সারাদেশের সাধারণ মানুষ মার্কেট থেকে শার্ট-প্যান্ট-লেডিস পোশাক-বাচ্চাদের জামা-পাঞ্জাবি-বোরখাসহ কমদামের যেসব দেশি রেডিমেড পোশাক কেনেন তার বেশিরভাগ তৈরি ও সরবরাহ হয় পুরনো ঢাকা ও কেরানিগঞ্জ থেকে। এখানকার পাইকারি ব্যবসায়ীরা নিজস্ব কারখানায় শ্রমিক খাটিয়ে রেডিমেড পোশাক উৎপাদন করায়। পুরোনো ঢাকার সদরঘাট, কেরানীগঞ্জ, গুলিস্থান, সাইনবোর্ডসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বহুতল ভবনে ছোট ছোট রুমে ২০/৩০ জন শ্রমিক নিয়ে গড়ে উঠেছে এক একটি কারখানা। দেশের মানুষের পোশাকের চাহিদা পূরণ করে যে রেডিমেড দর্জি শ্রমিকরা, তাদের জীবনের কাহিনী কেউ জানে না। তাদের তৈরি পোশাক পরে মানুষের সৌন্দর্য্য বাড়ে, মালিকদের মুনাফা বাড়ে। কিন্তু এই শ্রমিকদের মজুরি বাড়ে না, তাদের অবস্থার কোন উন্নতি হয় না। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, গত ১৫ বছরে এই শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি।
রেডিমেড দর্জি শ্রমিকরা বেশিরভাগ প্রোডাকশন ভিত্তিতে কাজ করে, অল্প কিছু শ্রমিক-কর্মচারী বেতনভুক্ত আছে। প্রোডাকশন শ্রমিকরা ‘কাজ নাই, মজুরি নাই’ ভিত্তিতে কাজ করে। তারা প্রতি পিস প্লেন ফুল শার্ট সেলাই বাবদ মাত্র ১৩ টাকা আর হাফ শার্ট সেলাইয়ে মাত্র ১১ টাকা মজুরি পায়। ৮ ঘন্টা কাজে তাদের গড় আয় ১৮০ টাকা। বাড়তি আয়ের জন্য শ্রমিকদের রাত পর্যন্ত টানা কাজ করতে হয়। যখন এই মজুরি নির্ধারণ হয়, তখন চালের মূল্য ছিল ১৩/১৪ টাকা। গত ১৫ বছরে চাল-ডাল-নুন-তেল, বাড়ি ভাড়া-গাড়ি ভাড়া বাড়লেও বাড়েনি এই শ্রমিকদের মজুরির হার। মালিকদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন — আর কতদিন গেলে বাড়বে শ্রমিকদের মজুরি? এই টাকায় কি ঢাকা শহরে পরিবার নিয়ে মানুষের মত বাঁচা সম্ভব?
১০ বছর আগে প্রতি গজ কাপড়ের দাম ছিল গড়ে ৫০-৬০ টাকা, যা বর্তমানে মালিকরা কিনছে ১২০-১৫০ টাকায়। ১২-১৫ টাকার সুতা ৩০-৩৫ টাকায়, ৭০০-৮০০ টাকার বকরম ১৪০০-১৫০০ টাকায় কিনছে। মালিকরা শুধু আগের মূল্যে কিনছে শ্রমিকের শ্রম। সদরঘাটে বিভিন্ন কারখানায় কর্মরত অধিকাংশ শ্রমিক কম ভাড়ায় বাসা নিয়ে থাকে কেরানীগঞ্জে। দশ বছর আগে বুড়িগঙ্গা পারাপার হতে লাগতো ৩ টাকা, বর্তমানে লাগে ১৪ টাকা। আবার মালিক আর শ্রমিক একই দোকান থেকে ৪০/৫০ টাকায় চাল কিনছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে সরকার নতুন পে-স্কেল ঘোষণা করে সরকারি কর্মচারীদের বেতন দ্বিগুণ বাড়িয়েছে। তাহলে শ্রমিকদের মজুরি বাড়বে না কেন? আমাদের দাবি, ফুল শার্ট সেলাই ৩০ টাকা এবং হাফ শার্ট সেলাই ২৫ টাকা মজুরি নির্ধারণ করতে হবে। প্রতি বছর এক টাকা করেও যদি বাড়তো তবে এর বেশি মূল্য বর্তমানে শ্রমিকরা পেত।
এছাড়াও আছে হাজার সমস্যা। কাজ করে শ্রমিকদের যা পাওনা হয় তা তারা মাসিক ভিত্তিতে পায় না। মালিক তাদের দৈনিক ২০০ টাকা খরচ দেয়। এর বাইরে কাজের বাকী টাকা ঝুলে থাকে চাঁদ রাতের (ঈদের আগের রাত) জন্য। রেডিমেড দর্জি কারখানাগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আলো-বাতাসহীন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, নেই পর্যাপ্ত টয়লেট। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শ্রমিকরা কাজ করলেও মালিকদের পক্ষ থেকে নেই কোন নাস্তার ব্যবস্থা, নেই বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ। ঈদ বা শীতসহ বিভিন্ন পোষাক কেনার মৌসুমে মধ্যরাত পর্যন্ত, কখনও টানা ২৪ ঘণ্টা পর্যন্তও কাজ করে শ্রমিকরা। মালিকরাও বেশি দামে মাল বিক্রি করে । কিন্তু ঈদ বোনাস বা সিজন বেনিফিট কোনটাই পায় না শ্রমিকরা।
রেডিমেড পোশাকশিল্পে প্রচুর শিশু শ্রমিক কাজ করে। পেটের তাগিদে ১১/১২ বছর বয়সে এসে কাজে যুক্ত হয় এই শ্রমিকরা। সাধারণত বছর তিনেক লাগে কাজ শিখে কারিগর হতে, এসময় তারা খাওয়া-পরার বেশি কিছু পায় না। বার্ধক্য আসার বা বয়স বাড়ার সাথে সাথে মূল্য কমে যায় তাদের। অবশেষে জীবনের ক্লান্তি মাথায় নিয়ে কাজ ছাড়েন এই শিল্পের শ্রমিকরা। তাদের অবসরকালীন বা ছাঁটাইজনিত পাওনা বলতে কিছু নেই। পান থেকে চুন খসলে ছাঁটাই হতে হয়। শ্রমিকরা যদি কোন কারণে কাজ ছাড়তে চায় এবং মালিক যদি টাকা পায় তবে তা পরিশোধ না করে যেতে পারে না। তার বকেয়া মজুরি প্রায়ই তাৎক্ষণিক পাওয়া যায় না, অপেক্ষা করতে হয় চাঁদরাতের জন্য। মালিকের মুনাফার জন্য উৎপাদন হচ্ছে, কিন্তু কারখানায় লোডশেডিং চলাকালে জেনারেটর ব্যবহারের বিল বাবদ মাসে ২০০ টাকা করে দিতে হয় প্রত্যেক কারিগরকে।
এখানে কারখানার সংখ্যা হিসাব করা গেলেও শ্রমিকের কোন হিসাব নেই। কোন বড় দুর্ঘটনায় শ্রমিকের খোঁজ নেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। আগুন বা ভূমিকম্পের মত দুর্ঘটনা বা দুর্যোগ হলে বহুতল মার্কেট থেকে দ্রুত বের হওয়ার সিঁড়ি অপর্যাপ্ত। নেই অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা। নেই দুর্ঘটনা বিষয়ে কোন প্রশিক্ষণ। এখানে কোন কোন ক্ষেত্রে শ্রমিকের মজুরি কমে। ২০১৩ সালে প্রতিটি জ্যাকেট সেলাই হত ১৫০-১৬০ টাকায়, ২০১৪ সালে তা ১৩০-১৪০ টাকা এবং ২০১৫ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১১০-১২০ টাকায়। প্রশ্ন হলো – বাজারে কি জ্যাকেটের দাম কমেছে?
এ অবস্থায় দর্জি শ্রমিকদের নিজেদের দাবি নিজেদেরই তুলে ধরার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন। শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের পক্ষ থেকে ২৬ জানুয়ারি ২০১৬ প্রকাশিত এক প্রচারপত্রে নিজেদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন ও একটি লড়াকু শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলার জন্য দর্জি শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রচারপত্রে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়, এই আন্দোলন ও সংগঠন আগামী দিনে শ্রমজীবি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করবে, নেতৃত্ব দিবে এবং মুক্তির পথ দেখাবে শ্রমিক শ্রেণীকে।
দাবিনামা
- প্লেন ফুল শার্ট সেলাই মজুরি ৩০ টাকা ও হাফ শার্টে ২৫ টাকা দিতে হবে।
- মাসিক মজুরি মাস শেষে পরিশোধ করতে হবে।
- কাজের মাঝে নাস্তার ব্যবস্থা কর, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে।
- ঈদ বা উৎসব বোনাস, সিজন বেনিফিট দিতে হবে।
- কারখানার স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ, অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা-প্রশস্ত সিঁড়ি নিশ্চিত কর।
- শ্রমিকদের নিয়োগপত্র-পরিচয় পত্র দিতে হবে, বিনা নোটিশে ছাঁটাই করা চলবে না।
- শ্রম আইন অনুসারে প্রাপ্য সকল অধিকার রেডিমেড দর্জি শ্রমিকদের দিতে হবে।
বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন
২২/১ তোপখানা রোড (৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১০০০। ফোন : ৯৫৭৬৩৭৩
মোবাইল : ০১৮৪৬-২২২৬৬৪