বাংলাদেশের আর্থিক খাতে যেন লুটের মহোৎসব চলেছে। শেয়ার বাজারে কোটি কোটি টাকা লুটের মাধ্যমে সর্বস্বান্ত হওয়া হাজার হাজার মানুষের কান্না এদেশে এখনো থামেনি। ডেসটিনি-যুবক-ইউনিপে ইত্যাদি কোম্পানির ফাটকাবাজীতে নিঃস্ব হয়েছে বহু মানুষ। এসবের পাশাপাশি দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে ব্যাংক লুটের ঘটনা — নানা কায়দায় সে লুট। মাটির তলায় সুরঙ্গ খুঁড়ে বা সিঁধ কেটে ব্যাংকের ভল্ট থেকে টাকা চুরি বা বন্দুক-বোমা নিয়ে ব্যাংক ডাকাতির চেষ্টার ঘটনা আলোড়ন তুললেও সেসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা ধরা পড়েছে। কিন্তু নামে-বেনামে ব্যাংকের টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত না দেয়ার অনেকগুলো ঘটনা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে — হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ ইত্যাদি ঘটনা। এসব ঘটনার বিচার এখনো আমরা দেখতে পাইনি।
এসব ‘ডিজিটাল’ চুরির বিচার হতে না হতেই বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ‘ডিজিটাল পদ্ধতিতে’ ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮০০ কোটি টাকারও বেশি) চুরির ঘটনা দেশের মানুষকে হতভম্ব করেছে। গত ৪ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করা হয়। এর মধ্যে দুই কোটি ডলার যায় শ্রীলঙ্কায়। শ্রীলংকায় প্যান এশিয়া ব্যাংকে জমা হওয়া দুই কোটি ডলার সন্দেহজনক হওয়ায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আটকে দেয় এবং এ অর্থ বাংলাদেশ ফেরত পেয়েছে। কিন্তু বাকি ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার গেছে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) একটি শাখার মাধ্যমে সেখানকার ক্যাসিনো বা জুয়ার ব্যবসায়। গোয়েন্দা তথ্য মতে, জালিয়াতির মাধ্যমে একই দিনে ২৩টি নির্দেশে প্রায় ১৩০ কোটি ডলার হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল।
১৯৯৫ সালে শেয়ার বাজার কেলেংকারির ঘটনায়ও মূল হোতাদের বিচার হয়নি। ১৮ বছর পর লোকদেখানো বিচার হয়েছে মাত্র। এরপর ২০১০ সালে শেয়ার বাজার থেকে নানা কৌশলে টাকা তুলে নিয়ে হাজার হাজার মানুষকে নিঃস্ব করা হয়েছিল। ওই ঘটনার বিচার বা কোনো দোষী ব্যক্তির শাস্তি হয়নি। হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে যখন ৪ হাজার কোটি টাকা লুটের ঘটনা দেশবাসীর সামনে আসল তখন অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ৪ হাজার কোটি টাকা এমন কোনো টাকা নয় যে এটা নিয়ে এত হৈচৈ করতে হবে। বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান নিজের প্রভাব খাটিয়ে ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। তার বিরুদ্ধে তখন কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
শুধু বাংলাদেশ নয়, সম্ভবত পৃথিবীর যে-কোনো দেশের ইতিহাসেই আর্থিক খাতে একসাথে এতগুলো বিপর্যয়ের ঘটনা বিরল। কিন্তু তারপরও সরকারের ভূমিকায় মানুষ সংশয়ের মধ্যেই আছে। একটার পর একটা এতগুলো আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটছে, প্রধানমন্ত্রী বা অর্থমন্ত্রী কেউ-ই দায় নিচ্ছেন না। আসলে দায় তারা নেবেন কেন? তারা যে নীতির ওপর দেশের অর্থনীতিকে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন, এসব চুরি-লুট সেই নীতিরই অংশ মাত্র।
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন একটা রূপান্তরের (ট্রানজিশনের) ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। এখানে এখন একচেটিয়া করপোরেট পুঁজি সংহত হচ্ছে। বড় পুঁজিগুলো নিজেদের থাবা বিস্তার করছে, ছোট-মাঝারিদের গিলে খাচ্ছে। ছোট-মাঝারি পুঁজি অস্তিত্ব রক্ষায় মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। পুঁজির এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাজনৈতিক ক্ষমতা বা প্রভাব একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে লুটপাট এখন পুঁজির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বর্তমান আওয়ামী মহাজোট অর্থনীতির এই পালাবদলের কালে (ট্রানজিশনাল পিরিয়ডের) শাসনক্ষমতায় আসীন। করপোরেট পুঁজির স্বার্থ যেমন সে রক্ষা করছে, তেমনি তার ক্ষমতার ছায়াতলে বসে অনেকেই পুঁজি লুটের মচ্ছবে মেতেছে। আর এই একচেটিয়া করপোরেট পুঁজি তার স্বার্থের বিপক্ষে যায় — সেটা আইন, বিচার, গণতন্ত্র যা-ই হোক — সেসব কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করে না। এদের স্বার্থেই বিভিন্ন ব্যাংকে দলীয় পছন্দের ভিত্তিতে পরিচালক-সহ গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগের ক্ষেত্রেও কোনো ধরনের নীতিমালা অনুসরণ করা হয় না। দলীয়করণের এই প্রবণতা দুর্নীতি-চুরি-লুটকে আরো বেগবান করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির পর এক ‘ইনফর্মাল’ বা ‘আন-অফিসিয়াল’ সাক্ষাৎকারে অর্থমন্ত্রীকে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, “আপনি কিন্তু বলেছিলেন বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন, পরে আর নেননি।” এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন: “হ্যাঁ, বলেছিলাম। ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এখনো হয়নি। যাই হোক। রাজনৈতিক ব্যাপার-স্যাপার সব আলাপ করা যায় না। …”
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী মহাজোট এখন যে করপোরেট পুঁজির সেবাদাস, অর্থমন্ত্রী সেই কাজের একজন অত্যন্ত দক্ষ কারিগর। তিনি সরলভাবে সত্য কথাটাই বলেছেন যে, এসব ‘চুরির’ পেছনে অনেক ‘রাজনৈতিক ব্যাপার-স্যাপার’ আছে যা জনসমক্ষে আলোচনা করা যায় না। এসব ‘রাজনৈতিক ব্যাপার-স্যাপারের’ বিচারও করা যায় না। সম্ভবত এ কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহিম খালেদ শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির বিচার প্রসঙ্গে একবার মন্তব্য করেছিলেন যে, সামরিক আইন ছাড়া এসব আর্থিক কেলেঙকারির বিচার সম্ভব নয়।অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন এসব তথাকথিত গণতান্ত্রিক শাসনে রাজনৈতিক প্রভাবাধীন চুরি-দুর্নীতি-লুটের বিচার সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির ঘটনার দুই মাসের বেশি সময় পার হয়েছে। এ ঘটনার দায় মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, সরানো হয়েছে অর্থ সচিবকেও। বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদত্যাগ সরকারের মুখরক্ষা হয়ত করেছে। কিন্তু এ ডিজিটাল চুরির বিচার এবং অর্থ উদ্ধারে কোনো বিশেষ অগ্রগতি ঘটেনি। কারা এর সাথে জড়িত সে সম্পর্কেও দেশবাসী বিন্দুমাত্র জানতে পারেনি। ফলে দিন যতই যাচ্ছে, জনমনে সংশয় সন্দেহ ততই বাড়ছে। আর সব চুরি-লুটের ঘটনা যেমন ধামাচাপা পড়ে গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে এই বিপুল অর্থ চুরির ঘটনাও কি শেষ পর্যন্ত ধামাচাপা পড়ে যাবে?