Saturday, November 23, 2024
Homeফিচারসঠিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে শক্তিশালী গণআন্দোলনই জনগণকে পথ দেখাতে পারে

সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে শক্তিশালী গণআন্দোলনই জনগণকে পথ দেখাতে পারে

সাম্যবাদ প্রতিবেদন
এশিয়া কাপ, টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপ – একের পর এক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলছে দেশে। এসবের জন্য ব্যয় হচ্ছে হাজার কোটি টাকা। খেলার মাঠে উদ্বেগাকুল দর্শক – কে হারল, কে জিতল? বাংলাদেশ কি হেরে গেল? স্বাধীনতা দিবস সমাগত। লক্ষ কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে রেকর্ড বুকে নাম ওঠানোর প্রস্তুতি চলছে। সংবিধান, গণতন্ত্র ইত্যাদি শব্দের উচ্চকিত ঢাক প্রতিদিনই পেটানো হচ্ছে। কিন্তু মাঠ আর টিভি পর্দার উন্মত্ততা, লক্ষ কণ্ঠের জাতীয় সঙ্গীতের আবেগ, সংবিধান ও গণতন্ত্রের দোহাই – কোনো কিছুই কি নিরন্ন কৃষক, আধপেটা শ্রমিক, নিত্যদিনের লাঞ্ছনা-নির্যাতন ভোগকারী নারী এবং বাংলাদেশের কোটি কোটি শ্রমজীবী মেহনতী মানুষের অসহায় অবস্থাকে ঢেকে রাখতে পারছে?
বাতাসে কান পাতলে আলুচাষীদের হাহাকার এখনো শোনা যাবে। সেচ মওসুম আসছে – ডিজেল-বিদ্যুতের জন্য চাষীদের হাহাকার শোনার জন্য আমরা প্রস্তুত হয়ে আছি। আর এর মাঝেই বাড়নো হচ্ছে বিদ্যুতের দাম। গার্মেন্ট শ্রমিকরা ন্যায়সঙ্গত মজুরি না পেয়েও মালিকী অবিচার-অনাচার মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। আগুনে পুড়ে-ভবন ধসে শত শত শ্রমিকের হত্যাকাণ্ডেরও কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। এই তথাকথিত নির্বাচিত ও সংবিধানের দোহাই-পাড়া সরকারের অধীনেই চলছে নির্বিচার বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড । সাগর-রুনি, ত্বকি, মিরাজ – এমন অসংখ্য আলোচিত হত্যাকাণ্ডের বিচার আদৌ হবে কিনা – কেউ বলতে পারে না। আর প্রতিদিনের অসংখ্য খুন, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, অপহরণের সাথে সাথে থেকে থেকে এখানে ওখানে সাম্প্রদায়িক হামলা মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলছে। আইনের শাসনের বালাই মাত্র নেই। মানুষ অসহায়, দিশেহারা।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকেই বিদ্রোহের পীঠস্থান এই বাংলা। ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ, চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, সাওতাঁল বিদ্রোহ – এমন অনেক বিদ্রোহের ইতিহাস এখানে রচিত হয়েছে। ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র বিপ্লববাদী ধারার পীঠস্থানও ছিল এই বাংলা। এরপর একে একে ভাষা আন্দোলন, ’৬২ ও ’৬৪-র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পথ বেয়ে এসেছে স্বাধীনতা সংগ্রাম। স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশের মানুষকে বারে বারে বিদ্রোহ করতে হয়েছে সামরিক-বেসামরিক নানা স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে – ’৯০এর গণঅভ্যুত্থান যার মাইল ফলক। কিন্তু সেই বিদ্রোহী বাংলা আজ যেন দিশেহারা, বাংলাদেশের মানুষ যেন অসহায়।

ফ্যাসিবাদ আজ বুর্জোয়া শাসনের সাধারণ প্রবণতা
একটা একতরফা ভোটারবিহীন প্রার্থীবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে পুনর্বার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসীন। একদা পতিত সামরিক স্বৈরাচার আর বামপন্থি বলে পরিচিত দুই বিপরীত মেরুর রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগের সাথী হয়েছে। ‘পাকা বাম’দের সাথে নিয়েই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী এদেশে এক ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। এবং আরো কিছু পাকা বাম হাসিনার অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী শাসককে বৈধতা দেয়ার নানা ফায়দা-ফিকির খুঁজছে।
জনগণের সাবভৌমত্ব অর্থাৎ জনগণের অধিকারের সুরক্ষা ও নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ঘোষণা করেই আধুনিক বুর্জোয়া রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছিল, এটা সবার জানা। এসব কথা আমাদের সংবিধানেও লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু এসবই এখন ইতিহাসের কথা, কেতাবের কথা। রুঢ় বাস্তব অন্য কথা বলছে। সারা দুনিয়া জুড়েই বুর্জোয়া রাষ্ট্র, আবির্ভাবের পর থেকে ক্রমাগত ফ্যাসিবাদী রূপ নিয়েছে। আইনসভা, বিচারবিভাগ ও প্রশাসন – রাষ্ট্রের এই তিন স্তম্ভের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য এখন সোনার পাথরবাটি। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ক্ষমতার মূল নিয়ন্ত্রণ ক্রমাগত প্রশাসনের হাতে, এবং পরোক্ষে সেনাবাহিনীর হাতে চলে গিয়েছে। সারা দুনিয়াকে গণতন্ত্রের সবক দেওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিলিটারি রাষ্ট্র। একই চিত্র আমাদের প্রতিবেশী, বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ বলে পরিচিত ভারতের ক্ষেত্রেও। কেন এমন হচ্ছে?
মহামতি মার্কস সারা দুনিয়ার মানুষের সামনে পুঁজির চরিত্র-বৈশিষ্ট্য উন্মোচিত করে দেখিয়ে গেছেন, পুঁজির ধর্মই শোষণ আর লুণ্ঠন। এ প্রক্রিয়াতেই পুঁজির বাড়-বাড়ন্ত হয়। নির্মম শ্রম শোষণ, সম্পদ লুণ্ঠন চালিয়ে এবং ছোট ছোট পুঁজিকে গ্রাস করে বড় পুঁজির জন্ম হয়। পুঁজি ক্রমাগত একচেটিয়া চরিত্র লাভ করে। মার্কসের সুযোগ্য অনুসারী কমরেড লেনিন উন্মোচন করেছেন একচেটিয়া পুঁজির চরিত্র। এই একচেটিয়া পুঁজি নিজের দেশের গণ্ডী ছাড়িয়ে হানা দেয় পরদেশে। পরদেশ হানাদেয়া পুঁজির এই চরিত্রকে তিনি চিহ্নিত করেছেন সাম্রাজ্যবাদ হিসেবে। সাম্রাজ্যবাদ মানেই বর্বর আগ্রাসন, নগ্ন শোষণ, নির্মম লুণ্ঠন।
কিন্তু সব দেশের পুঁজিই তো আর অন্যান্য সব বড় বড় সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির সাথে মোকবেলা করে নিজের দেশের গণ্ডী অতিক্রম করতে পারে না। বরং তাদের ওপর সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির আধিপত্যও থাকে। তাই বলে তার আগ্রাসী চরিত্র কি সংশোধন হয়ে যায়? না, তা যায় না। নিজ দেশের মাটিতেও সে ফ্যাসিস্ট চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হয়। এর আরো একটি কারণ হল, বুর্জোয়াশ্রেণী যে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি শব্দের দোহাই দিতে থাকে – এর কোনোটাই সে রক্ষা করতে কিংবা পালন করতে পারে না। দেশের মানুষের উপর পুঁজির নির্মম শোষণ চালাতে গিয়ে এর কোনোটাকে রক্ষা করা সম্ভবও নয়। শোষিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত জনগণের ক্ষোভ-বিক্ষোভকে দমন করার উদগ্র তাগিদ থেকে এবং শ্রমিক বিপ্লবের ভীতি থেকেই জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবিক অধিকার, নাগরিক অধিকার ইত্যাদি হরণ করা, খর্ব করা শুরু করে। এ যুগের মহান মার্কসবাদী দার্শনিক কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন যে আজকের দিনে বুর্জোয়া শাসনের সাধারণ প্রবণতাই হল ফ্যাসিবাদ। পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের খোলস বা দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার ঠাঁটবাট বজায় রেখেই সেটা হতে পারে।
এটা আমরা জানি যে, অবাধ প্রতিযোগিতামূলক (laissez-faire) পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে অবলম্বন করে রাজনৈতিক উপরিকাঠামোতে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। এই পুঁজিবাদ যখন অবাধ প্রতিযোগিতার স্তর পার হয়ে একচেটিয়া বৈশিষ্ট্য নিল (অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী স্তরে উন্নীত হল) তখন তার ছাপ শাসনতন্ত্র ও শাসনব্যবস্থাতেও পড়তে শুরু করল। আর এ কারণেই পুঁজিবাদী দেশগুলোতে শাসনব্যবস্থায় স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা দিনে দিনে ফুটে উঠতে লাগল। এই স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতাই বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অর্থনৈতিক সংকটের ফলে উগ্র জাত্যাভিমান, জাতীয়তাবাদ, গরিব মানুষের কল্যাণ ইত্যাদি মুখরোচক বুলির আড়ালে ফ্যাসিস্ট শাসনের চেহারা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল। আর আমাদের দেশে এই পুঁজিবাদ গড়ে উঠেছে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যদিয়ে বুর্জোয়াশ্রেণী শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে ইতিহাসের এমন একটা সময়ে যখন বিশ্বব্যবস্থা হিসেবে পুঁজিবাদ চূড়ান্ত অবক্ষয়ী। ফলে অর্থনীতিতে লুটপাট ও শাসনব্যবস্থায় জবরদস্তি এর জন্মকালীণন বৈশিষ্ট্য। রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এই ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটতে থাকে বিশেষ ক্ষমতা আইন, রক্ষী বাহিনী, বাকশাল, সামরিক অভ্যুত্থান, সামরিক শাসন, আদালতের উপর নিয়ন্ত্রণ, সংবাদ মাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ, বিরোধী মত দমন ইত্যাদি চেহারায়। বর্তমান শাসকদের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দেশপ্রেম, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গীবাদ মোকাবেলা ইত্যাদি আপাত প্রগতিশীল শব্দ ও ক্রিয়াকর্মের আড়ালে চূড়ান্ত ফ্যাসিবাদী শাসন পরিচালনা করার সাংস্কৃতিক ও ভাবাদর্শগত পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।

একচেটিয়া পুঁজির শোষণ-লুটপাটের জন্য চাই প্রতিরোধহীন ‘স্থিতিশীল’ পরিবেশ
বাংলাদেশের মাটিতে গত ৪২ বছর ধরে শিল্প-কৃষি-ব্যবসায়-বাণিজ্যের সমস্ত ক্ষেত্রে বেপরোয়া শোষণ, লুণ্ঠনের মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের প্রক্রিয়ায় একটি শক্তিশালী বুর্জোয়াগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। এই গোষ্ঠী দেশের অর্থনীতির উপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে অনেকটাই সক্ষম হয়েছে। ইতোমধ্যে গড়ে ওঠা শ্রমদক্ষতা ও সস্তা শ্রমের বিশাল বাজার কাজে লাগিয়ে বিনিয়োগের যে বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, বুর্জোয়াশ্রেণী একে পুরোপুরি কাজে লাগাতে চায়। বাংলাদেশের বুর্জোয়াশ্রেণী বিদেশের বাজারেও নিজেদের পুঁজি ও পণ্য নিয়ে হাজির থাকতে চায়। এই উভয় প্রয়োজনে বিদেশি বহুজাতিক পুঁজি এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে গাঁটছড়া বেঁধে থাকাটা আমাদের দেশের পুঁজিপতিগোষ্ঠীর জন্য একান্ত দরকার। দেশি-বিদেশি পুঁজির এই শ্রম-শোষণ ও বাজার লুণ্ঠনের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক ‘স্থিতিশীলতা’ যার আড়ালে বুর্জোয়া শোষণ-নিপীড়নে পিষ্ট বিশাল জনগণকে শাসনতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং গণবিক্ষোভ ও গণআন্দোলনকে নির্মমভাবে দমন করা যায়। একচেটিয়া পুঁজির প্রয়োজন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণমূলক একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা দাঁড় করানো – ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করা। আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, মাত্র কিছু দিন আগেও কথিত ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’র এক চক্রান্তমূলক পথে এদেশের বুর্জোয়াদের হাঁটতে দেখা গেছে। এর পেছনের অন্যতম উদ্দেশ্যও ছিল একটি নিয়ন্ত্রণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা দাঁড় করানো যেখানে জনগণের বিক্ষোভ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, গণআন্দোলনকে শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করা হবে।

বামপন্থীদের বিভ্রান্তি ও শক্তির দুর্বলতা : জনগণের অসহায়ত্ব
আমরা মনে করি, এদেশের বামপন্থী শক্তিগুলোর এক তীব্র আত্মসমালোচনার মুখোমুখি দাঁড়াবার সময় এসেছে। বুর্জোয়াশ্রেণী এবং শাসকগোষ্ঠী কেমন করে দেশের জনগণের উপর বর্বর ফ্যাসিবাদী শাসন চাপিয়ে দিতে পারল? একি শুধুই বুর্জোয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং বুর্জোয়াশ্রেণীর নিজস্ব প্রয়োজন ছিল বলেই? আমরা মনে করি, শুধু তা নয়। এক্ষেত্রে বাম-গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির বিভ্রান্তি ও দুর্বলতাও একটা বড় কারণ। এদেশের বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক শক্তি বলে পরিচিত দল ও শক্তিগুলোর নানা ধরনের বিভ্রান্তি এবং দুর্বলতাই জনগণকে অসংগঠিত ও শক্তিহীন, উপায়হীন অবস্থায় নিক্ষেপ করেছে এবং বুর্জোয়াশ্রেণীকে সুযোগ করে দিয়েছে।
এ কথা সত্য যে এদেশের মানুষ, এবং বামপন্থী শক্তিগুলো বহু লড়াই সংগ্রাম করেছে, বিরাট আত্মত্যাগও করেছে। কিন্তু কোনো লড়াই সংগ্রামই যথার্থ পথ পেতে পারে না, যদি না তার রাজনৈতিক দিশা সঠিক থাকে।
বামপন্থী দলগুলো আদর্শিকভাবে, তাত্ত্বিকভাবে এবং সাংগঠনিকভাবে এ দিশা তুলে ধরতে আপাত হলেও ব্যর্থ হয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা দুটি বড় ধরনের বিভ্রান্তি এবং দুর্বলতা দেখতে পাই : এক. শত্রু চিহ্নিত করার সমস্যা, দুই. শত্রুর বিরুদ্ধে যথার্থ এবং কার্যকর শক্তি গড়ে তোলার পথ অনুসরণ না করার সমস্যা।
আমাদের দেশের বামপন্থী শক্তির একটা বড় অংশই জনগণের মূল শত্রু হিসাবে দেশের বুর্জোয়াশ্রেণীকে চিহ্নিত করতে এবং তার বিরুদ্ধে কার্যকর গণআন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। বামপন্থী বন্ধুদের কেউ কেউ সাম্রাজ্যবাদকে জনগণের প্রধান শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করেছেন, কেউ কেউ প্রধান শত্রু ও সমস্যা হিসাবে মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতাকে চিহ্নিত করেছেন। বামপন্থী বন্ধুদের এই ভুল জনগণের একটা অংশকেও বিভ্রান্ত করেছে, ভুল পথে পরিচালিত করেছে। শুধু তাই নয়, এই ভুল থেকে বামপন্থীদের অনেকেই ঘুরে-ফিরে জাতীয় বুর্জোয়াদের মধ্যে প্রগতিশীল উপাদান খুঁজে পেয়েছেন, লড়াইয়ের মিত্র খুঁজে পেয়েছেন। অথচ গত ৪২ বছরের ইতিহাস প্রমাণ করেছে, এখানকার বুর্জোয়াদের কোনো অংশই সাম্রাজ্যবাদ বা মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কার্যকর ও আপসহীন লড়াই করা দূরে থাক, নানা মাত্রায় এসব শক্তির সাথে আপস-সমঝোতা করে চলেছে। এভাবে যে বুর্জোয়াশ্রেণী আজ দেশের জনগণের প্রধান শত্রু, জনগণের সকল দুর্দশার প্রধান কারণ – তাদেরকে উন্মোচিত করার পরিবর্তে বুর্জোয়াদের কোনো-না-কোনো অংশ সম্পর্কে জনগণকে মোহগ্রস্ত করতে সহযোগিতা করেছেন।
শত্রুর বিরুদ্ধে যথার্থ ও কার্যকর শক্তি গড়ে তোলার পথ কি? একমাত্র ধারাবাহিক ও দীর্ঘমেয়াদী গণআন্দোলন গণসংগ্রামের পথেই জনগণের শক্তি হিসাবে বামপন্থীরা দাঁড়াতে পারে। এবং এর ভিতর দিয়ে জনগণের অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের নিজস্ব আন্দোলনকারী সংস্থা ও প্রতিরোধের শক্তিও তৈরি হয়। জনগণের দাবি নিয়ে, বুর্জোয়া শাসনের ফলে জনজীবনের উপর চেপে বসা সমস্যাগুলো নিয়ে, বুর্জোয়া শাসনের মাধ্যমে হরণ করা গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকারগুলো (সিভিল রাইটস) পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার দাবি নিয়ে লড়তে লড়তেই বামপন্থীদের পক্ষে এবং বিশেষভাবে বিপ্লবী শক্তির পক্ষে শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো ও গণভিত্তি তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু এদেশের বামপন্থী দলগুলো জনগণের নাগরিক অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে কখনোই ধারাবাহিক ও দীর্ঘমেয়াদী গণআন্দোলনের ধারা গড়ে তুলতে পারেনি। এর পরিবর্তে বিভিন্ন সমস্যার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়া জানানো, নিজেদের মধ্যে সংকীর্ণ প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং প্রচার-সর্বস্ব কার্যক্রমের চক্রে বামপন্থী শক্তিগুলো ঘুরপাক খেয়েছে।

স্বাধীনতার চেতনার সাথে বুর্জোয়াশ্রেণী বিশ্বাসঘাতকতা করেছে
একথা সত্য যে বাংলাদেশের মানুষের লড়াই-সংগ্রামের অতীত অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার বিরাট ও বিপুল। কিন্তু সে ভাণ্ডার যত বিশালই হোক না কেন, জনগণের সংগ্রামী মেজাজ ও চেতনা কখনোই অতীতের অর্জিত উচ্চতায় এক সুরে বাঁধা থাকতে পারে না। এদেশের সংগ্রামী মানুষের সবচেয়ে বড় পরাজয় ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে বুর্জোয়াশ্রেণীর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও বুর্জোয়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। মানুষ লড়াই করেছিল একটি শোষণ-বৈষম্যমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে। সেই আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নের জন্যে মানুষ অপরিসীম আত্মত্যাগ করেছে, বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেছে। কিন্তু সেদিন কোনো বিপ্লবী শক্তি স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে পারেনি। উপরন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামে বুর্জোয়াশ্রেণীর নেতৃত্বের নানা ধরনের আপসকামীতা, দোদুল্যমানতা, চক্রান্ত ও সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভরতা জনগণের সংগ্রামী চেতনাকে ভুলুণ্ঠিত করেছে। আর স্বাধীনতার পর পরই মানুষ আবিষ্কার করেছে, তাদের বিপুল আত্মত্যাগ, সমস্ত স্বপ্ন-সাধ ও আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করে এদেশের বুকে একটি শোষণ-বৈষম্যমূলক এবং চূড়ান্ত নিপীড়নমূলক বুর্জোয়াব্যবস্থা কায়েম হয়েছে। এই ব্যর্থতা-বোধও জনগণের সংগ্রামী চেতনাকে হতাশায় নিমজ্জিত করেছে।
স্বাধীন দেশেও সংকট থেকে উত্তরণের আশায় মানুষ যাদের উপর নির্ভর করতে চেয়েছে, সেইসব বাম-গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর ব্যর্থতা, আপসকামীতাও জনগণকে হতাশার অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। সর্বোপরি বুর্জোয়া ব্যবস্থার নানা নিকৃষ্ট উপাদান জনগণের চেতনায় প্রবেশ করতে থাকে। তাৎক্ষণিক ফল লাভের প্রত্যাশা, সাংস্কৃতিক অবক্ষয়, বামপন্থী শক্তিগুলোর বিভ্রান্তি, বুর্জোয়া শাসকদের চাপিয়ে দেয়া অন্যায়ের প্রতিকারের ব্যর্থতা এবং তার থেকে সৃষ্ট হতাশা – এসবই জনগণের রাজনৈতিক চেতনার মান ও সংগ্রামী মেজাজকে ক্রমাগত ক্ষয় করে দেয়, ভোঁতা করে দেয়, দুর্বল করে দেয়। বাংলাদেশেও তাই ঘটছে। এছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয়ের পর বাম আন্দোলনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ অবস্থা থেকে জনগণের রাজনৈতিক চেতনা ও মেজাজকে পুনরায় তুলে আনার পথও একটাই – জনগণের মূল শত্রু শাসক বুর্জোয়াশ্রেণীর বিরুদ্ধে লাগাতার ধারাবাহিক গণআন্দোলনের ধারা গড়ে তোলা, গণসংগ্রামের পথে জনগণকে সংগঠিত করা।

বামপন্থীরাই একমাত্র ভরসা
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বা শাসক বুর্জোয়াশ্রেণী কি দেশের মানুষের প্রকৃত সমস্যাগুলো, জনজীবনের সংকটগুলোর সমাধান করতে পারবে? হলফ করে বলা যায়, পারবে না। বরং সংকট উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকবে। এবং দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে জনগণ প্রতিবাদে ফেটে পড়বেই। কখনো শ্রমিকরা রাস্তায় নামবে, কখনো কৃষকরা নামবে, কখনো ছাত্রেরা নামবে – নিপীড়িত ও বঞ্চিত জনগণের কোনো-না-কোনো অংশ রাস্তায় নামবে, লড়াই করবে, মার খাবে। এবং আমরা এও জানি, জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করবে, মার খাবে বামপন্থীরাই। নিজেদের ভুল-ভ্রান্তি ও সংকীর্ণতা দূর করে বামপন্থীরা যদি ঐক্যবদ্ধভাবে কার্যকর গণআন্দোলন-গণসংগ্রামের পথে এগিয়ে আসেন – তবে তারাই পারবেন বর্তমান অসহায় দশা থেকে জনগণকে রক্ষা করতে।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments