গত ২৮ এপ্রিল দেশের তিনটি সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন হলেও এর রাজনৈতিক গুরুত্ব জাতীয় নির্বাচন থেকে কম ছিল না। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার জন্য শতাধিক বিদেশি এবং দুই হাজারেরও অধিক দেশি পর্যবেক্ষক ছিলেন। ইউরোপিয় ইউনিয়ন, ইউএনডিপি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, সুইডেন, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশের পর্যবেক্ষক ও একাধিক সংস্থা পর্যবেক্ষণে ছিল। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের পরে জাতিসংঘের মহাসচিবকে টেলিফোন করে নির্বাচন সম্পর্কে অবগত করেছেন। কোনো দেশের অভ্যন্তরের স্থানীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এরকম পর্যবেক্ষণ ও মনোযোগ বিশ্বে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। আওয়ামী লীগ ৫ জানুয়ারি ২০১৪-এ একটি ভোটারবিহীন, অগণতান্ত্রিক, সম্পূর্ণ একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় এসেছে। তার অধীনে এই নির্বাচনে মহাজোট ও তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ ২০ দলীয় জোটভুক্ত দলগুলোসহ তিনটি বামদল অংশগ্রহণ করেছে। ফলে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা নির্বাচনকে বেশ গুরুত্ব সহকারে নিয়েছিল। তারা দেখতে চেয়েছে যে আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হয় কি না। তার ফ্যাসিবাদী শাসন বহাল রেখে, তার নেতৃত্বেই নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা চালু হয় কি না।
পত্র-পত্রিকা-টেলিভিশন চ্যানেলে ও নিজেদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় মানুষ দেখেছে কি নজিরবিহীন রিগিং এ নির্বাচনে হয়েছে। কেন্দ্র দখল, জাল ভোট, গণ সীল, ব্যালট ছিনতাই, কেন্দ্র ভাংচুর, গুলি, বোমাবাজি — কি হয়নি এ নির্বাচনে। খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে সাংবাদিকরা লাঞ্ছিত হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন। কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তারা ছিলেন অসহায়। বিএনপি বেলা ১২টায় নির্বাচন বর্জন করলেও তাদের নামে বিপুল সংখ্যক প্রাপ্ত ভোট দেখানো হয়েছে। বিএনপি নেতারাও বলেছেন, এই ভোট তাদের প্রাপ্ত ভোট নয়। নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য সরকার পরিকল্পিতভাবে ‘টেবিল মেড’ ফলাফল হাজির করেছে। পত্র-পত্রিকায় অনেকেই লিখেছেন, এ কাজ একমাত্র স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের সময় হয়েছে। অথচ নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সাথে ঢাকার নতুন মেয়ররা দেখা করতে গেলে তিনি তাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। সাংবাদিকদের বলেছেন, জনগণ তাদের সাথে আছে।
কেন সরকার এ সময়ে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন আয়োজন করলো?
২০১৩ সালের শেষের দিকে অর্থাৎ আওয়ামী লীগের প্রথম দফা মেয়াদকালের শেষের দিকে দেশের ৪টি সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচন হয়েছিল। তার সবকটিতেই আওয়ামী লীগ হেরেছে। ৫ বছরের শাসনে জনগণের যে ক্ষোভ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তৈরি হয়েছিল তারই প্রতিফলন ছিল এটি। এরপর আরও দেড় বছর পার হয়েছে। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ নির্লজ্জভাবে ৫ জানুয়ারির একটি সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় এসেছে। জনগণের সবরকম গণতান্ত্রিক দাবিকে উপেক্ষা করে গায়ের জোরে, লাঠির জোরে সে টিকে আছে। এবং সে টিকে আছে দেশের ব্যবসায়ী শিল্পপতিগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। তাকে উৎখাত করার ধারে-কাছেও কোনো শক্তি নেই। একটা বড় রকমের আন্দোলন করে তাদের সমস্যায় ফেলবে সেরকম কোনও সম্ভাবনা এখনও তৈরি হয়নি। কিন্তু মানুষের মনে পাহাড়প্রমাণ ক্ষোভ জমা হয়ে আছে। চূড়ান্ত অজনপ্রিয়তার এ সময়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তড়িঘড়ি করে নির্বাচন ঘোষণার একটি উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই আছে। স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করা এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরকে আধুনিক করে গড়ে তোলা — এ লক্ষ্যে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ নির্বাচনের ঘোষণা দেয়নি। তাহলে এই সময়ে কেন নির্বাচন?
আসলে এ নির্বাচন সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু করার জন্য আয়োজন করেনি। নৈতিক-গণতান্ত্রিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করবে, এ চিন্তাও তার ছিল না। কিন্তু গ্রহণযোগ্য করার কথা বলে সকল রাজনৈতিক শক্তিকে তার পেছনে জড়ো করা, মাথা নত করানো — এ কাজটি করা এবং সাথে সাথে তার ডাকে বেশিরভাগ দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তার শাসনের বৈধতা দেয়া, ন্যায্যতা তৈরি করা; এ জন্যেই সে নির্বাচনের ডাক দিয়েছে। আন্দোলনে ব্যর্থতার ফলে কোণঠাসা বিএনপি অসম প্রতিযোগিতা মেনে নিয়েই নির্বাচনে আসতে বাধ্য হবে — এটা বুঝেই সরকার এসময় হঠাৎ করে নির্বাচন দিয়েছে। বুঝে হোক্ বা না বুঝে হোক্, যারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন তারা সরকারের এই অসদুদ্দেশ্য পূরণে ভূমিকা পালন করেছেন।
আমরা একটা বিষয় পাঠকদের ভেবে দেখতে বলব। এই নির্বাচন ব্যবস্থা বুর্জোয়ারাই চালু করেছে। জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা শাসনকাজ পরিচালনা করা, শাসনকাজে জনগণের অনুমোদন নেয়া — এটা বুর্জোয়ারাই এনেছিল। জনগণের দ্বারা গঠিত, জনগণের জন্য, জনগণের সরকার — এ ছিল বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বহুল উচ্চারিত শব্দমালা। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তারা যে আইন-কানুন তৈরি করেছে — তাদের ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য এবং শেষ পর্যন্ত জনগণের উপর আরও শোষণ নির্যাতন নামিয়ে আনার জন্যই যা তৈরি — তবু মানুষের মত প্রকাশের কিছু সুযোগ ও তাদের কিছু অধিকার এই আইন-কানুনের মধ্যে থাকে। আজকে গণতন্ত্রের সেই ভানটুকুও তারা ধরে রাখতে পারছে না। আসলে, বুর্জোয়া ব্যবস্থার শুরুতে প্রতিযোগিতামূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিল। ফলে মতপ্রকাশের অধিকার দেয়ার বিষয়টি তাদের সামাজিক প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কালক্রমে পুঁজি একচেটিয়া রূপ নেয়ার কারণে তাদের সেদিনের সে প্রয়োজন আজ আর নেই।
জনবিচ্ছিন্ন বিএনপির নির্বাচন করা ছাড়া কোনো পথ ছিল না
বিএনপি’র নির্বাচন করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। কারণ যুদ্ধাপরাধী-প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি জামাতের সাথে ঐক্য এবং এদের সাথে মিলে আন্দোলনের নামে সে যা করেছে তাতে মানুষ তার ওপর এমনিতেই বিক্ষুব্ধ। মানুষকে নিয়ে আন্দোলন করার পরিবর্তে তারা পেট্রোল বোমা, গান পাউডার দিয়ে মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে। ফলে তারা ক্রমেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। একদিকে সরকার কর্তৃক কোণঠাসা অবস্থা, অপরদিকে পাবলিক থেকে বিচ্ছিন্নতা — এ দুয়ে মিলে একটা বদ্ধ-আটক অবস্থার মধ্যে সে পড়েছিল, নির্বাচনটা তার জন্য একটা ‘এসকেপ রুট’ হিসেবে এসে গেল।
আবার বিএনপি নির্বাচনে গেলেও কিছু করতে পারবে না, সরকার তাকে ঠিকই হারিয়ে দেবে — এটা জনগণের মধ্যে শিক্ষিত, সচেতন, কান্ড-জ্ঞানসম্পন্ন অংশ ঠিকই বুঝেছিলেন। তবে একটা আন্দোলনকারী শক্তি শ্রেণীসংগ্রামকে ভিত্তি করে যত স্পষ্ট ও প্রখরভাবে বোঝে, সাধারণ মানুষ ঠিক সেভাবে বোঝেন না। খানিকটা নিজেদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি-বিবেচনা ইত্যাদির সাথে মিলিয়ে বোঝেন। বুর্জোয়া ব্যবস্থায় অর্থনীতিতে যেমন অস্থিরতা, নানা ংঢ়বপঁষধঃরড়হ তার মধ্যে হয়, তেমনি সমাজে অবস্থিত মানুষের ভাবজগতেও নানারকম ংঢ়বপঁষধঃরড়হ হয়। জনগণের মধ্যে সেটিও ছিল। যদি স্বাভাবিক নির্বাচন হয়, যদি কিছু ঘটে যায় — ইত্যাদি ভাবনা মানুষের মধ্যেও ছিল। সেটা বিএনপি কাজে লাগাতে চেয়েছে। আবার সে যদি নির্বাচনে না যায়, তাহলে জনগণের কাছে সে কী উত্তর দেবে? ‘তাহলে কি করবেন? আন্দোলন থেকে বেরিয়ে এলেন, তাহলে নির্বাচন না করে কি করবেন?’ এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর বিএনপির কাছে নেই। সে নিরুপায়। তাই নির্বাচন করা ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিল না। এটা গেল বিএনপি’র দিক।
বামপন্থীরা কেন এই প্রহসনের নির্বাচনে গেলেন?
কিন্তু বামপন্থীরা কেন নির্বাচনে গেলেন? এ সরকার অবৈধ-অনির্বাচিত-গায়ের জোরে ক্ষমতায় বসা, এর অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না — এটা যে শুধু আমরাই বলেছি তা নয়, সিপিবি-বাসদও একটা পর্যায় পর্যন্ত, ঠিক এভাবে না বললেও এই কথাগুলিই বলেছেন। গণসংহতি আন্দোলন আমাদের সাথে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা জোটভুক্ত। তারাও এই কথা বলেছেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, সরকার নির্বাচন ঘোষণা করার পরপরই সিপিবি-বাসদ তিলমাত্র বিলম্ব না করে সবার আগে নির্বাচনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তারা যখন ছাপানো কাগজ নিয়ে নির্বাচনের প্রচারে নেমে গেছেন, তখনও নির্বাচন যার সবচেয়ে বেশি দরকার সেই আওয়ামী লীগ তার প্রার্থী ঘোষণা করেনি। বিএনপি তখনও নির্বাচনের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। কিন্তু তারা নেমে গেলেন। বামপন্থীদের প্রতি দরদ আছে, এমনকি এই নির্বাচন হওয়াটাকেও সমর্থন করেন এমন বহু মানুষ তাদের এই কান্ডে যার পর নাই দুঃখ পেয়েছেন। বামপন্থীরা সরকারের কূটকৌশলের পেছনে এভাবে ছুটবে তারা তা কল্পনাও করেননি।
বামপন্থীদের রাজনীতির মাঠে, লড়াইয়ের মাঠে থাকার কথা ছিল। কিন্তু তা না করে নির্বাচন ঘোষণার সাথে সাথেই তারা রাস্তায় নেমে গেলেন। সঠিক রাজনীতির কথা বাদ দিন, কোন্ দৈন্য তাদের দেখেশুনে পা ফেলার যে স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি, তাই গুলিয়ে দিল? আসলে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে আছে, দেশটা শেষপর্যন্ত যাতে বিশৃঙ্খলায় পড়ে না যায়। মানে, ‘যত যাই হোক নির্বাচনটা তো ঠিক আছে, নির্বাচন তো হওয়া উচিত। দেশে গণতান্ত্রিক ধারা তো আসা দরকার। এভাবে তো চলতে পারে না’ — ইত্যাদি। এভাবে চলতে পারে না ঠিক। সেটা পাল্টাবার জন্য জনগণকে সাথে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলুন। তা না করে বুর্জোয়ারা যেভাবে সমাধান চায়, তার স্বার্থ রক্ষা করে যেভাবে সমাধানের চেষ্টা করে, সেটার সহযোগী কেন হলেন?
আপনারা নির্বাচন ঘোষণা করাটাকে যৌক্তিক মনে করলেন কেন? নির্বাচন কে ঘোষণা করেছে? কি উদ্দেশ্যে করেছে? সরকারকে অবৈধ-অগণতান্ত্রিক বলছেন, আবার তার দেয়া নির্বাচনকে বৈধ ও সঠিক মনে করছেন। একটি অবৈধ, অগণতান্ত্রিক, চূড়ান্ত দমনমূলক সরকার কি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাচন ঘোষণা করে? তাহলে এরশাদের অধীনে নির্বাচন করেননি কেন? এখন কেন করছেন? সে সময়ও তো বামপন্থীরা ছোট পার্টিই ছিল। সেদিন পারলেন, আজ পারলেন না কেন? নির্বাচন বর্জন তো শুধু সামরিক শাসনের সময়ই করেননি। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি সরকারের অধীনে যে জাতীয় নির্বাচন হয়েছিল, সেটিতো আওয়ামী লীগসহ বেশিরভাগ দলই বর্জন করেছিল। ২০১৪ এর ৫ জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনেও তাই ঘটেছে। সেগুলো তো বর্জন করেছিলেন এই যুক্তি এনে যে, এগুলো পাতানো নির্বাচন। এর মাধ্যমে সরকার তার আকাক্সিক্ষত ফলাফল বের করতে চায়। এই নির্বাচনেও তো সরকার তাই চেয়েছে। তাহলে সেগুলো করলেন না, এটা কেন করলেন। এটা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন হলেও এর রাজনৈতিক গুরুত্ব কোনো অংশেই জাতীয় নির্বাচন থেকে কম ছিল না। কেন, তা আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি।
বামপন্থী সব দল মিলে যদি নির্বাচন না করার পয়েন্টে ঐক্যবদ্ধ থাকত, বলতে থাকত এটি অবৈধ-অগণতান্ত্রিক সরকার, এর অধীনে কোনো নির্বাচন নয়, এই ফ্যাসিস্ট সরকারের কোনো কিছুই আমরা মানব না; আর সারাদেশের শিক্ষিত-দেশপ্রেমিক মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করতো, কীভাবে নির্বাচন করলে গণতান্ত্রিক হবে তার রূপরেখা তৈরি করার চেষ্টা করতো Ñ সেটাই হতো সবচেয়ে উপযুক্ত কাজ। তা না করে যে সরকার এদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সমস্ত ঐতিহ্য ও অর্জনকে পদদলিত করে গোটা দেশকে পায়ের তলায় গুঁড়িয়ে দিলো, সেই ভয়ঙ্কর সরকারকে সহযোগিতা করলেন।
নির্বাচনে গিয়ে বামপন্থীদের কী লাভ হলো? তাদের নেতাদের প্রচার হলো, তাদের দলের প্রচার হলো। একথা তো ঠিক যে, দলের লাভ হলেও মানুষের লাভ নাও হতে পারে। কারণ তাদের এত প্রচার গণআন্দোলনের নেতা হিসেবে হয়নি। গণআন্দোলন সংগঠিত করতে করতে তৃণমূল থেকে ধীরে ধীরে জননেতায় পরিণত হয়ে তারা ভোটে আসেননি। শাসক দল নিজেদের প্রয়োজনে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিসেবে তাদেরকে প্রচার দিয়েছে। বুর্জোয়ারা তাদের ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা ও এর বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষার জন্য জন্য একটা মাত্রা পর্যন্ত ভিন্নমত প্রচারের সুযোগ দেয়, এভাবে ‘টক শো’গুলোর মাধ্যমে তারা কিছু নেতাকে পরিচিত করে তোলে।
যাই হোক, বামপন্থীরা শেষ পর্যন্ত নির্বাচন বয়কট করেছেন। বিএনপি তো তবু বেলা ১২টার দিকে নির্বাচন বর্জন করেছে। সিপিবি-বাসদ পুরো নির্বাচনটাই করলেন। যখন দেখলেন কোনো বিরোধী দলই নির্বাচন গ্রহণ করছে না, তখন উপায় না দেখে বর্জন করলেন। এটা কি আন্দোলনমুখী কোনো বর্জন হলো? এই নির্বাচনের একটি ফলাফল ঘোষিত হয়েছে এবং সেখানে বামপন্থীরা কত ভোট পেয়েছেন তাও দেখানো হয়েছে। বামপন্থী বন্ধুরা বলেছেন, ভোট কম দেখানো হয়েছে। আরও বেশি ভোট তারা পেতেন। ফলাফল প্রসঙ্গে বিএনপির নেতারা বলেছেন, ফলাফলে তাদের প্রাপ্ত ভোট বেশি দেখানো হয়েছে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের জন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস বলেছেন, এটি ‘টেবিল মেড ফলাফল’ যা একসময় সামরিক শাসনের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে চর্চা হত। তার মানে ভোটের সংখ্যা যেটা দেখানো হয়েছে, সেটি জনগণ প্রদত্ত ভোট নয়। সেটি বানোয়াট সংখ্যা। বলা বাহুল্য, বামপন্থীরা যে ভোট পেয়েছেন, তাও সরকারের দেয়া একই ‘টেবিল মেড’ ফলাফল। সেখানে যত ভোট পেলেন তার চেয়ে বেশি পেতেন কি না, এর থেকেও বড় কথা হলো যা পেয়েছেন সেটাও সরকারেরই দেয়া। এ কারণেই নির্বাচন কমিশন এবার প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের প্রাপ্ত ফলাফল আলাদাভাবে ঘোষণা করেনি।
বামপন্থীদের দৃষ্টিভঙ্গিগত সমস্যাই তাদের এই জায়গায় নিয়ে গেছে
অনেকে বলছেন, বিএনপি’র মতো বামপন্থীরাও ফ্যাসিবাদী সরকারের চেহারা উন্মোচন করার জন্য নির্বাচনে গেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগকে উন্মোচিত করতে বিএনপি নির্বাচনে যায়নি। দলগত বিবেচনা থেকেই নির্বাচনে গেছে, যা কারও কাছেই অস্পষ্ট নয়। কিন্তু বামপন্থীরা কেন এ কাজ করলেন? সারাদেশে গণধিকৃত এ সরকারকে উন্মোচন করার বেশি কিছু বাকি ছিল কি? বাস্তবে তারা এই ফ্যাসিস্ট শক্তির অধীনে আয়োজিত নির্বাচনে অংশ নেবার ফলে গণআন্দোলনের নৈতিক ভিত্তিটাকে আঘাত করলেন।
আর এটা করলেন এই কারণে যে, আন্দোলন করে এ সরকারকে মোকাবেলা করবেন — এমন কোনো দৃষ্টিভঙ্গিই তাদের ছিল না। জনগণকে নিয়ে যেভাবে আন্দোলনের চেষ্টা করতে হয়, তা তারা করেননি। ম্যানেজ করে কীভাবে ভোটের শক্তি হিসেবে আসতে পারেন, সে চেষ্টাই করেছেন। সিপিবি-বাসদ কিছুদিন পূর্বেও ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্না, আ.স.ম. রবদের নিয়ে বিকল্প হওয়ার চেষ্টা করেছেন। সেটা কোনো আন্দোলনকারী শক্তি হিসেবে বিকল্প নয়। এদের নিয়ে তারা কোনো আন্দোলনের ডাক দেননি। সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রাস্তায় পড়ে থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য তারা একত্রিত হননি। এক হয়েছিলেন ভোটের জন্য। তারা বুঝেছিলেন, মানুষ দু’দলের উপরই অনেকটা আস্থা হারিয়েছে। ফলে একটা শূন্যতা চলছে রাজনীতিতে। ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্নাদের নামধাম আছে। বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচার দিয়ে এই নাম এদেশের মালিকশ্রেণী নিজেদের স্বার্থেই তৈরি করেছে। একে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক এই শূন্যতার মাঝে তারা যদি ফাঁক দিয়ে কিছু একটা করতে পারেন, সে চেষ্টাই তারা করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ম্যানেজটা ঠিক ঠিক করে উঠতে পারেননি, ‘সুবর্ণ সুযোগ’ তাদের ‘হাতছাড়া’ হয়ে গেছে।
গণআন্দোলন করে, দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রাম, জয়-পরাজয়ের মধ্য দিয়ে জনগণের মধ্যে পরিচিতি গড়ে উঠতে পারে। তা না হলে আরেকভাবে পরিচিতি গড়ে উঠতে পারে, যদি বুর্জোয়ারা পেছন থেকে সাহায্য-সহযোগিতা করে। আন্দোলন-সংগ্রাম করতে করতে, মানুষের মধ্যে পড়ে থাকতে থাকতে, অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে একটা দলকে, একটা ঐক্যবদ্ধ বামপন্থী শক্তিকে মানুষ যেমনভাবে চিনে, তাকে বিশ্বাস করে — সেভাবে এগোনোর কোনো পরিকল্পনা সিপিবি-বাসদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। তারা নিজেদের পরিচিত করার জন্য, তাদের ভাষায় ‘দৃশ্যমান’ হওয়ার জন্য, ভোটকেন্দ্রিক ঐক্য গড়ে তুলছেন। বুর্জোয়া দুই দলের অগ্রহণযোগ্যতার কারণে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, সেই সুযোগে তারা সামনে আসতে চান।
গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি আমাদের জোট গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার সাথে আছেন। তিনি এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেন। বলা হচ্ছে যে, এবারের নির্বাচনে মিডিয়ায় প্রচারের ক্ষেত্রে তিনি তৃতীয় স্থানে ছিলেন। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ-বিএনপির প্রার্থীর পরই তার প্রচার ছিল। তাদের বক্তব্য, মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিয়েছে। এত মানুষ কেন জোনায়েদ সাকির পক্ষে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিলেন? জোনায়েদ সাকি তো বহুদিন ধরে বহু আন্দোলনের সাথে আছেন। সেসব ব্যাপারে তো তার পক্ষে এমন সাড়া দেখা যায়নি। এখন কি দেখে সাড়া দিচ্ছেন? গোটা বামপন্থী আন্দোলনে স্থবির অবস্থা। সেখানে সাকিরাও আছেন। সেটা শক্তিতে বাড়ল না, এমনকি সাকির প্রতি ভালবাসা থেকে বামপন্থী আন্দোলনের প্রতি শ্রদ্ধাও বাড়ল না, ব্যক্তিগতভাবে জোনায়েদ সাকির খুব নামধাম হলো, খুব প্রচার-প্রপাগান্ডা হলো। এর মাধ্যমে সমাজে বামপন্থী চিন্তার স্ফুরণ কতটুকু ঘটলো?
বামপন্থীরা কী করতে পারতেন?
নির্বাচনপূর্ব অবস্থায় দেশের পরিস্থিতি কি ছিল একবার ভেবে দেখুন। সরকার অবৈধ, অগণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় আসার কারণে জনগণ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত। তার গায়ের জোরের শাসনে জনগণ অতিষ্ঠ। আবার বিএনপি চরম প্রতিক্রিয়াশীল জামাতের হাত ধরে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নামে জনগণের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ চালিয়েছে। পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ, সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মারা Ñ এসবের জন্য তারাও সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন। এটা এমন এক পরিস্থিতি, যেখানে বুর্জোয়াদের নোংরামি-নষ্টামির রাজনীতি যত রকমভাবে, যত রূপ নিয়ে বেরিয়ে আসতে হয় — এসেছে। এ অবস্থায় বামপন্থীরা নির্বাচনের বিকল্প নয়, আন্দোলনের শক্তি হিসেবে হাজির হতে পারত। সরকার ও বিরোধী দল — দুয়েরই জনবিচ্ছিন্নতার জন্য এমন এক পরিবেশ ছিল। তখন বামপন্থীরা ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়ালে, সাহসী পদক্ষেপ নিলে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বামপন্থী ধারার সূচনা ঘটতে পারত।
আমরা দেশের সমস্ত শিক্ষিত সচেতন মানুষকে একটি কথা ভেবে দেখতে বলব। সেসময় দেশের পরিস্থিতিতে দুটো বিষয় পাশাপাশি ছিল। একটি হলো পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য গণবিচ্ছিন্ন ফ্যাসিস্ট সরকার দ্বারা আরোপিত ‘নির্বাচন’, অপরদিকে বাস্তব অবস্থার মধ্যে আন্দোলনের সম্ভাবনা, সরকার ও বিরোধী দল দুটোকেই কোণঠাসা করে দেয়ার সুযোগ। একটি বামপন্থী দলের কোনটি গ্রহণ করা উচিত?
বাম-গণতান্ত্রিক শক্তি কারা?
আরেকটি বিষয় প্রসঙ্গক্রমে আমরা একটু বলে যেতে চাই। বামপন্থী পার্টি হবার ক্ষেত্রে একটা দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার থাকতে হবে — বামপন্থী শক্তি তারাই যারা ‘ক্লাস স্ট্রাগল’ এবং ‘মাস স্ট্রাগল’-এ বিশ্বাস করে, অর্থাৎ যারা গণআন্দোলনে ও শ্রেণী সংগ্রামে বিশ্বাস করে। আবার আমরা যখন বাম-গণতান্ত্রিক শক্তি বলি তখন গণতান্ত্রিক শক্তি বলতে কাদের বোঝায়? গণতান্ত্রিক শক্তি মানেই হলো — তারা গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার আন্দোলনের পাশাপাশি দর্শনগতভাবে সেক্যুলারিজমে বিশ্বাস করে এবং এদেশে সাম্রাজ্যবাদের যে আগ্রাসন তার বিরোধিতা করে। এভাবে পরিষ্কার করেই বামপন্থী কারা, গণতান্ত্রিক কারা — এ কথাটা আমাদের বুঝতে হবে। আমাদের দেশে লিবারেল ডেমোক্রেটিক যাদের বলা হচ্ছে তারা সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক শক্তিই না। এরা কোনো না কোনোভাবে বুর্জোয়ারা যে ধারার রাজনীতির প্রসার এদেশে ঘটাচ্ছে, সে একই ধারারই রাজনীতি করেন। ক্ষমতায় না থাকলে লোকে যেভাবে মিষ্টি কথা বলে, মানুষের মনে প্রভাব ফেলার চেষ্টা করে — এরা তাই করছেন। তা না হলে সামগ্রিক ক্রিয়াকলাপে বুর্জোয়া রাজনীতির সাথে তাদের কোনো পার্থক্য নেই। সেক্যুলার গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বুর্জোয়াদের এই অংশের কোনটির মধ্যে নেই বললেই চলে।
বর্তমান সময়ে বামপন্থীদের করণীয় কি হওয়া উচিত
এদেশের বামপন্থীরা সাধারণভাবে প্রতিবাদধর্মী কিছু মিছিল-মিটিং করেন, কিছু সাংস্কৃতিক কাজকর্মও করেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের দাবি-দাওয়া নিয়ে সম্পূর্ণ বামপন্থী গণতান্ত্রিক ধারায় গণআন্দোলন গড়ে তোলার কাজ ধারাবাহিকভাবে তারা করেননি। বুর্জোয়াদের পার্লামেন্টারি রাজনীতির ফাঁদেই তারা আটকে আছেন। এদেশে বুর্জোয়াদের নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা-সংঘর্ষ নিত্য চলছে। একটা বিপ্লবী আন্দোলন বিকশিত হচ্ছে এবং তার চ্যালেঞ্জের সামনে বুর্জোয়ারা পড়ছে — এমন কোনো পরিস্থিতিই এদেশে কখনোই তৈরি হয়নি। এ অবস্থা থেকে বামপন্থী রাজনীতির উত্তরণ দরকার। বামপন্থীদের বুঝতে হবে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, শোষিত-মেহনতি মানুষের মুক্তির আন্দোলনে তারাই একমাত্র ভরসাস্থল। এখনও নিজেদের ভুলভ্রান্তি কাটিয়ে উঠে বিকল্প শ্রেণী সংগ্রামের শক্তি নিয়ে দাঁড়ান। সর্বোচ্চ বোঝাপড়া ও সর্বসম্মত ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধভাবে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যারা বিচ্ছিন্নভাবে আছেন, তারাও নিজ নিজ অবস্থান থেকে আন্দোলনের জন্য কাজ করুন। আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণই আমাদের পরস্পরকে ঐক্যবদ্ধ করবে।
[গত ২৯ এপ্রিল দলীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত কর্মী সভায় বাসদ (মার্কসবাদী) কার্য পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর প্রদত্ত বক্তব্য সম্পাদিত করে প্রকাশ করা হল।]