গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির গণবিরোধী সিদ্ধান্ত বাতিল এবং গ্যাস-বিদ্যুৎ-জ্বালানি তেলের দাম যৌক্তিকভাবে হ্রাস করার দাবিতে ২৮ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার ঢাকা মহানগরীতে অর্ধদিব হরতাল ও জেলায় জেলায় বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচি সফল করার জন্য আজ ২৭ ফেব্রুয়ারি বেলা ১২ টায় গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার উদ্যোগে কমরেড নির্মল সেন মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার সমন্বয়ক ফিরোজ আহমেদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)’র কেন্দ্রীয় কার্যপরিচালনা কমিটির সদস্য ফখরুদ্দিন কবির আতিক।
সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, গত ২৪ ফেব্রয়ারি সরকার আবারও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে, যা আগামী ১ মার্চ থেকে কার্যকর হবে। পরদিন ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা ২৮ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার ঢাকা শহরে সকাল ৬-১২টা হরতাল আহবান ও জেলায় জেলায় বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এই হরতাল কর্মসূচির যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা এবং জ্বালানির মত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্নে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার অবস্থান আমরা জনগণের সামনে তুলে ধরতে চাই।
গ্যাস একটি কৌশলগত পণ্য, যেমন কৌশলগত পণ্য বিদ্যুৎ-তেল প্রভৃতি। মানুষকে বেঁচে থাকতে এবং উৎপদান করতে গ্যাস একই সাথে কাঁচামাল ও জ্বালানি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর কোন দেশই সরকারগুলো জ্বালানির মত খাত থেকে মুনাফা করার চেষ্টা করে না। বরং জ্বালানির দাম কমিয়ে রেখে উৎপাদন বৃদ্ধি ও জনজীবনকে স্বস্তি দেয়াটাই স্বাভাবিক নীতি হওয়ার কথা।
বাংলাদেশ সরকার ঠিক তার বিপরীত নীতি গ্রহণ করেছে। বিইআরসির শুনানিতে প্রমাণিত হয়েছে যে, গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিটি সংস্থা লাভজনক অবস্থায় আছে। আপনারা সকলেই জানেন, গত ৫ বছরে সরকার গ্যাস খাত থেকে আয় করেছে ২৬ হাজার কোটি টাকা, এর মাঝে মুনাফার পরিমান ৩২০০ কোটি টাকা। এছাড়া, পেট্রোবাংলার প্রতিবেদন অনুযায়ী গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে জমা আছে আরও ৩২৭২ কোটি টাকা। এইখাতের বিপুল পরিমান অর্থের কোন হিসাব সরকার জনগণের সামনে প্রকাশও করছে না। গ্যাসের মত একটি অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ওপর বিপুল করও সরকার আদায় করছে। ফলে, দাম বৃদ্ধির এই প্রস্তাবের কোন যৌক্তিকতা নেই, তা সহজ হিসেবেই বোঝা যায়।
অন্যদিকে, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রভাব জনজীবনে গুরুতর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। এক বার্নার চুলার খরচ বর্তমানের ৬০০ টাকা থেকে ১ মার্চ ৭৫০ টাকা এবং ১ জুন থেকে ৯০০ টাকা হবে। দুই বার্নার চুলার খরচ বর্তমানের ৬৫০ টাকা থেকে পহেলা মার্চ ৮০০ ও পহেলা জুন ৯৫০ টাকা কার্যকর হবে। দেশের অধিকাংশ শ্রমজীবী মানুষ আলাদা করে চুলার ভাড়া দেন না, তারা ঘর ভাড়া দেন। এখন থেকেই বাড়িওয়ালারা তাদের ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন পোষাকশিল্পসহ এইসব খাতে নির্দিষ্ট আয়ের শ্রমজীবী মানুষের ওপর বিপুল চাপ সৃষ্টি করবে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি। সিএনজির দাম বৃদ্ধির ফলে পরিবহন ভাড়া বাড়বে। বাড়বে সার, সেচের খরচ। কৃষি উৎপদনে ব্যয় বৃদ্ধি হবে। শিল্পখাতেও এর বিরুপ প্রভাব পড়বে। দুইদফায় মূল্য বৃদ্ধির ফলে দেশীয় উৎপাদনশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, দেশের বাজার বিদেশী পণ্যের দখলে চলে যাবে এবং রফতানি শিল্পও হুমকির মুখে পড়বে। পোলট্রি, সুতা, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংযোজন খাত হস দেশীয় ছোট ও মাঝারি শিল্প বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এর বিরুপ প্রভাব গোটা উৎপাদনী খাতের ওপর পরবে। বেকারত্ব আরও বৃদ্ধি পাবে। আয়ের সাথে ব্যয়ের সঙ্গতি না থাকায় কম আয়ের মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ হতে থাকবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে অদৃষ্টপূর্ব দুর্নীতির রাজত্ব আমরা দেখতে পাচ্ছি। এখন এটা সবাই জানেন যে, বাংলাদেশে উন্নয়নের নামে প্রায় প্রতিটি নির্মাণ কাজে প্রয়োজনের চেয়ে বহুগুণ বেশি অর্থ ব্যয় করা হয়। এমনকি বাংলাদেশে উড়ালসেতু বানাবার খরচ যে ভারত-চীন-মালয়েশিয়ার চেয়ে বেশি শুধু নয়, কোন কোন ক্ষেত্রে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি, এই বিশ্লেষণ পত্রপত্রিকায় এসেছে। এছাড়া আপনারা দেখেছেন প্রায় সবগুলো সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠাই সরকারের বিপুল দুর্নীতি, জালিয়াতি ও খেলাপির কারণে বিপন্ন অবস্থায় আছে। দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের নেশায় মত্ত বর্তমান সরকার দেশের উৎপাদনশীলতা ও মানুষের জীবনকে সহজতর করার বদলে যেখানে যেভাবে সম্ভব কর চাপিয়ে, খাজনা বাড়িয়ে কিংবা দাম বৃদ্ধি করে তার এই দুর্নীতি-লুটপাট ও অপচয়ের তহবিল জোগাড় করতে চায়। এরই পরিণাম হলো সর্বশেষ গ্যাসের দাম বৃদ্ধি। জনগণের কাছ থেকে পাওয়া এই বিপুল অর্থ তারা উন্নয়ন ও ঋণের নামে ব্যক্তিগত লুণ্ঠনে ব্যয় করছে। এই কারণেই বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার নয়, লক্ষ কোটি টাকা পাচার হয়ে কানাডা-আমেরিকায় বিবিপাড়া গড়ে উঠছে।
এলএনজি গ্যাস আমদানীকারকদের বাণিজ্যসৃষ্টিও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির একটা কারণ। এই এলএনজি আমদানিকারকরা সকলেই সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। বলা হচ্ছে গ্যাসের দাম কম বলে সরকার তা বাজারের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করছে। আমরা সরকারের এই নির্লজ্জ অজুহাতের নিন্দা জানাই। এবং এলএনজি আমদানির নামে বাংলাদেশের জনগণকে জিম্মি করে কতিপয় সিন্ডিকেট গড়ে ওঠার যে তৎপরতা দেখা যাচ্ছে, আপনাদের মাধমে সে বিষয়েও সতর্কবার্তা হাজির করতে চাই। একই সাথে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, মিটারের অভাবে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ব্যবহারের চেয়ে গ্যাসের দাম বেশি দেন। মিটার না বসিয়ে তাই গ্যাসের দাম এক পয়সাও বৃদ্ধি করা চলবে না।
বাংলাদেশের গ্যাস বাংলাদেশের জনগণের সম্পদ। তার অপচয় রোধ করা এবং জনগণের জীবন স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ করা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্যই তা ব্যবহার করার কথা। কিন্তু আমরা বরং একদিকে দেখি, গ্যাসলাইন দেয়ার নামে ক্ষমতাসীনদের অবৈধ তৎপরতায় কোটি কোটি টাকা জনগণের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে, মাগুড়ছড়া-টেংরাটিলায় লক্ষ কোটি টাকার গ্যাস পুড়েছে বহুজাতিক কোম্পানির অবহলোয়, আরেকদিকে চেপে বসেছে সরকারের জনগণের পকেট সরাসরি কাটার এই বন্দোবস্ত। সরকার কার্যত পকেটমারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে নিম্নোক্ত দাবিসমূহ উত্থাপন করা হয়:
১. গ্যাসের দাম বৃদ্ধি নয়, বরং যৌক্তিক মাত্রায় কমাবার ব্যবস্থা করতে হবে। গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের টাকার হিসেব দিতে হবে। তেল-বিদ্যুৎসহ জ্বালানির দাম বৃদ্ধি চলবে না।
২. তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সমান করতে হবে। জ্বালানি খাত থেকে মুনাফা করা চলবে না।
৩. কম পরিমাণ গ্যাস ব্যবহারকারীদের স্বল্পমূল্যে গ্যাস দিতে হবে।
৪. নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ কর, বৃহৎ বিদ্যুৎপ্লান্ট স্থাপন কর।
৫. সুন্দরবন ধ্বংসকারী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল করতে হবে।