বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠন, পরিবেশ ও বন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং সর্বোপরি দেশের জনগণের সবরকম মতামত উপেক্ষা করে, হাজার হাজার পরিবারকে উচ্ছেদ করে, আবাদযোগ্য কৃষি জমি ধ্বংস করে একতরফাভাবে, গায়ের জোরে সরকার রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে যাচ্ছে। দেশের ভবিষ্যৎ ভয়াবহ সংকট চিন্তা করে গণতান্ত্রিক বামমোর্চা ১৬-১৮ অক্টোবর ঢাকা থেকে সুন্দরবন অভিমুখে রোডমার্চের ঘোষণা দেয়। সম্পূর্ণ দেশের স্বার্থের সাথে জড়িত একটি বিষয়ে গণতান্ত্রিক প্রচার-প্রচারণা ও জনমত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত রোডমার্চে পুলিশ পদে পদে হামলা চালিয়ে, নেতা-কর্মীদের আহত করে, রোডমার্চকে পথে খাবার খাওয়ার জন্যও বাস থেকে নামতে না দিয়ে, পুরো রোডমার্চকারীদের এমনকি মেয়েদেরও বাথরুমে পর্যন্ত যেতে না দিয়ে বাসে আটকে রেখে দমন-পীড়নের এক নজিরবিহীন উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।
রোডমার্চকারীদের একটাই উদ্দেশ্য ছিল, তা হলো রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভয়াবহতা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা এবং এর বিরুদ্ধে জনসচেতনতা গড়ে তোলা। সেই উদ্দেশ্যের বাইরে কোনো কিছু তারা করেন নি। কিন্তু সেই গণতান্ত্রিক কর্মসূচিও রাষ্ট্র গায়ের জোরে দমন করতে চাইলো।
যে সকল বুদ্ধিজীবী গণতন্ত্রের কথা বলেন, কোন হামলায় কতখানি গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্থ হলো তার হিসেব করেন, তারা এর কী জবাব দেবেন। মাগুরা থেকে রওয়ানা দেয়া বাস ঝিনাইদহে থামতে দেয়া হয়নি, যশোরে থামতে দেয়া হয়নি। যশোরে নেতৃবৃন্দ একটু নেমেছিলেন, সাথে সাথে পিস্তল ও হকিস্টিকে সজ্জিত পুলিশ তাদের ঘেরাও করে বাসে তুলে দেয়। পথে কয়েকজন নারী কর্মী বাথরুম-টয়লেটে যেতে চাইলে তেড়ে আসে পুলিশ, ‘যা করার সুন্দরবন গিয়ে কর, এখানে না’। এমন সীমাহীন নিষ্ঠুর আচরণ আগে কেউ প্রত্যক্ষ করেছেন? লাঠি, জেল, গুলি দেখেছেন, কিন্তু এরকম কান্ড দেখেছেন? যারা এখনও এ সরকারের কোন আচরণ গণতান্ত্রিক আর কোনটা নয়; মিডিয়াতে, টক শোতে এই বাহাস করে বাহবা কুড়াচ্ছেন, আপনাদের কবে সম্বিৎ ফিরবে? চরম ফ্যাসিবাদী দমন-নিপীড়ন চলছে, এই সময়ে আন্দোলন ছাড়া আবার গণতন্ত্র কথাটির অর্থ কী? আন্দোলনবিহীন গণতন্ত্রের কথা এখন যারা বলেন তারা সবাই নিরীহ ভদ্রলোকের ছদ্মবেশে বিষধর সাপ মাত্র। সুন্দর কথা বলে, শুদ্ধ সমালোচনার আড়ালে এ ফ্যাসিস্ট সরকারের টিকে থাকার ভাবগত জমিন তারাই তৈরি করছেন।
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত জনগণের সমর্থন নিয়ে সমস্ত বাধা অতিক্রম করে এগিয়েছে রোডমার্চ। ১৮ অক্টোবর বাগেরহাটের কাটাখালিতে সমাপনী সমাবেশের মধ্য দিয়ে রোডমার্চ শেষ হয়।
পদে পদে বাঁধা অতিক্রম করে এগিয়ে গেছে রোডমার্চ। ১৬ অক্টোবর সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে উদ্বোধনী সমাবেশ শুরু হয়। এদিন সকাল থেকেই একে একে মোর্চার শরিক পার্টিগুলো মিছিল সহকারে জড়ো হতে থাকে প্রেসক্লাবের সামনের রাজপথে। শিক্ষক-শিক্ষাবিদ-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীরাও অনেকেই উপস্থিত হয়েছিলেন সংহতি জানিয়ে। উপস্থিত হয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ ও বিশিষ্ট সাংবাদিক গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ।
উদ্বোধনী সমাবেশে বাসদ (মার্কসবাদী)-র সাধারণ সম্পাদক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী বলেন, “আজ এমন এক সময় আমরা মিলিত হয়েছি যখন দেশ সমস্ত দিকে স্তব্ধ হয়ে আছে। দেশে সত্যিকারের কোনো গণআন্দোলন নেই। এই সময়ে গণতান্ত্রিক বামমোর্চা, দেশের বামপন্থীদের যতখানি শক্তি আছে, তাকে ঐক্যবদ্ধ করে জনগণের কাছে আবেদন করছে সুন্দরবন ধ্বংসকারী এই ভয়ঙ্কর সমস্যাকে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য। ভারতীয় সা¤্রাজ্যবাদের সাথে বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট সরকার Ñ এই দুই আগ্রাসী শক্তি মিলে দেশ ও দেশের সম্পদ ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। এর বিরুদ্ধে সত্যিকারের যারা সংগ্রামী শক্তি, তারাই আমরা একত্রিত হয়েছি। সরকারের সাথে যে বামপন্থীরা আছেন তাদের সাধ্যই নেই এই আন্দোলন করার। এই জোর নিয়ে আমরা এগোতে থাকি, আমরা যাতে এই আন্দোলনকে প্রতিরোধের আন্দোলনে নিয়ে যেতে পারি।”
অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন নান্নু, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আহ্বায়ক হামিদুল হক, বাসদ(মাহবুব)-এর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ইয়াছিন মিয়া। মোর্চার সমন্বয়ক বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক রোডমার্চের উদ্বোধন ঘোষণা করে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী পরিবেশ রক্ষায় অবদানের জন্য একদিকে চ্যাম্পিয়ন অব দ্যা আর্থ পুরস্কার গ্রহণ করছেন অন্যদিকে রামপালে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র করে সুন্দরবন ধ্বংসের আয়োজন করছেন। সুন্দরবন ধ্বংস হলে শুধু দক্ষিণাঞ্চলই নয়, সুন্দরবনের জীব বৈচিত্র্যই নয়, গোটা বাংলাদেশের প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংসের মুখে পড়বে। তাই দেশের প্রাণ-প্রকৃতিকে রক্ষায় সুন্দরবনকে আমাদের বাঁচাতে হবে। এই অঙ্গীকারেই বাম মোর্চার রোডমার্চ।”
উদ্বোধন শেষে একটি মিছিল রাজধানীর রাজপথ প্রদক্ষিণ করে। মুহুর্মুহু স্লোগানে ঢাকার আকাশ প্রকম্পিত করে হাইকোর্ট, শাহবাগ, সায়েন্সল্যাব হয়ে কলাবাগানে গিয়ে মিছিলটি শেষ হয়। যাত্রা করে মানিকঞ্জ অভিমুখে। মানিকগঞ্জে দুপুরের খাবার গ্রহণের পর শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের সমাবেশ স্থলে গিয়ে মোর্চার নেতা-কর্মীরা হতবাক। পুলিশ ব্যানার ছিঁড়ে ফেলেছে। মাইক-চেয়ার সরিয়ে ফেলেছে। প্যান্ডেলটিও খুলে ফেলছে। সমাবেশের অনুমতি দিয়েও সমাবেশ করতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত বর্তমান অনির্বাচিত অগণতান্ত্রিক সরকারের স্বৈরাচারী চরিত্রেরই বহিঃপ্রকাশ। সমাবেশ করতে না দেয়ায় মোর্চার নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান নেন মিছিল করে পরবর্তী গন্তব্যের দিকে রওয়ানা দেবে রোডমার্চ। তাতেও পুলিশ বাধা দিল Ñ মিছিলও করতে দেবে না। এই বাধার মুখেও মিছিল নিয়ে সামনে এগোতে চাইলে অতর্কিতে বেধড়ক লাঠিচার্জ করে, বন্দুকের বাঁট দিয়ে আঘাত করে মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। হামলায় গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, বাসদ (মার্কসবাদী)-র কেন্দ্রীয় কার্য পরিচালনা কমিটির সদস্য কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী ও ফখরুদ্দিন কবির আতিকসহ ২০-২৫ জন নেতা-কর্মী আহত হন। বেপরোয়া পুলিশ পাশের মাঠে ঢুকে আবার হামলা করতে উদ্যত হলে বাসদ (মার্কসবাদী)-র নেতাকর্মীরা সহ রোডমার্চকারীরা সংগঠিত হয়ে এবার পুলিশকে প্রতিরোধ করে। প্রতিরোধের মুখে পুলিশ কিছুটা পিছু হটে। তারপর মিছিল সহকারে ঢাকা বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে সেখান থেকে বাসে গোয়ালন্দের দিকে রওয়ানা দেয় রোডমার্চ। শান্তিপূর্ণ রোডমার্চে পুলিশের এই ন্যাক্কারজনক ভূমিকা রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ফ্যাসিবাদী চরিত্রকে আরেকবার উন্মোচিত করেছে।
যে দেশে প্রধানমন্ত্রী পরিবেশ রক্ষায় চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ পুরস্কার পান, সেখানে সুন্দরবনের মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সম্পদের আধার, যাকে দেশের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ হিসেবে অভিহিত করা হয় তাকে রক্ষার দাবিতে আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশ দিয়ে হামলা যেন এই পুরস্কারকেই ব্যঙ্গ করছে। ভূমিদস্যুরা এদেশের নদী-খাল দখল করছে, বন দখল করছে সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না, অথচ যারা পরিবেশ রক্ষায় কাজ করছে উল্টো পুলিশি হামলা করে তাদের জীবন বিপন্ন করছে। এটাই প্রমাণ করে দেশের স্বার্থ রক্ষা নয়, পরিবেশ রক্ষা নয় — সরকার স্বার্থ রক্ষা করছে ভূমিখেকো পুঁজিপতিদের, মালিকদের।
এই পুঁজিপতিরাই তো দেশ পরিচালনা করছে। দেশের সম্পদ লুটে নিচ্ছে। প্রাকৃতিক গ্যাস-কয়লা লুটে নেয়ার জন্য নানা উপায় বের করছে, নিজেদের সহযোগী হিসেবে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে ডেকে আনছে। তারাই আজ মুনাফার অদম্য লালসায় গোটা বিশ্বের ঐতিহ্য, বিরল প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যের আধার, লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকার উৎস সুন্দরবনকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে। মানুষের জীবনের মূল্য যে শাসকদের কাছে নেই, প্রকৃতি-পরিবেশের কী মূল্য এদের কাছে আছে? মানুষের জীবন, শ্রম ও প্রকৃতির সম্পদ সবই এদের কাছে মুনাফার উপায় মাত্র। এই মুনাফা অর্জনের পথ নিষ্কণ্টক করতেই এদেশের একচেটিয়া পুঁজিপতিগোষ্ঠী একটা স্বৈরতান্ত্রিক সরকারকে গদিতে আসীন করেছে, সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকারকে সংকুচিত করছে। তাই এই রোডমার্চ শুধু সুন্দরবন রক্ষা নয়, মানুষের জীবন রক্ষাকারী প্রকৃতি যে লুটেরা শাসকদের হাতে বিপন্ন তাদের কবল থেকে দেশ, দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের অংশ। রোডমার্চে পুলিশি হামলা এই চেতনাকে আরো শাণিত করে।
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে এক নির্মাণাধীন ভবনে রাত্রিযাপন শেষে পরদিন সকাল ৯টায় রোডমার্চ যাত্রা শুরু করে। এখানেও মিছিলে পুলিশি বাধা আসে। সেই বাধা উপেক্ষা করে মাগুরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয় রোডমার্চ। মাগুরায় প্রবেশের পথে গড়াই ব্রিজের পাশে দাঁড়িয়ে বাসদ (মার্কসবাদী)-র স্থানীয় কর্মীরা রোডমার্চকে স্বাগত জানায়। বাস থেকে নেমে একটু অগ্রসর হতেই মিছিল আবার পুলিশি বাধার মুখে পড়ে মিছিলটি। নেতা-কর্মীদের সাথে বাক-বিতন্ডা শুরু হয় — কিছুতেই মিছিল করতে দেবে না। আগের দিনের অভিজ্ঞতায় রোডমার্চকারীদের মনোবল দৃঢ়, পথ না ছাড়ার শপথ — ফলে কিছুতেই পুলিশ টলাতে পারছিল না। একপর্যায়ে পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করে। এতে মোর্চার সমন্বয়ক কমরেড সাইফুল হক সহ ১৮/২০ জন নেতা-কর্মী আহত হন। উপর্যুপুরি পুলিশের এহেন ভূমিকায় ক্ষুব্ধ, দৃঢ়চিত্ত রোডমার্চকারীরা কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে যায় — পুলিশের হামলা ও বাধাকে উপেক্ষা করে মিছিল নিয়ে ঢাকা মোড় থেকে ভায়না মোড় পর্যন্ত যায়। কিন্তু পূর্ব নির্ধারিত সমাবেশ না করেই ঝিনাইদহের দিকে রওয়ানা দিতে হয়।
রোডমার্চের গাড়িবহর মাগুরা থেকে চলা শুরু করতেই দেখা যায় পুলিশের পিকআপ ভ্যান পিছু নিয়েছে। সাম্যবাদ বুলেটিন বিক্রির জন্য একটি অগ্রগামী টিম গিয়েছিল ঝিনাইদহে। পুলিশ তাদের পত্রিকা বিক্রি করতে বাধা দেয় এবং জোর করে ঝিনাইদহ থেকে মাগুরা গামী যাত্রীবাহী বাসে তুলে দেয়। পথে তারা রোডমার্চের বহরে যোগ দেয় এবং তাদের কাছ থেকেই জানা গেল যে শহরে প্রবেশমুখে শত শত পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশ রোডমার্চ শহরে ঢুকতে দেবে না।
ঝিনাইদহে দুপুরের খাবার ও পায়রা চত্বরে বিকেলের সমাবেশ পূর্ব নির্ধারিত। কিন্তু ঝিনাইদহের সীমানায় ঢুকতেই দেখা গেল দাঙ্গা পুলিশে সয়লাব। রাস্তার মোড়ে মোড়ে হকিস্টিক, লাঠি, বন্দুক হাতে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। এক ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করেছে। বাস থেকে নামা তো দূরের কথা গাড়িগুলোকে এক মিনিটের বেশি দাঁড়াতেও দেয়নি। গাড়ির দরজা খোলা থাকায় অশ্র্রাব্য গালিগালাজ শুরু করল। শ’পাঁচেক মানুষকে অভুক্ত আর পিপাসার্ত রেখে গাড়ি বহর পাঠিয়ে দিল যশোরের দিকে। সভা-সমাবেশ করা নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। সমাবেশ করতে না দিয়ে সরকার সুস্পষ্টভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করেছে। অথচ সংবিধান রক্ষার কথা বলে, গণতন্ত্রের কথা বলে সরকার ক্ষমতায় আসীন হয়েছে — এই কি সংবিধান রক্ষা ও গণতন্ত্রের নমুনা? সমাবেশ করার সাংবিধানিক অধিকার তো হরন করেছেই এমনকি খাবার খাওয়া, বাথরুমে যাওয়া কিছুই করতে দেয়া হয়নি।
গাড়ি বহরের সামনে পেছনে পুলিশের পিকআপভ্যান কার্যত রোডমার্চকে কর্ডন করে যশোরের দিকে নিয়ে যায়। যশোরে টাউন হলে ছিল পূর্ব নির্ধারিত জনসভা ও রাত্রিযাপন। কিন্তু এখানে শহরেই ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। পালবাড়ি মোড়ে রাস্তার উপর সারভর্তি ট্রাক রেখে ব্যারিকেড দিয়ে গাড়ি বহর খুলনার দিকে পাঠিয়ে দেয়। যশোর শহরে ঢোকার প্রতিটি প্রবেশমুখে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করে রাখে। যে রোড ধরে গাড়ি বহর এগোচ্ছিল চারদিকে জনতার সন্ত্রস্ত চোখ। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সময়ে কিংবা নব্বইয়ে সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের আমলেও এমন বল প্রয়োগ ও অধিকার হরনের দৃষ্টান্ত দেখে নি কেউ। সমস্ত দিক থেকে আওয়ামী লীগ অতীতের ফ্যাসিবাদী সরকারগুলোর কর্মকা-কে হার মানিয়েছে। ফ্যাসিবাদী শাসন যে মানুষের মানবিকতাকে ধ্বংস করে, মনুষ্যত্বকে নষ্ট করে — তার চূড়ান্ত উদাহরণ পুলিশের এই নিষ্ঠুর আচরণে প্রকাশ পেয়েছে। যুদ্ধবন্দিদের সাথেও এমন আচরণ করা হয় কিনা সন্দেহ।
এরপর রোডমার্চ যাত্রা করে অজানার উদ্দেশ্যে। দুপুরে খাওয়া হয়নি, রাত্রে জুটবে কিনা নিশ্চয়তা নেই। খুলনায় প্রবেশ করতে দেবে কিনা, রাত্রিযাপন কোথায় হবে — এতোসব অনিশ্চয়তার মধ্যেই খুলনা শহরে প্রবেশ করে রোডমার্চ। জোড়াগেটের সিএমভি কলোনির হলে রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা হয়। যশোর থেকে আনা হয় রাতের খাবার।
পরদিন দুপুরে সেখান থেকে মিছিল করে খুলনার শহীদ পার্কে সমাবেশে মিলিত হয় রোডমার্চ। মোস্তফা খালিদ খসরুর সভাপতিত্বে এ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন মোশাররফ হোসেন নান্নু, জোনায়েদ সাকী, মোশরেফা মিশু, শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী, ইয়াসিন মিয়া, হামিদুল হক, এড. বিপ্লব কান্তি মন্ডল। রোডমার্চের ঘোষণা পাঠ করেন সাইফুল হক।
অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এবার সমাপনী সমাবেশের পালা। গন্তব্য বাগেরহাটের কাটাখালি মোড়। এখানেও দেখা গেল পুলিশের তৎপরতা। কিন্তু স্থানীয় জনগণের দৃঢ়তার কারণে সমাবেশ প- করার সাহস পায়নি। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে শুরু হয় সমাপনী সমাবেশ। রণজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন সাইফুল হক, জোনায়েদ সাকী, মোশরেফা মিশু, আব্দুস সাত্তার, হামিদুল হক, শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী।
কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী বলেন, রামপাল কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভয়াবহতা সম্পর্কে নতুন করে বলবার কিছু নেই। সমগ্র সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে। দক্ষিণাঞ্চলের প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। দেশের পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। এ আমরা কিছুতেই হতে দিতে পারি না।
তিনি বলেন, অনেকে প্রশ্ন করেন, আপনারা বামপন্থীরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করছেন না কেন? আপনারা সবাই আলাদা আলাদা কেন? আমরা আপনাদের এই আকুতিকে সম্মান করি। আপনারা আন্দোলন চান, লড়াই চান। আর সে কারণেই আমরা বলি, আপনারা কি আমাদের এমন কোনো ঐক্যের মধ্যে যেতে বলবেন যে ঐক্য আন্দোলনকে ভেতর থেকে ধ্বংস করে দেবে? বাংলাদেশে এখন বামপন্থী নামধারী কেউ কেউ আওয়ামী মহাজোট সরকারের শরিক। ফলে যারা সরকারের শরিক হয়ে জনগণকে শোষণ করার পাহারাদার হয়েছে, জনগণের সম্পদ লুটের পাহারাদার হয়েছে, দেশের বুকে একটা ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েমের শরিক হয়েছে — তাদের সাথে নিয়ে কীভাবে আন্দোলন করা সম্ভব? আমাদের কথা অত্যন্ত স্পষ্ট। আমরা আন্দোলন চাই, আন্দোলনের জন্য ঐক্য চাই। ঐক্যের কথা বলে আন্দোলনকে ধ্বংস করতে দিতে পারি না।
রোডমার্চের পথে পথে ছিল জনগণের আবেগভরা সমর্থন। যশোর সীমান্ত পেরিয়ে ফুলতলার এক বাজারেএকজন বৃদ্ধ নিজের যৌবনের দিনগুলোর কথা মনে করে বললেন, “আমারও ইচ্ছে করছে আপনাদের মত পথে নেমে পড়ি।” ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিতে সেই যে মহান সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, “বয়স কখনও কাউকে দেশের ডাক থেকে বিরত রাখতে পারে না।” রোডমার্চে এই কথাগুলোর গভীরতা সত্যতা আরো নিঃসংশয় হল। খুলনার হাদিস পার্কে সমাবেশ শেষে এগিয়ে আসে এক বালক — কতোইবা বয়স হবে, ১২/১৩, সবে ক্লাস সেভেনে পড়ে Ñ তারও আকুতি জেগেছে, “কথাগুলো আমার ভালো লেগেছে। আমিও কিছু করতে চাই।”
আন্দোলন কিশোর যুবক-বৃদ্ধ নির্বিশেষ সকলের মনকে আন্দোলিত করে। পথে নেমে পড়ার ডাক দিয়ে যায়, নিজস্ব ব্যক্তিগত স্বার্থের গন্ডি থেকে বেরিয়ে দেশের জন্য কিছু করতে উদ্বুদ্ধ করে। এভাবেই পথে পথে জনগণের মধ্যে জাগরণের ঢেউ তুলে, সদ্যপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রীর চ্যাম্পিয়ন অব দ্যা আর্থ পুরস্কারের মুখোশ উন্মোচন করেছে তিনদিনের রোড মার্চ।