একদা সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত, ১৯৯১ সালে সমাজতন্ত্রের পতন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের পর পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত ইউক্রেন সম্প্রতি সংবাদের শীর্ষে এসেছে। ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়ার মতই ইউক্রেনের ক্ষেত্রে দাবি উঠেছিল নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগ করে নতুন নির্বাচন করতে হবে। এই দাবিতে ‘প্রবল গণবিক্ষোভ’, গুলি-পাল্টা গুলি, বহু মানুষের মৃত্যু ঘটে গেছে। শেষ পর্যন্ত ২২ ফেব্রুয়ারি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইউনুকোভিচ “তাঁর বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে ‘ক্যু’ করা হয়েছে” এই অভিযোগ তুলে টিভি-তে বক্তব্য রেখে রাজধানী কিয়েভ ছেড়ে পূর্বাঞ্চলে, যেখানে তাঁর প্রতি জনসমর্থন আছে, চলে গিয়েছেন। ইউক্রেনের সমস্যা ও ঘটনাবলীর আপাত বিচার দিয়ে এর তাৎপর্য ও বিপদকে বোঝা যাবে না। প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচ ‘গণতন্ত্রী’ ও ‘জনকল্যাণকারী’ ছিলেন একথা যেমন সত্য নয়, তেমনই ‘গণবিক্ষোভ’ বলে যেটা এতদিন চলছে, সেটা প্রকৃতই জনগণের দ্বারা সংগঠিত ও পরিচালিত বিক্ষোভ, সুশাসন ও গণতন্ত্রের দাবিই এই বিক্ষোভের মূল লক্ষ্য – এ কথাও সত্য নয়। অন্যদিকে পুঁজিবাদী রাশিয়ার শাসক রাষ্ট্রপতি পুতিন এর রাজনৈতিক চরিত্র ও চেহারা যাই হোক, এ কথাও সত্য নয় যে, রাশিয়া ইউক্রেন দখল করতে চায় বলেই যেন এই সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়েছে, যদিও বুর্জোয়া মিডিয়া তেমনই প্রচার করছে।
কেন এই সংঘর্ষ? গত বছরের নভেম্বরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক চুক্তি না করে প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচ রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করার সিদ্ধান্ত নেন। বুর্জোয়া প্রচারমাধ্যম বলছে, এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে গণতন্ত্রকামী ইউক্রেনবাসী সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। অপরদিকে ইনডিপেনডেন্স স্কোয়ারকে বিদ্রোহীদের দখলমুক্ত করতে সরকারি সেনা-পুলিশ নির্বিচারে দমন-পীড়ন চালায়।
কারা এই বিদ্রোহী? কারা তাদের গণতন্ত্রী নেতা? তাদের আসল পরিচয় কিন্তু ঐ মিডিয়া ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ করছে না। জানা গেছে, গত ২১ নভেম্বর থেকে তিন মাস ধরে এই বিক্ষোভে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা স্টেপান বান্দেরার অনুসারী। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন নাৎসী বাহিনীর এজেন্ট। এ ছাড়া আন্দোলনকারীদের মধ্যে রয়েছে নাৎসীবাদী আওয়ার ইউক্রেন পার্টি। রয়েছে অল ইউক্রেনিয়ান ইউনিয়ন ‘স্ভোবোদা’ পার্টি। চরম দক্ষিণপন্থী জোট অ্যালায়েন্স অব ইউরোপিয়ান ন্যাশনাল মুভমেন্ট (এইএনএম)-এর অন্তর্ভুক্ত হল স্ভোবোদা পার্টি। এই জোটের অন্য শরীকরা হল হাঙ্গেরির নয়া নাৎসী জোব্বিক পার্টি, ফ্রান্সের ন্যাশনাল ফ্রন্ট। ব্রিটিশ ন্যাশনাল পার্টির নেতা নিক গ্রিফিন এইএনএম-এর সহ-সভাপতি। স্ভোবোদা ইটালির নাৎসীবাদী ফোর্জা নুয়োভা এবং চরম দক্ষিণপন্থী জার্মান ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সাথে সম্পর্ক রেখে চলে। হিটলার কবলিত সোভিয়েত ইউনিয়নে অসংখ্য গণহত্যার ধারাবাহিকতা আজও বহন করে চলেছে এই সভোবোদা। অন্দোলন চলাকালীন এরাই ভেঙ্গেছিল মহান লেনিনের মূর্তি। এই নিষ্প্রাণ মূর্তিই তাদের বুকে কাঁপন ধরায়। কারণ তারা জানে এই মানুষটির মহান শিক্ষাই সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদীদের সমস্ত জারিজুরি ভেঙ্গে বিশ্বে আবার সমাজতন্ত্র আনবে। সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করবে।
রাশিয়া বিরোধী এমনই কীর্তিমানদের সাথে যুক্ত হয়েছে ভিতালি ক্লিৎস্কোর ইউডার পার্টি। ইনি বিশ্ব হেভিওয়েট বক্সিং চ্যাম্পিয়ান এবং ন্যাশনাল হিরো। ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হবেন বলে তিনি আগাম ঘোষণা করে রেখেছেন। জার্মান ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট ইউনিয়ন পার্টি খোলাখুলি স্বীকার করেছে, ক্লিৎস্কোকে নিয়োগই করা হয়েছে ইউক্রেনে একটি দক্ষিণপন্থী পার্টি গঠন করে রাজধানী কিয়েভে সর্বদা ইইউ সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রাখার জন্য।
এই হলো গত তিনমাস ধরে ইউক্রেনে চলা আন্দোলন এবং গত কয়েকদিনের কিয়েভের ইনডিপেনডেন্স স্কোয়ার দখলের লড়াইয়ের রাজনৈতিক নেতৃত্ব। এরা আনবেন ইউক্রেনে শান্তি, সুস্থিতি এবং জনগণের সমৃদ্ধি!
সে যাই হোক, এরাই সে দেশে পুঁজিবাদী শাসনে বিক্ষুব্ধ মানুষদের মিথ্যা প্রচারে বিভ্রান্ত করে এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে নামিয়েছেন। শুধু কি এরা? এদের পেছনে রয়েছেন নাটের গুরুরা। আমেরিকার রিপাবলিক সেনেটর জন ম্যাককেইন ও অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট ভিক্টোরিয়া নিউল্যান্ড, ইইউ-র বৈদেশিক দপ্তরের প্রধান ক্যাথরিন অ্যাস্টন এবং জার্মান চ্যান্সেলার অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের প্রতিনিধি বিদেশমন্ত্রী গুইডো ওয়েস্টারওয়েলের মতো হেভিওয়েটরা এসে বারবার প্রতিবাদী মিছিলে অংশগ্রহণ করেছেন। সাম্রাজ্যবাদীদের অর্থপুষ্ট বিভিন্ন এনজিও এইসব বিক্ষোভ মিছিলে সক্রিয় অংশ নিয়েছে। এমনকী কুখ্যাত ‘অটপর’ সংগঠনও কিয়েভে বিরোধীদের আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। এই সেই ‘অটপর’ যারা পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদীদের দেয়া অর্থের বিনিময়ে যুগোস্লাভিয়ার স্লোবাদান মিলোসেভিচ সরকারের পতন ঘটিয়েছিল, ভেনিজুয়েলায় উগো শ্যাভেজবিরোধী দক্ষিণপন্থীদের মদত দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচকে অপসারণের সাথে সাথেই যে ইউলিয়া টিমশেঙ্কোকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হল এবং যাকে প্রেসিডেন্টের পদে বসানোর তোড়জোড় চলছে, তার পার্টি জার্মানি ঘেঁষা ‘বাটকিভচাইনা’ও এই ষড়যন্ত্রীদের সঙ্গে আছে। এই ইউলিয়া টিমশেঙ্কো ছিলেন ইউক্রেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। প্রতারণা ও তহবিল তছরুপের অভিযোগেই তিনি জেল খাটছিলেন।
এইসব মহান গণতন্ত্রী ও স্বাধীনতাপ্রেমী নেতাদের স্বার্থ কী? আসলে তারা চান ইউক্রেনকে ইইউ-র লেজুড়ে পরিণত করতে। আর আমেরিকা ও ইউরোপের বিশেষ স্বার্থ হল বিশ্বে তাদের আধিপত্য বাড়িয়ে চলা। এবং সেই উদ্দেশ্যে অপর শক্তিধর দেশ রাশিয়াকে ঘায়েল করতে তাকে ঘিরে মার্কিন-ইইউ প্রভাবাধীন অঞ্চল, সেখানে তার বশংবদ পুতুল সরকার এবং সামরিক ঘাঁটি তৈরি করা।
একটু পেছনের দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পাব, সাম্রাজ্যবাদী জার্মান ইউক্রেনসনহ এতদ অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলিকে তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ইউক্রেনকে রাশিয়ার প্রভাব থেকে বের করে আনার জন্য সে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করছে। পাশাপাশি ইইউ-কে দিয়ে চাপ সৃষ্টি করছে যাতে ইউক্রেন ওই অর্থনৈতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। না করলে তারা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করারও হুমকি দিয়েছে। অথচ এই বাণিজ্য চুক্তি মানলে ইইউ-এর পণ্যে ইউক্রেন ছেয়ে যাবে, দেশীয় শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। কিছু ঋণ পাওয়া যাবে সত্য, কিন্তু শর্ত অনুযায়ী জনগণের জন্য বরাদ্দ সমস্ত ভর্তুকি বন্ধ করতে হবে এবং ঋণ শোধ করতে ব্যাপক ব্যয় সংকোচ করতে হবে। এর ফলে ইউক্রেন সম্পূর্ণ দেউলিয়া হয়ে যাবে গ্রিস, পর্তুগাল, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, সাইপ্রাস সহ অন্যান্য ইইউ সদস্য দেশগুলোর মতো। সেই কারণেই পুঁজিবাদী রাশিয়ার সঙ্গে অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক শর্তে চুক্তি স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত ছিল প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচের। ফলে, রাজধানী কিয়েভে সম্প্রতি যা ঘটে গেল, তাকে ‘গণতান্ত্রিক ইইউ পন্থী বিরোধীদের’ সঙ্গে ‘রাশিয়াপন্থী স্বৈরাচারী’ সরকারের সংঘর্ষ বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।
কিন্তু ইউক্রেনকে আজ ইইউ বা রাশিয়ার দ্বারস্থ হতে হচ্ছে কেন? সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় ইউক্রেন তো ছিল অর্থনৈতিক দিক থেকে দ্বিতীয় সর্বোন্নত প্রজাতন্ত্র। বিশাল পরিমাণ উর্বর কৃষি জমির দেশ। ইউক্রেনকে বলা হতো রাশিয়ার শস্যভাণ্ডার। সেখানে শিল্পের জন্য গড়ে তোলা হয়েছিল নানা শক্তির কেন্দ্র, দেশের অগ্রগতির জন্য ছিল বিশাল পরিমাণ সুশিক্ষিত মানব সম্পদ। কিন্তু সংশোধনবাদী নেতৃত্বের কবলে পড়ে ১৯৯১ সালে সেই রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতন ঘটে, ফিরে আসে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। ইউক্রেনও স্বাধীনতা লাভ করে, পুঁজিবাদী স্বাধীনতা। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার চেয়ে এই স্বাধীনতাতেই অধিকতর কল্যাণ হবে – জনসাধারণের কাছে এই প্রচার করতে করতেই পুনরাবির্ভূত পুঁজিপতিশ্রেণি সে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গড়ে তোলা সমস্ত সামাজিক সম্পদকে ব্যক্তিগতভাবে লুঠ করেছে। সমৃদ্ধশালী দেশ ইউক্রেনে আজ শতকরা ২৫ ভাগ লোকই দরিদ্র। ৬ কোটি মানুষ বিদেশে চলে গেছেন রোজগারের আশায়। তাদের পাঠানো টাকাই এখন দেশের জিডিপি’র ২৫ শতাংশ। যার উপর নির্ভর করে কোনোরকমে বেঁচে আছে দেশের বিশাল সংখ্যক মানুষ। গরিব ঘরের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ নেই, বাড়ছে মানুষের মৃত্যুহার। এই হল অতি সংক্ষেপে সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উন্নয়নের খতিয়ান। ফলে, শোষিত মানুষের মধ্যে জমা হয়েই ছিল বিক্ষোভের বারুদের স্তুপ। সাম্রাজ্যবাদীরা আজ তারই সুযোগ নিয়েছে।
পুঁজিবাদী শাসক ইয়ানুকোভিচের অপসারণের পর পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে, তাতে সমগ্র ইউক্রেন গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেও আশ্চর্যের হবে না।
[সূত্র : ভারতের সোশ্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অব ইন্ডিয়া(কমিউনিস্ট) – এসইউসিআই(সি) দলের বাংলা মুখপত্র সাপ্তাহিক গণদাবী, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সংখ্যা থেকে সংগৃহীত]
সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে প্রতারণার শিকার ইউক্রেনের জনগণ
RELATED ARTICLES