Saturday, November 23, 2024
Homeফিচারবিদ্যুতের বর্ধিত মূল্য কার স্বার্থে?

বিদ্যুতের বর্ধিত মূল্য কার স্বার্থে?

সাম্যবাদ প্রতিবেদন
আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোট তাদের বিগত মেয়াদে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছিল ৬ বারে মোট ৪৭%। ভোটার ও প্রার্থীবিহীন একতরফা প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে গায়ের জোরে ক্ষমতায় বসতে না বসতেই আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে মহাজোট সরকার।
বিদ্যুতের দাম এখন প্রতি বছরই, এমনকি কখনো কখনো একই বছরে দুই বার করে বাড়ানো হচ্ছে। কখনো অর্থনীতির লোকসান কমানোর কথা বলে, কখনো আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কথা বলে বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুতের দাম। গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য গত ২০ বছরের নির্বাচিত সরকারের আমলে বাড়ানো হয়েছে ১৯ বার। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার দাম বাড়িয়েছে ১৩ বার। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সাতবার ও ২০১০-২০১২ মেয়াদে মহাজোট সরকারের আমলে ৬ বার দাম বাড়িয়েছে। ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার সময় বিদ্যুতের দাম ছিল প্রতি ইউনিট ২ টাকা ২৬ পয়সা। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের মেয়াদ শেষে বিদ্যুতের হয়েছিল প্রতি ইউনিট গড়ে ৫ টাকা ৭৫ পয়সা। এছাড়া আওয়ামী মহাজোট তাদের শাসনামলে জ্বালানি তেলের দাম একবছরে চার বার বাড়িয়েছিল।
নতুন ঘোষণায় বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করা হল প্রায় ৭%। ২৫০ ইউনিট ব্যবহার করলে প্রতিমাসে বাড়তি বিল দিতে হবে ৬৮ টাকা, ৫০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের বাড়তি বিল আসবে ১৮৮ টাকা। এবারের মূল্যবৃদ্ধির পর বিদ্যুতের গড় বিক্রয়মূল্য প্রতি ইউনিট ৫ টাকা ৭৫ পয়সার থেকে বেড়ে ৬ টাকা ১৫ পয়সায় দাঁড়াবে। আওয়ামী লীগ বিদ্যুৎ উৎপাদনে তাদের সাফল্যের কথা বেশ জোরেশোরেই প্রচার করে। অথচ এই লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির কথা বলে না।DLA_16.03.14-1

কেন এই মূল্যবৃদ্ধি?
বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণ কি এই যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বিপুল পরিমাণে বেড়ে গিয়েছে? তা কিন্তু নয়। পিডিবির নিজস্ব উৎপাদন ব্যয় এখনও গড়ে ২ টাকা ৬৫ পয়সা। তাহলে এই দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধির কারণ কি? কারণটা বাংলাদেশের সমস্ত মানুষই জানেন – ধনী বিদ্যুৎ-ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষার সরকারি নীতি এবং রেন্টাল-কুইক রেন্টালের সীমাহীন লুটপাট। মূলত তিনটি কারণে বিদ্যুৎ খাতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে:
(১) ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক রেন্টাল প্লান্টগুলো থেকে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে প্রতি ইউনিট গড়ে ৮/৯ টাকা দরে এবং ডিজেল ভিত্তিক কেন্দ্র থেকে কেনা হচ্ছে গড়ে ১৫/১৬ টাকা ইউনিট দরে। এসকল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সর্বোচ্চ ৩৮ টাকা পর্যন্ত দরে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে। উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কেনার ফলে সৃষ্ট লোকসান কমাতে সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে।
(২) বিদেশ থেকে উচ্চ দামে তেল আমদানি করে রেন্টাল প্লান্টগুলোতে ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহ করতে গিয়ে বিপুল লোকসান হচ্ছে। বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম না বাড়লেও তরল জ্বালানি-ভিত্তিক রেন্টাল প্লান্টগুলোর কারণে গত কয়েক বছরে তেল আমদানি দ্বিগুণ করতে হয়েছে।
(৩) প্রতি মাসে ক্যাপাসিটি বিল্ডিং চার্জের নামে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে প্রতি মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার উপর ৯ হাজার থেকে ৩০ হাজার ডলার ভাড়া দিতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ২০১১-’১২ অর্থবছরে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালগুলোকে শুধু ভাড়া বাবদ দিতে হয়েছে ৩ হাজার ১২১ কোটি ৩১ লাখ ৮ হাজার টাকা। এখন এই পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকার ওপরে। বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও এই ভাড়া দিতে হবে। এই অর্থ দিতে হচ্ছে ডলারে, ফলে চাপ পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর।
অর্থাৎ তেলভিত্তিক রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্যে ২০০৯-’১০ অর্থবছরে বিদ্যুৎখাতে সরকারের ভর্তুকি ছিল ৯৯৩ কোটি টাকা, যা ২০১০-’১১ অর্থবছরে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার কোটি টাকা, ২০১১-’১২ অর্থবছরে ৬ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা এবং ২০১২-’১৩ অর্থবছরে ৫ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা। বলাই বাহুল্য, এবার এই ভর্তুকি আরো বাড়বে।
রেন্টাল-কুইক রেন্টালকে বলা হয় যুদ্ধকালীন সমাধান। স্বাভাবিক সময়ে এই পদ্ধতি কোনো জনস্বার্থরক্ষাকারী সরকারই অনুসরণ করে না। বিদ্যুৎ উৎপাদক বড় ব্যবসায়ীদের লুটপাটের সুবিধা করে দেয়ার জন্যই সরকার এই পদ্ধতি অনুসরণ করছে। বিদ্যুৎখাতে ভর্তুকি দেয়ার নাম করে জনগণের টাকা নিয়ে তুলে দিচ্ছে বিদ্যুৎ-ব্যবসায়ীদের পকেটে।
এক্ষেত্রে আরো একটি বিষয় কাজ করছে। সেটি হল, বিদ্যুৎখাতসহ বিভিন্ন সেবামূলক খাতকে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার জন্য আইএমএফ ও ঋণদানকারী সাম্রাজ্যবাদী সংস্থাগুলোর চাপ। একসময় যেসব নাগরিক সুবিধা সরকারি উদ্যোগে ও দায়িত্বে দেয়া হত, সেগুলো ক্রমাগত সরকারি হাত থেকে বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানায় তুলে দেয়ার নীতি বাস্তবায়নের পরামর্শ ও চাপ এরা দিচ্ছে। এবং আমাদের শাসকগোষ্ঠীও এই নীতি বাস্তবায়ন করে দেশি-বিদেশি পুঁজিপতিদের জন্য বিদ্যুৎ-জ্বালানি-পরিবহন-চিকিৎসা ইত্যাদি সেবামূলক খাত উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে জনগণের ওপর বাড়তি মূল্যের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।

বিদ্যুৎ-গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কারা?
বিদ্যুৎ-গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সুফল যে রেন্টাল-কুইকরেন্টাল বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের পকেটে যায়, এ নিয়ে আজ কোনো সন্দেহ আছে কি? না, নেই। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী বি ডি রহমতউল্লাহ হিসাব করে দেখিয়েছেন, ভাড়াভিত্তিক রেন্টাল-কুইকরেন্টালের কারণে এ পর্যন্ত আমাদের ক্ষতি হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। এ প্রক্রিয়ায় ২০২০ সালে গিয়ে আমাদের লোকসানের পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ কোটি টাকা! (আমাদের বুধবার, ১৯ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ’১৪) তার মানে এই ক্ষতি বা লোকসানের টাকাটা দিচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষ এই বিপুল অর্থের যোগান দিচ্ছে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ – দু’ভাবেই।
এবারও যখন বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব পিডিবির পক্ষ থেকে রাখা হয়, তখন তার খাঁড়াটা কিন্তু সাধারণ বিদ্যুৎ গ্রাহকদের উপরই চালানো হয়। গত ৫ মার্চ ’১৪ দৈনিক প্রথম আলোর ‘বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব : গরিবের দেড় টাকা, ধনীর দুই পয়সা!’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সবচেয়ে গরিব আবাসিক গ্রাহকদের প্রতি ইউনিট (এক কিলোওয়াট ঘণ্টা) বিদ্যুতের দাম এক টাকা ৩৭ পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। আর সবচেয়ে ধনী আবাসিক গ্রাহকের প্রতি ইউনিটের দাম বাড়াতে বলেছে মাত্র দুই পয়সা।”
আর বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত ঘোষিত হওয়ার পর ১৫ মার্চ দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত ‘শেষ পর্যন্ত গরিবের ওপরই বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির শক’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “দুটি বাতি, একটি ফ্যান নিয়মিত ব্যবহার করলেই মাসে ৭৫ ইউনিটের মতো বিদ্যুৎ ব্যয় বলে ধরা হয়ে থাকে। এ ধাপের গ্রাহকের বিদ্যুতের দাম এত দিন কম রাখা হয়েছিল। গত বৃহস্পতিবার ঘোষিত বিদ্যুতের নতুন দরবিন্যাসের পর সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে এই শ্রেণীর ব্যবহারকারীরা। এবার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকারীদের লাইফলাইন নামে একটি ভিন্ন বিন্যাসের আওতায় আনলেও এ স্তরের ব্যবহারকারীর সংখ্যা বড় নগণ্য। ফলে দরিদ্রদের বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়নি – বিদ্যুৎখাতের মূল্যনিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির এমন ভাষ্যকে অনেকে ‘আইওয়াশ’ তথা ‘চোখে ধুলা দেওয়া’ হিসেবেই দেখছেন।” এতে আরো বলা হয়, “… বাংলাদেশে সব থেকে কম বিদ্যুৎ যাঁরা ব্যবহার করেন তাঁদেরও প্রতিমাসে কমপক্ষে ৬৫ থেকে ৭৫ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়। এর আগে যখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে তখন বিইআরসি দরিদ্রদের রক্ষার জন্য ৭৫ ইউনিট বিদ্যুতের দাম কম রেখেছিল। এবার বিইআরসি লাইফলাইন নামিয়ে এনেছে মাত্র ৫০ ইউনিটে। আর এবার লাইফলাইন শুধু পল্লী বিদ্যুৎ বোর্ডের (আরইবি) হাতেগোনা কিছু গ্রাহক এ সুযোগ ভোগ করবেন।”
“দেশে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ আবাসিক গ্রাহক বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। এর মধ্যে শুধু পল্লীবিদ্যুৎ বোর্ডের (আরইবি) ৭২টি সমিতির আওতায় ৮৩ লাখ আবাসিক গ্রাহক রয়েছে। বাকি চারটি বিতরণ প্রতিষ্ঠান পিডিবি, ওজোপাডিকো, ডিপিডিসি ও ডেসকোর রয়েছে ৩৭ লাখ আবাসিক গ্রাহক। আরইবিতে ৭৫ ইউনিট ব্যবহার করেন এমন গ্রাহকের সংখ্যা রয়েছে ৫৫ লাখ এবং এই দরিদ্র গ্রাহকের সবার ঘাড়েই চাপছে বাড়তি দরের বোঝা। আর ৫০ ইউনিটের দর ছাড়ের আওতায় আসা ভোক্তার সংখ্যা হবে বড়ই নগণ্য – মাত্র ৯ লাখ।”
এখানে আরো একটি অভিনব প্রতারণার শিকার হচ্ছে দেশের মানুষ। বলা হচ্ছে যে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নিয়ে বিইআরসি গণশুনানির আয়োজন করেছে, এবং ওই গণশুনানির মাধ্যমেই সিদ্ধান্ত সংশোধন ও কার্যকর করা হবে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, গণশুনানির ভিত্তিতে বিইআরসি ১৫ মার্চের মধ্যে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেও সে সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে ১ মার্চ থেকেই। অর্থাৎ গণশুনানিও একটা লোকদেখানো প্রক্রিয়া, আইওয়াশ মাত্র।

সুলভে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কি উপায় নেই?
অবশ্যই সুলভে, অল্প খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথ আছে। আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎপ্লাটগুলো থেকেই আমরা সুলভে বিদ্যুৎ পেতে পারি। কিন্তু সরকার সে পথে চলছে না। পিডিবির তথ্য অনুযায়ী গত তিন বছরে মেরামত না করার কারণে ১৪টি বিদ্যুৎপ্লান্টের ২৫টি গ্যাস চালিত ইউনিট বন্ধ হয়েছে। এছাড়া বড়পুকুরিয়াসহ অনেকগুলো প্লান্ট নানা কারিগরি ত্রুটির কারণে উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। গ্যাস দিতে না পারায় অনেক প্ল্যান্ট বন্ধ। বিদ্যুৎ উৎপাদনে পুরনো যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কারণে ১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জ্বালিয়ে গড়ে ৫ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে, যন্ত্রপাতির সংস্কার করে ৮ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। পুরনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি পরিবর্তন করে একই পরিমাণ গ্যাসে অন্তত ১ হাজার মেগাওয়াট বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। (প্রথম আলো, ১৬.১.১২) তিতাসের জরিপ অনুযায়ী, অধিকাংশ শিল্পকারখানার বয়লার পুরনো ও জ্বালানি ব্যবহারে অদক্ষ হবার কারণে ১৫ কোটি ঘনফুট গ্যাসের অপচয় হচ্ছে। তিতাসের আওতাধীন আবাসিক গ্রাহকদের ব্যবহৃত চুলা জ্বালানি ব্যবহারে দক্ষ হলে প্রতিদিন আরও ৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সাশ্রয় করা সম্ভব। বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের বর্তমান চাহিদার তুলনায় ঘাটতি মাত্র ২০ কোটি ঘনফুট। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জ্বালানি ব্যবহারে গড় দক্ষতা ৬০ শতাংশের মতো। এগুলোতে কম্বাইন্ড সাইকেল প্রযুক্তি ব্যবহার করলে একই পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করে শতকরা ৫০ থেকে ৬০ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এসব দিকে মনোযোগ দেয়া বা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার কোনো উদ্যোগ লক্ষিত হচ্ছে না। গ্যাস সংকটের কারণে বন্ধ ঘোড়াশাল সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১৪০ মেগাওয়াটের একটি ইউনিট। সিদ্ধিরগঞ্জ এসটি ২১০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটি গত বছরের জানুয়ারি থেকে বন্ধ। রাউজান ৩৮০, শিকলবাহা ২৫০, খুলনা এসটি ১১০ ও এসটি ৬০ এবং বাঘাবাড়ি জিটি ৭১ মেগাওয়াটের সরকারি কেন্দ্রগুলো দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। বন্ধ ভোলার ৭৮ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটিও।
একদিকে সরকার গ্যাস সংকটের কথা বলে তেলভিত্তিক রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমতি দিয়েছে, অন্যদিকে দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো অসম শর্তে বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর হাতে তুলে দিয়েছে।

বিদ্যুৎ খাতে লুটপাট ও মূল্যবৃদ্ধি রুখে দাঁড়ান
বিদ্যুৎ একটি অত্যাবশ্যকীয় জ্বালানি পণ্য যা শিল্প-কারখানা, কৃষি কাজ, ঘরবাড়ি সর্বত্রই প্রয়োজন। বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের প্রধান অংশই সাধারণ মানুষ – শহরের নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত, গ্রামের ছোট ও মাঝারি কৃষক, ছোট ছোট উৎপাদক, দোকানদার। এরা খুব অল্প পরিমাণে বিদ্যুৎ ব্যবহার করলেও মূল্যবৃদ্ধির ফলে এরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। অথচ বড় বড় শিল্প-কারখানা ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিক যারা বিপুল পরিমাণে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে, তাদের জন্যে সরকার নানা রকম ভর্তুকি, কর ছাড়, আমদানি-রফতানি সহায়তা ইত্যাদি দিয়ে থাকেন। তারওপর এই বড় শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা দিনের পর দিন সরকারের ট্যাক্স ফাঁকি দেয়, বিদ্যুৎ-গ্যাসের বিল বকেয়া রাখে। এরাই রেন্টাল-কুইক রেন্টালের মালিক হয়ে লক্ষ কোটি টাকা লুট করছে। আমাদের সরকারগুলো – আওয়ামী লীগ হোক, বিএনপি-জামাত হোক – সবাই এদেরই স্বার্থ রক্ষা করে চলছে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলাফল সরাসরি যতটা দেখা যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি ঘটে চক্রাকারে। এর ফলে কৃষি উৎপাদনের খরচ বাড়ে, শিল্পোৎপাদনের খরচও বাড়ে। আর ওই বাড়তি খরচের বোঝাও বহন করতে হয় সাধারণ মানুষকেই।
বিদ্যুৎখাতে সীমাহীন লুটপাট ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির এই দুষ্টচক্রের অবসান ঘটাতে হলে প্রয়োজন সর্বস্তরের সাধারণ বিদ্যুৎ গ্রাহক এবং জনগণের পক্ষের বাম-গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর সম্মিলিত গণআন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্র এবং সরকারের নীতির পরিবর্তন ঘটানো।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments