বিপ্লবী চেতনায় শিক্ষাব্যয় বৃদ্ধি রুখে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার
৩০ মার্চ, সকাল ১১টায় সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। উদ্বোধন করবেন দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা ৯টা বাজতে না বাজতেই সারাদেশ থেকে আগত সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের নেতা-কর্মীসহ শিক্ষার্থীরা স্ব স্ব জেলার বিরাটকায় মিছিলগুলো নিয়ে সম্মেলন স্থলে উপস্থিত হতে থাকে। মূহুর্তেই অপরাজেয় বাংলা, বটতলা একখ- উত্তাল সমুদ্রে পরিণত হয়। সেই সমুদ্রের তরঙ্গ থেকে উত্থিত হচ্ছে একটাই ধ্বনি — শিক্ষাব্যয় বৃদ্ধি বন্ধ কর।
সম্মেলনের উদ্বোধক ছিলেন দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বক্তা ছিলেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল(মার্কসবাদী)-র সাধারণ সম্পাদক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী, কেন্দ্রীয় কার্য পরিচালনা কমিটির সদস্য কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, আমন্ত্রিত বক্তা ছিলেন অল ইন্ডিয়া ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশনের সভাপতি কমরেড কমল সাঁই, সাধারণ সম্পাদক কমরেড অশোক মিশ্র, সহ-সভাপতি কমরেড ভি এন রাজশেখর। বিশেষ আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে সঙ্গীত পরিবেশন করেন ভারতের প্রখ্যাত গণসঙ্গীত শিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়।
একতরফা নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন বর্তমান সরকার ফ্যাসিবাদী শাসনকে আরও পাকাপোক্ত করছে। ফ্যাসিবাদী শাসনের ভিত মজবুত করার জন্য আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দৃশ্যমান কিছু তথাকথিত উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। অন্যদিকে পুঁজিপতি শ্রেণীর ব্যবসার স্বার্থে অর্থনীতিতে উদারীকরণের পালে জোর হাওয়া দিচ্ছে। স্বাস্থ্য-বিদ্যুৎ-যোগাযোগসহ পরিষেবাখাতগুলোতে ভর্তুকি কমিয়ে ক্রমাগত বেসরকারিকরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পরিষেবার অন্যান্য খাতের মতোই শিক্ষাক্ষেত্রেও বেসরকারিকরণ-বাণিজ্যিকীকরণের তীব্র আক্রমণ নামিয়ে আনছে। ফলাফল, প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়— সমস্তক্ষেত্রে সরকারি বরাদ্দ কমছে। কিন্তু ফি বেড়েছে কয়েকগুণ। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না বাড়লেও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেড়েছে। বর্তমানে শিক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রে বেসরকারি ধারাই প্রধান হয়ে উঠছে। এর মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্র থেকে প্রতিবছর বিপুল মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে একদল শিক্ষা ব্যবসায়ী। এভাবে শিক্ষা ব্যবসায়ের পণ্যে পরিণত হওয়ায় শিক্ষা ব্যয় বাড়ছে। ফলে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যারা শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির কারণে তাদেরও শিক্ষাজীবন খুঁড়িয়ে চলছে। শিক্ষা বঞ্চিত অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত কোটি মানুষের বুকের বেদনা ও স্বাধীনতার পূর্বাপর গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামের আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট জন্মলগ্ন থেকেই শিক্ষা আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। সেই ধারাবাহিকতায় শিক্ষাব্যয় বৃদ্ধি ও দুর্নীতি রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান নিয়ে ৪র্থ সম্মেলন আহুত হয়েছিল।
৩০ মার্চ সকাল হতে না হতেই সূর্যের আলোতে দিগন্ত প্লাবিত। আকাশে সূর্য উঁকি দিতেই সকল আশঙ্কার মেঘ কেটে যায়। আগের দিন সন্ধ্যায় হঠাৎ বৃষ্টি, কাল বৈশাখীর ছোবল। থেমে থেমে অঝোর বারিবর্ষণ। প্রকৃতির এই রুদ্ররোষে স্টেজ নির্মাণের কাজ সম্ভব হবে কি’না তাই নিয়ে তৈরি হয়েছে ঘোর অনিশ্চয়তা । স্টেজের বিকল্প হতে পারে কিন্তু এভাবে বৃষ্টি হলে দূর দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা আসবে কিভাবে? একদিকে প্রকৃতির বাধা অন্যদিকে খবর আসছে দেশের কয়েকটি স্থানে দুর্বৃত্তদের বাধাঁ — ‘ঢাকায় বোমা হামলা হবে’ বলে ভয় দেখিয়ে প্রোগ্রামে আসতে নিরস্ত করার অপতৎপরতা — এই দুই প্রতিবন্ধকতা জয় করেই শিক্ষার্থীরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে। সমস্ত প্রতিকূলতা জয় করে , সমস্ত বাধাঁ অতিক্রম করে সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিই প্রমাণ করেছে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ, শিক্ষাব্যয় বৃদ্ধি তাদের জ্বলন্ত সমস্যা — সেই সমস্যার প্রতিকার কী?
সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বক্তব্যে এই সমস্যা সমাধানের পথনির্দেশ, “শিক্ষাকে এখন লাভজনক পণ্যে পরিণত করা হয়েছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতি সমাজে নানা ধরণের সংকট তৈরি করছে। ক্রমান্বয়ে মানুষের জীবনে সংকট তৈরি করে জীবন দুর্বিসহ করে তুলছে। এই সমাজ ব্যবস্থাকে পাল্টানো ছাড়া সমাধানের আর কোন পথ নেই। যুগে যুগে তরুণরাই সেই ভূমিকা পালন করেছে। আজকেও তাদের সেই অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।”
এর আগে সকাল ১১টা ১০মিনিটে জাতীয় পতাকা, সংগঠন পতাকা ও বেলুন উড়িয়ে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও সংগঠন পতাকা উত্তোলন করেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ও সভার সভাপতি সাইফুজ্জামান সাকন। উদ্বোধনী বক্তব্যের পরই বক্তব্য রাখেন সভাপতি। সভাপতির বক্তব্যে সাইফুজ্জামান সাকন বলেন, “ইংরেজদের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানিরাও শিক্ষাকে ব্যয়বহুল করেছিল। স্বাধীন দেশে পুরনো সে নীতির বদল ঘটেনি। বহু শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে, কিন্তু সুর একই। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ক্রমাগত অস¦ীকৃত হয়েছে। বেসরকারিকরণের ধারাই ক্রমশ প্রধান হয়ে এসেছে। উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যের দিক থেকেই মানুষ হওয়া, চরিত্র গঠনের বদলে চাকুরী বাগানো, সার্টিফিকেট শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেসরকারিকরণ-বাণিজ্যকীকরণের ফলাফল হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ একটা স্তর পেরিয়েই আর এগুতে পারছে না। পাবলিক প্রতিষ্ঠান সমূহের পাবলিক চরিত্র ক্ষুন্ন করে সেল্ফ ফিনান্সিং হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। আর মানের কথা তো বলাই বাহুল্য। শতভাগ পাশ হচ্ছে। এ প্লাস -এর ছড়াছড়ি। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় তাদের সিংহভাগই পাশ করতে পারছে না। সমাজে সর্বব্যাপী এই অন্যায় অসঙ্গতি দূর করবে যে ছাত্রসমাজ তাদের আত্মকেন্দ্রিক ভোগের সমুদ্রে নিমজ্জিত করা হচ্ছে। অপরাজনীতির প্রভাবে চরিত্রহীন করে তোলা হচ্ছে। মাদকের প্রভাব তো আছেই। ফলে আজ জেগে ওঠার লড়াই কেবল শিক্ষার অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে নয়, শাসক বুর্জোয়া শ্রেণীর মনুষ্যত্ববিনাশী এ চক্রান্তের বিরুদ্ধেও।”
সভাপতির বক্তব্যের পর অজস্র ব্যানার প্ল্যাকার্ডে সুসজ্জিত বণার্ঢ্য একটি মিছিল ঢাকার রাজপথ প্রদক্ষিণ করে। মিছিলের অগ্রভাগে সংগঠনের পতাকা, তারপর বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র ,সুভাষ বোস, মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিনসহ ২০ জন মনীষীর ছবি, তারপর ৫ সারিতে ২৫ জনের হাতে সংগঠনের পতাকা — এরপরই মূল মিছিল এই সজ্জা মিছিলকে অনন্য এক রূপদান করেছিল। পদাতিক বাহিনীর মতো সুশৃঙ্খল মিছিল এগিয়ে চলেছে অপরাজেয় বাংলা থেকে শুরু করে কলাভবন ঘুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগার গেট দিয়ে রাজু ভাস্কর্য, দোয়েল চত্বর, কদম ফোয়ারা, পল্টন হয়ে জিমনেসিয়ামে গিয়ে মিছিল শেষ হয়।
দুপুরের খাবার গ্রহণের পর বিকাল সাড়ে তিনটা থেকে শুরু হয় আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর্ব। আলোচনা সভায় প্রধান বক্তা ছিলেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল(মার্কসবাদী)-র সাধারণ সম্পাদক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী, কেন্দ্রীয় কার্যপরিচালনা কমিটির সদস্য কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, ভারত থেকে আগত অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশনের সভাপতি কমরেড কমল সাঁই। আলোচনা সভার পূর্বে ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য সোমার নেতৃত্বে চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের একটি সঙ্গীত টিম প্রায় ঘণ্টাব্যাপী গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন। ততক্ষণে আলোচনাসভার স্থান কানায় কানায় পূর্ণ।
আইনস্টাইন বলেছিলেন, জ্ঞানের চেয়ে বড় হলো কল্পনা শক্তি। সেই কল্পনা শক্তি তৈরি হবে কি, আমাদের স্কুলশিক্ষার আয়োজন এমন শিশুমনের কৌতুহল সবকিছুকে হত্যা করা হয়। একসময় স্বাধীনতার পর ৯৯ ভাগ স্কুল ছিল সরকারি। এখন বেশিরভাগ স্কুলই বেসরকারি। সরকার নতুন করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করছে না। ফলে নির্বিচারে চলছে বেসরকারিকরণ। ৬৩ হাজার সরকারি প্রাথমিক স্কুলের মধ্যে প্রায় ২০ হাজার স্কুলে প্রধান শিক্ষক নেই। মাত্র ১৯ হাজার মাধ্যমিক স্কুলের মধ্যে ৩২৩টি সরকারি। এর মধ্যে ২১৩ টি প্রধান শিক্ষক নেই। মাধ্যমিকে ১৭০০ শিক্ষকের পদ শূণ্য। এরকম একটা অরাজকতার মধ্যে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালিত হচ্ছে। তারমধ্যে গোঁদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো পিইসি-জেএসসি পরীক্ষা চালু করা হয়েছে। আমরা বলেছি ৫ম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত চারটি পাবলিক পরীক্ষা পৃথিবীর কোথাও নেই। অথচ সরকার এটা চালু করেছে। এতে কি শিক্ষার মান বেড়েছে? এতটুকুও নয়। এই পরীক্ষাগুলো ছাত্রদের হয়রানি বাড়াচ্ছে। পাশের হার বাড়িয়ে দেখানোর জন্য উদারভাবে খাতা দেখা, দেদারছে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটছে। এমনিতেই আমাদের দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক যে পরিবেশ তাতে একটা শিশুর কোমলতার মনোভাব বেশিদিন থাকে না। এরকম একটা বাস্তবতার মধ্যে দাঁড়িয়ে আমরা তাকে প্রাইমেরি লেভেলেই শিখিয়ে দিচ্ছি তোমার যোগ্যতা না থাকলেও চলবে, বাবা-মা প্রশ্নপত্র সন্তানকে সরবরাহ করছে, সন্তান পরীক্ষা দিচ্ছে। সন্তান বুঝল যা তার যোগ্যতায় নেই তাও সে পেতে পারে। ছোটবেলা থেকেই বিষ ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। মনুষ্যত্ব হরণের একটা বিষ শিশুদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। শৈশব কেড়ে নিচ্ছে। এখন একজন শিশু সুকুমার রায়কে চেনে না, রবীন্দ্রনাথকে জানে না, নজরুলের বিদ্রোহী সত্ত্বার সাথে সে পরিচিত নয়। সে জানে না একদিন রোকেয়া রংপুরে ধর্মীয় গোঁড়ামির এক চরম পরিবেশে কিভাবে সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়েছিলেন কেবলমাত্র শিক্ষার জন্য, নারীসমাজকে জাগাবার জন্য। এই ইতিহাস ছাত্রদের জানানো হয় না। আসলে আমাদের এমন বড় চরিত্রদের বুঝতে দেয়া হচ্ছে না। আত্মকেন্দ্রিকতায় গোটা যুবসমাজকে নিমজ্জিত করা হচ্ছে। কারণ এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় জনগণ যদি সমাজ সচেতন হয়, বিজ্ঞানমনষ্ক হয়, জনগণ যদি দায়বদ্ধ হয় তবে এই মুনাফার জোয়াল টিকে থাকবে না। তাই অনিবার্যভাবেই শিক্ষাকে তাদের বিকৃত করতে হবে। যে শিক্ষায় বিজ্ঞানমনষ্কতা তৈরি হয়, তাকে ঝেড়ে ফেলতে হবে এবং সবার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থাকে বন্ধ করতে হবে। এভাবে ধাপে ধাপে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে বড়লোকের পণ্যে পরিণত করা হচ্ছে। শিক্ষার এই বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট তার জন্মলগ্ন থেকেই লড়াই পরিচালনা করছে। চলমান লড়াইকে আরও বেগবান করার উদ্দেশ্যে এই সম্মেলন।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক স্নেহাদ্রী চক্রবর্তী রিন্টুর সঞ্চালনায় ও সভাপতি সাইফুজ্জামান সাকনের সভাপতিত্বে শুরু হয় আলোচনা সভার কাজ। শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য রাখেন ৪র্থ সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক নাঈমা খালেদ মনিকা। মঞ্চের সামনে সবগুলো চেয়ারে আসীন সাদা ক্যাপ পরিহিত ছাত্র-ছাত্রীরা তখন নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের রূপ ধারণ করেছে। এরই মাঝে বক্তব্য দিতে আসেন অল ইন্ডিয়া ডিএসও’র সভাপতি কমরেড কমল সাঁই। শিক্ষার উপর শাসকশ্রেণীর আক্রমণ আজ গোটা দুনিয়ায়— সাম্রাজ্যবাদী ভারতেও তীব্র আক্রমণ পরিচালিত হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ ডিএসও। সেই আন্দোলনের অভিজ্ঞতা আর এদেশে ছাত্রদের লড়াইয়ের সাথে সংহতি রেখে কমল সাঁই বলেন, “ ভারতবর্ষ এবং বাংলাদেশ অবিভক্ত ভারতের একই স্বাধীনতা আন্দোলনের অংশীদার। আমাদের দেশে যখন স্বাধীনতার কথা উঠেছিল তার প্রধান কারণ ছিল সাধারণ মানুষের দুরবস্থা থেকে উত্তরণ, বিদেশী শাসন শোষণ থেকে উদ্ধারের আন্দোলন। দাবি ছিল শিক্ষার অধিকারের। সর্বজনীন গণতান্ত্রিক শিক্ষার দাবি উঠেছিল। বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, পুরাতন মানুষের নয়, নতুন মানুষের চাষ করতে হবে। নতুন যুগের উপযোগী মানুষ। বিদ্যাসাগরের সাথে ইংরেজদের তর্ক হয়েছিল। তারা টোলে-মাদ্রাসায় তাদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু নবজাগরণের দূতেরা প্রকৃত শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভারতবর্ষে মানুষের অনেক অধিকার আদায় হয়নি। তেমনি শিক্ষার অধিকারও আদায় হয়নি। সরকার তাদের দায়িত্ব পালন করেনি, বৈজ্ঞানিক শিক্ষার পরিবর্তে কারিগরি শিক্ষার প্রসার করছে, সত্যিকারের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করছে। সাম্প্রদায়িক শক্তি প্রবলভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আমাদের দেশে মুক্ত স্বাধীনচিন্তার মানুষ যারা তাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে।
ভারতবর্ষে যথেষ্ট সংখ্যক স্কুল-কলেজ নেই। প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা খুব খারাপ। ছাত্রদের মিনিমাম শিক্ষার আয়োজন নেই। পূর্ণ শিক্ষক নিয়োগ করা হচ্ছে না। ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পাশ-ফেল পদ্ধতি তুলে দিয়েছে। আমরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি। পিপিপি’র বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি। সরকার মেডিকেল নির্মাণ করবে আর সেটা তুলে দিবে বেসরকারি সংস্থার হাতে। সাধারণ শিক্ষার্থী আশা নির্বাপিত হচ্ছে। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ‘ড্রপ আউট’ করছে। এই অবস্থা চলছে। এই প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন সঠিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতেই একমাত্র তা সম্ভব।” এই শিক্ষার ভিত্তিতেই আমরা জানি, শিক্ষার যে সংকট সেটা সমাজের সামগ্রিক সংকট থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এদেশে শ্রমিক-চাষী, মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্তদের জীবনে আর্থিক টানাপোড়েনের যেটি মূল কারণ— পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সেই পুঁজিবাদই শিক্ষাক্ষেত্রেও সংকটের জন্ম দিচ্ছে। তাই অন্যান্য শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের যোগসূত্র তৈরি করতে হবে। সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী বলেন, “ যখন তারা শিক্ষার খরচ প্রতিমুহূর্তে বাড়াচ্ছে তার উদ্দেশ্য কি? তার উদ্দেশ্য হচ্ছে বাস্তবে বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র মানুষের ছেলে মেয়েরা যাতে উচ্চ শিক্ষার দ্বারে আর কোনোদিন যেতে না পারে। উচ্চশিক্ষিত হলে, এই উচ্চ শিক্ষিত মানুষের জন্য গত চুয়াল্লিশ বছরে বাংলাদেশের শাসকরা যে পরিমাণ চাকুরি দরকার সে চাকুরির যোগাড় করতে পারে নাই। সরকার হিসাব দিচ্ছে যে, প্রতিবছর বাংলাদেশে বাইশ লক্ষ ছেলে মেয়ে চাকুরির বাজারে আসে আর বিভিন্ন ধরণের কাজের মধ্য দিয়ে আট থেকে দশ লক্ষ চাকরি পায়। যদি এটাও ঠিক হিসাব হয় তাহলে প্রতিবছর দশ থেকে বার লক্ষ ছেলে মেয়ে তারা কোনো কাজ পায় না। এর ফলে বাংলাদেশে এখন চার কোটি সক্ষম মানুষ বেকার। এই যে বেকার এই বেকার অবস্থাটা তাদের জন্য বিপদজনক। সেইজন্য গোটা দেশের সাংস্কৃতিক অবক্ষয়। ড্রাগের ব্যাপক চালান, গোটা সমাজে ড্রাগ এবং অপসংস্কৃতি ছড়িয়ে দিয়েছে।” আলোচনা চলতে চলতেই আকাশ আবার অন্ধকার। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমক দিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির আশঙ্কায় প্রধান বক্তা কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী আমন্ত্রিত অতিথি শিল্পী প্রতুল মুখ্যোপাধ্যায়কে সুযোগ করে দিতে বক্তব্য সংক্ষিপ্ত করেন।
কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী বলেন, শিক্ষা সামাজিক সম্পদ। ফলে শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে সামাজিক। সামাজিক দায়বদ্ধতা ছাড়া বড় মানুুষ হওয়া যাবে না। ছাত্রদের শ্রমিক কৃষক সাধারণ মানুষের প্রতি ভালবাসা, দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। বড় চরিত্র অর্জন করতে হবে। এজন্য ইতিহাসের বড় মানুষদের জীবন সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিতে হবে। তিনি বলেন, শিক্ষা একটা বিশেষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপরিকাঠামো এবং কোনও না কোনও শ্রেণীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আজ শিক্ষাকে নিজের শ্রেণী স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ করছে ক্ষমতাসীন পুঁজিপতি শ্রেণী। পুঁজিবাদবিরোধী শ্রমিক শ্রেণীর অভ্যুত্থানের পরিপূরক সংগ্রামে ছাত্রদের সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে, শিক্ষা-সভ্যতাকে শোষক শ্রেণীর হাত থেকে মুক্ত করতে হবে।
আলোচনা সভার পর মঞ্চে আসেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়। গান শুরু হতেই বৃষ্টিও শুরু হয়ে যায়। কিন্তু বৃষ্টির ভ্রƒকূটি উপেক্ষা করে উপস্থিত ছাত্র-জনতা ঠাঁই বসে। প্রতুল মুখার্জিও সাগ্রহে বৃষ্টির মধ্যেই গান পরিবেশন করেন। বৃষ্টি বাড়লে ছাতা মাথায় নিয়ে গান গেয়ে শোনান। গানের সুর, ভাষা, গায়কী দিয়ে দর্শক শ্রোতাদের হৃদয়ে সংগ্রামের প্রেরণা সঞ্চার করে তিনি বিদায় নেন। এর মধ্য দিয়েই সম্মেলনের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হয়।
সম্মেলনে নাঈমা খালেদ মনিকাকে সভাপতি ও স্নেহার্দ্রী চক্রবর্তী রিন্টুকে সাধারণ সম্পাদক করে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের ২৫ সদস্য বিশিষ্ট নতুন কমিটি পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। সত্যজিৎ বিশ্বাস সহ-সভাপতি, মাসুদ রানা সাংগঠনিক সম্পাদক, রাশেদ শাহরিয়ার দপ্তর সম্পাদক, শরীফুল চৌধুরী অর্থ সম্পাদক, ইভা মজুমদার প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, মুক্তা ভট্টাচার্য শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক, তাজনাহার রিপন স্কুল বিষয়ক সম্পাদক নির্বাচিত হন। সদস্য নির্বাচিত হন আহসানুল আরেফিন তিতু, জয়দীপ ভট্টাচার্য, কলিন চাকমা, মাসুদ রেজা, বিটুল তালুকদার, মনিরুজ্জামান মনির, তাজিউল ইসলাম, সেজুুঁতি চৌধুরী, রুহুল আমিন,অজিত দাস, রেজাউর রহমান রানা, রোকনুজ্জামান রোকন, আরিফ মঈনুদ্দীন, শীতল সাহা, সুস্মিতা রায় সুপ্তি, আবু রায়হান বকশি।