষণ দেখলে কেমন করে লাঠি, টিয়ার গ্যাস, জলকামান, নতুন আবিষ্কার ‘সাউন্ড স্টিমুলেটর’ ব্যবহার করা যায় — এসব দেখলে সরকারের পেটোয়া বাহিনীর দক্ষতা নিয়ে কোনো প্রশ্নই উঠবে না। দেশে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক পরিবেশও সরকার রাখেনি। প্রধান বিরোধী দল বলে যারা পরিচিত, যদিও তারা একই শ্রেণির, তাদের সভা-সমাবেশ করারও অনুমতি সরকার দিচ্ছে না বহুদিন ধরে, বরং সামান্য মিছিল-মিটিং করলেই হামলা-মামলা দিয়ে বিরোধী নেতা-কর্মীদের নাজেহাল করে ছাড়ছে।

সামান্য প্রতিবাদও সরকারের সহ্যের অতীত। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও মানুষ তার প্রতিবাদটুকু জানাতে পারবে না। জাতির পিতা, প্রধানমন্ত্রী, স্বাধীনতা যুদ্ধ কিংবা সরকারের কর্মকান্ড— কোনো কিছু নিয়েই ভিন্ন কোনো মত উপস্থাপন করা যাবে না। বলতে হলে সরকারের বয়ানেই তা বলতে হবে। এর অন্যথা হলে রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার খড়গ। চট্টগ্রামে নবম শ্রেণির এক প্রশ্নপত্রে এমনি এক অবমাননার অভিযোগ তুলে ১৩ জন শিক্ষককে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। (২৩ আগস্ট ’১৭, বিবিসি) একটা মিথ্যা অভিযোগে যখন শিক্ষকদেরও জেলের ঘানি টানানো যায়, তখন আর মান-সম্মান নিয়ে এ সমাজে বেঁচে থাকার পথ থাকে না। এতসব অন্যায়ের পরও কিছুটা হলেও যাবার জায়গা ছিল আদালত। সেটিও ক্ষমতাসীনদের একদম পদতলে। নিম্ন আদালত তো সম্পূর্ণ সরকারের অধীন। নি¤œ আদালতে সরকার দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিচারাধীন প্রায় সাত হাজারের বেশি মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এসবের মধ্যে এমনকি খুনের মামলাও আছে। উচ্চ আদালতের হাল কী — তা কিছুদিন আগে প্রত্যক্ষ করেছে দেশের মানুষ। সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর পরই যার অবস্থান সেই প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে কীভাবে টেনে হিচড়ে তাঁর পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। এতবড় পদে আসীন থাকা একজন ব্যক্তির যখন এই হাল হয়, তখন সাধারণ মানুষের অবস্থা কী, তা সহজেই অনুমেয়।

দেশের এমন সংকটকালে তরুণ-যুবকদের প্রতিবাদ করার কথা ছিল। রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন করেছিলেন, ‘বসিয়া আছ কেন আপন মনে/ স্বার্থনিমগ্ন কী কারণে?’ হৃদয় প্রসার করে চারিদিকের এত এত অন্যায়-নিপীড়ন যে তরুণরা দেখতে পারছে না, তার কারণ আছে বহুবিধ। তাদের মনে গেঁথে দেয়া হচ্ছে অর্থ-বিত্ত-প্রতিষ্ঠার প্রবল ছাপ। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, পেশি শক্তির জয়জয়কার আর পরিবার থেকে সামাজিক প্রতিষ্ঠান সবক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতার প্রবল সংকট প্রতি মুহূর্তে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে ‘যেভাবেই হোক অঢেল টাকার মালিক হতে হবে।’ টাকা হলেই পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়বে সব। গত ৩০ ডিসেম্বরে পত্রিকায় এসেছে এক ৩৩ বছরের তরুণের কথা। যে মাত্র কয়েক বছরে রাস্তার টোকাই থেকে হয়ে উঠেছে শত কোটি টাকার মালিক। কীভাবে? কোন ব্যবসা করে? ব্যবসা হলো ইয়াবাসহ নেশাজাতীয় পণ্যের। একা একা তো নিশ্চয় এত টাকার মালিক হওয়া সম্ভব ছিল না। হয়তো সাহায্য ছিল সমাজের তেমন ‘গণ্য-মান্যদের’। যদিও সেগুলো খবরে বেশি আসে না। আসবে কী করে? তাদের তো মস্ত খুটির জোর! এই যেমন, সকলে জানে দেশের ইয়াবা চালানের একটা বড় রুট টেকনাফ, সেখানকার এমপি আব্দুর রহমান বদি হলো এই মাদক ব্যবসার হোতা। বদির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এই বদিকেই কিছুদিন আগে দেখা গেছে প্রধানমন্ত্রীর পাশে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে, প্রধানমন্ত্রীর সাথে হাস্যোজ্জ্বল মুখে পানিতে পা ডুবিয়ে হাঁটতে! এমন ব্যক্তির টিকি ছোঁয়ার সাধ্যও কি কারও আছে? কেবল দুঃখজনক ঘটনা হলো এই, এরা যাদের কাছে ইয়াবা বিক্রি করে সেই কোটি তরুণ-তরুণীরা মাদকের নীল ছোবলে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যৌবনের স্বপ্ন-সাধ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে স্পর্ধা নুইয়ে পড়ছে কোনমতে দিন যাপনের গ্লানিতে। হারিয়ে ফেলছে ন্যায়-অন্যায় বোঝার শক্তিটুকু। জাতির মেরুদ- ক্ষয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন।

প্রতিবাদের শক্তি যখন দুর্বল হয়, অন্যায়ের শক্তি তখন সংহত হয় দিনদিন। সমাজে শোষণ-জুলুম বাড়ে। বাংলাদেশে আজ তেমনই পরিস্থিতি। রিপোর্টে এসেছে, স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বেশি আয়বৈষম্য চলছে বর্তমানে। জাতীয় আয়ের অর্ধেকই উচ্চ আয়ের ১০ শতাংশ মানুষের। (১৯ আগস্ট ’১৭, দৈনিক বণিক বার্তা) সরকারের তথাকথিত উন্নয়ন আর বৈষম্য বাড়ছে হাত ধরাধরি করে। ধনী হচ্ছে আরও ধনী, তাই গরীব হচ্ছে আরও নিঃস্ব, অসহায়। একদিকে দেশের মাত্র ৫টি পরিবারের হাতে জাতীয় আয়ের ২৮ শতাংশ সম্পত্তি জমা হয়েছে, অন্যদিকে শেরপুরে ভাতের অভাবে কিশোরী আত্মহত্যা করেছে। এমনই বৈপরীত্য! ব্যাংকগুলো হয়েছে হরিলুটের কেন্দ্র। প্রায় সমস্ত ব্যাংক অর্থ পাচার, অবৈধ লেনদেনে বিপর্যস্ত। ব্যাংক থেকে সাধারণ মানুষের সঞ্চিত টাকা পুঁজিপতিরা ঋণ হিসেবে নিয়ে পাচার করছে বিদেশে। এভাবে গত ৬ মাসেই প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ হয়েছে। এসব দেখার যেন কেউ নেই। এত কিছুর পরও সরকারের অর্থমন্ত্রী জনগণকে নিশ্চিন্ত থাকতে বলেছেন! জনগণের সাথে প্রতিদিনই চলছে এমন নির্মম তামাশা।

সরকারের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান পরিণত হয়েছে দুর্নীতি আর লুটপাটের আখড়ায়। শিক্ষাব্যবস্থার এমন ভয়াবহ দুরবস্থা আগে কেউ প্রত্যক্ষ করেছে কিনা জানা নেই। প্রতিটি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস এখন স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। প্রথম শ্রেণি থেকে যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা Ñ কোটি কোটি টাকায় প্রশ্নপত্রের বাণিজ্য হচ্ছে বাংলাদেশে। শিক্ষামন্ত্রীর তাতে কিন্তু কোনো দায় নেই! তিনি বলেছেন, ‘সেই ১৯৬১ সাল থেকেই প্রশ্নফাঁস হচ্ছে।’ যেন জঘন্য কাজ বারবার করলে তা নীতিসিদ্ধ হয়ে যায়। কথা প্রসঙ্গে তিনি নিজেকে ‘চোর’ বলেছেন। কিন্তু তারপরও দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেননি। বরং সবাইকে ‘সহনীয় মাত্রায়’ ঘুষ খাবার পরামর্শ দিয়েছেন। শিক্ষাব্যবস্থার দায়িত্বে থেকে এমন নিম্নস্তরের রুচিহীন কথা কারও পক্ষে বলা সম্ভব, তা বিশ্বাস করাও কঠিন। এরা দেবে আমাদের শিক্ষার পাঠ!

যে শ্রম এমন বিপুল সম্পদের সৃষ্টি করছে সেই মানুষগুলো কেমন আছে? ভালো যে নেই তা তো বোঝাই যাচ্ছে। তাদের হাড় জিরজিরে শরীরটাকে ছিবড়ে, নিংড়ে নিয়ে পুঁজিপতিরা সম্পদের পাহাড় গড়লেও তাদের দুমুঠো খাবারেও বসিয়েছে মুনাফার থাবা। মোটা চালের দাম বেড়ে হয়েছিল ষাট টাকার উপরে, এমন কখনও হয়নি ‘ধানের দেশ’ বাংলাদেশে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে আটবার, গ্যাসের দামও বেড়েছে দফায় দফায়। বেড়েছে গাড়ি ভাড়া, বাড়ি ভাড়া। কিন্তু বাড়েনি মজুরি। গার্মেন্টস শ্রমিকের মজুরি আজও ৫০০০ টাকা। শুধু মজুরি নয়, মালিকের মুনাফার লোভে আজ পর্যন্ত যত শ্রমিক হত্যাকা- হয়েছে, তার কোনোটিরও বিচার করেনি সরকার। তাজরিন হত্যাকান্ডের পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও ‘সাক্ষীর অভাবের’ কথা বলে আজও দোষীদের বিচার হয়নি। টাম্পাকো হত্যাকান্ডের এক বছর অতিক্রান্ত হলো, ৪১ জন শ্রমিক মারা গেল, আজও দায়ীদের শাস্তি দেয়া হলো না। স্পষ্টতই বোঝা যায়, সরকার কার পক্ষে। যেন সরকার আর মালিক সহোদর।

মুনাফার উদগ্র লালসা যখন সাধারণের স্বার্থকে কেড়ে খায়, তার কাছে যে প্রকৃতিও রেহাই পাবে না — তা আর বিস্ময় কী? মানুষের কান্নাই যাদের মধ্যে কোনো সংবেদনশীলতা তৈরি করে না, তারা প্রকৃতি-পরিবেশের যন্ত্রণা বুঝবে কী করে? তাই তৎপর হয়ে উঠেছে প্রকৃতির এক অপার বিস্ময়, বাংলাদেশের ‘ফুসফুস’ খ্যাত সুন্দরবনকে ধ্বংস করতে। দেশের অভ্যন্তরে গত চার বছর ধরে ধারাবাহিক আন্দোলন, আপামর জনসাধারণের মতামত, দেশের বাইরে ইউনেস্কোসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের নিষেধ সত্ত্বেও সরকার সুন্দরবনের অদূরে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র নয়, সুন্দরবনের কোল ঘেষে ৩২০টি শিল্পকারখানাকে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এসব ভারীশিল্প যে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে পুরোপুরি বিনষ্ট করবে, বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি করবে — তার অসংখ্য বৈজ্ঞানিক যুক্তিপ্রমাণ হাজির করা হলেও সরকার কার্যত দেশের পুঁজিপতি এবং ভারতের পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করতেই এই অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তটি নিয়েছে।

এই হলো দেশের সাধারণ মানুষ, প্রকৃতি ও পরিবেশের অবস্থা — যা আমাদের নিত্যদিনের জীবনযাপনের সঙ্গী। গত ২০১৭ সাল আমাদের এভাবেই কেটেছে। এরই ধারাবাহিকতায় এসেছে ২০১৮ সাল। এ বছরের সূচনাই হয়েছে ভোটের কথা বলে। জাতীয় নির্বাচন হবে এ বছরের শেষে, তার আগে হবে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। পত্রিকা, টেলিভিশনসহ অন্যান্য প্রচার মাধ্যমে শুরু হয়ে গেছে এর ভীষণ প্রচার। আসছে সময়ে তা আরও তীব্র হবে। ভোটে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে জানিয়েছে। কিন্তু আপাত অর্থেও একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আওয়ামী লীগ করবে কি না এ নিয়ে সংশয় এখনও আছে। রংপুর সিটি কপোরেশন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ এই বার্তা দিতে চাইছে যে, তার অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়। কিন্ত এ বার্তায় কেউ আশ্বস্ত হয়েছে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনের উপর প্রচন্ড ক্ষুব্ধ মানুষ হয়তো বিএনপি-কেই ভোট দেবে। তবে তাতে মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হবে না। মানুষ যতক্ষণ না এই সংকটের কারণ ধরতে পেরে এই সমাজব্যবস্থাকেই উচ্ছেদের সংগ্রামে লিপ্ত হচ্ছে, ততক্ষণ এই ভোট ভোট খেলা চলতেই থাকবে। এটি নতুন কিছু নয়। অনেক আগে থেকেই এ জিনিস চলে আসছে। সেই ১৯৭০ সালেই যখন অবিভক্ত পাকিস্তানে নির্বাচন এসেছিল, মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, “ভোট মনে হয় আজ সকলের ঠোঁট ফাটাইয়া দিয়াছে, ‘ভোট ভোট’ করিয়া দেশে আজ হায় মাতম শুরু হইয়া গিয়াছে।… সমস্যা-সাগরের উত্তাল তরঙ্গের মধ্যে পতিত হইয়া বাঁচিবার জন্য অনেকে আজ পথ হাতড়াইতেছেন। … যতবারই দেশ কোনো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সঙ্কটে পতিত হইয়াছে, ততবারই এই ভোটের আশ্রয় লওয়া হইয়াছে, সঙ্কট ত্রাণের একমাত্র পরিত্রাণ হিসাবে ভোট গ্রহণ করা হইয়াছে, সঙ্কটের সুদীর্ঘ রাস্তা পাড়ি দেওয়ার জন্য ভোটের উপর সওয়ার করা হইয়াছে, সমস্যা-সঙ্কট হইতে বাঁচিবার জন্য ভোটের আশ্রয় লওয়া হইয়াছে।” ভাসানী ‘ভোটের আগে ভাতের কথা’ বলেছিলেন। আজ অবশ্য জনগণ দুটোই হারিয়েছে। বর্তমান সরকার ভাতের পাশাপাশি ভোটের অধিকারও কেড়ে নিয়েছে। গত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিতে তারা এমনই এক নির্বাচন করেছে, যেখানে ১৫৪টি সিটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিল বিনাভোটেই! জনগণ তাদের মত দেবারও ফুরসৎ পায়নি! এবারের নির্বাচন এর থেকে ভাল বা এর থেকে খারাপ যাই হোক না কেন, তাতে নির্বাচন ভালো-মন্দ হবে, মানুষের জীবনে মন্দ বৈ ভালো কিছু হবে না।

তাই কেমন কাটবে আমাদের আগামীর সময়গুলো তা হয়তো বলাই যায়। কিন্তু চারপাশে এই যে এত এত সংকট তা থেকে আমরা বাঁচব কীভাবে? কোথায় যাব আমরা? পালাব? উপেক্ষা করব? নিজের কষ্টকে আপন করে সময় পার করব? তাতেও কোনো সমাধান হচ্ছে না। প্রায় প্রত্যেকেই তো আমরা দমন-পীড়নের শিকার হচ্ছি। তাই আমাদের অন্য কোথাও যাবার সুযোগ নেই। এখানে থেকেই সংকট সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। আবার একা একাও কোনো সমাধান করতে পারব না। যেহেতু সেগুলো আসছে সমাজ থেকে, তার সমাধানও করতে হবে সামাজিকভাবে। সমষ্টির শক্তি দিয়ে। কেবল রাজনীতির পালাবদলে কি এর পরিবর্তন আসবে? না। তেমন পালাবদল অতীতে এসেছে বারবার। আওয়ামী লীগের বদলে বিএনপি-জামাত, কখনো এসেছে সেনাশাসন। কিন্তু মানুষের ভাগ্যের তাতে পরিবর্তন আসেনি। তাহলে সমাধানে সূত্রটি কোথায় আছে?

আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি যেখানে কোনো একজন কবি, লেখক, সাহিত্যিক, ডাক্তার, উকিল, শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার বা খেটে খাওয়া যেকোন মানুষ সততা নিয়ে, মর্যাদার সাথে বাঁচতে পারছে না। যে নারী স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাইছে, তার প্রতি পদক্ষেপে সামাজিক আচার, পুঁজিবাদী ভোগবাদিতা আর ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। যে শ্রমিক-মুটে-মজুর রাতদিন উদয়অস্ত পরিশ্রম করছে, সেও দু মুঠো অন্ন জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে। শিল্পী-বিজ্ঞানী বা আর কেউ যাদের দেশের জন্য কিছু করার মন আছে, তাদেরকেও নতি স্বীকার করতে হচ্ছে। এর মধ্যেই কোনো রকমে টিকে আছি আমরা। কিন্তু একে কি বেঁচে থাকা বলে?

দেয়ালে এতটা পিঠ ঠেকার পরও কি আমরা ভেবে দেখব না — কে আমাদের আটকাচ্ছে? এমন অবস্থা কি যুগের পর যুগ চলতেই থাকবে এবং আমরা কেবল দেখব? অথবা পরিত্রাণের পথ না পেয়ে শেষ করে দেবে নিজেকে ও আপনজনদেরকে, যেমনটি ওই মেয়েটি করেছিল? এগুলোর কোনোটিই যে সঠিক পথ নয়, তা আমরা জানি। পথ জানতে হলে প্রথমেই জানতে এতসব সংকটের কারণ। তবেই বেরুবে তা থেকে উত্তরণের পথ। আজ স্পষ্টভাবেই আমাদের বুঝতে হবে, দেশের সকল সংকটের মূল কারণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। ফলে সমাধানের জন্য আজ যাই করি না কেন পুঁজিবাদকে উচ্ছেদ করার জন্য লড়াই করতেই হবে।

সভ্যতা আজ পুঁজিবাদের রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি চাইছে, অপেক্ষা করছে নতুন পালাবদলের। চাইছে এমন এক সমাজের যেখানে মানুষে মানুষে সম্পর্ক বৈষম্যের হবে না, হবে বাধাহীন মৈত্রীর। মানুষ তার সামর্থ্য অনুযায়ী শ্রম দেবে, আর নেবে উৎপাদন অনুযায়ী। একসময় হবে — শ্রম দেবে সামর্থ্য অনুযায়ী আর নেবে প্রয়োজন অনুযায়ী। শ্রম হবে আনন্দের খোরাক, সৃষ্টিশীলতা হবে মানুষের নিত্য অভ্যাস। সেই সমাজ কষ্টকল্পনা নয়, বিজ্ঞানের নিয়মেই সেটি আসবে। ব্যক্তি মালিকানার অবসান ঘটে সৃষ্টি হবে সামাজিক মালিকানার। সেই সমাজের নাম সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ।

আসছে ২০১৮ সাল হোক সেই অভিযাত্রার দিকে এক নতুন ধাপ। সমাজের সকল অন্যায়কে প্রশ্ন করা, প্রতিবাদ করা, প্রতিরোধ করার বছর। একবিংশ শতক তারুণ্যে পা দিয়েছে, গত শতকের এইরকম তরুণ বয়সে দুনিয়াকে কাঁপিয়ে দিয়ে রুশ বিপ্লব হয়েছিল। ২০১৮ সেই মহা দুঃসাহসী রক্তপতাকা বুকে বহন করুক।

সাম্যবাদ জানুয়ারি ২০১৮

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments