২২ সেপ্টেম্বর শিক্ষা কনভেনশন সফল করুন
[dropcap]স[/dropcap]মাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে আগামী ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় এক শিক্ষা কনভেনশন আহ্বান করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তনে ওই দিন সকাল ১০টায় কনভেনশনের কার্যক্রম শুরু হবে।
কনভেনশন আহ্বানের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা প্রকাশিত এক প্রচারপত্রে শিক্ষার অধিকার সর্বজনীন আখ্যায়িত করে বলা হয়, শিক্ষার মধ্য দিয়েই মানুষ মানবিক গুণাবলি অর্জন ও তাকে বিকশিত করে। কিন্তু শাসকরা সবসময়ই সর্বজনীন শিক্ষার অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত রাখতে চায়। এদেশের শাসকশ্রেণীরও শিক্ষা সম্পর্কিত নীতি সেটাই। তাই তারা ক্রমাগত শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করে শিক্ষার মর্মবস্তুকে ধ্বংস করছে। সরকারি বরাদ্দ কমিয়ে বেসরকারি বিনোয়োগের রাস্তা উন্মুক্ত করছে। ফলে দেশের দরিদ্র-নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত ঘরের অনেক সন্তান উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারছে না। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ-বেসরকারিকরণ-সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট শিক্ষা কনভেনশনের আয়োজন করছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ লক্ষ শিক্ষার্থীর নিরন্তর দুর্ভোগ উল্লেখ করে প্রচারপত্রে বলা হয়, ১৯৯২ সালে সেশনজট নিরসনের কথা বলে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠেছিল। কিন্তু ২২ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, এর বয়স যত বেড়েছে, ভোগান্তি বাড়িয়েছে তার চেয়েও বেশি। নামে বিশ্ববিদ্যালয় হলেও বাস্তবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত ক্লাসরুম এবং শিক্ষকের সংকট আজও বহাল আছে। চার বছরের অনার্স কোর্স শেষ করতে সময় লাগে ছয় থেকে সাত বছর। শিক্ষাজীবন শেষ হতে না হতেই চাকুরির বয়সসীমা পার হয়ে যায় অনেকের। শিক্ষাজীবনে সময়ের এই অপচয় কি শুধুই একজন শিক্ষার্থীর? পড়ালেখা শেষে একজন শিক্ষার্থী রাষ্ট্রের উন্নয়নে যে অবদান রাখতে পারতো, তা না হওয়ায় রাষ্ট্রই তো বঞ্চিত হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-মন্ত্রীরা কথায় কথায় উন্নয়নের জোয়ার বয়ে দেন, অথচ এটা দেখার যেন কেউ নেই।
অন্যদিকে নাইটকোর্স, ফি বাণিজ্যে আক্রান্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র বর্ণনা করে ছাত্র ফ্রন্টের প্রচারপত্রে বলা হয়, সর্বক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ইউজিসি’র ২০ বছর মেয়দী কৌশলপত্র। ইউজিসি’র কৌশলপত্রের সুপারিশ অনুসারে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ হ্রাস ও অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন খাতে বর্ধিত ফি আরোপ, নাইটকোর্স চালুসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো ভাড়া দেয়ার কথা বলা হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গত ১০ বছরে নানাখাতে ফি বেড়েছে ১০ গুণেরও বেশি। বাণিজ্যিক নাইটকোর্স চালু ও ফি বৃদ্ধি করে পাবলিক প্রতিষ্ঠানকে ক্রমাগত প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা হচ্ছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গুলো কার্যত সার্টিফিকেট বিক্রির প্রতিষ্ঠান। ঘোষিত অবকাঠামো ও অন্যান্য আয়োজন নিশ্চিত করার কোন উদ্যোগ নেই। শুধু শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করা নয় শিক্ষার বিষয়বস্তুকেও ক্রমাগত বাজারমুখী করে তোলা হচ্ছে। ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্যের মতো বিষয়গুলোর তথাকথিত বাজার মূল্য না থাকায় নতুন প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তা উপেক্ষিত হচ্ছে। শিক্ষার মানোন্নয়নে গবেষণাখাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই। অথচ বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে তথাকথিত ‘উচ্চশিক্ষার মানন্নোয়ন প্রকল্প’ চালু করে গবেষণাখাতে বিদেশী পুঁজি বিনোয়োগের দ্বার উন্মোচন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর নিরঙ্কুশ একাডেমিক ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্য গঠন করা হচ্ছে ‘উচ্চশিক্ষা কমিশন’। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন বলে আর কিছু থাকবে না।
স্কুল শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের চিত্র তুলে ধরে প্রচারপত্রে বলা হয়, ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৩৮ হাজার, সে সময় বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৯ হাজার। ব্যানবেইসের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী সরকারি প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা প্রায় একই থাকলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাড়িয়েছে প্রায় ৫০ হাজারে। মাধ্যমিকেও ১৮,৭৯৫ টি স্কুলের মধ্যে মাত্র ৩১৭ টি সরকারি! বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে গড়ে উঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ফি ৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর বার্ষিক পরীক্ষায় পাস করার পরও পুন:ভর্তির নামে টাকা নেওয়ার সংস্কৃতি অধিকাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়মে পরিণত হয়েছে। কোচিং বন্ধের নাম করে স্কুলেই কোচিং-এর নামে বাধ্যতামূলক ফি আদায় করা হচ্ছে। এর সাথে এসএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলাপের সময় অতিরিক্ত ফি আদায় করা হয়। এসব কারণে গরীব নি¤œবিত্ত পরিবারের সন্তানদের শিক্ষাজীবন হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নৈতিক মূল্যবোধ ধ্বংস করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে প্রশ্নপত্র ফাসঁ মহামারী আকার ধারণ করেছে। শিক্ষামন্ত্রী বরাবরই ‘ষড়যন্ত্র’ বলে দায় এড়িয়েছেন, গত ৫ বছরে প্রশ্ন ফাঁস হয়নি বলে নির্লজ্জ উক্তি করেছেন। ফলে দোষী ব্যক্তিরা শাস্তির আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো এমন অনৈতিক ঘটনা শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের ফলেই ঘটছে। শিক্ষা যখন মুনাফার হাতিয়ারে পরিণত হয়, তখন ছাত্র-শিক্ষক-প্রশ্নপত্র প্রণয়নের সাথে যুক্ত কর্মকতা-কর্মচারি কারো মাঝে নীতি নৈতিকতা মূল্যবোধ এসব কাজ করে না। আবার ফাঁসকৃত এসব প্রশ্ন যে সমস্ত শিক্ষার্থীদের হাতে পড়ছে, তাদেরও নৈতিক অধঃপতন ঘটছে। কোমলমতি এই শিক্ষার্থীদের নৈতিক অধঃপতনের দায় কে নেবে?
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের পক্ষ থেকে শিক্ষকের উপযুক্ত বেতন-ভাতা ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করার গুরুত্ব তুলে ধরে বলা হয়, তা ছাড়া মানসম্মত শিক্ষা সম্ভব নয়। শাসকশ্রেণীর শিক্ষা সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে শিক্ষক সমাজও সবসময়ই ন্যায্য বেতন-ভাতা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ফলে একদিকে কম বেতন, অন্যদিকে সামাজিক অনিশ্চয়তা আর সম্মানজনক জীবনের প্রত্যাশা শিক্ষকদের যেভাবেই হোক অর্থ উপার্জনে মরিয়া করে তুলেছে। তাই স্কুল পর্যায়ে কোচিং, প্রাইভেটের সাথে তারা যুক্ত হয়ে পড়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্যিক কোর্স খুলে বাড়তি আয়ের চেষ্টা করছেন। তাই শুধু আইন করে স্কুল-কলেজ পর্যায়ে কোচিং-প্রাইভেট-টিউশন বন্ধ করা যাবে না। শিক্ষক সমাজের উপযুক্ত বেতন কাঠামো, সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে।
শিক্ষা কনভেনশন সফল করার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে আমরা যদি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারি, তাহলে গরীব-মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীরা কেবল বঞ্চিত হবে না, মনুষ্যত্ব বিনাশের প্রক্রিয়াটি বাধাহীনভাবে চলতে থাকবে। ফলে একদিকে সর্বজনীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, সেক্যুলার, একইপদ্ধতির গণতান্ত্রিক শিক্ষার দাবিতে যেমন লড়তে হবে; পাশাপাশি শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ-বেসরকারিকরণ-সাম্প্রদায়িকীকরণ ও শিক্ষা সংকোচনের এই সময়ের বিশেষ পদক্ষেপগুলোর বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।