১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাস। এরশাদ পতনের আড়াই বছরও পার হয়নি। এরইমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সংগঠন ‘বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ’ সরকারের কাছে ৪ দফা সুপারিশনামা পেশ করে। এরমধ্যে একটি সুপারিশ ছিল ৫ বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা। এই ছাত্ররা নব্বইয়ের স্বৈরাচারী এরশাদ পতনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ফলে এর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ সংঘটিত হয়। সরকারকে এই প্রস্তাবনা থেকে সরে আসতে হয়।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন সাহাবুদ্দিন আহমদ। তিনি ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে গঠিত প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ছিলেন, প্রাক্তণ প্রধান বিচারপতি ছিলেন। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তিনি ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছিলেন। তাঁর একটা গ্রহণযোগ্যতা সমাজে ছিল, ফলে অনেক বুদ্ধিজীবী ও লেখক তাকে তখন সমর্থন দিয়েছিলেন। কিন্তু আন্দোলনের মুখে সেবারও এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা যায়নি।
স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার পতনের পর এই দুই সরকারের আমলেই শুধু নয়, এর পরবর্তী প্রতিটি সরকারের আমলেই ছাত্ররাজনীতি বন্ধের ব্যাপারটি বারবার আলোচনায় আসে। এ ব্যাপারে একটা সামাজিক স্বীকৃতি আদায় করার চেষ্টা বিভিন্ন গণমাধ্যম ও তথাকথিত সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে ছিল। তারা ছাত্ররাজনীতির সংঘাতপূর্ণ ঘটনাগুলোকে সামনে নিয়ে আসেন। ক্যাম্পাসে হত্যাকাণ্ড ও সংঘাতের কারণে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকা- এই দুই যুক্তি তখন বারবার সামনে নিয়ে আসা হয়। এ থেকে বোঝা যায় ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা এদেশের শাসকশ্রেণির একটা পুরনো প্রকল্প। ক্ষমতায় যারাই থাকুক না কেন, তারাই এ ব্যাপারে একমত। কারণ এদেশে ছাত্ররাজনীতির যে ইতিহাস ও ঐতিহ্য, তাতে বোঝা যায় যে, এটি ক্ষমতাসীন শাসকশ্রেণির অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে একটি বড় হুমকি।
তবে ২০০৮ সালের পর থেকে, বিশেষতঃ ২০১৪ সালের পর থেকে শাসকদের পক্ষ থেকে দেয়া যুক্তিগুলোর ধরণ অনেকখানি পাল্টে যায়। কারণ ইতিমধ্যে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সবগুলো ক্যাম্পাসের সম্পূর্ণ দখল নেয়া সম্পন্ন হয়েছে। ছাত্রলীগের একচ্ছত্র দখল, র্যাগ, গেস্টরুম এবং এসবের মধ্য দিয়ে বিভীষিকাময়, নির্মম একটা বিশ্ববিদ্যালয় জীবন তৈরি হয় তখন। একটা প্রজন্ম সৃষ্টি হয় যারা বাস্তবে ছাত্ররাজনীতির নামে এই অপমান, নির্যাতন, নিপীড়ণ ও দখলদারিত্বই দেখেছে। তাদের কাছে এই দখলদারিত্বই ছাত্ররাজনীতি হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। এর একটা চূড়ান্ত রূপ আমাদের সামনে আসে ২০১৯ সালে বুয়েটের ছাত্র আবরার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। রাতভর নির্যাতন করে যেভাবে একটা ছেলেকে পিটিয়ে মেরে ফেলে একটা নজিরবিহীন ঘটনার জন্ম দেয়া হলো দেশের সবচেয়ে মেধাবীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তখন থেকে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয় এবং ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের জন্য কিছু মহল থেকে দাবি উঠে। এই সময়টিতে আগের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, এই কারণে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকা ও সেশনজট- এই যুক্তিগুলোর বদলে ক্যাম্পাসে দখলদারিত্ব, ছাত্রনির্যাতন ও র্যাগিংয়ের বিষয়গুলো সামনে আসে।
এই সবকিছুর প্রতিক্রিয়া হয়েছে নানাবিধ। এ সময়ে ছাত্ররাজনীতি ও দখলদারিত্ব একটা বিরাট অংশের শিক্ষার্থীদের কাছে সমার্থক হয়ে গেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় গণঅভ্যুত্থান পরবর্তীতে ক্যাম্পাসগুলোতে রাজনীতি বন্ধের আলোচনা যখন একটা গোষ্ঠী শুরু করে তখন সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটি অংশ এতে সমর্থন দেয়। একটি গোষ্ঠী বলার কারণ এই যে, এই আলোচনাটা অভ্যুত্থান পরবর্তীতে কিছু রাজনৈতিক কর্মীই শুরু করেন তাদের সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ড থেকে।
ছাত্ররাজনীতি বন্ধের আলোচনা শুরু হতে না হতেই আমরা দেখলাম তড়িৎগতিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলো, সকল প্রকার সভা-সমাবেশের অধিকার কেড়ে নেওয়া হলো। এটা মত প্রকাশের অধিকারের উপর হস্তক্ষেপই শুধু নয়, গণঅভ্যুত্থানের চেতনারও বিরোধী।
এদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে ছাত্রসংগঠনগুলোর একটা ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে। পাকিস্তান পর্বে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি লড়াইয়ে ছাত্র সংগঠনগুলো সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে, জনতার মুক্তি সংগ্রামকে তরান্বিত করেছে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রসংগঠগুলো ছাত্র-জনতাকে সংগঠিত করেছে, এরশাদকে হটিয়েছে। ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানেও ছাত্রসংগঠনগুলো ছাত্র-জনতার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর প্ল্যাটফর্ম থেকে লড়াইয়ে সামিল হয়েছে, জীবন পর্যন্ত দিয়েছে। সমস্ত ছাত্রসংগঠন আওয়ামী বিরোধী লড়াইয়ে সর্বাত্মক অংশগ্রহণ করেছে বলেই হাসিনা সরকারকে উৎখাত করা সম্ভব হয়েছে। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য যে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের অধিকাংশই কোন না কোন ছাত্রসংগঠনের সাথে যুক্ত।
দ্বিতীয়ত, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ ও সভা-সমাবেশের অধিকার কেড়ে নেয়ার মধ্য দিয়ে জনগণের এক বড় অংশ শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিকভাবে মত প্রকাশের অধিকার হরণ করা হয়েছে। কোন সুনির্দিষ্ট ছাত্রসংগঠন যদি সামনের দিনে ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস-দখলদারিত্বের পরিবেশ তৈরি করে করে তবে এর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং সরকার আইনগত ব্যবস্থা নেবে। একইসাথে শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধভাবে এই সন্ত্রাসী শক্তিকে প্রতিরোধ করবে, আন্দোলন গড়ে তুলবে। কিন্তু এসব বাদ দিয়ে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ এই সামগ্রিক সংকটকে দূর তো করবেই না, উল্টো ক্যাম্পাসে অগণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করবে।
তৃতীয়ত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি এবং ছাত্র সংগঠন থাকতে পারবে না- এটা নির্ধারণ করে দেয়া চরম অগণতান্ত্রিক এবং জবরদস্তিমূলক। একটি নির্দিষ্ট সংগঠন করতে হবে এর জন্য একজন ছাত্রকে বাধ্য করা, চাপ প্রয়োগ করা যেমন জবরদস্তিমূলক; একইভাবে একজন ছাত্র গণতান্ত্রিক উপায়ে কোন সংগঠন করতে পারবে না, মত প্রকাশ করতে পারবে না- এটাও সমানভাবে জবরদস্তিমূলক। ব্যক্তির মতপ্রকাশ বাধাগ্রস্ত হলে, সংগঠন করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হলে স্বাভাবিকভাবেই সৌহার্দ্যপূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশে আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক বন্ধ হয়ে যায়। গায়ের জোরে ভিন্ন ভিন্ন মতের বহিঃপ্রকাশ যেখানে আটকে দেয়া হয় এরকম বদ্ধ পরিবেশেই ফ্যাসিবাদ আসে। যেখানে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রচারের পথ উন্মুক্ত থাকে, ভিন্ন ভিন্ন মতের দ্বন্দ্ব হয় এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকে- সেখানে ফ্যাসিবাদ আসতে পারে না।
চতুর্থত, ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক রাজনীতি না থাকলে শিক্ষা সম্পর্কিত রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপের ব্যাপারে কোথা থেকে কথা উঠবে? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি অন্যায় করে তার বিরুদ্ধে কে কথা বলবে? কোন ব্যক্তির প্রতিবাদ তো শক্তিশালী হয় না, তাকে সংগঠিত হতে হয়। ছাত্রদের সংগঠিত হওয়ার অধিকার কেড়ে নেয়া মানে তো ক্যাম্পাসে অগণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিহীন পরিবেশ সৃষ্টি করা।
পঞ্চমত, অনেকে মনে করেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন করে তাদের হাতে সকল দায়িত্ব তুলে দিলেই হবে, আর কোন সংগঠন লাগবে না, ছাত্রদের সংগঠিত হতে হবে না। এই ভাবনা সঠিক নয়। গোটা নির্বাচিত ছাত্র সংসদও যে কোন সময় ছাত্রস্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে নির্বাচিত লোকেদের জনস্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর উদাহরণ কি আমরা দেখি নাই? ছাত্রসংগঠনগুলো না থাকলে ছাত্র সংসদ ও প্রশাসন একত্রিত হয়ে একটা ফ্যাসিস্ট ক্যাম্পাস সৃষ্টি করবে।
ষষ্ঠত, সংগঠন করার অধিকার একটা মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার, যা সংবিধানে স্বীকৃত। এটার চর্চা বাধাগ্রস্ত করা মানে মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন করা, সংবিধান লংঘন করা। অনেক জায়গায় প্রশাসনকে এমন যুক্তি দিতে আমরা শুনেছি যে, বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ছাত্র রাজনীতি চায় না বলে সেটা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটা কি সঠিক কথা হলো? সংবিধানসিদ্ধ মৌলিক অধিকার কি সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটের মধ্য দিয়ে কোন প্রতিষ্ঠান খারিজ করে দিতে পারে? বাক স্বাধীনতার অধিকার নিয়ে কি ভোটাভুটি করা যায়?
শিক্ষার্থীরা যে আশঙ্কা থেকে ছাত্র রাজনীতির বিরোধিতা করছে সে আশঙ্কা পুরো অমূলক নয়। শিক্ষার্থীরা বিগত ১৫ বছরে ছাত্রলীগের চরম দখলদারিত্ব, গণরুম-গেস্টরুমের অত্যাচার দেখেছে। এইসব নিপীড়ন-নির্যাতন এবং নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ যেমন সাধারণ শিক্ষার্থীরা করেছে, একইসাথে প্রতিবাদী ছাত্রসংগঠনসমূহও করেছে। আবু সাইদসহ শত শত ছাত্রজনতা কেন শহীদী আত্মদান করলো? এজন্যই যে, মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা যেন অবাধ হয়- যা ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার কেড়ে নিয়েছিলো। অসংখ্য মানুষের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে পাওয়া ‘নতুন বাংলাদেশে’ আমরা চাই না মত প্রকাশের অধিকার হরণ হোক, গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হোক।
আর ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হলেই কি ক্যাম্পাসে প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্র, দখলদারিত্ব এবং ছাত্রস্বার্থ বিরোধী সিদ্ধান্ত বন্ধ হবে? বাস্তবে আমাদের সমাজে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুই ধরনের রাজনীতি অবস্থান করে। একটা রাজনীতি দখলদারিত্ব, গণরুম-গেস্টরুম তৈরি করে, শিক্ষার্থীদের অমানবিক জীবনের দিকে ঠেলে দেয়। হত্যা-নির্যাতন এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমন করে শোষণমূলক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে চায়। এসব হলো রাজনীতির নামে অপরাজনীতি। আরেকটা রাজনীতি আছে- যা এসবের প্রতিবাদ করে। সমস্ত শোষণ-জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াই করে। শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থের পক্ষে দাঁড়ায়। এটিই হলো প্রকৃত রাজনীতি, ছাত্রদের পক্ষের রাজনীতি। এই প্রকৃত রাজনীতির বিকাশের মাধ্যমেই একমাত্র অপরাজনীতি এবং সন্ত্রাস-দখলদারিত্ব নির্ভর ছাত্ররাজনীতির বিলোপ সম্ভব। এর বাইরে সমস্ত পথই আত্মপ্রবঞ্চনার পথ, যা সমস্যার প্রকৃত সমাধান দেবে না।