২৫-২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা- কুড়িগ্রাম রোডমার্চ
ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে তিস্তা পাড়ের হাজার হাজার চাষী হাহাকার করছে। ফারাক্কার কারণে পদ্মা অববাহিকায় ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এসেছে। এককালের নদীমাতৃক বাংলাদেশের অধিকাংশ নদী আজ মৃতপ্রায়। ভারতের পানি আগ্রাসনে বাংলাদেশ যখন মরুভূমির দিকে ধাবিত হচ্ছে তখন তা আরো ত্বরান্বিত করতে ভারত সরকার বিতর্কিত ‘আন্তঃ নদী সংযোগ প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করতে তৎপর হয়ে উঠেছে। গত ১৬ মে ২০১৬ ভারতের পানি সম্পদ মন্ত্রী উমা ভারতী বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন ভারত আন্তঃ নদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। উমা ভারতী বলেন, ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রধান নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে খরাপ্রবণ এলাকায় পানি পৌঁছানোই এখন কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের কাজ। এ দু’টি নদীই বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা (বাংলাদেশে পদ্মা) থেকে পানি সরিয়ে নিলে তার রেশ বাংলাদেশের ওপরে প্রবলভাবে পড়বে। কমে যাবে ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা ও যমুনার পানি।
ভারত জুড়ে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের যে মহাপরিকল্পনা রয়েছে তারই অংশ হিসেবে ‘মানস-সংকোষ-তিস্তা-গঙ্গা’ নদী সংযোগ প্রকল্পের কাজ শুরু করা হবে বলে ভারতের তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রী সানোয়ার লাল জাট-এর বক্তব্য দিয়ে গত ১৩ জুলাই ২০১৫ ভারতের পত্র-পত্রিকায় রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। দেশটির পানিসম্পদ মন্ত্রী সানোয়ার লাল জাট জানিয়েছেন — তার মন্ত্রণালয় আসাম, পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহার সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নদী সংযোগ প্রকল্প ‘মানস-সংকোষ-তিস্তা-গঙ্গা’র কাজ শুরু করবে। এ সময় পানিসম্পদ মন্ত্রী আরো বলেছেন, এ সংযোগ প্রকল্প শুধু এ অঞ্চলের কৃষি ও পানি প্রাপ্যতাকেই সহজ করে তুলবে না, একইসঙ্গে তা দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিশাল পরিমাণ পানি চালান করবে। মানস ও সংকোষ হল ব্রহ্মপুত্রের দু’টি উপনদী যার পানি সরিয়ে নেয়ার অর্থ হল ব্রহ্মপুত্রে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া। বাংলাদেশের মিঠা পানির তিন ভাগের দুই ভাগই আসে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে। এমনিতেই চীন ব্রহ্মপুত্রের ওপর বাঁধ নির্মাণের পাঁয়তারা করছে। তার ওপর এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের জন্য এক অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
ভারত আগামী ৫০ বছরের ক্রমবর্ধমান পানি ও খাদ্যের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে দেশের ছোটবড় ৩৮টি নদীকে ৩০টি সংযোগকারী খালের মাধ্যমে জুড়ে দেওয়ার যে পরিকল্পনা নেয় তার নাম আন্তঃ নদী সংযোগ প্রকল্প। এই ৩০টি নদীর মধ্যে ১৪টি নদী হিমালয়ান অঞ্চলের এবং ১৬টি পেনিনসুলার নদী। পরিকল্পনার মূল দিক হচ্ছে এক নদী বেসিন থেকে পানি অন্য নদী বেসিনে স্থানান্তর করা। বৃষ্টিপ্রধান উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে পানি খাল কেটে পশ্চিম ভারতে নিয়ে যাওয়া হবে। সংযোগ খালের মাধ্যমে গঙ্গা থেকে পানি নিয়ে যাওয়া হবে গুজরাট, হরিয়ানা, রাজস্থান ও তামিলনাড়– এলাকায়। এতে গঙ্গায় যে পানি সঙ্কট হবে তা পূরণ করা হবে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি দিয়ে। এভাবে মোট ১৭৪ বিলিয়ন কিউসেক পানি পশ্চিম ভারতে নিয়ে যাওয়া হবে। অর্থাৎ, আন্তঃ নদী সংযোগ প্রকল্পের শুরু হবে আসামের ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে।
‘মানস-সংকোশ-তিস্তা-গঙ্গা’ সংযোগ পরিকল্পনা অনুসারে প্রথমে মানস-এর ওপর বাঁধ তৈরি করে সংযোগ খালের মাধ্যমে সংকোশ নদীর সাথে যুক্ত করা হবে। সেখান থেকে ব্যারেজ ও সংযোগ খালের মাধ্যমে পানি নিয়ে ফেলা হবে তিস্তা ব্যারেজের ওপরের অংশে। তিস্তা ব্যারেজে পানিপ্রবাহের দিক পরিবর্তন করে মহানন্দা নদীর মাধ্যমে গঙ্গায় ফারাক্কা বাঁধের ওপরের অংশে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা আগেই অগ্রসর হয়েছে। এভাবে ব্রহ্মপুত্র বেসিনের উপনদী থেকে উদ্বৃত্ত পানি নিয়ে যাওয়া হবে গঙ্গায়। পরিকল্পনা অনুসারে গঙ্গার পানি সুবর্ণরেখা ও মহানদীর মাধ্যমে চলে যাবে ভারতের অন্য রাজ্যে। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের অধীনে ‘মানস-সংকোশ-তিস্তা-গঙ্গা’ সংযোগ পঞ্চম আন্তঃরাজ্য প্রকল্প। প্রথম প্রকল্প মধ্যপ্রদেশ ও উত্তর প্রদেশের কেন-বেতওয়া নদীসংযোগের চূড়ান্ত কাজ এবছরের শেষ নাগাদ শুরু হবে। আরো তিনটি প্রকল্প জরিপ-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর্ব শেষ করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।
২০০২ সালের ১৪ আগস্ট তৎকালীন বিজেপি সরকারের আমলে ভারতের রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম আন্তঃ নদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে সংকটকালে দেশের নদীগুলোকে জুড়ে দেয়ার ঘোষণা দেন। প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উনড়বয়ন ব্যাংক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ভারতীয় নাগরিকরা অর্থ সাহায্যের আশ্বাস দেয়। ২০০২ সালের অক্টোবরে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নদীসংযোগ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিতে সরকারের প্রতি নির্দেশনা জারি করে। ২০০৪ সালে দু’দেশে রাজনৈতিক দল, পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের মুখে ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন স্থগিত হয়ে পড়ে। ২০১২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট নদীসংযোগ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করতে ভারত সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রীর নেতৃত্বে বিশেষ কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেয়। বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এসে এই প্রকল্পকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। গত ২০১৪-১৫ সালের বাজেটে এজন্য ১০০ কোটি রুপি বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
গত বছর জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার ঢাকা সফরের সময় ৬৫ দফা সম্বলিত যে যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেখানে ২১নং দফায় অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছিল যে, ভারত আন্তঃ নদী সংযোগের ব্যাপারে এমন কিছু করবে না যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। ভারতের পানিসম্পদ মন্ত্রীর আন্তঃ নদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা উপরোক্ত অঙ্গীকারের পরিপন্থী । ভারত এভাবেই অতীতে ১৯৯৬ সালের ফারাক্কা চুক্তি, তিস্তা ও টিপাই বাঁধ নিয়ে প্রতিশ্রুতি কোনোটাই রক্ষা করেনি। আরো উল্লেখ্য, ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শীর্ষ বৈঠকে যৌথ নদী বিষয়ে অববাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনার সিদ্ধান্ত হয়। তাই, ভারত ইচ্ছে করলেই একতরফাভাবে অভিনড়ব নদীগুলোর ওপর আন্তঃ নদী সংযোগের প্রকল্প বা আন্তঃ নদী পানি সরানোর প্রকল্প (ইন্টার রিভার ওয়াটার ট্রান্সফার প্রজেক্ট) বাস্তবায়ন করতে পারে না।
দেশের প্রায় ৬০/৭০ ভাগ পানি ব্রহ্মপুত্র দিয়ে প্রবাহিত হয। এই নদের পানি উজানে প্রত্যাহার হলে বাংলাদেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। অথচ, মহাজোট সরকার তাদের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে ভারতের অন্যায়ভাবে একতরফা পানি প্রত্যাহারের বিরোধিতা করছে না। উল্টো ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং যাওয়ার স্বার্থে ভারতের শাসকশ্রেণীকে তোয়াজ করছে। দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে ফেলে ভারতকে ট্রানজিট দিচ্ছে, বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিচ্ছে। অথচ, অভিনড়ব নদী নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক অনেক আলোচনা-চুক্তি-যৌথ ঘোষণা হলেও বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা পায়নি। স্বাধীনতা পরবর্তী সকল সরকারই ভারত তোষণ ও নতজানু পররাষ্ট্র নীতির কারণে বাংলাদেশ পানির ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। দেশ ও দেশের মানুষ বিপনড়ব হলেও শাসক গোষ্ঠী থেকেছে নির্বিকার। ভারত সরকারের একতরফা পানি প্রত্যাহার ও বাংলাদেশ সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই-সংগ্রাম গড়ে তোলা আজ জনস্বার্থে জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।