জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা চাই ॥ গুম-ক্রসফায়ার-রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও পেট্রোল বোমার সন্ত্রাস রুখে দাঁড়াও ॥ স্বৈরতান্ত্রিক একতরফা নির্বাচন জনগণ মানে না
বাম গণতান্ত্রিক শক্তির নেতৃত্বে গণআন্দোলন গড়ে তুলুন
এদেশের মানুষের আজ কোনো স্বাভাবিক জীবন নেই। ঘর থেকে বের হলে নেই ঘরে ফেরার নিশ্চয়তা, অসুস্থ হলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যাবে কিনা তারও ঠিক নেই। লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে এসএসসি পরীক্ষা দেবে – পরদিন পরীক্ষা হবে কি না তা তারা আগের দিন জানে না। দিনমজুর-কৃষক-ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের চলছে বাঁচা-মরার লড়াই। প্রতিটি দিন শুরু হচ্ছে সীমাহীন অনিশ্চয়তা দিয়ে। দুই দলের ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতা ধরে রাখার লড়াইয়ের যুদ্ধক্ষেত্র এ দেশ। জনগণের কোনো স্বার্থ এতে নেই। আছে অশেষ যন্ত্রণাভোগ। যে ব্যবস্থার ভিত্তিতে দেশ চলছে সেই ব্যবস্থাটিই এসব ঘটনার পুনঃ পুনঃ জন্ম দিলেও বর্তমান সংকটের উৎপত্তি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন থেকে। আওয়ামী লীগ একটা অবৈধ, ভোটারবিহীন, অগণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে ও জোরপূর্বক ক্ষমতায় টিকে থাকে। সেই থেকেই বর্তমান সংকটের শুরু। আওয়ামী লীগ এ সংকটের সূত্রপাত করেছে। আবার বিএনপি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন সহিংসতার মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চাইছে। গণধিকৃত যুদ্ধাপরাধী শক্তি জামাতকে সে সাথে নিয়েছে। তারা নৃশংস সন্ত্রাস সংগঠিত করছে ও এই প্রক্রিয়ায়ই তাদের উপস্থিতি তুলে ধরছে। একদল বোমা মেরে-মানুষ হত্যা করে ক্ষমতায় যেতে চাইছে, অন্যদল সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করে গুম-পুলিশি হেফাজতে খুন-নির্বিচার গ্রেফতার-বিনাবিচারে হত্যা করে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চাইছে। দুটোই ফ্যাসিস্ট শক্তি। তারা জনগণকে যুক্ত না করে সংঘাত ও সংঘর্ষের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে ও টিকে থাকতে চাইছে। এই দুই ফ্যাসিস্ট শক্তির কবল থেকে জনগণ মুক্তি চায়। মুক্তির পথ কী?
জনগণের মুক্তির বিভিন্ন রকম পথ যারাই দেখাচ্ছেন, তারা সবাই এই সমাজব্যবস্থার মধ্যেই সমাধান খুঁজছেন
দেশের সুশীল সমাজ সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন। বিভিন্ন সংগঠন, ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে দু’দলকে আলোচনায় বসার জন্য বলা হয়েছে। এটা একটা আপাত সমাধান। একটি গ্রহণযোগ্য ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে এ সমস্যার আপাত সমাধান হতে পারে। কিন্তু এরকম সংকট কেন হয় — এর ব্যাখ্যা তারা দিতে পারছেন না। তারা মনে করছেন, দুই নেত্রীর জেদাজেদিই এ ব্যবস্থার জন্য দায়ী। কিন্তু যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দেশ পরিচালিত হয়, সেই ব্যবস্থার মধ্যেই যে এই সংকটের কারণ নিহিত, ব্যবস্থার পরিবর্তন না হলে যে সংকট ঘুরে ফিরে বারবার আসতে থাকবে — সে কথা তারা তুলছেনই না। সুশীল সমাজের কথা আমরা বুঝতে পারি। তারা কেউ কেউ ব্যক্তিগত অর্থে সৎ মানুষ, কিন্তু সমাজ বিকাশের সঠিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে ধারণ করেন না। আর কেউ কেউ সমাজ চালায় যে পুঁজিপতিশ্রেণী তাদেরই পরামর্শদাতা, তাদের স্বার্থেই বিদ্যা-বুদ্ধি খরচ করেন। তাই তাদের বিষয়ে আমাদের বিশেষ বক্তব্য নেই। কিন্তু আমরা দুঃখ পাই যখন আমরা দেখি আমাদের বামপন্থী বন্ধুদের কেউ কেউ এরকম পরামর্শ দেন। যেন দু’দলকে মেলানোর দায়িত্ব বামপন্থীদের। সারা দেশের মানুষের কাছে যখন এই দুই দলের চরিত্র উন্মোচিত, তখন এই বামপন্থীরা তাদেরকে আলোচনায় বসার জন্য আল্টিমেটাম দেন, তারা যাতে দেশের কথা ভাবে তার জন্য অনুনয় বিনয় করেন, বৃথা আস্ফালনও করেন। আরেক দল বামপন্থী বন্ধু মনে করেন বর্তমান সংকটের সমাধান গণতান্ত্রিক সংবিধানের মধ্যেই নিহিত। তাদের আন্তরিকতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলতে হয় — এই সংবিধান কায়েম করার জন্য তাদের দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সংসদে যেতে হবে অথবা বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করতে হবে। দুটোর কোনোটাই এই সময়ের জন্য বাস্তবসম্মত কথা নয়। আর শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বহাল থাকলে সবচেয়ে গণতান্ত্রিক সংবিধানও জনগণের অধিকারের সুরক্ষা দিতে পারে না, কারণ আজকের যুগে বুর্জোয়ারা আর গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ধারণ করে না। গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে জনগণের রাস্তায় নামার কোন বিকল্প নেই — বামপন্থীদের আহ্বান ও প্রচেষ্টা হওয়া উচিত সেটাই।
দেশে এখন কি ধরনের গণতন্ত্র চলছে?
এ গণতন্ত্রকে আজ চেনা যায় না। যে দল একাত্তরে বলেছিল — ‘এদেশের লোকেদের উপর শোষণ-নির্যাতন করা যাবে না, অত্যাচার করা চলবে না, দেশের লোকের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের নিশ্চয়তা চাই, কিন্তু তা দেয়া হচ্ছে না, দাবি করলে গুলি চালানো হচ্ছে, এ অবস্থা মানা যায় না, সাতকোটি মানুষকে দাবিয়ে রাখা যাবে না’ — সেই দলই আজ কী পরিমাণ ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। দেশের নিরাপত্তা রক্ষার দোহাই দিয়ে চলছে ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, পালাতে গিয়ে ট্রাকচাপায় মৃত্যু ইত্যাদি নানা নামে বিনা বিচারে খুন। এ বছরের ৬ জানুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি এই এক মাসের মধ্যেই পুলিশী হেফাজতে নিহত হয়েছেন ১৯ জন। আটকের পর পায়ে গুলি করে পঙ্গু করার অভিযোগ উঠছে। পাওয়া যাচ্ছে গুলিবিদ্ধ লাশ, স্বজনদের অভিযোগ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ধরে নিয়ে গিয়েছিল, পুলিশ দায়িত্ব অস্বীকার করছে। প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্য বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন যেকোন ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। বিজিবি প্রধান বলেছেন আত্মরক্ষার জন্য তার বাহিনী গুলি করতে পারবে। র্যাব প্রধানের প্রশ্ন — অস্ত্র কি হা ডু ডু খেলার জন্য? একজন মন্ত্রী বলেছেন ‘দেখামাত্র গুলি’ করতে হবে। কেউ বলছেন — অপরাধীদের এনকাউন্টারে দিতে হবে, কেউ বলছেন — তাদের ধরা হবে, জীবিত বা মৃত। মন্ত্রীসভার বৈঠকে ৬ বছর আগে করা ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন’-কে পুনরুজ্জীবিত করার কথা বলা হয়েছে। কারণ এতে দ্রুত বিচার শেষ করতে হয়, এই আইনে মামলা জামিন অযোগ্য, সন্ত্রাসের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন, এমনকি মৃত্যুদণ্ড — সুতরাং তা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য খুবই কার্যকরী। ফোনে আড়ি পাতা নিয়ে সারা বিশ্বে তোলপাড় হচ্ছে। একদিন এই বুর্জোয়ারাই মানুষের প্রাইভেসির কথা তুলেছিল। আজ তারাই কোনো প্রকার প্রাইভেসির তোয়াক্কা করছে না। বাংলালিকস নামে একটি সাইটে নিয়মিতই বিভিন্ন লোকের কথোপকথনের টেপ প্রকাশ করা হচ্ছে। সরকার তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। হয়তো তার পক্ষে যাচ্ছে এ কারণেই অথবা হয়তো তাদের ইন্ধনেই একাজ হচ্ছে। ফেইসবুকে প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে লেখার জন্য জেলে পুরে দেয়া হচ্ছে। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘সম্প্রচার নীতিমালা’ করা হয়েছে। উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা একটা অনির্বাচিত সংসদের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। এ তালিকা চাইলে আরও বড় করা যাবে। অর্থাৎ একদিকে সবরকম গণতান্ত্রিক অধিকারের সংকোচন, আর অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীসমূহের ক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ — এ ছাড়া আজকের দিনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আর কোনো পথ খোলা নেই। আবার স্বাধীনতার পর থেকে যে দলই ক্ষমতায় এসেছে তারাই বিচার ব্যবস্থাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে, ব্যাপকভাবে দলীয়করণ করেছে। ফলে বিচার ব্যবস্থার আপেক্ষিক নিরপেক্ষ কোনো শক্তি নেই যার দ্বারা গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহ রক্ষা পেতে পারে।
৪৪ বছর ধরে ক্ষমতায় যারাই এসেছে তারা শুধু এ ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা রক্ষাকারী
স্বাধীনতার পর থেকে যে দলই ক্ষমতায় এসেছে, তারাই এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নিপীড়ন, নির্যাতন ও জনগণকে সবরকম গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার প্রক্রিয়া বহাল রেখেছে। ছাত্রদের উপর গুলি, বিনা বিচারে রাজনৈতিক হত্যা, সংবিধান সংশোধন করে কালো আইনসমূহকে ফিরিয়ে আনা, সব দল বিলুপ্ত করে একদলীয় শাসন কায়েম — এসব মানুষ দেশ স্বাধীন হওয়ার সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই প্রত্যক্ষ করেছে। এর কোনোটাই স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা ছিল না। অথচ বিপরীত কা-টাই ঘটে গেল। কারণ তখন পাকিস্তানিদের তাড়ানোর জন্য ব্যবসায়ী-পুঁজিপতিশ্রেণী এবং তাদের দল আওয়ামী লীগ এসব কথা মেনে নিলেও স্বাধীনতা পরবর্তীকালে রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে পাওয়ার পর তা মানার আর কোনো দরকার ছিল না। এরপর অনেক ক্যু পাল্টা ক্যু হয়েছে, অনেকেই ক্ষমতায় এসেছে গেছে — কিন্তু সামগ্রিক ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। রাজনৈতিক অস্থিরতা যেটা আছে সেটাতো গোটা পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে যে অস্থিরতা সব সময় বিরাজ করে, যেটা সারা বিশ্বেই এ যুগে সবচেয়ে বেশি, বাংলাদেশ একটি পিছিয়ে পড়া পুঁজিবাদী দেশ হওয়ার কারণে আরও বেশি। বাংলাদেশে পুঁজিবাদীরা অর্থনীতির উপযুক্ত করে তার উপরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারেনি। তাই এখানে একদিকে যেমন অর্থনীতিতে অস্থিরতা বিরাজ করে, অন্যদিকে তেমনি তার উপরিকাঠামো অর্থাৎ রাজনীতিতেও অস্থিরতা বিরাজ করে। কিন্তু সবকিছুর পরও পুঁজিপতিদের সম্পদ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়া, জনগণের ক্রমাগত নিঃস্ব হয়ে যাওয়া, জমি হারানো, সরকার কর্তৃক পুঁজিপতিদের একচেটিয়া মুনাফার ব্যবস্থা করে দেয়া — প্রত্যেকটি সরকারের আমলে তা বহাল ছিল। একথা ভাববার কোন অবকাশ নেই যে, কোনো সরকার বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত বলে জনগণ কষ্টে ছিল, আরেকটা সরকার ভাল ছিল বলে জনগণ ভাল থেকেছে — এমনটি কখনও ঘটেনি। কেন ঘটল না? কেউই ভাল ছিল না বলে? এমন অনেককেই বলতে শোনা যায়, ‘না ভাই, এই দেশের কিছু হবে না। সবাই খারাপ।’ এরকম করে বোঝা কোনোরকম যুক্তির ভিত্তিতে বোঝা না। হতাশা থেকে উদ্ভূত কিছু কথা। আসলে দেশটা যে ব্যবস্থার ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে তাতে পৃথিবীর সবচেয়ে সৎ ব্যক্তিকে দেশের প্রধান করলেও মানুষের ভাগ্য পাল্টাবে না। গোটা দেশের মানুষকে শোষণ করে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ ধনী হবে, তারাই দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে, ব্যক্তি মালিকানার ভিত্তিতেই এদেশের অর্থনীতি চলবে — এটাই হলো পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। এখানে দেশের প্রধান একজন সৎ লোককে করে দিলে সে নিজে অনৈতিক উপায়ে টাকা-পয়সা না খেতে পারে, কিন্তু ব্যাপক লুটপাট-দুর্নীতিতে সম্মতি দেয়া ছাড়া সে তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে টেকাতে পারে না। ফলে সে সৎ থাকতেও পারে না। সৎ মানুষ থাকতে হলে সে মানুষ হওয়ার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বহাল রেখে সৎ মানুষ তৈরির কোনো পথ নেই। আবার ব্যক্তিগত অর্থে সৎ মানুষ দিয়ে এ ব্যবস্থার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য যে দুর্নীতি-লুটপাট, তাকে পাল্টাবারও কোনো উপায় নেই।
জনগণ নয়, বড় বড় শিল্পপতিদের সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে
স্বাধীনতার পর থেকে যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে, সেই ক্ষমতা ছেড়ে যেতে চায়নি। প্রত্যেকটি সরকারই অগণতান্ত্রিকভাবে, জোরপূর্বক ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছে। সামরিক সরকার তো বটেই, এরশাদ সরকারের পতন ঘটিয়ে অনেক রক্তের বিনিময়ে যে গণতন্ত্র অর্জিত হলো, ক্ষমতায় আসলো বিএনপি সরকার, সে এসেও আন্দোলনের তাপের মধ্যেই সাজানো নির্বাচন করতে চেয়েছে। সেই থেকে শুরু করে যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে, সবাই যে কোনপ্রকারে অগণতান্ত্রিকভাবে হলেও ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছে। কিন্তু কেউই পারেনি। তাদের ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে জনগণের বিক্ষোভের কারণে। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম। আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসেছে। এতে তারা জনগণের মতামতের তোয়াক্কা করেনি, শুধু নিয়ম রক্ষার জন্য নামেমাত্র ভোট হয়েছে। এ কাজটা তারা করতে পারলো বাংলাদেশের বড় বিজনেস্ গ্রুপগুলোর সমর্থনের কারণে। বাংলাদেশ সবচেয়ে সস্তা শ্রমের বাজার। সারা বিশ্বে ব্যবসায় মন্দা চলছে। মাল্টিন্যাশনালরা সস্তা শ্রম যেখানে, সেখানে ছুটছে। সেকারণে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানীতে চীনকে টপকে বিশ্বে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। এরকম বহু ফাটকা ব্যবসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে এদেশের ব্যবসায়ীদের সামনে। মাল্টিন্যাশনালদের সাথে কোলাবরেশনে বিপুল মুনাফার সম্ভাবনা উঁকি মারছে দ্বারে। পুঁজিপতিদের লাভ মানেই শ্রমিকদের বিরামহীন দুর্দশা। দুর্দশা জনগণের, কারণ সমস্ত রকম সুবিধা পুঁজিপতিদের দিতে গিয়ে তাদের উপর ভয়াবহ নিপীড়ন নামিয়ে আনা হয়। এটাকে শক্ত হাতে মোকাবেলা করার মতো নির্ভরযোগ্য দল আওয়ামী লীগের মতো আর কেউ নেই। তারাও পুঁজিপতিদের সমস্ত প্রকারের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ফলে পুঁজিপতিশ্রেণী তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তার সমস্ত প্রচার-প্রপাগা-া কিছুটা সমালোচনা করলেও মূলতঃ এ সরকারের পক্ষেই। সমস্ত দমন-পীড়ন চললেও সমস্যা নেই, ব্যবসা চললেই হলো। তাই এত অত্যাচার চললেও ব্যবসায়ী নেতারা বিগত বছর নিয়ে খুব খুশি। তাদের মতে এই সময়কালে এরকম একটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বছর আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
বিএনপি-জামাত এ কী ধরনের আন্দোলন করছে?
বিএনপি পুঁজিপতিশ্রেণীরই একটি দল। কারও মনে যদি কোন সন্দেহ পূর্বে থেকেও থাকে যে, ‘না, বিএনপি শুধু পুঁজিপতিদের স্বার্থই দেখে না, সে মানুষের কথাও চিন্তা করে’ — এ ক’দিনের কর্মকা- দেখে নিশ্চয় তাদেরও ভুল ভেঙ্গেছে। দেখুন কত বড় দল বিএনপি। কত তার কর্মী, সমর্থক, শুভানুধ্যায়ী। দু’বার রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা দল। কিন্তু এখন তার রাস্তায় বের হওয়ার লোক নেই। বিএনপির এ সময়কার আন্দোলনের এ এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য — এখানে জনগণকে সংযুক্ত করার কোনো প্রশ্ন নেই, বরং জনগণকে ভয় দেখানো, আতঙ্ক সৃষ্টি করাই আন্দোলনের ফর্ম। তাদের এতবড় যোগাযোগের কেউ জনগণের এত এত সমস্যা যে এই সরকার তৈরি করছে, এত নিপীড়ন করছে — তার বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন সংগঠিত করেনি। তাদের কষ্ট একটিই — তারা ক্ষমতার বাইরে। তাদের দাবি একটিই — সরকারের পতন। অর্থাৎ জনগণের সমস্যা নিয়ে কথা বললে, মিছিল করলে, আন্দোলন করলে তা শেষ পর্যন্ত এ সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে যায়, পুঁজিপতিশ্রেণীর বিরুদ্ধে যায়। তাই তারা এর ধার দিয়েও যাবে না। তারা অগণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক শক্তি জামাতকে সাথে নিয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে এবং সাম্প্রদায়িক পরিবেশ তৈরি করছে।
শেষ পর্যন্ত লাভ কার হচ্ছে
অব্যাহত রাজনৈতিক সহিংসতায় ব্যবসায়ীদের ক্ষতি কত হচ্ছে দেখাতে সব টিভি-পত্রিকা প্রতিযোগিতায় নেমেছে। প্রতিদিন হিসেব বের করা হচ্ছে। অথচ আমরা জানি সরকার বাহাদুর তাদের লোক। তিনি অচিরেই রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তাদের লোকসান পুষিয়ে দেবেন। এমনটি তারা আগেও দিয়েছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন পূর্ববর্তী সংঘাতে তাদের লোকসান পুষিয়ে দেয়ার জন্য রাষ্ট্র থেকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু যারা এই সংঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে — তারা কারা? তারা হলো দেশের খেটে খাওয়া মানুষ। সে গ্রামের কৃষক। শহরের দিনমজুর, রিকশাচালক, সিএনজি চালক। তারা ফুটপাতে কাপড় বিক্রি করে, মনোহারী জিনিস বিক্রি করে পেট চালায়। টানা অবরোধে তাদেরই ত্রাহি ত্রাহি রব। কৃষক তার উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতে না পেরে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। সর্বস্বান্ত কৃষকের জমি বিক্রি করে শহরে আসা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু জমি কিনবে কে? গ্রামের সকল জমি মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে কেন্দ্রিভূত হচ্ছে। আবার জমি বিক্রি করে শহরে আসা লোকেরা কাজ করবে কোথায়? তাদেরকে দিয়ে আরও সস্তায় কাজ আদায় করিয়ে নেবেন এই কারখানা মালিকেরাই। তাই ক্ষতি তাদের নেই। টানা অবরোধে ক্ষতির যত মায়াকান্নাই তারা কাঁদুন না কেন — আসলে শেষ বিচারে তাদের লাভই হয়।
তাহলে পথ কী?
এ থেকে বাঁচার উপায় কী? এই সমস্যার আপাত সমাধানের জন্য সকলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দরকার ও তার জন্য বাম গণতান্ত্রিক শক্তি ও দেশপ্রেমিক মানুষের ঐক্য গড়ে তুলতে হবে, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ভিত্তি স্থাপন করতে হবে। কিন্তু এতেই পুরো সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ সমাজটা শ্রেণীবিভক্ত, একদিকে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিশ্রেণী, অন্যদিকে বিপুল সংখ্যক খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। দু’শ্রেণীর স্বার্থ এক নয়, লাভ-লোকসান এক নয়, ভাল-মন্দের ধারণা এক নয়, গণতন্ত্রও এক নয়। আমাদের দেশে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করে তারা এ দেশের পুঁজিপতিশ্রেণীর পলিটিক্যাল ম্যানেজার মাত্র। শিল্পপতিরা তাদের ফ্যাক্টরি চালানোর জন্য যেমন ম্যানেজার নিয়োগ করে, তেমনি দেশ চালানোর জন্যও তারা ম্যানেজার নিয়োগ করে। সরকার হলো তাদের সেই পলিটিক্যাল ম্যানেজার। শুধু একটা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল হলেই দেশে শান্তি আসবে না, সাধারণ মানুষের দুঃখ ঘুচবে না, রুটি-রুজির প্রশ্নের মীমাংসা হবে না। কারণ এতে শুধু ম্যানেজার পাল্টাবে, মালিকদের হাত থেকে রাষ্ট্রটা শ্রমিকদের হাতে যাবে না। নতুন ম্যানেজার মালিকের কথামতোই চলবে। এ থেকে মুক্তির পথ একটাই — খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের নিজেদের শক্তি গড়ে তোলা। নিজের শ্রেণীর মুক্তির জন্য, রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় গণআন্দোলন গড়ে তোলা। এজন্য পাড়ায়-মহল্লায়-এলাকাতে সকল রকম গণবিরোধী চক্রান্তের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তোলা দরকার। তাই শিক্ষা-স্বাস্থ্য-নারী নির্যাতনসহ সকল সংকটকে কেন্দ্র করে এলাকায় এলাকায় শিক্ষিত-সচেতন-বিবেকসম্পন্ন মানুষরা এগিয়ে আসুন, জনগণকে সাথে নিয়ে রুখে দাঁড়ান। বাম গণতান্ত্রিক শক্তির নেতৃত্বে গণআন্দোলন গড়ে তুলুন। মানুষকে সংঘবদ্ধ করুন। দীর্ঘস্থায়ী গণআন্দোলন গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে এই অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার বিকল্প শক্তি সৃষ্টি করুন। একমাত্র এ পথেই এ নির্মম শোষণের জোয়াল কাঁধ থেকে নামতে পারে।