সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু বিষয়ে বিচার বিভাগের সাথে সরকারের মতানৈক্য দেশের শিক্ষিত সচেতন মানুষের মধ্যে বিভিন্ন প্রশ্নের উদ্রেক করেছে ও তা নিয়ে তারা নানারকম মতামত দিচ্ছেন, তর্ক-বিতর্ক করছেন। বর্তমান সরকার দেশের বৃহৎ পুঁজিপতিদের সমর্থন নিয়ে অগণতান্ত্রিক অন্যায় প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় এসেছে এবং তার অন্যায় শাসন পাকাপোক্ত করতে সে সংসদ, প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে সরকারের প্রধান নির্বাহীর একেবারে কর্তৃত্বের মধ্যে নিয়ে এসেছে। বর্তমান এই পরিস্থিতির ব্যাপারে সকলেই অবগত। আইনের শাসন বলে বাস্তবে কিছু এদেশে নেই। বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা বরাবরেরই মতই প্রশ্নবিদ্ধ। প্রশাসন বিরোধীদের নিঃশেষ করে দিতে তৎপর আর সংসদ একের পর এক জনগণের উপর দমনমূলক ও জনঅধিকার হরণকারী আইন তৈরিতে ব্যস্ত। কিন্তু ইদানিংকালে কয়েকটি বিষয়ে বিচার বিভাগের সাথে সরকারের দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে। এটা এই কারণে যে, ইউরোপের নবজাগরণের চিন্তাসমূহ এদেশে মানুষ অনুশীলন না করলেও একাডেমিকভাবে যে অন্ততঃ জেনেছিলো; ব্যক্তিস্তরের মানুষের মধ্যে, বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে, আইনজীবীদের মধ্যে, বিচারপতিদের মধ্যে, চিকিৎসকদের মধ্যে— সেই চিন্তার প্রভাব ও তার কিছু রেশ এখনও দেখা যায়। এই রেশটা এখনও আছে বলে মাঝে মাঝেই ব্যক্তির সাথে ব্যবস্থার দ্বন্দ্ব বাঁধে। বুর্জোয়া শ্রেণী বর্তমানে টিকে থাকার প্রয়োজনে যখন সমাজের সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করছে, তখন সেই প্রশ্নে ব্যক্তির সাথে মাঝে মধ্যেই ব্যবস্থার দ্বন্দ্ব বাঁধছে। অর্থাৎ ব্যক্তি যখন নবজাগরণের সেই চিন্তা কিছুটা অর্থে ধারণ করে একটা অন্যায়, অসংগত কাজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়, তখন ব্যক্তি বুর্জোয়ার সাথে বুর্জোয়াদের শ্রেণীস্বার্থ তার দ্বন্দ্ব বাঁধে। মনে রাখতে হবে, বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় অর্থনৈতিক ভিত্তির সাথে তার উপরিকাঠামো অর্থাৎ মানুষের চিন্তা-ভাবনার দ্বন্দ্ব সবসময়ই থাকে। সেই প্রশ্নে দেখা যাবে যে, একজন বিচারপতি যিনি একদিন একাডেমিকভাবেই বিচারের নিরপেক্ষতার ধারণা পেয়েছিলেন, কোনো একটা বিষয়ে সেটার পক্ষে দাঁড়িয়ে গেলেন। জনস্বার্থের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এরকম কিছু মানুষ কখনও কখনও দেখতে পাওয়া যায়। বিশেষ করে বিচারকদের মধ্যে আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগকে কেন্দ্র করে এবং ডাক্তারদের মধ্যে বুর্জোয়া মানবতাবাদের মানবসেবামূলক ধারণাকে কেন্দ্র করে এরকম ঋজুভাবে হঠাৎ দাঁড়িয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত মেলে। সাধারণভাবে বুর্জোয়া সমাজের যে দমন-পীড়ন সেটাই চলে, কিন্তু মাঝে মাঝে এরকম কিছু ঘটনা বুর্জোয়া সমাজের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব সেটাকে সামনে নিয়ে আসে।
বুর্জোয়া রাষ্ট্রে বিচার বিভাগ এই শ্রেণীবিভক্ত রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে
সরকারের সাথে বিচার বিভাগের দ্বন্দ্বটি প্রকাশ্যে এসেছে প্রধান বিচারপতি এস.কে সিনহা এবং সুপ্রীম কোর্টের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এইচ.এম শামসুদ্দিনের মধ্যকার তর্ক-বিতর্ককে কেন্দ্র করে। বিতর্কের বিষয় ছিলো বিচারপতিদের অবসরে যাওয়ার পর রায় লেখার ব্যাপারে প্রধান বিচারপতির মন্তব্যকে কেন্দ্র করে। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কতিপয় সংসদ সদস্য সংসদে প্রকাশ্যে প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ্য করে রীতিমত হুমকি উচ্চারণ করেন। এরপর ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে করা একটি রিটের রায়ে আদালত সে নির্বাচনকে আইনত বৈধ ঘোষণা করেন কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কিছু নির্দেশনা দেন। এতে নির্বাচনকালে প্রধানমন্ত্রীসহ যে কোনো মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত নাকচ করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দেয়ার পক্ষেও আদালত মত দেন। ক্ষুব্ধ সাংসদরা একে আদালতের ‘ধান ভাঙতে শিবের গীত’ আখ্যা দিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন। এরপর ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের ব্যাপারে ১৩ বছর আগে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের উপর তৎকালীন বিএনপি সরকার সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগে যে আবেদন করে, সেই আপীলের রায়ে আদালত হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রাখেন। এ নিয়েও সংসদে ঝড় বয়ে যায়। বিনা ভোটে জয়লাভ করে প্রবল ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠা সংসদ সদস্যরা হাক ছাড়েন যে, বিচার বিভাগ আইন সংশোধনের ব্যাপারে কোনো নির্দেশ দিতে পারেন না, মত প্রকাশ করতে পারেন মাত্র। আইন সংশোধন হবে কি না হবে তা ঠিক করবে সংসদ। এ সময়ে বিচারপতিদের অভিশংসন সংসদের অধীনে আনার ব্যাপারে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর প্রেক্ষিতে সাংসদরা যখন আইন প্রণয়ন করতে বসবেন, তখন আদালত খোদ ষোড়শ সংশোধনীকেই অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করেন। আবার সংসদ সদস্যরাও বিচারকদের বেতন ভাতা বাড়ানোর একটি বিল নাকচ করে দেন, কিন্তু একই অধিবেশনে মন্ত্রী ও সাংসদদের বেতন ভাতা বাড়ানোর বিল পাশ করান। এতে রাষ্ট্রের দুই প্রধান স্তম্ভের নিয়ন্ত্রণকারীদের মধ্যেকার প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব আরও তীব্র রূপ নেয়।
বিচার বিভাগের এরকম একের পর এক কিছু পদক্ষেপ সরকারের বিরোধিতা সত্ত্বেও নেয়ার প্রেক্ষিতে আমরা কি এই ধারণা করতে পারি যে, বিচার বিভাগ স্বাধীন অবস্থান ব্যক্ত করছে কিংবা সরকারের প্রভাবমুক্ত হয়ে সে কাজ করার চেষ্টা করছে? এ সরকারের অবস্থানের দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পাব যে, রাষ্ট্রের শক্তিকেন্দ্রসমূহকে একক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার মধ্য দিয়েই সে দেশ শাসন করছে, সবদিক থেকে চূড়ান্ত ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছে এবং বিরোধীদের কঠোরভাবে দমন করছে। এই দমন পীড়নের মধ্য দিয়ে সরকার যে সীমাহীন নৈরাজ্য চালাচ্ছে, বেহিসেবী হয়ে উঠছে, তাতে মানুষের মধ্যে যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে, এভাবে চলতে থাকলে রাষ্ট্রে যে আন্দোলন ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে— এটা বুর্জোয়া রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক। একটা কথা এখানে মনে রাখতে হবে যে, সরকার ও রাষ্ট্র এক বিষয় নয়। সরকার হলো পুঁজিপতিদের হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করার শক্তি। একভাবে বলা যায়, এটা একটা ম্যানেজারি করার কাজ। সরকার এক অর্থে পুঁজিপতিশ্রেণীর পলিটিক্যাল ম্যানেজার। কিন্তু রাষ্ট্র হলো শ্রেণীর সামগ্রিক স্বার্থরক্ষাকারী সামাজিক ব্যবস্থা। সরকার পাল্টায়, কিন্তু রাষ্ট্র পাল্টায় না। আর এই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকে রক্ষা করার জন্য তার যে শক্তিকেন্দ্রগুলো আছে এর একটি হলো বিচার বিভাগ। কীভাবে, কোন্ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় তার এই আবির্ভাব হলো তা আমরা প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে আলোচনা করবো। কিন্তু একথা বুঝতে হবে যে, এই সময়ে বিচার বিভাগ যা করছে তা এই শ্রেণী রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখার জন্যই। সরকারের স্বেচ্ছাচারী আচরণকে খানিকটা নিয়ন্ত্রিত করা, খানিকটা বিচার আছে, গণতন্ত্র আছে এসব দেখানো, রাষ্ট্রকে একেবারে ব্যর্থ হিসেবে উপস্থিত হতে না দেয়া, মানুষকে রাষ্ট্রের প্রতি খানিকটা আশ্বস্ত করা— ইত্যাদি বিষয়গুলো এর মধ্যে আছে। এগুলো কোনো পরিকল্পনা করে বিচার বিভাগ করছে আমরা তা বলছিনা। এখানে কিছু কিছু বিচারকের দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ভূমিকা আছে তাও সত্য, একথা আমরা শুরুতেই বলেছি। কিন্তু যেসকল ব্যাপার ঘটছে, তার সবকিছুই ঘটছে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার কাঠামোর মধ্যেই, রাষ্ট্র ও শ্রেণীকে রক্ষা করার জন্য তার যে নির্ধারিত পথ সে পথেই। এটা দিয়ে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে দাঁড়িয়েছে কিংবা জনগণের স্বার্থরক্ষার জন্য সে তৎপর হয়ে উঠেছে— সে সিদ্ধান্ত করা যাবে না। তাই ন্যায় বিচারের দাবিতে কিছু সংখ্যক বিচারকের সাহসী ভূমিকা যেহেতু পুঁজিবাদী কাঠামোর মধ্যেই ঘটে তাই তা শেষ পর্যন্ত বুর্জোয়া গণতন্ত্রের পক্ষে জনগণকে বিভ্রান্ত করে।
বুর্জোয়ারাই একসময় ‘আইনের চোখে সবাই সমান’ এই চিন্তা নিয়ে এসেছিল
আধুনিক বুর্জোয়া রাষ্ট্রের জন্মের মধ্য দিয়েই বিচার ব্যবস্থা, পার্লামেন্ট ও আধুনিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা স্থাপিত হয়। ইতিহাসে এক সময় সামন্ততন্ত্রকে হটিয়ে যখন বুর্জোয়ারা ক্ষমতায় আসে তখন তারা এই আধুনিক রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করে, গড়ে তোলে পার্লামেন্ট ও বিচার ব্যবস্থা। ক্ষুদ্র আঞ্চলিক বাজার ভেঙ্গে দিয়ে এই বুর্জোয়ারা জাতীয় বাজার গড়ে তোলে। জাতীয় বাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে জাতীয় রাষ্ট্র। সেই জাতীয় রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে এ প্রশ্নকে সামনে রেখে, বুর্জোয়ারা তখন যে সমস্যাসমূহের মুখোমুখি হয়েছিল সেগুলোকে ভিত্তি করে, তার সমাধানের জন্য তারা রাষ্ট্রের এই কাঠামোটা দাঁড় করায়। সে সময় বুর্জোয়াদের ছোট ছোট পুঁজি ও সেই পুঁজির মালিকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং তাকে কেন্দ্র করে সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও শক্তিসমূহের মতামত প্রদানের স্থান হিসেবে পার্লামেন্টের উৎপত্তি।
সে সময়ে বুর্জোয়া শ্রেণী এটাও বুঝেছিল যে, বুর্জোয়া সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনসভা ও প্রশাসন যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে থাকে, সেখানে নিরপেক্ষ বিচার কেবলমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মর্জির উপর নির্ভর করে। বুর্জোয়া রাষ্ট্রের প্রধান তিনটি স্তম্ভের মধ্যে আর বাকি থাকে বিচার বিভাগ। বুর্জোয়া রাষ্ট্রবিদেরা তখন ভেবেছিলেন যে, এই বিচার বিভাগের আপেক্ষিক নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা বজায় রাখাই ন্যায় বিচার ও আইনি ব্যবস্থার শেষ অবলম্বন। তাই তখন তারা ক্ষমতা বিভাজন তত্ত্ব নিয়ে আসেন। অর্থাৎ আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও প্রশাসন যার যার জায়গায় অপর বিভাগের হস্তক্ষেপমুক্ত আপেক্ষিক স্বাধীনতা অর্জন করবে। তাহলে রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা কোনো দলের হাতে কেন্দ্রীভূত হবে না, ক্ষমতার একটা ভারসাম্য থাকবে। ফরাসী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মঁতেস্কু ছিলেন এই ক্ষমতা বিভাজন তত্ত্বের (Doctrine of separation of power) প্রবক্তা। যদিও কোনো বুর্জোয়া রাষ্ট্রেই এই ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটেনি, তবু এটা ঠিক যে পুঁজিবাদের অবাধ প্রতিযোগিতার সময়ে যেখানেই বুর্জোয়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানেই এই মূলনীতিকে কার্যকরী রূপ দেবার চেষ্টা করা হয়েছে।
আমরা বলেছিলাম যে, বুর্জোয়া ব্যবস্থার ঊষালগ্নের সেই চিন্তার রেশ বর্তমানেও ব্যক্তি মানুষের মধ্যে কিছু কিছু দেখা যায়, এবং যখন তা দেখা যায় তখন ব্যবস্থার সাথে তার দ্বন্দ্ব প্রকাশ পায়। এ প্রসঙ্গে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের অধীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। কী নির্মম অত্যাচারই না ব্রিটিশরা অবিভক্ত ভারতবর্ষের মানুষকে করেছে। সেখানে আইন-কানুনের কোনো বালাই ছিল না। এই সময়ই আবার কলকাতা হাইকোর্টের চীফ জাস্টিসকে বাংলার গভর্নর কোনো একটি অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করেন। চীফ জাস্টিজ সেই গভর্নরের বিরুদ্ধে সেসময় ‘কনটেম্ট অব কোর্ট’ অর্থাৎ আদালত অবমাননার মামলা করেন। কারণ গভর্নর সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি। সুতরাং তিনি একটি পক্ষ। আর বিচার বিভাগ অন্তত আপেক্ষিক অর্থে নিরপেক্ষ। তাই চীফ জাস্টিজকে কেউ ব্যক্তিগতভাবে নিমন্ত্রণ করতে পারে না। এটাও একইভাবে জনগণের মধ্যে আইনের শাসনের বিভ্রম তৈরি করে।
তবে আমাদের দেশে এতটুকু মাত্রায় এর বিস্তার ঘটেনি। গত ২৮ জানুয়ারি সন্ধ্যেবেলায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, আইনমন্ত্রী ও এটর্নি জেনারেল মিলিত হন। আইনমন্ত্রী বলেছেন, এটি কোনো বৈঠক নয়, নৈশভোজমাত্র। প্রধান বিচারপতির এই ভোজসভায় অংশ নেয়া বিচারবিভাগকে কোথায় দাঁড় করায়? নৈশভোজে কী আলোচনা হয় দেশের জনগণ কি বোঝেন না? কিন্তু পুঁজিবাদ নামতে নামতে মানুষের চেতনার স্তরকেও এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যে, দেশের শিক্ষিত লোকেরাও এ বিষয়টাকে অন্যায় মনে করেন না। এমনকি আইনের লোকেরাও না। কারণ হাতে গোনা কয়েকজন আইনবিদের প্রতিবাদ ছাড়া এ বিষয়ে কারও কোনো বক্তব্যও পরিলক্ষিত হয়নি।
আবার এটা তো ঠিক যে, বুর্জোয়ারাই একসময় রাজার নিরঙ্কুশ ক্ষমতার উপর গড়ে ওঠা সামন্ততান্ত্রিক যুগের ব্যক্তি শাসনের (Rule of person) উচ্ছেদ ঘটিয়ে তার পরিবর্তে সমাজে আইনি শাসন (Rule of law) প্রতিষ্ঠা করেছিল। ব্যক্তির পরিবর্তে আইনের শাসন হলো রাজতন্ত্রের স্বেচ্ছাচার থেকে মুক্ত হওয়ার ফল, তাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বুর্জোয়া রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেছেন — আইনের শাসনের অর্থ হলো- (১) সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে অনুমোদিত আইন ব্যতিরেকে কোনো সরকার শাসন চালাতে পারবে না। (২) নাগরিকের যেসব কাজকর্ম তৎকালীন আইন অনুযায়ী দন্ডনীয় ছিলনা, তাকে দন্ডনীয় করে এমন কোনো আইন হতে পারে না। (৩) কোনো ব্যক্তিকে প্রকাশ্য বিচারের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে আটকে রাখা যাবে না (৪) বিচারকরা বিচারকালে বাইরের চাপ ও নিয়ন্ত্রণ দ্বারা পরিচালিত না হয়ে স্বাধীনভাবে সাধারণ আইনকে বিশেষক্ষেত্রে প্রয়োগ করবেন। এই হলো আইনের শাসনের চার স্তম্ভ।
বুর্জোয়া ব্যবস্থার সূচনালগ্নের সেই ঘোষণাগুলোর দিকে তাকালে অবাক হতে হয় এই ভেবে যে, আজ ৫৪ ধারা ও ১৬৭ ধারা নিয়ে বিচার বিভাগ ও সরকারের মধ্যে আইনি লড়াই ও ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে অথচ সূচনাপর্বের প্রাথমিক নীতিগুলোকে অনুসরণ করলেও এই ধারাসমূহ বহাল থাকার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু বিচার বিভাগ আইনের শাসনের মূলনীতির বিরোধী এই ধারাগুলো বহাল রেখেই সামান্য সংশোধনীর পরামর্শ দিয়েছিলো মাত্র, আর তাতেই সরকারের সবগুলো বিভাগ একত্রে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন।
সেদিন বুর্জোয়া রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একথাও বলেছিলেন যে, আইনের শাসন যেখানে প্রতিষ্ঠিত নেই, সেই শাসনব্যবস্থাকে সভ্য, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলা যায় না, কেননা সেখানে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও মর্যাদা বলতে কিছু থাকে না। ব্যক্তির নিরাপত্তা সেখানে শাসকবর্গের মর্জির উপর নির্ভর করে।
বুর্জোয়া উন্মেষের যুগে ব্যক্তিস্বাধীনতাই ছিল আইনের শাসনের ভিত্তি
আইনের শাসনের ভিত্তি তখন ছিল ব্যক্তির স্বাধীনতা, ব্যক্তির মর্যাদা। বুর্জোয়ারা দাবি করেছিল, “The rule of law is based upon the liberty of individual and has as it’s the harmonizing of the opposing notions of individual liberty and public order. The notion of justice maintains a balance between those notions. Justice has a variable content and cannot be strictly de ned, but at a given time and place, there is an appropriate standard by which the balance between private interest and common good can be maintained.” (Colloquim on the rule of law) অর্থাৎ “আইনি শাসন ব্যক্তিস্বাধীনতাকে ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এর লক্ষ্য হলো- ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সামাজিক নিয়মশৃঙ্খলা, এই দুই বিপরীত চিন্তার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা; আর ন্যায়বিচারের ধারণা এই দুইয়ের মধ্যে পারস্পরিক ভারসাম্য বজায় রাখে। বিচারবোধ বা তার চিন্তাচেতনার মধ্যে একটি পরিবর্তনশীল প্রাণসত্ত্বা থাকে এবং এর কোনো সীমিত সংজ্ঞা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। স্থান ও কাল অনুযায়ী তার একটি যথাযথ মাপকাঠি থাকে, যার সাহায্যে ব্যক্তিস্বার্থ ও সকলের কল্যাণ— এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হয়।”
অর্থাৎ ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সেদিন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। আইনের ঊর্ধ্বে কেউই নন, আইনের চোখে সবাই সমান — এই কথাগুলো সেদিন এসেছে। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের কাজও আইনের চোখে বিধিসম্মত হতে হবে, না হলে সে কাজ করা যাবে না— এই কনভেনশনগুলো তখন এসেছিল।
রাষ্ট্রীয় প্রশাসন কিংবা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি সবাইকেই আইনের কাছে জবাবদিহি করতে হবে
বুর্জোয়াদের দ্বারা প্রভাবিত ও পরিচালিত সমাজে বাহ্যিক বা নিয়ম মাফিক হলেও দেশের প্রচলিত আইন (Law of land) সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য এটা ধরা হয়। কোনো কোনো বুর্জোয়া রাষ্ট্রে প্রচলিত ‘প্রশাসনিক আইন’ (Administrative Law- DROIT ADMINITRATIF) কোনো দিক থেকে আইনি শাসনের এই ধারণার বিরোধী নয় বরং আইনজ্ঞদের অভিমত হলো, এটি আইনি শাসন সম্পর্কিত ধারণারই প্রসার মাত্র। আইনের শাসন যে কোনো ব্যক্তি, সরকার বা রাষ্ট্রের যে কোনো প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছামত কাজ করার ক্ষমতা, পদমর্যাদালব্ধ বিশেষ ক্ষমতা বা আইনের প্রভাবমুক্ত কোনো অবাধ সার্বভৌম ক্ষমতার অস্তিত্বকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে।
এ প্রসঙ্গে বৃটেনের সাবেক প্রশাসনিক প্রধান চার্চিল, যিনি ছিলেন একটি সা¤্রাজ্যবাদী দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, তার একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য, “The principles of complete independence of the judiciary from the executive is the foundation of many things in our island life……the judge has not only to do justice between man and man, he also- and this is one of the most important functions…. he has to do justice between the citizens and the state. He has to ensure that the administration conforms with the law and adjudicate upon the legality of the exercise by the executive of its power.” অর্থাৎ “প্রশাসনের প্রভাবমুক্ত বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আমাদের দ্বীপের বহু কিছুর ভিত্তি। বিচারককে শুধুমাত্র ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির বিরোধের বিচারই করতে হয় না, তাকে নাগরিক ও রাষ্ট্রের পারস্পরিক বিরোধেরও বিচার করতে হয় এবং এটা তার অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। তাকে লক্ষ্য রাখতে হয় প্রশাসন যেন আইন মেনে চলে এবং প্রশাসনিক ক্ষমতার প্রয়োগ আইনসঙ্গত হয়েছে কি’না সেটা তাকে বিচার করে রায় দিতে হয়।”
বুর্জোয়া রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, পুঁজিবাদের উন্মেষকালে গৃহীত সংবিধানসমূহ, চুক্তিসমূহ প্রভৃতি থেকে এ বিষয়ে এরকম অসংখ্য উক্তি সংযোজন করা যাবে যেখানে নাগরিকদের অধিকার রক্ষা, রাষ্ট্রীয় আইন পালনের ক্ষেত্রে অধিকার কোথাও ক্ষুণœ হয় কি’না সেটা বারবার করে দেখা, বিচার বিভাগের সে সম্পর্কিত দায়িত্বÑ ইত্যাদি উল্লেখ করা আছে। এমনকি সেদিন এইসকল প্রশ্নে রাষ্ট্রের সমালোচনা করা, মানুষকে সচেতন করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকায় বুর্জোয়ারা সেদিন সংবাদপত্রকে ক্ষমতার আধারের বিচারে একটি স্বতন্ত্র শক্তি (Fourth Estate) হিসেবে মেনে নিয়েছিল।
আজ আমাদের দেশের প্রশাসনের দিকে তাকালে কথাটি অনেকের কাছেই হাস্যকর বলে ঠেকবে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৫ সালে দেশে ১৮৩টি বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি দুই দিনে একজন বিচার ছাড়াই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে মৃত্যুবরণ করছে। একটি আধুনিক রাষ্ট্রে বিচার বহির্ভূতভাবে এত সংখ্যক হত্যার ব্যাপারে বিচার বিভাগ নির্বিকার। নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জড়িত থাকার কথা প্রমাণিত হয়েছে। ইতোমধ্যে পুলিশ-র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিনতাই, মুক্তিপণ আদায়ের সাথে জড়িত বলে প্রমাণিত হয়েছে, কয়েকজন পুলিশ সদস্য পাবলিকের হাতে ধরা পড়েছেন, কেউ কেউ মারও খেয়েছেন। এই পরিস্থিতি স্বীকার করে পুলিশের আই.জি বলেছেন, এরকম পুলিশ কর্মকর্তাদের যাতে জনগণ প্রতিরোধ করে। অর্থাৎ কথাটি ঘুরে ফিরে এই দাঁড়ায় যে, বিষয়টি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে একজন ব্যাংক কর্মকর্তা ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের একজন কর্মকর্তাকে বেধড়ক পিটিয়ে সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছে পুলিশ। মিরপুরে চাঁদা নিয়ে বাকবিতন্ডার এক পর্যায়ে চায়ের দোকানদারকে ধাক্কা দিয়ে উনুনে ফেলে দিয়ে হত্যা করে পুলিশ। রাজধানীর শ্যামলী এলাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ ওঠে পুলিশের এক এস.আই এর বিরুদ্ধে। সাম্প্রতিক সময়ে ক্যান্টনমেন্টের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে কুমিল্লায় ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী তনুকে ধর্ষণ ও খুন করা হলো। এসকল ঘটনার কোনোটারই আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি। অর্থাৎ প্রশাসনের কাজ আইনসঙ্গত হয়েছে কি’না তা দেখার জন্য যে আপেক্ষিক অর্থে স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রয়োজনের কথা বুর্জোয়ারা বলেছিল এবং তাকে যে ক্ষমতা একসময় দিয়েছিল তার অস্তিত্ব এদেশে নেই। এসব কথা আজ ইতিহাস মাত্র।
যা কিছু আইনসঙ্গত তা ন্যায়সঙ্গত ও মানবিক নাও হতে পারে
আইনের এ বিষয়সমূহ আলোচনার সময় একটা জিনিস আমাদের মাথায় রাখা দরকার তা হলো, আমরা যে আইনের আলোচনা করছি, সেটিও একটি বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে সমাজে এসেছে, বিকশিত হয়েছে। তাকে গড়ে তোলা হয়েছে ঐ সমাজে তখন যারা নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তাদের প্রয়োজনেই। সামন্ত রাজা-বাদশাদের শাসনের মধ্যে সওদাগররা বিভিন্ন জায়গায় পণ্য বিক্রি করার মাধ্যমে যে বণিকী পুঁজি গড়ে তুলেছিল, তার আরও প্রসার ঘটার সম্ভাবনা, কুটির শিল্পের বৃহৎ শিল্প হয়ে ওঠার সম্ভাবনা— ইত্যাদি ক্ষেত্রে তখনকার সামন্ত শাসন ব্যবস্থা ছিল এক বিরাট বাধা। তাই তখন সমাজের সেই সময়ের অগ্রসর শ্রেণী, বণিক শ্রেণী নিজের স্বার্থেই সেই সমাজ ভাঙতে চেয়েছে। সামন্ত সমাজ ভেঙে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় তারাই ছিল সেদিন নেতৃত্বে। তাদের ছোট ছোট পুঁজির প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যাতে নিরপেক্ষ থাকে, ন্যায় বিচার যাতে নিশ্চিত হয়— সেজন্য তারা আইনের এই কথাগুলো এনেছে। অর্থাৎ সেদিনও আইন সমাজের একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীকে রক্ষার জন্যই এসেছিল। কালক্রমে পুঁজিবাদ একচেটিয়া পুঁজিতে রূপান্তরিত হওয়ায় বুর্জোয়াদের কাছে ন্যায়বিচারের যে প্রয়োজন সে সময় ছিল তা আজ আর নেই। রাষ্ট্রের সমস্ত শক্তিকে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের পদানত করা ও তাদের স্বার্থে কাজে লাগানোই হচ্ছে আজ রাষ্ট্রের প্রধান উদ্দেশ্য। তাই আজ সকল বুর্জোয়া রাষ্ট্রে শোষিত মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের সঙ্গে যখনই শাসক শ্রেণীর স্বার্থের দ্বন্দ্বটি উপস্থিত হচ্ছে, তখন সাধারণ মানুষের দাবির ন্যায্যতাকে অস্বীকার করেই তার তথাকথিত মীমাংসা হচ্ছে। অর্থাৎ রাষ্ট্র যখন একটি শ্রেণীর রাষ্ট্র, সমাজে অবস্থিত কোনো না কোনো শ্রেণী যেহেতু তাকে পরিচালিত করে সেহেতু তার সমস্ত প্রতিষ্ঠান তা প্রশাসনই হোক আর বিচার বিভাগই হোক- নিরপেক্ষ থাকতে পারে না। সেই শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার জন্যই সে কাজ করে।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্ন আমাদের সামনে আসে। বুর্জোয়া রাষ্ট্রে বিচারব্যবস্থা যদি সত্যই আপেক্ষিক নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা অর্জন করে তাহলেই কি মানুষের একান্ত মানবিক, যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত দাবিগুলোর সমর্থন মিলবে? বুর্জোয়া মানবতাবাদীদের মধ্যে সৎ, নৈতিক অনেক লোক যারা এখনও ন্যায়বিচারের জন্য লড়েন তাদের এ প্রশ্নটি ভেবে দেখা দরকার বলে আমরা মনে করি।
সমাজবিকাশের ইতিহাস সম্পর্কে যারা জানেন, তারা স্বীকার করবেন— নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের মতনই আইন সম্পর্কে প্রচলিত মূল্যবোধটিও সমাজ অগ্রগতির সঙ্গে সম্পর্কিত সামাজিক ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতার ধারণাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। একটি নতুন সমাজ গঠনের সময় সে সময়ের সমাজপ্রগতির স্বার্থে যে নীতি-নৈতিকতা-মূল্যবোধের সৃষ্টি হয় ও তার ভিত্তিতে যে আইন প্রণীত হয়, সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে তাও পুরাতন রক্ষণশীল সুবিধাভোগী শাসকশ্রেণীর কায়েমী স্বার্থে পর্যবসিত হয়। বুর্জোয়া সমাজ চলতে চলতে একসময় যখন শাসকশ্রেণীর চরিত্র হয়ে পড়লো সমাজপ্রগতির পরিপন্থী, তখন তারই স্বার্থের রক্ষক রাষ্ট্রকে রক্ষা করার জন্য যে আইন তাও হয়ে পড়লো প্রতিক্রিয়াশীল। যে কোনো সমাজে এই পরিস্থিতিতে, এই সময়ে সমাজপ্রগতির প্রয়োজনে সমাজ অভ্যন্তরে নতুন চিন্তা, ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবোধ গড়ে ওঠে- যার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়ে আইন ও ন্যায্যতা সম্পর্কে নতুন প্রশ্ন, নতুন ধারণা ও নতুন মূল্যবোধ জন্ম নেয়। পুরাতন ন্যায়নীতিমূল্যবোধের সাথে তখন তার দ্বন্দ্ব সংঘাত হয়। একসময় পুরাতনের প্রয়োজন নিঃশেষ হয়ে যায়, তা পরিত্যক্ত হয়। তার জায়গা পূরণ করে উন্নত চিন্তা ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা নতুন আইন ও বিচার ব্যবস্থা। এভাবেই একদিন সামন্ত সমাজের নীতি-আদর্শ-মূল্যবোধ ও তার আইনকে নিঃশেষ করে দিয়ে বুর্জোয়া বিচার ব্যবস্থা গড়ে ওঠেছিল। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে একদিন তাকেও বিদায় নিতে হবে।
তাই প্রচলিত আইনের সাথে নতুন চিন্তার সংঘাত হচ্ছে, আইনসঙ্গত হচ্ছে না; মানে এই নয় যে তা অন্যায়, অন্যায্য। ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভার করণীয় নির্দেশ করতে গিয়ে এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করে কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছিলেন, “এথিক্স ও জুরিস্প্রুডেন্স এর ছাত্রদের জানারই কথা যে, শ্রেণীশোষিত সমাজে যা কিছু আইনসঙ্গত তা ন্যায়সঙ্গত, যুক্তিযুক্ত ও নৈতিক নাও হতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই, যা কিছু প্রচলিত আইনসম্মত নয়, তাও অনৈতিক, অন্যায় ও অযৌক্তিক নাও হতে পারে।”
কোন্ আইনের শাসন— একথা বিচার করা গুরুত্বপূর্ণ
আইনের শাসনের কথা বলতে হলে আইনের চরিত্র উন্মোচিত করাও গুরুত্বপূর্ণ। ২০০২ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তৎকালীন বিএনপি সরকারের যৌথ বাহিনীর হাতে ৫৮ জন মানুষের মৃত্যু হয়। সংবাদপত্রের ভাষায় যাকে বলে ‘নন জুডিশিয়াল কিলিং’। এ হত্যার জন্য যৌথ বাহিনীকে আইন করে দায়মুক্তি দেয়া হলো। অর্থাৎ আইনগতভাবেই কোনো বিচার ছাড়াই তাদের হত্যাকে বৈধ বলে ঘোষণা করা হলো। ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে নির্বাচিত প্রথম সংসদের মেয়াদ ছিলো ৫ বছর। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে সংবিধানে ৪র্থ সংশোধনী এনে বলা হলো ঐ প্রথম সংসদের মেয়াদ হবে ৫ বছর। তবে গণনা শুরু হবে ৪র্থ সংশোধনীর দিন থেকে অর্থাৎ ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ থেকে। আজ যদি আইন করে এ সরকারের মেয়াদ ২০২১ কিংবা ২০৪০ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হয়— তাহলেও সরকারের ক্ষমতায় থাকাটা আইনসঙ্গত হবে। কিন্তু তা ন্যায়সঙ্গত হয় কি? ৫ জানুয়ারির নির্বাচন আইন রক্ষার জন্য, সংবিধান রক্ষার জন্য, আইনসঙ্গত পথেই হয়েছে বলে সরকারের দাবি। আদালত এ ব্যাপারে রায়ও দিয়েছেন। কিন্তু রায়ের পরেও আদালতকে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে নির্দেশনা দিতে হলো কেন? কারণ এটা এতোটাই অন্যায়, অসঙ্গত হয়েছে যে, আদালত আইনের সাধারণ, স্বাভাবিক যুক্তিতে একে বৈধ ঘোষণা করলেও গোটা দেশের জনগণের কাছে এ নির্বাচন অবৈধ, অগণতান্ত্রিক হিসেবেই প্রতীয়মান। আইনসভার বর্তমান সদস্যবৃন্দের নির্বাচন প্রক্রিয়াই প্রশ্নবিদ্ধ বর্তমান আইনসভার সদস্য অর্থাৎ সাংসদদের মধ্যে ১৫৩ জনই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। বাকিরা যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারা কী প্রক্রিয়ায় হয়েছেন তা সকলের জানা। এরকম একটি সংসদে কি ধরনের আইন প্রনয়ণ হতে পারে? যে আইনসভাকে জনগণ সমর্থন করেনি, সেখানে যে আইন তৈরি হবে সেটি হবে জনগণের অনাস্থাকে জোরপূর্বক দমনের জন্যই, এছাড়া আইনসভা নিজেকেই টিকিয়ে রাখতে পারে না। বর্তমান সময়ে সরকার খুব দ্রুততার সাথে একের পর এক আইন তৈরি করে যাচ্ছে। এই আইনগুলোকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তার সবগুলোই বিরোধী মতকে জোরপূর্বক দমনের জন্য। উদাহরণস্বরূপ ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধন) আইন ২০১৩’, ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকরণ অপরাধ আইন’-র উল্লেখ করা যেতে পারে। এই আইনগুলো প্রনয়ণ ও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে বুর্জোয়া রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরা, বুদ্ধিজীবীরাও শঙ্কিত। দেশের প্রথম সারির একটি পত্রিকায় তাদের আইন বিষয়ক লেখক লিখেছেন, “সমাজে যখন গণতান্ত্রিক রীতিনীতির ঘাটতি বেশি পড়ে, তখন নতুন আইনের আবির্ভাব কোনো স্বস্তির বিষয় হতে পারে না। …আগে আইনের অপব্যবহার নিয়ে আমরা বড় উদ্বিগ্ন থাকতাম। এখন তার থেকে অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। কারণ কতিপয় ক্ষেত্রে খোদ আইনটাই হচ্ছে এমনভাবে যা ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে প্রয়োগ করার সুযোগ নেই।” সামন্ততন্ত্রের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে বুর্জোয়ারা যে সংবিধান ও আইনের শাসনের কথা বলে একদিন গৌরব করতো— আজ তাকেই তারা চরম স্বেচ্ছাচারিতা করার জন্য ব্যবহার করছে। তাই আজ বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের অল্প অংশ হলেও বলতে বাধ্য হচ্ছেন যে, আইনটাই এমন করে তৈরি হচ্ছে যে ন্যায়বিচার থাকার কোনো উপায়ই এর মধ্যে নেই।
উন্নত-অনুন্নত সকল পুঁজিবাদী দেশেই ফ্যাসিবাদ আজ সাধারণ বৈশিষ্ট্য
আজ সারা বিশ্বের কোথাও আর সেই আইনের শাসন নেই। অথচ বুর্জোয়ারাই এখনও ক্ষমতায় যারা এই আইনের শাসন দুনিয়ায় এনেছিল। সত্য হলো এই যে, বুর্জোয়ারা যখন এই আইনের শাসনের কথা বলেছিল, মত প্রকাশের অধিকারের কথা বলেছিল, একথা সেদিন সে বলেছিল তারই প্রয়োজনে। তখন ছিল পুঁজিবাদের শুরুর সময়। আমরা আগেই বলেছি, তখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুঁজির মালিকরা ছিল, তাদের মধ্যে অবাধ প্রতিযোগিতা ছিল। পুঁজিবাদের সূচনালগ্নে অবাধ প্রতিযোগিতার অর্থনীতির উপরিকাঠামো হিসেবে পার্লামেন্ট, বিচার ব্যবস্থা ইত্যাদি এসেছিল। কিন্তু পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশের স্বাভাবিক নিয়মেই অবাধ প্রতিযোগিতার স্তরের একদিন অবসান হলো। বিকাশের এই স্তরে পুঁজিবাদ একচেটিয়া পুঁজি ও লগ্নি পুঁজির জন্ম দিল, যার অপর নাম সাম্রাজ্যবাদ। পুঁজিবাদ পরিবর্তিত হয়ে হল একচেটিয়া পুঁজিবাদ। এই একচেটিয়া পুঁজি রাষ্ট্রীয় পুঁজির সাথে মিলন ঘটিয়ে রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া পুঁজির সৃষ্টি হয়েছে। এই রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া পুঁজি ফ্যাসিবাদের ভিত্তিমূল। পুঁজিবাদের এই অবস্থা অবলোকন করে এ যুগের অগ্রণী মার্কসবাদী চিন্তানায়ক ও দার্শনিক, ভারতের এসইউসিআই(সি) এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছেন, “কি উন্নত, কি অনুন্নত, সকল পুঁজিবাদী দেশেই, বিশেষতঃ প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ও রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে ফ্যাসিবাদ নানা রূপে, নানা প্রকারে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। …..এমনকি যে সব বুর্জোয়া দেশে পার্লামেন্টের সুদীর্ঘ ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল, সেখানেও বুর্জোয়া সংসদীয় গণতান্ত্রিক অধিকার, সুযোগ সুবিধাগুলোও ক্রমাগত খর্ব করা হচ্ছে। বুর্জোয়া শ্রেণীর কাছেও বুর্জোয়া পার্লামেন্টের প্রয়োজনীয়তা দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।”
ইতালি, জার্মানি, অস্ট্রিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন বুর্জোয়া দেশের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি যে, কোনো একটি ফ্যাসিস্ট দলের পক্ষে, রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অংশ— পুলিশ, আমলা, মিলিটারির যোগসাজশে, নকল নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, ভয়-ভীতি-সন্ত্রাসের আবহাওয়া সৃষ্টি করে, নিরঙ্কুশ একচেটিয়া ক্ষমতার অধিকারী হয়ে, সংবিধানকে সামনে সাজিয়ে রেখে তারই আড়ালে ফ্যাসিবাদী একনায়কত্ব কায়েম করা খুব একটা দুরূহ ব্যাপার হয়নি। ঐসব দেশে এইভাবেই ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় এই সব শাসন ব্যবস্থাকে ‘সাংবিধানিক একনায়কত্ব” (Constitutional Dictatorship) বলে আখ্যায়িত করা হয়। ইতালিতে ক্রিসপির নেতৃত্বে এইভাবেই সংসদকে বজায় রেখেই ক্ষমতার স্বেচ্ছাতন্ত্র তৈরি হয়েছিল। ক্রিসপির সাংবিধানিক একনায়কত্বের ইতালিয়ান এই মডেলটি হলো, সংসদকে জিইয়ে রেখে বুর্জোয়া শ্রেণীর শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত অংশের একজন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট প্রধানমন্ত্রীর হাতেই বাস্তবে ক্ষমতার চূড়ান্ত কেন্দ্রিকরণ। এরা প্রগতিশীলতা, সাম্প্রদায়িক সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই করা, দেশের উন্নতি— ইত্যাদি কথা বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করেন এবং জনগণের মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা গড়ে তোলেন। যেমনটি এখন আমাদের দেশে হচ্ছে। রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানকে একচ্ছত্রভাবে দলীয় করায়ত্তে নিয়ে আসা হয়েছে আর তার পক্ষে জনগণকে ধরে রাখার জন্যে একদিকে যেমন নিপীড়ন, নির্যাতন, জেল, জুলুম চলছে; অপরদিকে চলছে উগ্র জাতীয়তাবাদের চর্চা, উন্নয়নের ডামাডোল আর অসাম্প্রদায়িকতার ভেক। আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবী ও তথাকথিত বাম প্রগতিশীলরা ফ্যাসিবাদের ইতিহাস হয়তো আমাদের থেকেও ভাল জানেন, তবুও দেশে সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহ সমস্যা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের বিকল্প কিছু দেখেন না, সবরকম অধিকার কেড়ে নেয়ার পরও কিছু তো উন্নয়ন হচ্ছে এই যুক্তি তুলেন। ফ্যাসিবাদের পক্ষে জনগণকে বিভ্রান্ত করে রাখার জন্য তাদের জ্ঞান ও বুদ্ধির এই অপূর্ব চর্চাকে আমরা সাধুবাদ না জানিয়ে পারছিনা !
জনগণের মনে রাখা দরকার যে আইন, সংসদ, সংবিধান ইত্যাদি প্রসঙ্গে বুর্জোয়ারা যে কথাগুলো এনেছিল সেগুলো সেদিন তাদের শ্রেণীস্বার্থেই এনেছে, আজ আবার তাদের শ্রেণীস্বার্থেই তাকে তারা নির্মমভাবে পদদলিত করছে।
বিশ্বপুঁজিবাদের ক্ষয়ের যুগে বাংলাদেশের জন্ম। ফলে সে পুঁজিবাদের উন্মেষকালের সেই চেতনাকে ধারণ করবে না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দীর্ঘদিন পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে স্বাধীনতা অর্জন এবং স্বাধীনতা পরবর্তীকালে স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি ঐতিহ্য থাকায় এদেশের বুর্জোয়াদের কিছু অধিকার জনগণকে দেয়ার কথা বলতে হয়েছিল, সংবিধানেও কিছু কথা লিখতে হয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে তার সবই লয়প্রাপ্ত হচ্ছে, বিশেষ করে মহাজোট সরকার দ্বিতীয়বারের মতো যখন সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এলো এবং দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতিরা যেভাবে তার সমর্থনে দাঁড়ালো তাতে গণতন্ত্রের ভানটুকু ছেড়ে দিয়ে সরাসরি ফ্যাসিবাদী কায়দায় দেশ পরিচালিত হওয়া শুরু করলো। সংবিধানসম্মতভাবেই নির্মম ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠা করলো আওয়ামী লীগ। এ অবস্থায় দেশে এখন বিচার বিভাগের উপর উপর সম্ভ্রমটুকুও আর থাকছে না। বিচারপতিদের নিজেদের মধ্যে বিতর্কই শুধু নয়, বর্তমান সময়ে বিনা বিচারে মৃত্যু রেকর্ড ছাড়িয়েছে, সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল নিয়ন্ত্রণে নতুন আইন প্রবর্তিত হয়েছে, দুটি পত্রিকার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী, প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং বিষোদগার করছেন, হুমকি দিচ্ছেন, একটি পত্রিকার সম্পাদকের নামে দেশের বিভিন্ন কোর্টে অর্ধশতাধিক মামলা করা হয়েছে হয়রানির জন্য, এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলা অনানুষ্ঠানিক মন্তব্যকেও বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে ফেসবুকে মন্তব্য লেখার জন্য গ্রেফতার করা হচ্ছে। সদ্য সংশোধিত ২০০৬ সালের আইসিটি অ্যাক্টের মাধ্যমে যাকে তাকে যখন তখন জেলে পুরে দিচ্ছে সরকার। এ বিষয়ে ইতিহাসের একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে আমেরিকার আইনে মানুষের মত প্রকাশের অধিকারকে এত গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল যে, বলা হতো, কেউ যদি ঘোষণা করে যে কাল আমি আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে হত্যা করব, তাকে ততক্ষণ পর্যন্ত প্রশাসন গ্রেফতার করতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে আক্রমণে উদ্যত হয়। আমেরিকার আইনি ব্যবস্থায় একটা কথা আছে ‘একই বিষয় দেখা যায় ইউরোপিয়ান কনভেনশনেও। হায় বুর্জোয়া গণতন্ত্র, বুর্জোয়া রাষ্ট্র, তার আইন! আজ সে কোথায় নেমেছে!
আজ মানুষ এই বিচার ব্যবস্থার উপর আস্থা হারিয়েছে। পার্লামেন্টের উপর আস্থা হারিয়েছে। বাস্তবে আজ এগুলো অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এর কারণ পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করেই এগুলো এসেছিল, সেই ব্যবস্থাই আজ অকার্যকর। দেশের এক বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক বলেছেন, “শিশু আব্দুল্লাহ্ হত্যা মামলার প্রধান আসামী মোতাহার র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ায় টিভিতে দেখলাম এলাকাবাসী উল্লাস করছে, মিষ্টি খাচ্ছে এবং বলছে ন্যায়বিচার হয়েছে। তাহলে আমাদের অবস্থা কোথায়? মানুষ মনে করছে এটাই বিচার। জনগণকে এটা মনে করাতে আমরা বাধ্য করেছি।”
তিনি বলেছেন, “এখন ফোর ইন ওয়ানের যুগ। অভিযোগ গঠন করে র্যাব, তদন্ত করে র্যাব, দোষী-নির্দোষ সিদ্ধান্ত নেয় র্যাব। শাস্তি কার্যকর করে র্যাব। ফোর ইন ওয়ান। যেসব ব্যাপার বা ঘটনায় র্যাবের কোনো ইন্টারেস্ট নেই, সেসব ঘটনায় আমরা আদালতে মামলা চালাই।…২০৪১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না। তার আগেই আমরা উন্নত বিশ্বের কাতারে যোগ দেব। তবে আইনের শাসন বাদ দিয়ে। চলবে র্যাবের শাসন, পুলিশের শাসন, রিমান্ডের শাসন এবং আরও নতুন নতুন শাসন। জাদুঘরে ঢুকবে আইনের শাসন।”
মানুষের যাওয়ার শেষ জায়গা আদালত— সে আজ জাদুঘরে, পার্লামেন্ট তো অনেক আগেই প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনে পরিণত হয়েছে। সংসদে ৩০০ জন সাংসদের ১৫৩ জনই ভোটের পূর্বে জয়ী হয়েছেন। বাকিরা কীভাবে হয়েছেন তা সকলের জানা। কিন্তু তার বাইরের ঠাঁট-বাট ঠিকই আছে। সরকারি দল আছে, বিরোধী দল আছে, স্পিকার আছেন, তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে, আইন পাশ হচ্ছে— সবই আছে, সবই চলছে, নেই শুধু ‘জনতার ইচ্ছা’, যার জন্য বুর্জোয়ারা একসময় প্রাণ শপথ করেছিল। এই হচ্ছে আজ আব্রাহাম লিংকনের ‘of the people, by the people, for the people’ গণতন্ত্রের হাল। এই হয়! রাষ্ট্রের এই ভয়াবহ ফ্যাসিবাদী চেহারা দেখিয়ে এখন বিএনপি-জামাতরা গণতন্ত্রের তাল ঠুকবেন, জনগণের জন্য আন্দোলন, লড়ালড়ির ভাব দেখাবেন। এ সবই গদিতে বসার জন্য। ক্ষমতায় গেলে এরা সবাই এক— সেই একই বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থরক্ষা, মানুষের স্বার্থ জলাঞ্জলী। পূর্বের তুলনায় আরও ভয়াবহ শোষণ, অন্যায়, নির্যাতন, ক্ষমতার যথেচ্ছা ব্যবহার। এদের সম্পর্কে শোষিত মানুষ সতর্ক না হলে ঠকবে। এবং এই ঠকবাজী বিরামহীন চলতেই থাকবে, যতদিন বুর্জোয়ারা তা চালিয়ে যেতে পারে। এর অবসান সেইদিনই হবে যেদিন সর্বহারা গরীব মানুষেরা এই ঠকবাজী ধরতে পারবে, নিজেদের শ্রেণী রাজনীতিটা বুঝতে পারবে, চিনে নিতে পারবে সর্বহারা শ্রেণীর প্রকৃত দলটিকে। তাই আজ ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র চাইলে এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে হবে— এটা যতদিন না মানুষ বুঝতে পেরেছে এবং তা ভাঙ্গার লড়াইয়ে নেমে আসছে ততদিন তার মুক্তি নেই। আর আজকের দিনে বাম গণতান্ত্রিক শক্তিকেই এই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। এই বিশ্বাসে আমরা জনগণের সবরকম আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করব এবং তাদের সংগঠিত করে গণআন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করব। আমরা সকল বাম গণতান্ত্রিক শক্তিকে এ লড়াইয়ে এগিয়ে আসার আহবান জানাই।