Saturday, November 23, 2024
Homeসংবাদ ও প্রেস বিজ্ঞপ্তিপার্টি ও সংগঠন সংবাদগ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনকে আরও বিপন্ন করে তুলবে

গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনকে আরও বিপন্ন করে তুলবে

গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির গণবিরোধী পরিকল্পনা রুখে দাঁড়ান – বাসদ (মার্কসবাদী)

Bangla_Logo1বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী) ঢাকা নগর শাখা গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সরকারি পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দ্রব্যমূল্যের উদ্ধগতিতে পর্যুদস্থ নগরবাসীকে সংগঠিত করে এই আন্দোলন গড়ে তোলার এক ধারাবাহিক  পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে ১৫ ডিসেম্বর ২০১৪  অনুষ্ঠিত নগর শাখার বৈঠকে। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জনমত গড়ে তুলতে প্র্রকাশ করা হয়েছে এক প্রচারপত্র।

এই প্রচারপত্রে গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির গণবিরোধী পরিকল্পনা রুখে দাঁড়াবার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে, অনেক গ্লানি আর কষ্টে বছর পার করেও মানুষের সামনে আজ কোনো আশাবাদ নেই। অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধি, শিক্ষা-চিকিৎসার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ভার, নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদির ভারে জর্জরিত সাধারণ মানুষের কাঁধে আরও বোঝা চাপানোর ঘোষণা দিয়েছে সরকার। জানুয়ারি থেকে পুনরায় বাড়বে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম! গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে আবাসিক খাতে গ্যাসের নতুন মূল্য হবে বর্তমান মূল্যের দ্বিগুণেরও বেশি। দ্রব্যমূল্যের লাগামছাড়া ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ যখন দৈনন্দিন সংসার খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন, তখন গ্যাসের এই অকল্পনীয় মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মত জনজীবনকে আরও বিপন্ন করে তুলবে।

 মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে সরকারের যুক্তি হলো:

  • সারাদেশে কয়েকটি জেলার অল্পসংখ্যক শহরবাসী মানুষ গ্যাস ব্যবহার করে। শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষের জ্বালানি বাবদ খরচ বেশি অনেক। কয়েকগুণ বেশি দামে সিলিন্ডার গ্যাস কিনে তারা ব্যবহার করে। তাই রান্নার গ্যাসের দাম বাড়িয়ে গ্রামে ভর্তুকি বাড়ানো হবে।
  • শহরের লোকেরা গ্যাস অপচয় করে। চুলা জ্বালিয়ে কাপড় শুকায়, ঘর গরম রাখে।
  • পৃথিবীর অন্যান্য দেশে গ্যাসের দাম বেশি।

বিষয়গুলো একটিু তলিয়ে দেখা যাক।

14253প্রথমত, গ্রামের মানুষের জ্বালানি খরচ কমাবার কথা বিবেচনায় থাকলে গ্যাসের সুষ্ঠু ব্যবহার ও সরবরাহ নিশ্চিত করে গ্রামাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ করা হতো। গ্রামাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ না করার কারণে গ্রামের মানুষকে চড়া দামে সিলিন্ডার গ্যাস কিনতে বাধ্য হচ্ছে। আর এই কারণ দেখিয়ে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করা কি সঙ্গত? প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-হাসপাতালে খরচ অনেক বেশি, এটাকে দেখিয়ে কেউ সরকারি প্রতিষ্ঠানে খরচ বাড়ানোর অজুহাত তুললে নিশ্চয়ই জনগণ তা মেনে নেবে না। শহরে শুধু ধনীরাই থাকে না, নিম্ন মধ্যবিত্ত-গরীব মানুষরাই শহরাঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ। গ্রামের মানুষের প্রতি দরদের ভাবটিও প্রতারণামূলক। প্রত্যেক মওসুমে কৃষক ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়, সরকারের সেখানে কোন ভূমিকা থাকে না। গার্মেন্টস শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরির দাবিতে আন্দোলনে নামলে সরকার পুলিশের লাঠি-গুলিতেই দরদ প্রকাশ করে! ষড়যন্ত্রের গন্ধ খোঁজে। আবার পৃথিবীর কোথায় কোথায় দাম বেশি সে উদাহরণও দেয়া হচ্ছে। ওইসব দেশে জীবনযাত্রার মান-ব্যয়-জনঅধিকারের দিকসমূহের আলোচনা বাদ দিয়ে এভাবে সরকারি সিদ্ধান্তকে যুক্তিসিদ্ধ করা হচ্ছে। ভুলিয়ে দিতে চাচ্ছে গ্যাস আমাদের নিজেদের সম্পদ। উৎপাদক দেশ বলে এখানে দাম কম থাকাই যুক্তিযুক্ত। যেরকম মধ্যপ্রাচ্য ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে কম। অদ্ভুত বিষয় হল, জনগণের অধিকার পূরণের জন্য উন্নত দেশের উন্নত সেবার উদাহরণ দেয়া হয় না।

দাম বাড়ানোর জন্যই গ্যাস অপচয় রোধের অজুহাত দেয়া হচ্ছে, অথচ সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি-অপচয় চলছে

price hike Gasবাসাবাড়িতে গ্যাসের যে অপচয় হয়, তার হিসাব কি? কতটুকু ব্যবহার আর কতটুকু অপচয় তা নির্ধারণের উপায় না খুঁজে অপচয়ের দায় সবার ঘাড়ে তুলে দেয়া কেন? সরকারি হিসাব মতে, গ্যাসের আবাসিক গ্রাহক ২৭ লক্ষ। লাইন প্রতি ৫ জন করে ধরলে ১ কোটি ৩৫ লক্ষ মানুষ গ্যাস ব্যবহার করে। প্রতিদিন উৎপাদিত ২২৫ কোটি ঘনফুট গ্যাসের মধ্যে ২৫ কোটি ঘনফুট বা মাত্র ১১% বাসা-বাড়িতে ব্যবহার হয়। অথচ শিল্পকারখানা, সার কারখানা ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, বিশেষ করে ব্যক্তিমালিকানাধীন ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোতে ৪০ কোটি ঘনফুট গ্যাস অপচয় হয়। এ অপচয় রোধ করা গেলে আরো ১ কোটি মানুষের ঘরে গ্যাস পৌছানো যেত। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাব মতে, প্রতি বছর ২৩ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়। অপ্রদর্শিত আয় প্রায় ৮ লক্ষ কোটি টাকা, যা দিয়ে ৩০ বছরের বাজেট হয়। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৭ হাজার কোটি টাকা। শেয়ার বাজার, হলমার্ক, ডেসটিনি, বেসিক ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি তো অর্থমন্ত্রীর ভাষায় ‘সামান্য টাকা’। অথচ গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি কার্যকর হলে সরকারের তহবিলে আসবে ১৩৫ কোটি টাকা। দুর্নীতির সমুদ্র চোখের আড়ালে রেখে অপচয়ের কুয়ো খোঁজা হচ্ছে।

 

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অর্ধেক কমেছে, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর যুক্তি কি?

SPB_15.10.14-2 copyআন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে সরকার তাকে অজুহাত করে দাম বাড়ায়। অথচ বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৫৮ ডলার, একবছর আগে যা ছিল ১২২ ডলার। অর্ধেক দাম কমার পরও দেশ তেল বা বিদ্যুতের দাম কমেনি। আর তেলভিত্তিক ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে অতিরিক্ত উৎপাদন বাবদ ভর্তুকির জন্য তো জনগণ দায়ী নয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা আপৎকালীন পরিস্থিতিতেই কেবল এরকম উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়, স্থায়ীভাবে করা হয় না। এ কেন্দ্রগুলো ২০১৩ সালের মধ্যে বন্ধ করে দেয়ার কথা থাকলেও এখন বলা হচ্ছে ২০২০ পর্যন্ত চলবে। দুদিক থেকেই জনগণের পকেট কাটা হচ্ছে – প্রথমত: আমদানিকৃত তেল কম মূল্যে বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের সরবরাহ করে, দ্বিতীয়ত: তদের কাছ থেকে বেশি মূল্যে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে। ফলে বাড়ছে সরকারি ভর্তুকি, অন্যদিকে তা কমানোর জন্য জনগণের ঘাড়ে বর্ধিত মূল্য চাপানো হচ্ছে। এভাবে একদল লুটপাট করবে, আর তার ভোগান্তি সহ্য করবে জনগণ – এটা আমাদের নিয়তি ছিল না।

জনগণের জন্য সুলভে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেত

দীর্ঘদিন ধরে দেশপ্রেমিক বিশেষজ্ঞগণ গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বড় আয়তনের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের দাবি জানালেও সরকার তা কানে তোলেনি। একদিকে উপায়হীনতার কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নির্ধারিত উৎপাদনের অক্ষমতা দূর করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। পিডিবি-র তথ্যমতে গত ৩ বছরে মেরামত না করার কারণে ১৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ২৫টি গ্যাসচালিত ইউনিট বন্ধ রয়েছে। বড়পুকুরিয়াসহ অনেকগুলো প্ল্যান্টে কারিগরি ত্রুটির কারণে উৎপাদনক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। গ্যাস সরবরাহ না হওয়ায় অনেকগুলো প্ল্যান্ট বন্ধ। বিশেষজ্ঞদের মতে, পুরনো বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর যন্ত্রপাতির পরিবর্তন করে বর্তমানে সরবরাহকৃত গ্যাস দিয়েই অন্ততঃ ১ হাজার মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। এছাড়াও সিস্টেম লস কমিয়ে এবং জ্বালানি সাশ্রয়ী কম্বাই- সাইকেল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলেও বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো যাবে।

আন্দোলনের পথেই মূল্যবৃদ্ধি রুখতে হবে

গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে আজ বিএনপি সরব, অথচ তারাও ক্ষমতায় থাকাকালে দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধি করেছেন। যে দুষ্কর্মের জন্য এরা এক অন্যকে দোষারোপ করে, ক্ষমতায় গেলে একই দুষ্কর্মে নিয়োজিত হন। কিন্তু আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারা মুখের কথায় ভুলি। কথার পার্থক্যে বিচার করি, নীতির সাদৃশ্য দেখি না। ফলে বারবার ক্ষমতার বদলেও জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। লুটপাটের পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতির মোদ্দা কথাই হল সর্বোচ্চ মুনাফা। সর্বোচ্চ মুনাফা মানে হল সর্বাধিক শোষণ-লুটপাট। বর্তমান সময়ে পাবলিক সেবাখাতসমূহ যার অন্যতম ক্ষেত্র। তাই মূল্যবৃদ্ধির দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পেতে আশু আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ যেমন নিতে হবে, তেমনি দীর্ঘমেয়াদে শোষণ-বৈষম্যের সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে যথার্থ নীতি-আদর্শভিত্তিক রাজনীতি নির্মাণ আজ সময়ের দাবি হয়ে এসেছে।

প্রচারপত্রে বাসদ (মার্কসবাদী) গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির গণবিরোধী পরিকল্পনা রুখে দিতে এ আন্দোলনে সকলের অংশগ্রহণ, সহযোগিতা ও সক্রিয়তা প্রত্যাশা করা হয়েছে।

SPBM-27.11.14

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments