Saturday, December 21, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - জানুয়ারি ২০১৬রাষ্ট্র ও বিপ্লব — ভি. আই. লেনিন

রাষ্ট্র ও বিপ্লব — ভি. আই. লেনিন

প্রথম রুশ সংস্করণের ভূমিকা
তত্ত্বের ক্ষেত্রে ব্যবহারিক রাজনীতির ক্ষেত্রে, উভয়তই রাষ্ট্রের প্রশ্ন বর্তমানে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হইয়া উঠিতেছে। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের ফলে একচেটিয়া পুঁজিতন্ত্র অধিকতর দ্রুত ও তীব্র বেগে রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া পুঁজিতন্ত্রে রূপান্তর লাভ করিতেছে। সর্বশক্তিমান পুঁজিদার সঙ্ঘগুলির সহিত রাষ্ট্রশক্তি ক্রমশই অধিকতর ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত হইয়া পড়িতেছে; মেহনতী জনগণের উপর এই রাষ্ট্রশক্তি কর্তৃক বীভৎস উৎপীড়ন ক্রমশই আরও বীভৎস হইয়া উঠিতেছে। উন্নত দেশগুলি — এখানে আমরা দেশের ভিতরকার কথা বলিতেছি — মজুরদের কারাগারে পরিণত হইতেছে, যেখানে তাহাদের সামরিক বন্দীর ন্যায় পরিশ্রম করিতে হয়। দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের অভূতপূর্ব দুর্দশা ও বিভীষিকার ফলে জনগণের অবস্থা অসহনীয় হইয়া উঠিতেছে, এবং তাহাদের বিক্ষোভ ক্রমেই বাড়িয়া যাইতেছে। একটা আন্তর্জাতিক মজুর-বিপ্লব স্পষ্টতই পাকাইয়া উঠিতেছে। রাষ্ট্রের সহিত এই বিপ্লবের কী সম্পর্ক, সেই প্রশ্নও তাই ব্যবহারিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হইয়া উঠিতেছে।

অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ বিকাশের যুগে সুবিধাবাদের উপাদানগুলি একসঙ্গে জোড়া হইবার ফলে, সারা দুনিয়ার সরকারী সোসালিস্ট দলগুলির মধ্যে সোসাল-শভিনিস্ট* প্রবণতা দেখা দিয়াছে। এই প্রবণতা — মুখে সমাজতন্ত্র আর কাজে জাতীয়তাবাদ — (রাশিয়াতে প্লেখানভ, পোত্রেসভ, ব্রেশকোভস্কায়া, রুবানোভিচ এবং সামান্য প্রচ্ছন্নভাবে ৎসেরেতেলি, চের্নভ প্রভৃতি; জার্মানিতে শাইদেমান, লেগীন, ডেভিড প্রভৃতি; ফ্রান্স ও বেলজিয়ামে রেনোদেল, গেদ, ভান্দেরভেলদে; ইংল্যান্ডে হাইন্ডমান ও ফেবিয়ানরা ইত্যাদি ইত্যাদি)।

সমাজতন্ত্রের এই নেতাদের এই যে প্রবণতা মূর্ত হইয়া উঠিতেছে, তাহার বিশিষ্ট লক্ষণ হইল এই যে, ইহারা শুধু ‘তাহাদের’ জাতীয় বুর্জোয়াশ্রেণীর স্বার্থের সহিতই নয়, ‘তাহাদের’ রাষ্ট্রের স্বার্থের সহিতও হীনভাবে গোলামের মতো নিজেদের খাপ খাওয়াইয়া লইয়াছে; কারণ তথাকথিত বৃহৎ শক্তিগুলির অধিকাংশই দীর্ঘকাল যাবৎ কতকগুলি ক্ষুদ্র ও দুর্বল জাতিকে শোষণ করিতেছে এবং দাসত্বের শৃঙ্খলে বাঁধিয়া রাখিয়াছে। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ এই ধরনের লুটের মাল ভাগাভাগির যুদ্ধ। সাধারণভাবে বুর্জোয়াশ্রেণীর, বিশেষভাবে সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়াশ্রেণীর প্রভাব হইতে মেহনতী জনগণের মুক্তির সংগ্রাম রাষ্ট্র সম্পর্কে সুবিধাবাদিসুলভ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ব্যতীত অসম্ভব।

প্রথমে রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কস ও এঙ্গেলসের শিক্ষা আলোচনা করিব; তাঁহাদের শিক্ষার যে সব দিক সুবিধাবাদীরা বিকৃত করিয়াছে অথবা আমরা বিস্মৃত হইয়াছি, বিশেষভাবে সেই সব দিকের পূর্ণ আলোচনা আমরা করিব। তারপর, যাহারা মার্কস ও এঙ্গেলসের শিক্ষা বিকৃত করিয়াছে, তাহাদের মুখ্য প্রতিনিধি কার্ল কাউটস্কির মতামত বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করিব; দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের (১৮৮৯-১৯১৪) নেতা রূপে সর্বাপেক্ষা সুপরিচিত এই কার্ল কাউটস্কি বর্তমান যুদ্ধের সময় অতি-করুণ রাজনৈতিক দেউলিয়া মনোভাবের পরিচয় দিয়াছেন। সর্বশেষে প্রধানত ১৯০৫ সালের বিশেষত ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের অভিজ্ঞতা সংক্ষেপে আলোচনা করিব। বিপ্লবের বিকাশের প্রথম স্তর (১৯১৭ সালের আগস্ট মাসের প্রারম্ভে) স্পষ্টতই সম্পূর্ণ হইতেছে; কিন্তু সাধারণভাবে ইহাই বলিতে হয় যে, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের ফলে যে সব সমাজতান্ত্রিক মজুর-বিপ্লব ঘটিতে যাইতেছে, এই বিপ্লবকে সেই বিপ্লব-শৃঙ্খলের একটি গ্রন্থিরূপে বিচার করিলেই ইহার সমগ্রতা উপলব্ধি করা যাইতে পারে; সুতরাং রাষ্ট্রের সহিত সমাজতান্ত্রিক মজুর-বিপ্লবের সম্পর্ক কী, এই প্রশ্ন যে কেবল ব্যবহারিক রাজনীতির ক্ষেত্রেই গুরুত্ব লাভ করিয়াছে, তাহাই নয়, আজিকার দিনের এক জরুরী সমস্যা হিসাবেও প্রশ্নটি গুরুত্ব লাভ করিয়াছে; অদূর ভবিষ্যতেই পুঁজিতন্ত্রের জোয়াল হইতে মুক্তি লাভের জন্য জনগণকে কী করিতে হইবে, আজিকার দিনের জরুরী সমস্যা হইল জনগণের নিকট সেই কর্তব্য ব্যাখ্যা করিয়া বলা।

ভ. ই. লেনিন
আগস্ট, ১৯১৭

প্রথম অধ্যায়

শ্রেণী-বিভক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র

১। রাষ্ট্র শ্রেণী বিরোধ সমাধানের অসম্ভাব্যতার ফল
বর্তমানকালে মার্কসের মতবাদের ক্ষেত্রে যাহা ঘটিতেছে, মুক্তিসংগ্রামরত নিপীড়িত শ্রেণীদের অন্যান্য চিন্তানায়ক ও নেতাদের মতবাদের ক্ষেত্রেও ইতিহাসের গতিপথে প্রায়শ তাহা-ই ঘটিয়াছে। মহান বিপ্লবীদের জীবদ্দশায় উৎপীড়ক শ্রেণীরা নির্মমভাবে তাঁহাদের নির্যাতন করে, তাঁহাদের শিক্ষার প্রতি বিদ্বেষ-দুষ্ট বৈরিতা ও হিংস্র ঘৃণা প্রকাশ করে এবং নির্বিচারে তাঁহাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও কুৎসার অভিযান চালায়। মৃত্যুর পরে এইসব বিপ্লবীকে নিরীহ দেব-বিগ্রহে পরিণত করিবার, সাধু সিদ্ধপুরুষরূপে গণ্য করিবার চেষ্টা হইয়া থাকে; নিপীড়িত শ্রেণীদের ‘সান্ত্বনা’র জন্য এবং তাহাদের প্রতারণার উদ্দেশ্যে এই-সব বিপ্লবীর নামের সহিত একটা জৌলুস জুড়িয়া দেওয়া হয়; সেই-সঙ্গে তাঁহাদের বৈপ্লবিক মতবাদের মর্মবস্তুকে ছাঁটিয়া দিয়া তাহাকে নিবীর্য খেলো করা হয়, তাহার বৈপ্লবিক তীক্ষ্নতা ভোঁতা করিয়া দেওয়া হয়। বর্তমানকালে বুর্জোয়ারা এবং মজুর আন্দোলনের অন্তর্গত সুবিধাবাদীরা মার্কসবাদ ‘সংশোধনে’র কাজে পরস্পরের সহিত সহযোগিতা করিতেছে। তাহারা মার্কসীয় শিক্ষার বৈপ্লবিক মর্মকেই পরিহার করে, মুছিয়া ফেলে ও বিকৃত করে। বুর্জোয়াশ্রেণীর নিকট যতটুকু গ্রহণযোগ্য হইতে পারে বলিয়া বোধ হয়, ততটুকুই মাত্র ইহারা প্রকাশ্যে তুলিয়া ধরে ও জোর গলায় তাহার প্রশংসা করে। সব সোসাল—শভিনিস্টই* আজকাল মার্কসবাদী — ঠাট্টা নয়! জার্মানির বুর্জোয়া অধ্যাপকেরা যাঁহারা মাত্র গতকালও মার্কসবাদ উচ্ছেদের কাজে পারদর্শী ছিলেন, তাঁহারাই আজকাল ‘জাতীয় জার্মান’ মার্কসের কথা ঘন ঘন বলিতেছেন; আর যে মজুর-ইউনিয়নগুলিকে একটা পররাজ্যগ্রাসী যুদ্ধ পরিচালনার স্বার্থে চমৎকার সংগঠিত দেখা যাইতেছে, তাঁহাদের মতে, মার্কস-ই নাকি মজুর-ইউনিয়নগুলিকে শিক্ষিত করিয়া তুলিয়াছেন!

এই রকম অবস্থায় যখন ব্যাপকভাবে মার্কসবাদের বিকৃতি চলিতেছে, তখন রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসের প্রকৃত শিক্ষা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই আমাদের প্রথম কর্তব্য। এই জন্য মার্কস ও এঙ্গেলসের রচনা হইতে বহু দীর্ঘ উদ্ধৃতির প্রয়োজন হইবে। অবশ্য দীর্ঘ উদ্ধৃতির ফলে গ্রন্থ ভারাক্রান্ত হইয়া উঠিবে, এবং সাধারণের পক্ষে সহজপাঠ্য হইবে না; কিন্তু তথাপি দীর্ঘ উদ্ধৃতি বর্জন করাও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদের (অর্থাৎ দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দর্শনের — স.) উদ্ভাবকদের সমগ্র মতামত ও সেই মতামতের ক্রমবিকাশ সম্পর্কে পাঠক যাহাতে স্বাধীনভাবে একটা ধারণা গঠন করতে পারেন, এবং বর্তমান কাউটস্কিপন্থীদের হাতে সেই-সব মতামতের যে বিকৃতি ঘটিতেছে কাগজে-কলমে তাহা যাহাতে সর্বসমক্ষে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় সেই জন্য মার্কস ও এঙ্গেলসের রচনায় রাষ্ট্রের কথা যেখানে আছে সেই সমস্ত অংশ-ই, অন্তত সর্বাপেক্ষা সার অংশগুলি যথাসম্ভব পুরোপুরি অবশ্যই উদ্ধৃত করিতে হইবে।

‘পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ নামক এঙ্গেলসের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় গ্রন্থ লইয়াই শুরু করা যাক; ১৮৯৪ সালে স্টুটগার্টে এই গ্রন্থের ষষ্ঠ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। মূল জার্মান ভাষা হইতে উদ্ধৃত অংশ তরজমা করিয়া লইতে হইবে; কারণ রুশ ভাষায় এই গ্রন্থের বহু তরজমা থাকিলেও, অধিকাংশ স্থলেই সে- সব তরজমা অসম্পূর্ণ, অথবা আদৌ সন্তোষজনক নয়।

এঙ্গেলস তাঁহার ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের সংক্ষিপ্তসার দিতে গিয়া বলিয়াছেন :
“অতএব রাষ্ট্র বাহির হইতে সমাজের উপর আরোপিত একটি শক্তি কোনও ক্রমেই নয়; হেগেল বলিতেন, রাষ্ট্র ‘নৈতিক বোধের বাস্তব রূপ’, রাষ্ট্র ‘যুক্তির প্রতিমূর্তি ও বাস্তব রূপ’; কিন্তু রাষ্ট্র তেমন কিছু নয়, বরং বিকাশের বিশেষ কোনও স্তরেই রাষ্ট্রের উদ্ভব। সমাজে রাষ্ট্রের উদ্ভব হইয়াছে মানেই সমাজ সমাধানের অতীত একটা স্ববিরোধিতার জালে জড়াইয়া পড়িয়াছে; ইহার অর্থ, মীমাংসার অতীত এক দ্বন্দ্বে সমাজ দীর্ণ, যে দ্বন্দ্ব নিরাকরণে সমাজ অক্ষম। বিভিন্ন শ্রেণী, যাহাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ পরস্পর বিরোধী, তাহারাই হইতেছে সমাজের এই অর্ন্তদ্বন্দ্ব; এই দ্বন্দ্বরত শ্রেণীগুলি যাহাতে নিষ্ফল সংগ্রামে নিজেদের ও গোটা সমাজকেই ধ্বংস করিয়া ফেলিতে না পারে, তাহারই জন্য এমন একটি শক্তির প্রয়োজন ঘটে যাহাকে আপাতদৃষ্টিতে সমাজের ঊর্ধ্বে অবস্থিত বলিয়া প্রতীয়মান হয়; শ্রেণী-সংঘাতকে প্রশমিত করিয়া ‘শৃঙ্খলা’র গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ করিয়া রাখাই হইল যাহার উদ্দেশ্য; এই শক্তি সমাজ হইতে উদ্ভূত হইয়াও নিজেকে সমাজের উর্ধ্বে স্থাপন করে এবং ক্রমশ সমাজ হইতে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করিয়া নেয়; এই শক্তি-ই হইতেছে রাষ্ট্র।”(পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি, পৃ: ১৭৭-৭৮, ষষ্ঠ জার্মান সংস্করণ)

রাষ্ট্রের অর্থ ও ঐতিহাসিক ভূমিকা কী, সে-সম্পর্কে মার্কসীয় তত্ত্বের মূল ধারণা উদ্ধৃত অংশের মধ্যে বিশদভাবে প্রকাশ পাইয়াছে। রাষ্ট্র হইতেছে শ্রেণী-বিরোধ সমাধানের অসম্ভবপরতার ফল ও অভিব্যক্তি। যখন যেখানে ও যে-অনুপাতে শ্রেণী- বিরোধ বাস্তবে সমাধান করিতে পারা যায় না তখন সেই অবস্থায় ও সেই অনুপাতে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। অপর দিক হইতে ইহাও বলা চলে যে, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব-ই প্রমাণ করে যে, শ্রেণী-বিরোধ মীমাংসার অতীত। ঠিক এই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও মূল বিষয়টির ব্যাপারেই মার্কসবাদকে বিকৃত করা হয়, বিকৃত করা হয় প্রধানত দুই দিক হইতে।

একদিকে, বুর্জোয়া তত্ত্ব-প্রবক্তারা, বিশেষভাবে খুদে-বুর্জোয়া তত্ত্ব-প্রবক্তারা, যেখানে শ্রেণী-বিরোধ ও শ্রেণী-সংগ্রাম আছে কেবল সেখানেই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিদ্যমান, অবিসংবাদিত তথ্যের চাপে ইহা স্বীকার করিতে বাধ্য হইলেও তাহারা মার্কসকে এমনভাবে ‘শোধন’ করে যাহাতে মনে হইবে যে, রাষ্ট্র হইল বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে আপস-নিষ্পত্তি ঘটাইবার একটি যন্ত্র বিশেষ। মার্কসের মতে বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে আপস-নিষ্পত্তি যদি সম্ভব-ই হইত, তাহা হইলে রাষ্ট্রের উদ্ভবই হইত না, রাষ্ট্র স্বকীয় অস্তিত্বই বজায় রাখিতে পারিত না। কিন্তু খুঁদে-বুর্জোয়া এবং পন্ডিতমূর্খ অধ্যাপক ও প্রচারকদের মতে, রাষ্ট্রশক্তি বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে আপস-নিষ্পত্তি ঘটায় তাঁহারা প্রায়ই সদভিপ্রায়ে মার্কসের উক্তির দোহাই পাড়িয়া তাঁহাদের এই মত জাহির করেন! মার্কসের মতে, রাষ্ট্র হইতেছে শ্রেণীগত শাসনের যন্ত্র, এক শ্রেণী কর্তৃক অপর শ্রেণীকে পীড়ন করিবার যন্ত্র; যে-‘শৃঙ্খলা’ শ্রেণীসংঘর্ষকে প্রশমিত করিয়া এই পীড়নকে বিধিবদ্ধ করে, সেই কায়েমী ‘শৃঙখলা’ প্রবর্তন করাই রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য। কিন্তু খুদে-বুর্জোয়া রাজনীতিকদের মতে শৃঙ্খলার অর্থ হইতেছে বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে আপস-নিষ্পত্তি, এক শ্রেণী কর্তৃক অপর শ্রেণীকে পীড়ন করা নয়; তাঁহাদের মতে, শ্রেণী-সংঘর্ষ প্রশমিত করার অর্থ হইতেছে নিপীড়িত শ্রেণীদের খুশি করা, উৎপীড়কদের উৎখাত করার সংগ্রামের নির্দিষ্ট উপায় ও পদ্ধতি হইতে নিপীড়িত শ্রেণীদের বঞ্চিত করা নয়।

উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, ১৯১৭ সালের বিপ্লবে (ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে) যখন রাষ্ট্রের আসল অর্থ ও ভূমিকার প্রশ্ন একটি ব্যবহারিক প্রশ্ন হিসাবে বিরাট আকারে দেখা দেয় এবং ব্যাপক ভিত্তিতে সেই প্রশ্নের আশু মীমাংসার প্রয়োজনও দেখা দেয়, তখন সঙ্গে সঙ্গেই, সোসালিস্ট-রেভোলিউশনারি** ও মেনশেভিকরা সকলেই ‘রাষ্ট্র’ বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে ‘আপস-নিষ্পত্তি ঘটায়”, খুদে-বুর্জোয়াদের এই মতবাদের কবলে সম্পূর্ণরূপে ঢলিয়া পড়ে। এই উভয় দলের রাজনীতিকদের অসংখ্য প্রস্তাব ও প্রবন্ধ খুদে-বুর্জোয়াদের ‘আপস-নিষ্পত্তি’র এই নোংরা তত্ত্বে একেবারে ভরপুর। খুদে-বুর্জোয়া গণতন্ত্রীরা এই কথাটি কখনও বুঝিতে পারিবে না যে, রাষ্ট্র হইতেছে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর শাসন-যন্ত্র, যে-শ্রেণী তাহার প্রতিপক্ষের (তাহার বিরুদ্ধে শ্রেণীর) সহিত আপস-নিষ্পত্তিতে আসিতে পারে না। আমাদের সোসালিষ্ট-রেভোলিউশনারি ও মেনশেভিকরা যে আদবেই সোসালিস্ট নয়। (আমরা বলশেভিকরা এই কথা বারবার বলিয়া আসিতেছি) সোসালিস্ট-ঘেঁষা বুলি আওড়াইতে অভ্যস্ত খুদে-বুর্জোয়া গণতন্ত্রী মাত্র, তাহার অন্যতম জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ হইতেছে রাষ্ট্র সম্বন্ধে তাহাদের ধারণা।

অন্যদিকে ‘কাউটস্কিপন্থীরা’ যেভাবে মার্কসকে বিকৃত করে, তাহা আরও সূক্ষ্ম ধরনের। রাষ্ট্র হইতেছে শ্রেণীগত শাসনের যন্ত্র, এবং বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ আপসে মীমাংসা করা যায় না — ‘তত্ত্বের দিক হইতে’ তাহারা একথা অস্বীকার করে না; কিন্তু যে বিষয়টি তাহারা ভুলিয়া যায় বা উপেক্ষা করে, তাহা হইল এই : মীমাংসার অতীত যে শ্রেণী-বিরোধ, তাহারই ফলে যদি রাষ্ট্রের উদ্ভব হইয়া থাকে, রাষ্ট্র যদি সমাজের উর্ধ্বে অবস্থিত এক শক্তি হয় যে-শক্তি ‘সমাজ হইতে নিজেকে ক্রমশই বিচ্ছিন্ন করিয়া লইতেছে’ তাহা হইলে স্পষ্টই বুঝা যায় যে, একটা সশস্ত্র বিপ্লব ব্যতিরেকে নিপীড়িত শ্রেণীর মুক্তিলাভ সম্ভব নয়; শুধু তাহাই নয় — শাসকশ্রেণী রাষ্ট্রশক্তির যে-যন্ত্র তৈয়ার করিয়াছে এবং যাহার মধ্যে এই ‘বিচ্ছেদ’ মূর্ত রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে, সেই যন্ত্রের ধ্বংস ব্যতিরেকে নিপীড়িত শ্রেণীর মুক্তি সম্ভব নয়। আমরা পরে দেখিব যে, বিপ্লবের বিভিন্ন সমস্যা ঐতিহাসিক দিক হইতে মূর্ত রূপে বিশ্লেষণ করিয়া মার্কস এই সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়াছিলেন এবং তত্ত্বের দিক হইতে এই সিদ্ধান্ত স্বতঃপ্রকট। কাউটস্কি যে ঠিক এই সিদ্ধান্ত-ই ‘বিস্মৃত হইয়াছেন’ ও বিকৃত করিয়াছেন, আমাদের পরবর্তী আলোচনায় আমরা তাহা বিশদভাবে দেখাইব।
… … … … … … … … … (চলবে)
* সোসাল-শভিনিস্ট : “যাহারা কথায় সমাজতন্ত্রী কিন্তু কাজে উগ্র জাতীয়তাবাদী, যাহারা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের সময়ে ‘জাতীয় দেশরক্ষা’র পক্ষপাতী।  — লেনিন
** সোসালিস্ট-রেভোলিউশনারি : জারের আমলে রাশিয়ার একটি দল। কেরেনেস্কি ছিলেন এই দলের অন্যতম নেতা।


 

[চিরায়ত মার্কসবাদী সাহিত্য ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের অংশ হিসাবে ১৯১৭ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশিত কমরেড লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ গ্রন্থটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হবে। এবার রচনাটির প্রথম কিস্তি পত্রস্থ হল। বাংলা অনুবাদ নেয়া হয়েছে ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, কর্তৃক প্রকাশিত পুস্তিকা থেকে। প্রকাশ-সংক্রান্ত ত্রুটি-বিচ্যুতির দায় আমাদের।]

সাম্যবাদ জানুয়ারি ২০১৬

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments