শিক্ষার সর্বস্তরে ব্যয় বৃদ্ধির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আহবান নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট রংপুর বিভাগের সমাবেশ। ১৭ সেপ্টেম্বর রংপুরের টাউন হল মাঠে সকাল ১১ টায় অনুষ্ঠিত এ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বাসদ (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় কার্যপরিচালনা কমিটির সদস্য কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুজ্জামান সাকন, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নিলুফার ইয়াসমিন শিল্পী, এস.এম মনিরুজ্জামান প্রমুখ। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন আহসানুল আরেফিন তিতু।
কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্তী বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থা দুরদশাগ্রস্ত হলে দেশের সমস্ত ক্ষেত্রের অরাজক পরিস্থিতি থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। একদিকে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতি, অন্যদিকে গ্যাস-বিদ্যুতের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি দরিদ্র মানুষকে আরো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি করছে। উপর্যুপরি বন্যায় উত্তরবঙ্গের জনপদ এখন বিপর্যস্ত। জরুরি তৎপরতা খাদ্য সরবরাহ ও পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেই। খুন-ধর্ষণ লাগামহীন ভাবে চলছে, বিচার নেই। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুম-ক্রস ফায়ার জনজীবনকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মত মৌলিক অধিকারকে পুঁজিপতিদের অবাধ মুনাফার ক্ষেত্রে পরিণত করে দিয়েছে সরকার। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র লাগামহীন ব্যয়বৃদ্ধি দরিদ্র মানুষের শিক্ষা নেবার রাস্তা বন্ধ করে দিচ্ছে। ধনীরা ট্যাক্স ফাঁকি দিচ্ছে, ঋণ খেলাপী হচ্ছে, আর দরিদ্র মানুষ ও ছাত্রদের উপর বর্ধিত হারে ট্যাক্স আরোপ করা হচ্ছে। শিক্ষকের বেতন-স্কেল ও গ্রেড নীচে নামিয়ে দিয়ে তাদের অসম্মানিত করা হয়েছে। জনগণের সরকার মুখে বলে, এরা কার্যত ধনী মানুষের স্বার্থেই দেশ চালাচ্ছে। শিক্ষাসহ জনঅধিকারের উপর এই আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়বে যে ছাত্রসমাজ তাদেরকে বিপথগামী করা হয়েছে। চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি সহ বৈষয়িক স্বার্থে পরিচালিত এদের কর্মকান্ড ছাত্র-যুব সমাজের চরিত্রকে কলুষিত করেছে। পাশাপাশি সমাজ জুড়ে ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’ – এ সংস্কৃতি ও ভোগবাদী মানসিকতা ছড়িয়ে দিয়ে সমাজবিমুখ ও স্বার্থপর করে তোলা হচ্ছে। এ দু:সহ পরিস্থিতিতে আলো জ্বালবে কারা ? নজরুল-রবীন্দ্রনাথ-রোকেয়া সহ সমস্ত বড় মানুষের জীবনের শিক্ষাকে ধারণ করে কেবল শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নয়, মনুষ্যত্ববিনাশী যে প্রক্রিয়াটি সমাজে চালু আছে তাকে প্রতিরোধ করতে হলে, ছাত্র-যুবকদেরই আজ জাগতে হবে। সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধের শক্তি গড়ে তুলতে হবে।
ছাত্রনেতা সাইফুজ্জামান সাকন বলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই প্রধান ধারা হয়ে উঠেছে। শিক্ষার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব অস্বীকার করে সরকার ’৬২এর সেই স্বৈরতান্ত্রিক পাকিস্তানিদের নীতিকেই অনুসরণ করছে। সে কারণেই শিক্ষা দিবসকে এরা মানুষের সামনে প্রচার করে না।
আজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের হালচিত্র কি ? অবকাঠামো সহ চরম শিক্ষক সংকটে জর্জরিত। প্রায় ১৫ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ভূক্ত কলেজ সমূহে বছরে ২ মাসও ক্লাশ হয় না। সরকারি কলেজগুলোতেই বিভাগ প্রতি গড়ে ৪/৫ জনের বেশি শিক্ষক নেই। সিলেবাস-প্রশ্ন পদ্ধতির পরিবর্তন ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়ার মতো। শিক্ষক নিয়োগ, উপর্যুক্ত প্রশিক্ষণ সহ যথাযথ আয়োজনের অভাবে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি, গাইড-কোচিং নির্ভরতা কমানোর পরিবর্তে অনেকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। কোমলমতি শিশুদের জন্য অযৌক্তিক পাবলিক পরিক্ষা চালুর ফলে স্কুলেই এখন কোচিং বিস্তৃত হয়েছে। এভাবেই ঘটছে শিক্ষাক্ষেত্রে অস্বাভাবিক ব্যয়বৃদ্ধি। শিশুদের এখন আর আনন্দময় শৈশব নেই। পাসের হার বাড়িয়ে কৃতিত্ব জাহিরের প্রেক্ষাপটে প্রশ্নফাঁস, নম্বর বাড়িয়ে দেয়া সহ নানা দুর্নীতিই উৎসাহিত হয়েছে। গোটা শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনার ধরণ ও লক্ষ্য যখন সার্টিফিকেট অর্জন হয়ে দাঁড়ায়, তখন শিক্ষিত মানুষরা সমাজে আলো ছড়ানোর পরিবর্তে দুর্নীতি ও স্বার্থপরতার পঙ্কে নিমজ্জিত হয়। এমনটাইতো দেখা যাচ্ছে সমাজে। এভাবে দেশের ভবিষ্যত বিপন্ন হবে, আর ছাত্রসমাজ চেয়ে চেয়ে দেখবে- এ হতে পারে না। ’৫২, ’৬২, ’৭১, ’৯০- এর গর্বিত উত্তরাধিকারী হিসেবে নতুন সময়ের প্রয়োজনকে ধারণ করতে হবে।
বক্তারা, শিক্ষা সর্বস্তরে শিক্ষাব্যয় বৃদ্ধির বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনে সামিল হতে ছাত্রসমাজ সহ সর্বস্তরের মানুষের প্রতি আহবান জানান। সমাবেশ শেষে একটি সুসজ্জিত মিছিল শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে।