রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের জন্য কতটা ক্ষতিকর
সেই যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, কাদম্বরী মরিয়া প্রমাণ করিল যে সে মরে নাই, অবস্থা অনেকটা সেই রকম। বহুদিন থেকেই সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগে সুন্দরবন ও তার জৈববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। বিশেষত সুন্দরবনের পাশেই কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণের পর থেকে বিশেষজ্ঞগণ বারবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আসছেন। সরকার সেই সব কথায় কর্ণপাত করেনি। উল্টো জোর গলায় বলেছে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে এমন উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে যাতে পরিবেশের কোন ক্ষতি হবে না। শ্যালা নদীতে সাউদার্ন সেভেন নামের একটি তেলবাহী জাহাজ ডুবে গিয়ে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল সুন্দরবনের কী ক্ষতি হতে পারে।
গত ৯ ডিসেম্বর শ্যালা নদীতে জাহাজ দুর্ঘটনায় ট্যাংকার থেকে তেল ছড়িয়ে পড়ে ৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, তেল ছড়িয়ে পড়ার পর সুন্দরবনের প্রাণী ও উদ্ভিদের সংখ্যা অস্বাভাবিক পরিমাণে কমেছে। তেল ছড়িয়ে পড়ায় সুন্দরবনের জলজ প্রাণীর উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে। অনেকক্ষেত্রে বনের প্রাণীদের জিনগত বা জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের উপরও প্রভাব পড়ে। ১৯৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় যে তেল ছড়িয়ে পড়েছিল,তার প্রতিক্রিয়ায় পরবর্তী ১০-১২ বছর পর দেখা গেছে অনেক প্রাণী এলাকা থেকে হারিয়ে গেছে।
বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়, জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ দলসহ সবাই এই ঝুঁকির কথা বলেছে। কিন্তু বরাবরের মতোই সরকারের মন্ত্রীরা একই বুলি আওড়াচ্ছেন – তেমন কোনও ক্ষতি হবে না। সাময়িকভাবে নৌ-চলাচল বন্ধ রাখলেও আবার তা চালু করেছে। এই সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌ-চলাচল প্রাণীদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘিœত করে, আচরণের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
রামপালের মতো প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য যে পরিমাণ কয়লা আমদানী হবে তা সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে চলাচল করবে। এতে যেমন ওই এলাকার পরিবেশের ক্ষতি হবে তেমনি কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এর চেয়েও মারাত্মক আকার ধারণ করবে।
তাই বিশ্বব্যাপী বনের নিকটস্থ জায়গায় অর্থাৎ পঁচিশ কিলোমিটারের মধ্যে এই রকম স্থাপনা নিষিদ্ধ। ভারতীয় জনগণের প্রতিবাদের মুখে এটি করতে পারেনি অথচ এই দেশের শাসকশ্রেণী, পুঁজিপতি-ব্যবসায়ীদের মুনাফার বাসনা এমন উগ্র যে দেশটা অন্তত ভৌগলিক ভাবে টিকে থাকবে কি থাকবে না সে চিন্তাও তাদের নেই।
হোক প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপন্ন, মানুষের জীবন বিপন্ন হোক – তাতে কি? লাভের লোভ পুঁজিপতি শাসকশ্রেণীকে এতটা টেনে নামিয়েছে। প্রায় দেড়শ বছর আগে মহামতি কার্ল মার্কস এ জন্যই বলেছিলেন, “… ১০০ ভাগ লাভ হবে জানলে সে ন্যূনতম মানবতাটুকুর গলায় পা দিয়ে দাঁড়াবে। ৩০০ ভাগ লাভ হবে এই নিশ্চয়তা পেলে হেন অপকর্ম নেই যা সে করতে পারবে না, এমন ঝুঁকি নেই যা সে নেবে না, এমনকি পুঁজির মালিকের ফাঁসি হতে জেনেও পুঁজি ছুটবে লাভের অদম্য লালসায়।”