দুই দলের ক্ষমতাকেন্দ্রিক অপরাজনীতি প্রত্যাখ্যান করুন
বাম গণতান্ত্রিক শক্তির নেতৃত্বে গণআন্দোলন গড়ে তুলুন
লক্ষ লক্ষ মানুষের শহীদী আত্মদানের বিনিময়ে এ কোন্ বাংলাদেশ? প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় ভয়ংকর খবর-ছবি দেখে এ প্রশ্নটিই বারবার মনে আসবে। প্রধান দু’দলের যুদ্ধংদেহী বক্তব্য, সরকারি দমন-পীড়ন, হরতাল-অবরোধে পেট্রোল বোমায় পুড়ে যাওয়া মানুষের স্বজনদের বেদনার্ত আহাজারি, গ্রেফতার-নির্যাতন, বন্দুকযুদ্ধ-ক্রসফায়ারের নামে বিনা বিচারে হত্যা, ‘দেখামাত্র গুলি’র হুংকার জনজীবনে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
গায়ের জোরে ক্ষমতায় টিকে থাকা কিংবা গণবিচ্ছিন্ন হয়ে গায়ের জোরে ক্ষমতায় যাওয়ার বাসনা – বর্তমান সংকটের জন্য দায়ী
গত ৪৪ বছরে এমন এক অবস্থা তৈরি হয়েছে, শাসক দলগুলো ক্ষমতা ধরে রাখা কিংবা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জনমত-জনঅধিকারের কোন তোয়াক্কা করেনি। ক্ষমতা এদের কাছে জনসম্পদ লুটের বৈধতা, দুর্নীতি-লুটপাটের মাধ্যমে অর্থ-বিত্ত সঞ্চয়ের আইনী অনুমোদন। স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বজায় থাকলে ক্ষমতা হারানোর ভয় থাকে বলে এরা যেনতেন ভাবে ক্ষমতা ধরে রাখতে চেষ্টা করে। বিএনপি জোট সরকারের সর্বশেষ শাসনামলে প্রধান বিচারপতির বয়সসীমা বাড়িয়ে নিজেদের অনুগত লোককে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার চেষ্টা হয়েছিল; একইভাবে আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোটও ক্ষমতা হারানোর শংকায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে নিজেদের অধীনে একতরফা ভোটারবিহীন নির্বাচন করে পুনরায় ক্ষমতাসীন হয়। বলা হয়েছিল, সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রাখতে এটা নিয়মরক্ষার নির্বাচন, পরে আবার নির্বাচন দেয়া হবে। অথচ ক্ষমতায় বসে সদম্ভে ঘোষিত হচ্ছে – ৫ বছর শেষে তবেই নির্বাচন! জনস্বার্থবিমুখ দুই জোটের ক্ষমতাকেন্দ্রিক চলমান হানাহানির বীজ ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনের মধ্যেই প্রোথিত।
ক্ষমতায় বসে আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার জনগণের মৌলিক অধিকার সংকোচনের পাশাপাশি ক্রসফায়ার, গুম-খুনকে রীতিসিদ্ধ ব্যাপার পরিণত করে জনজীবনকে নিরাপত্তাহীন করে তুলেছে। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী শক্তি জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়ে, জনগণকে যুক্ত করে আন্দোলনের রীতি-ঐতিহ্য বাদ দিয়ে ক্ষমতাকেন্দ্রিক হিংস্র প্রতিযোগিতার মধ্যে মানুষকে ঠেলে দিয়ে ক্ষমতায় যেতে চাইছে। জনগণের অধিকার নিয়ে লড়াকু কোন রাজনৈতিক শক্তি না থাকার দরুণ এরা আজ এই অবস্থা তৈরি করতে পারছে।
বর্তমান সংকটের বাইরের কারণ আওয়ামী-বিএনপি জোটের জনবিচ্ছিন্ন ক্ষমতার রাজনীতি; ভেতরের কারণ লুটপাটের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা
বর্তমান পুঁজিবাদী আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা তার অর্থনীতির নিয়মেই এমন জায়গায় পৌঁছেছে, জনগণের ন্যূনতম অধিকার পূরণের অঙ্গীকারকেও পদদলিত করছে। এ চিত্র উন্নত দেশগুলোতে যেমন, মাত্রাগত পার্থক্য থাকলেও বাংলাদেশেও তেমনি। সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষ হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে যে সম্পদ তৈরি করে, তা হস্তগত করে কয়েক হাজার কোটিপতি তৈরি হয়েছে। শাসক দলগুলো এদেরই প্রতিনিধি। সে কারণেই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে পর্যুদস্ত অবস্থায় ঠেলে দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, গ্যাস-বিদ্যুৎসহ শিক্ষা-চিকিৎসার খরচ বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি-লুটপাট করেও এরা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পায়। সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা বাড়ে আর এরা কর ছাড়সহ কালো টাকা সাদা করার সুযোগ পায়। সরকারের উন্নয়ন-গণতন্ত্রের বুলি এদেরই স্বার্থকে নিরঙ্কুশ করে আর সাধারণ মানুষের জীবনসংহার করে। ফলে ক্ষমতার পালাবদল ঘটলেও জনগণের দিনবদল হয় না। একদল ক্ষমতায় থাকাকালে গণবিরোধী নানা কর্মকাণ্ড সহ স্বৈরতান্ত্রিক যেসব নিয়মবিধি চালু করে, অন্য দল প্রতিবাদ করে, আবার ক্ষমতায় এলে সেগুলোকেই হাতিয়ার করে দমন-পীড়নে কাজে লাগায়, ভুক্তভোগী হয় জনগণ।
বর্তমান সময়েও একদিকে আন্দোলনের নামে জনবিচ্ছিন্ন ও জনবিরোধী তৎপরতা চলছে, অন্যদিকে তাকে দেখিয়ে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে দমন-পীড়ন, ক্রসফায়ার, দেখামাত্র গুলির নির্দেশ, সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধকরণসহ স্বৈরতান্ত্রিক পন্থার যৌক্তিকতা হাজির করা হচ্ছে।
ক্ষমতাকেন্দ্রিক হানাহানিতে জনস্বার্থ আড়ালেই থাকছে
এরকম জিম্মিদশার মধ্যেই আবার বিদ্যুৎ-গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির পাঁয়তারা চলছে। গ্রামীণ ক্ষেতমজুর ও কৃষকদের হাহাকার ডামাডোলে চাপা পড়ছে। সারের দাম বাড়তি, সেচের ডিজেল ও কৃষি উপকরণের দাম চড়া। শীত মানানোর সামান্য বস্ত্রও নেই। শুরু হবে এসএসসি পরীক্ষা, আবারো প্রশ্ন ফাঁসের আশংকা!
জনগণের রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলা ছাড়া এ অবস্থার বদল হবে না
মানুষের অন্তরের বেদনাকে যৌক্তিক ও নৈতিকভাবে ধারণ করার দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক শক্তি থাকলে এ অবস্থা চলতে পারত না। বামপন্থীরা জনগণের দাবিতে লড়লেও, নিরবছিন্ন লড়াকু ভূমিকা নিয়ে আপনাদের আস্থায় আসতে পারেনি। এ অবস্থায় ‘তৃতীয় শক্তি’, ‘বিকল্প শক্তি’ – এসব নানা বিষয় আলোচিত হচ্ছে। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ হয়ে ব্যানার নিয়ে দাঁড়ালেই কি বিকল্প হবে? আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বদলের লক্ষ্যে জনদাবিতে দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন গড়ে তোলার পথ এড়িয়ে কেউ যদি ক্ষমতায় আসেও, পরিস্থিতি তাতে পাল্টাবে না। এ চরম সংকটে শিক্ষিত, সচেতন, মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষরা নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারেন না। জনগণের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তাহীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ, দুর্নীতি-লুটপাট, সাম্প্রদায়িকতা, নারীদের লাঞ্ছনা, মাদক-জুয়া-পর্ণো দিয়ে আমাদের কিশোর-যুবকদের অমানুষ করা হচ্ছে – এর বিরুদ্ধে এলাকায় এলাকায় সংগ্রাম কমিটি করে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। জনগণের এই প্রতিরোধের শক্তিই সমাজকে নতুন দিশা দেখাতে পারে। তাই সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে অবৈধ সরকারের দমন নীতি প্রতিরোধে এগিয়ে আসুন। জনগণের অংশগ্রহণবিহীন আন্দোলনের নামে মানুষ পোড়ানো প্রতিরোধ করুন। দমন নীতির সুযোগে গ্যাস-বিদ্যুৎসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি রুখে দাঁড়ান। বাম গণতান্ত্রিক শক্তির আন্দোলনকে শক্তিশালী করুন।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী) কর্তৃক প্রকাশিত প্রচারপত্র
প্রকাশকাল : ২৮ জানুয়ারি ২০১৫