Saturday, December 21, 2024
Homeসাম্যবাদঅন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুই মাস : একটি পর্যালোচনা

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুই মাস : একটি পর্যালোচনা

গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী এই সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক। আওয়ামী লীগ আমলে ব্যাপকভাবে শোষিত, অত্যাচারিত, নিপীড়িত মানুষ এই গণঅভ্যুত্থানে প্রাণ দিয়েছে মুক্তির প্রত্যাশায়। ফলে ছাত্রদের মধ্যে শুরু হওয়া বিক্ষোভ গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছে। ছাত্রদের সাথে প্রাণ দিয়েছে শ্রমিক, দোকান কর্মচারি, ছোট ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। বহু স্কুল ও ইন্টারমিডিয়েট পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও এই গণঅভ্যুত্থানে নিহত হয়েছে। এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুসারে এই অভ্যুত্থানে প্রায় দেড় হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত ও পঙ্গু হয়েছেন, দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন প্রায় প্রায় ২৩ হাজার মানুষ।

কিন্তু একথা সত্য যে, এটি বিপ্লব ছিল না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করার কোন এজেন্ডা এই অভ্যুত্থানের ছিল না। এটি ছিল গণঅভ্যুত্থান। আওয়ামী লীগের একতরফা নির্মম শাসনের বিরুদ্ধে গণমানুষের ব্যাপক বিস্ফোরন। তাই এর মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটেনি, আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাচারী শাসনের পতন ঘটেছে মাত্র। একটা স্বেচ্ছাচারী সরকারের পতন হলেই ফ্যাসিবাদ চলে যায় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তীকালে, সারা দুনিয়ায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যখন চূড়ান্ত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক বিপর্যয়ের সামনে- তখন জনজীবনের মৌলিক সমস্যাগুলোকে সমাধান করতে না পেরে, ছোট বা বড় সকল দেশই ফ্যাসিবাদের আশ্রয় নিয়েছে।

অভ্যুত্থানের চাপে শেখ হাসিনা পালিয়ে যান। সাম্রাজ্যবাদী ভারত সরকার, যে আওয়ামী লীগের এই স্বেচ্ছাচারী শাসনের একতরফা সমর্থন জুগিয়েছে, সে শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেয়। আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীরা পালিয়ে যায়। পালিয়ে যায় পুলিশ বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা, যারা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার অন্যতম সহযোগী ছিল। ফলে সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ- প্রায় সকল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও পুলিশ প্রশাসন অকার্যকর হয়ে পড়ে। এককথায় রাষ্ট্রের অবস্থানটাই টলোমলো করতে থাকে।

দেশটার চালক যে ব্যবসায়ী-পুঁজিপতি শ্রেণি, তারা একটা গভীর সংকটে পড়ে। আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ থাকার কারণে জনরোষের ভয়ে তাদের কয়েকজনকে পালিয়ে যেতে হয়, কেউ কেউ গ্রেফতার হন। যদিও তাদের পুঁজির নিরাপত্তা সরকার দিয়েছে ও দেবে। এই সংকটকালিন সময়ে বুর্জোয়া শ্রেণি তার রাষ্ট্র রক্ষা করেছে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে। গণঅভ্যুত্থানের পর তিনদিন দেশে সরকার ছিল না। একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয় রাষ্ট্রের বিভিন্ন শক্তিকেন্দ্রের বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে।আন্দোলনকারীরা ছাড়াও এই আলোচনার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ছিল সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী এই সরকারকে সমর্থন করেছে। যেহেতু এই সরকারের সাংগঠনিক ভিত্তি নেই, তাই দিনে দিনে এটি সেনাবাহিনীর উপর বেশি করে নির্ভরশীল হচ্ছে ও তা হতে তারা বাধ্য।

তার একটা নমুনা আমরা দেখতে পাই, প্রথমে সেনাবাহিনী ও তার কয়েকদিন পরে গোটা সশস্ত্র বাহিনীকে (সেনা, নৌ ও বিমান) ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রদান করার মধ্য দিয়ে। এটা সিভিল প্রশাসনকে আরও দুর্বল করবে, বিচার বিভাগ ও প্রশাসনের মধ্যে দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি করবে এবং বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করবে।

যদিও সরকার গত দুইমাসে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশকিছু সংস্কার উদ্যোগ নিয়েছেন ও নিচ্ছেন। ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করছেন, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে আলোচনা করছেন। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পদে কয়েকজন যোগ্য মানুষকে বসিয়েছেন। যদিও কোন কমিশনই রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে গঠিত হয়নি। এগুলোর কাজের পরিধি, সময় এসবের কোন রোডম্যাপও সরকার দিতে পারছে না। আবার পাঠ্যপুস্তক সংস্কারের জন্য কমিটি করার পর মৌলবাদীদের চাপে সেটা বাতিল করতেও আমরা দেখলাম, যার কোন ব্যাখ্যা সরকারের কাছে নেই।

ফলে এ সরকার সম্পর্কে মানুষের আস্থা যে প্রতিদিন বাড়ছে তা নয়। বিশেষতঃ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে এ সরকার মোটেও ভূমিকা নিতে পারছে না। এটা আমরা পূর্বেও বলেছিলাম যে, সিন্ডিকেট এখন বৃহৎ ব্যবসায়ীদের হাতে। তাদের নাড়ানোর ক্ষমতা সরকারের নেই। ফলে বাজারে জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়ছে। খাদ্যমূল্যস্ফীতি আওয়ামী লীগ আমলের মতোই, একটুও কমেনি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মব কিলিংয়ের মতো নির্মম ঘটনা ঘটছে। মন্দির, মাজার ভাঙচুর হচ্ছে। বেতন না পাওয়া পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভে গুলি চালানো হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ঘরবাড়ি, দোকানপাট পোড়ানো হয়েছে। তাদের উপর গুলি চালানো হয়েছে, তাদের নামে মামলা দেয়া হয়েছে। অনেকেই এলাকাছাড়া। ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার কথা বলা হচ্ছে, অনেক ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটই ছিল মত প্রকাশের স¦াধীনতা। সবচেয়ে বড় কথা, অভ্যুত্থানে শহিদদের পূর্ণ তালিকা এখনও তৈরি হয় নাই, আহত সকলের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায় নাই, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা যায় নাই। জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের তেমন উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না। গ্রেফতার করা আওয়ামী লীগ নেতাদের নামে যে মামলা দেয়া হয়েছে, আইনজীবীদের ধারণা, সেগুলোর বেশিরভাগই শেষ পর্যন্ত টিকবে না। এই ঘাটতিগুলো মারাত্মক।

এ সকল ঘটনা জনমনে প্রভাব ফেলছে। জনগণ একেবারে মুখ ফিরিয়ে না নিলেও প্রতিদিনই বিক্ষুব্ধ হচ্ছে। পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে বিচার করে তারা কোন দলের উপরই আস্থা রাখতে পারছে না। ফলে একটা রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে সমাজে।

এই শূন্যতার মধ্যে দুইটি ব্যাপার ঘটছে। একদিকে বিভ্রান্তিকর চিন্তা ও আলোচনা বাড়ছে। বহুধরণের তত্ত্ব ও ব্যাখ্যা সৃষ্টি হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে। মতের বৈচিত্র্যের অর্থে সেটা ভাল। কিন্তু কার্যকর আলোচনা ছাড়াও অনেক ধরনের বিভ্রান্তিকর চিন্তা ছড়াচ্ছে সমাজে, যা সঠিক চিন্তা দিয়ে পুনস্থাপিত হচ্ছে না। অন্যদিকে ধর্মীয় মৌলবাদ শক্তিশালী হচ্ছে। আদর্শিক শূন্যতা ও বামপন্থার দুর্বল অবস্থান- এই দুইয়ের কারণে মৌলবাদী রাজনীতি স্থান করে নিচ্ছে। বামপন্থাবিরোধী প্রচার ব্যাপকভাবে চলছে। স্বাভাবিকভাবেই জনগণ সঠিক পথের দিশা পাচ্ছে না।

এদিকে সংস্কার কতটুকু হবে, হলে কী ধরনের হবে তা নিয়ে ইতোমধ্যেই আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে জাতীয় নির্বাচন নিয়েও। বাংলাদেশের উপর প্রভাব বিস্তারকারী বড় তিনটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হলো ভারত, চীন ও আমেরিকা। নিজেদের দরকষাকষির মধ্য দিয়ে তারা বাংলাদেশে নির্বাচন চাইবে, নাকি সেনাশাসন চাইবে, নাকি এই সরকারকেই নিরাপদ মনে করবে- তা এখনও নিশ্চিত নয়। এদেশের ব্যবসায়ী-পুঁজিপতিশ্রেণির সাথে তাদের বোঝাপড়া কী দাঁড়াচ্ছে সেটাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা মনে করি, ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে যতখানি সংস্কার করা যায়, ততখানি সংস্কার করা উচিত। নানা কারণেই এ সরকারকে দিয়ে পূর্ণ সংস্কার সম্ভব নয়। ততটুকু জনভিত্তিও এই সরকারের নেই। এই সংস্কারের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের সাথে সময় নিয়ে বারবার বসতে হবে সরকারকে। আমলাতন্ত্র ও সেনাবাহিনী নির্ভরতা কমিয়ে জননির্ভরতা বাড়াতে হবে। এই সংস্কারের পর একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে এগোতে হবে।

উগ্র সাম্প্রদায়িক চিন্তার যে রূপ চারপাশে দেখা যাচ্ছে, তাতে দেশের গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষের একটা অংশ আতঙ্কিত হচ্ছেন। তাদের এটা বোঝা উচিত যে, সাম্প্রদায়িকতা গণঅভ্যুত্থানের ফলাফল নয়। রাষ্ট্রে ফ্যাসিবাদ গড়ে উঠলে মৌলবাদ বিকশিত হতে বাধ্য। ফ্যাসিবাদ চিন্তার সংঘাত সহ্য করে না। আওয়ামী লীগ তার ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম রাখার স্বার্থেই মৌলবাদকে প্রশ্রয় দিয়েছে। আবার মৌলবাদের উত্থানের ভয় দেখিয়ে উদার ও গণতান্ত্রিক চিন্তাসম্পন্ন মানুষের সমর্থন আদায় করতে চেয়েছে। এর বিষময় ফলাফল আমরা এখন দেখছি। এটা গণঅভ্যুত্থানের ফলাফল নয়, এটা ফ্যাসিবাদী শাসনের ফলাফল।

ফলে এই মুহূর্তে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। পতিত স্বৈরাচার যাতে ফিরে আসতে না পারে এবং সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো যাতে নতুনভাবে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে- সে লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ লড়াই করতে হবে। গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে প্রতিটি এলাকায় বিশিষ্ট নাগরিক, বিভিন্ন পেশাজীবী ও ছাত্র-জনতাকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ কমিটি গড়ে তুলতে হবে। এভাবে জনগণের নিজস্ব রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলতে পারলে, জনগণের কাছে সেটাই হবে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের সমস্ত আক্রমণ মোকাবেলা করার একমাত্র বিকল্প হাতিয়ার।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments