Sunday, November 24, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - আগষ্ট ২০১৬সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের সাথে সব সরকারই হাত মিলিয়েছে

সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের সাথে সব সরকারই হাত মিলিয়েছে

img10গত ১ জুলাই গুলশানের ‘হলি আর্টিজান’ রেস্টুরেন্টে আইএস নামধারী ধর্মীয় মৌলবাদীদের হাতে বিদেশিসহ ২২জন মানুষের নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনায় দেশবাসীর সাথে আমরাও গভীরভাবে বেদনাহত, উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ। এর এক সপ্তাহের মাথায় ৭ জুলাই ঈদের দিন কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের বৃহত্তম ঈদ জামাতকে লক্ষ্য করে সংলগ্ন এলাকায় পরিচালিত সন্ত্রাসী আক্রমণে ৪ জনের মৃত্যু ঘটেছে। এই হামলাগুলো মানুষের মনে চরম আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। মানুষ আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে লক্ষ্য করছে যে, এই ধর্মান্ধ উগ্রবাদী শক্তির হাত থেকে এমনকি ধর্মপ্রাণ মানুষও নিরাপদ নয়।

কিন্তু এ কথাটিও ঠিক যে ঘটনাগুলো ঘটছে। কেন ঘটছে তা নিয়ে আলোচনাও কম হচ্ছে না। মানুষ এ থেকে পরিত্রাণের রাস্তা খুঁজছেন। তবে হঠাৎ ছড়িয়ে পড়া এই উগ্রতা ও নৃশংসতার উৎস কী- তা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে না পারলে মানুষের মধ্যে এই শঙ্কা ও আতঙ্ক বাড়তেই থাকবে। সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী সম্পন্ন ঘরের ছেলেরা কোন্ অভাবের কারণে এমন আত্মঘাতী হয়ে উঠছে, কেনই বা একটা বিরাট সংখ্যক ছেলেরা ক্যারিয়ার ত্যাগ করে হত্যাকারী হয়ে উঠছে- এর কারণ সঠিকভাবে একেবারে নির্দিষ্ট করে ধরতে না পারলে এই ভয়, আতঙ্ক, অসহায় অবস্থা থেকে মানুষ মুক্তি পাবে না। তাই বলে কারণ বের করার প্রচেষ্টা থেমে নেই। যেহেতু মানুষ এই সমস্যার ভুক্তভোগী- সেহেতু এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছেই। মানুষ বুঝতে চাইছেন, পথ খুঁজে পেতে চাইছেন।

এরকম পরিস্থিতিতে দেশের প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া দলসমূহ বসে থাকে না। তারা ঘটনাটিকে কাজে লাগায়, এর ত্রাস এবং আতঙ্কের দিকটিকে নিজেদের ক্ষমতা হস্তগত করার রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে। জনগণের বেশির ভাগই তাদের মধ্যে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ও ক্ষমতার বাইরে থাকা- এই দুটো অংশের কোনো একটির চিন্তা দ্বারা বিভ্রান্ত হন, যেহেতু তারাই প্রচার মাধ্যমগুলোতে বেশি থাকে। ফলে সত্য আবিষ্কার করা জনগণের বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই হয়ে ওঠে না। আজকের এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে, যেখানে দেশের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়ার উপক্রম- এরূপ অবস্থায় আমরা মনে করি দেশের মানুষ ঘটনাসমূহকে বিচারের ক্ষেত্রে বিগ বিজনেস হাউসগুলোর স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য তৈরি করা মিডিয়াগুলোর উপর নির্ভর না করে নিজের যুক্তি-বুদ্ধি এবং বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের আলোকে বিচার বিশ্লেষণের চেষ্টা করবেন।

ইসলামপন্থী উগ্র জঙ্গীদের সাম্রাজ্যবাদীরাই সৃষ্টি করেছিলো

আফগানস্তানের সোভিয়েতপন্থী নজিবুল্লাহ্ সরকারকে উৎখাত করার জন্য আমেরিকা তালেবানদের সৃষ্টি করেছিলো। প্রায় ৯০ হাজার তালেবান অর্থাৎ মাদ্রাসার ছাত্রদের আমেরিকার অর্থ ও অস্ত্রের সাহায্যে কিভাবে পাকিস্তানে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, বিভিন্ন মুসলিম দেশগুলো থেকেও কিভাবে জিহাদিদের সংগ্রহ করা হয়েছে তা এখন এক রোমাঞ্চকর গল্পের মতো শোনাবে। সিআইএ ‘অপারেশন সাইক্লোন’ নামে যে প্রজেক্ট পরিচালনা করে তাতে তারা শত শত কোটি টাকা সেদিন তালেবানদের পেছনে ঢেলেছিল। সেদিনও বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মভীরু ছাত্র-যুবকরা ধর্ম রক্ষার সংগ্রাম মনে করেই আফগানিস্তানের শাসন ক্ষমতা দখলের এ লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলো, প্রাণও দিয়েছিলো। আজ তাদের পরিবারের কেউ হয়তো ইন্টারনেট টিপলেই তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানের সাথে তালেবান নেতাদের বৈঠকের ছবি দেখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলবেন।

১৯৯৬ সালে তালেবানরা ক্ষমতায় এলো। তাদের মধ্য দিয়েই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে এই উগ্র মৌলবাদী রাজনীতি কোনো একটি দেশের ক্ষমতা দখল করলো। আফগান যুদ্ধের সময়ই গড়ে উঠেছিলো ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বে ‘আল কায়েদা’। বিভিন্ন ধর্মীয় জঙ্গী সংগঠন গড়ে ওঠা ও তাদের একত্রিত হওয়ার জায়গা ছিলো এই আফগান যুদ্ধ। নজিবুল্লাহ্ সরকারের পতনের পরই আমেরিকার সেই সময়ের কাজ শেষ হয়। কিন্তু এই গ্রুপগুলো তখন সশস্ত্র ও শক্তিশালী।

তাদের ঘাঁটি আছে, অস্ত্র আছে, ট্রেইন্ড ক্যাডার আছে। অস্ত্রের ধর্মই এই যে, এটি যার হাতে যখনই যায়, সেই তখন একটি স্বতন্ত্র শক্তি ধারণ করে এবং এক সময় সে তার স্রষ্টার বিরুদ্ধেই অস্ত্র তাক করে। এক্ষেত্রে তাই হলো। ১৯৯৮ সালে আল কায়েদা কেনিয়া ও তাঞ্জানিয়ার আমেরিকান অ্যাম্বেসিতে বোমা হামলা চালায়। সারা বিশ্বেই তখন এরকম ঘটনা একের পর এক চলতে থাকে। চলতে চলতে একসময় ৯/১১ এর টুইন টাওয়ার কান্ড ঘটে। আমেরিকা তখন বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধের শ্লোগান তুলে। আক্রমণ শুরু হয় মধ্যপ্রাচ্যে।

জঙ্গীবাদকে সামনে রেখেই সাম্রাজ্যবাদ আজ আংশিক ও স্থানীয় যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে

টুইন টাওয়ারের ঘটনা নিয়েও অনেক কথা আছে। আমেরিকার মতো দেশে এরকম ঘটনা নিরব সমর্থন ছাড়া যে ঘটতে পারেনা- এটা অনেকেরই ধারণা। এই বিতর্কে আমরা যদি নাও যাই তবুও এ কথা সত্য যে জঙ্গী গোষ্ঠীগুলো আমেরিকা ও ইউরোপের নানা দেশে হামলা করেছে ও করছে তারা অস্ত্র ও অর্থ সহযোগিতা পাচ্ছে আমেরিকা ও ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো থেকেই। কারণ আজ দেশে দেশে পুঁজিবাদ ব্যর্থ, বিপর্যস্ত। একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বেকার শ্রমিকের বিক্ষোভে উত্তাল গোটা ইউরোপ। গ্রীস দেউলিয়া হয়ে গেলো। আমেরিকায় ঘটে গেলো ‘ওয়াল স্ট্রিট মুভমেন্ট’। এই ক্রমবর্ধমান বাজার সংকট মোকাবেলা করার উপায় কী? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে পুঁজিবাদের আপেক্ষিক স্থায়িত্বও আর নেই। অর্থাৎ একসময় একটা সংকট থেকে আরেকটা সংকট আসার মধ্যবর্তী সময়ে যে আপেক্ষিক স্থায়িত্ব পুঁজিবাদের থাকতো- এখন আর তা নেই। এখন বিশ্ব পুঁজিবাদের সংকট এবেলা ওবেলার সংকটে পরিণত হয়েছে। পুঁজিবাদের এই প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে এ যুগের অন্যতম মার্কসবাদী দার্শনিক ও চিন্তানায়ক, ভারতের এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন, আজকের যুগে দেশে দেশে পুঁজিবাদ বাঁচার জন্য অর্থনীতির সামরিকীকরণের পথ ধরেছে। এ ভিন্ন তার বাঁচার আর কোনো পথ নেই। অর্থাৎ সমস্ত শিল্প যখন মন্দায় ডুবছে তখন ব্যাপক পরিমাণে সামরিক শিল্পের প্রসার ঘটাচ্ছে। পুঁজিপতিরা অস্ত্র উৎপাদন করছে, রাষ্ট্র তা অর্ডার দিচ্ছে এবং নিজেই কিনছে। এতে সুবিধা হলো মানুষের ক্রয় ক্ষমতার উপর এ বাজারকে নির্ভরশীল থাকতে হয় না, উপরন্তু অস্ত্র কারখানা ও তাকে কেন্দ্র করে যে সহযোগী ব্যবসাসমূহ গড়ে উঠে তা দিয়ে অর্থনীতিতে একটি তেজিভাব আসে। কিন্তু এর আর এক দিক হলো এই অস্ত্র খালাস করার জন্য রাষ্ট্রকে বিভিনড়ব আংশিক ও স্থানীয় যুদ্ধ (Local and partial war) লাগিয়ে রাখতে হয়, নিজেকে তাতে যুক্ত হতে হয়, অপরকে যুক্ত করতে হয়। ফলে সাম্রাজ্যবাদ আজ দুনিয়াব্যাপী সংঘাত সংঘর্ষ ছড়িয়ে দিচ্ছে ও তাকে দীর্ঘস্থায়ী করছে।

এই আংশিক ও আঞ্চলিক যুদ্ধ লাগানোর জন্য এখন সন্ত্রাসবাদ একটা বিরাট অস্ত্র। বিশ্বের যে কোনো দেশে সন্ত্রাসীদের কথা বলে আমেরিকা ঢুকে পড়ছে। টুইন টাওয়ারে হামলার পর ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ এর নামে আমেরিকা যত্রতত্র আক্রমণ করার লাইসেন্স পেয়েছে। গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে ছাড়খার করে দিয়েছে। ২০০১ সালে আমেরিকা আক্রমণ চালিয়ে তাদেরই প্রতিষ্ঠিত তালেবান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে কারজাই সরকারকে বসায়। তারপর ইরাক, তারও পরে লিবিয়া আক্রমণ করে, লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষকে হত্যা করে ঐ দেশগুলোর তেলক্ষেত্র দখল করে। বাস্তবে তেলক্ষেত্র দখল ও তার আধিপত্য রক্ষার জন্য ঐ সকল দেশের সরকারকে উৎখাত করা, সেসব দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করা- এসব কাজে সাম্রাজ্যবাদীরা এই গোষ্ঠীসমূহকে ব্যবহার করেছে। এ সকল ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো উগ্র সুন্নি ধারণার। আমেরিকা তাদের এই বিভেদকে উস্কে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে বিরাট গোষ্ঠীগত দাঙ্গা লাগিয়ে দেয়। আজ সেখানে শিয়ার বিরুদ্ধে সুন্নি লড়ছে, সুন্নির বিরুদ্ধে কুর্দিরা লড়ছে, এক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আরেক গোষ্ঠী লড়ছে। রক্তের সাগর বয়ে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে।

আর আমেরিকা? সে তাদের সবাইকে অস্ত্র বিক্রি করছে। যে আইএসের বিরুদ্ধে সে মহাযুদ্ধ ঘোষণা করে সারা দুনিয়ার মানুষকে রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে, নিজের প্রাণ তুচ্ছ করে পরের উপকার করছে এ ভাব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাকে সে নিজেই অস্ত্র বিক্রি করছে। তার ভুরি ভুরি প্রমাণ এখন পত্রপত্রিকায় আসছে। ইরাকি সেনারা কয়েকবার আইএস’এর জন্য অস্ত্র নিয়ে যাওয়া আমেরিকান বিমান গুলি করে নামিয়েছে। শুধু আমেরিকাই নয়, আইএস’এর কাছে অস্ত্র বিক্রি করছে প্রায় সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী দেশ। সম্প্রতি প্রকাশিত এক তথ্যে দেখা গেছে আইএস’এর বিস্ফোরকসমূহের কেমিক্যাল সরবরাহকারীদের খাতায় প্রায় সকল বড় বড় সাম্রাজ্যবাদী দেশের নাম আছে, এমনকি ভারতেরও।

বাংলাদেশে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের বিস্তার

বাংলাদেশে সশস্ত্র ইসলামী জঙ্গীবাদের বিস্তার নতুন কোনো ঘটনা নয়। আফগান যুদ্ধে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ‘মুজাহিদরা’ দেশে ফিরে ১৯৯২ সালে হরকত-উল-জিহাদ গঠন করে বলে জানা যায়। ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন স্থানে জঙ্গী হামলা শুরু হয়। পরবর্তী কয়েকবছর রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে, সিপিবি-র জনসভায়, যশোরে উদীচী অনুষ্ঠানে, মাজার-সিনেমা হল-যাত্রা অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলায় অসংখ্য মানুষ হতাহত হয়। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এসব হামলার সুষ্ঠু তদন্ত-বিচার-হামলাকারীদের পরিচয় উদঘাটন করেনি, বরং এসব ঘটনা থেকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল ও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টায় ব্যস্ত ছিল। জঙ্গীদের প্রশ্রয় দেয়া বা তাদের সাথে সরকারের কোনো কোনো মহলের যোগসাজশের অভিযোগ তখনো উঠেছিল। পরবর্তীতে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাজশাহীর বাগমারায় সর্বহারা দমনের নামে বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে জেএমবিকে সরকারী মদদ দিয়ে একধরণের মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেয়া হয়। এমনকি সরকারের উচ্চ মহলের যোগসাজশে ২০০৪ সালে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালাতে মুফতি হান্নানের নেতৃত্বে হরকত-উল-জিহাদের একটি গ্রুপকে সহযোগিতা করে প্রশাসন। ২০০৫ সালে জেএমবি ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কথিত জিহাদের ডাক দেয় এবং সারাদেশে বিভিন্ন স্থানে হামলা চালাতে শুরু করে। জঙ্গীরা সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণে নামায় বাধ্য হয়ে সরকার তাদের দমনে তৎপর হয়। জেএমবি নেতাদের ফাঁসি, বহু জঙ্গী সদস্য গ্রেপ্তার, প্রশিক্ষণকেন্দ্রে অভিযান ও প্রচুর গোলাবারুদ উদ্ধারের মাধ্যমে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড তখনকার মতো অনেকটা স্তিমিত হয়।

কিন্তু, প্রকাশ্য তৎপরতা বন্ধ হলেও গোপনে সদস্য সংগ্রহ ও খেলাফত রাষ্ট্র কায়েমের লক্ষ্যে কাজ করতে থাকে বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন। এই সরকারের আমলে নতুন করে আলোচনায় আসে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও হিজবুত তাহরীর। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে জামাত নেতাদের ফাঁসি ও শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ চলাকালীন সময়ে ‘নাস্তিক’ ইস্যুকে সামনে আনা হয়। হেফাজতে ইসলামী নামক যে সংগঠনটি ‘নাস্তিক’ ব্লগারদের তালিকা প্রকাশ করে ফাঁসিসহ নারীবিদ্বেষী প্রতিক্রিয়াশীল ১৩ দফা দাবি নিয়ে হাজির হয় সেই হেফাজতে ইসলামের সাথে মহাজোট সরকারের আপোষ ও দহরম-মহরম আমরা দেখেছি। এরপর থেকে নাস্তিক কতলের নামে ঘোষণা দিয়ে তালিকা ধরে ধারাবাহিক হত্যা শুরু হয় এবং পরবর্তীতে তা ধর্মীয় ভিন্নমতাবলম্বী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, লেখক-প্রকাশক-শিক্ষক-সংস্কৃতিকর্মীসহ উদারমনা ব্যক্তিবর্গকে হত্যার অভিযানে বিস্তৃত হয়েছে।

স্বাধীনতা পরবর্তী সকল সরকারই দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিস্তার ঘটিয়েছে

ওপরে বর্ণিত ঘটনাপ্রবাহ থেকে আমরা দেখতে পাই, শাসকগোষ্ঠী সবসময় জঙ্গীবাদের সমস্যা নিজেদের রাজনৈতিক হীন স্বার্থে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে এবং সঠিক সময়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের পরিবর্তে একে প্রশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর যত শক্তি ক্ষমতায় এসেছে, শুরু থেকে আজ অবধি, তাদের সবাই ধর্মীয় শক্তির সাথে আপোষ করেছে। আন্দোলন ঠেকানোর জন্য, মানুষকে ধোকা দেয়ার জন্য তারা ধর্মীয় শক্তির প্রসার ঘটিয়েছে, তাদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দিয়েছে। নিজেদের গণবিরোধী শাসন আড়াল করতে ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করেছে, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে মদত দিয়েছে, কূপমন্ডুক মাদ্রাসা শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়েছে। বর্তমান সরকারের সময়ে সবচেয়ে বেশি ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার ঘটেছে। আর ইতিহাস হলো এই যে, জনগণকে দমন করার জন্য বুর্জোয়ারা যাদের সৃষ্টি করেছে, যাদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের ব্যবস্থা করে দিয়েছে- তারা ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠার পর নিজেরাই আজ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করতে চাইছে। এরা আন্তর্জাতিকভাবে যে সকল জঙ্গীরা আছে (তাদের সৃষ্টি কি করে তা আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি) তাদের সাথেও সংযোগ স্থাপন করেছে। অথচ এদেশের মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ছিল ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র — যেখানে ধর্ম হবে কোনো মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার, রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্মের কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না। কিন্তু তাকে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের জায়গায় না রেখে ক্রমাগত রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হতে থাকলে তার মধ্যে উগ্রতা তৈরি হতে বাধ্য। কারণ রাষ্ট্র যদি কোনো ধর্মের পৃষ্ঠপোষণ করে তবে তার যে রাজনৈতিক – সামাজিক – সাংস্কৃতিক প্রভাব তৈরি হয়, সেটা রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ক্ষমতা হস্তগত করার স্পর্ধা না দেখিয়ে পারে না।

গোটা বিশ্বেই পুঁজিবাদ আজ ধর্মের সাথে আপোষ করে চলছে

সামন্ত স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে ব্যক্তি স্বাধীনতা, নারীর স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সম্পত্তির ব্যক্তিগত অধিকার অর্থাৎ ব্যক্তিমালিকানা- এসবকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিলো বুর্জোয়া শাসন ব্যবস্থা। সামন্ত সমাজের এ্যাবসলিউটিজমের বিপরীতে ব্যক্তির স্বাধীনতা, ব্যক্তির মুক্তি ইত্যাদি চিন্তাগুলো তারা সমাজে এনেছিলো। রাজারা ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে যে চিন্তা সামন্ত সমাজের মধ্যে ছিলো- তার বিরুদ্ধে লড়াই করে বুর্জোয়ারা সম্পূর্ণ ইহজাগতিক, পার্থিব মানবতাবাদী চিন্তাভাবনা সমাজে এনেছিলো। এই মানবতাবাদের মূল সুর ছিলো ‘Non recognition of any spiritual entity’। সেই স্পিরিট তারা ততদিন পর্যন্তই টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলো যতদিন পর্যন্ত তাদের মধ্যে অবাধ অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ছিলো। সেই প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতির উপরিকাঠামো হিসেবেই সেগুলো সমাজে বজায় ছিলো। কিন্তু যেহেতু পুঁজিবাদ সর্বোচ্চ মুনাফার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, সেহেতু একসময় সে অবাধ প্রতিযোগিতার স্তর অতিক্রম করে বিকাশের অমোঘ নিয়মেই একচেটিয়া পুঁজিবাদে পরিণত হলো। ক্রমেই সে শিল্প পুঁজি ও ব্যাংক পুঁজির মিলন ঘটিয়ে লগিড়ব পুঁজির জন্ম দিলো এবং সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হলো। এই একচেটিয়া পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের স্তরে এসে পুঁজিবাদ প্রতিযোগিতাবিহীন অবস্থায় আগের সেই স্পিরিট ধরে রাখতে পারেনি এবং পারবেনা যে সেটাই ছিলো স্বাভাবিক। ফলে পুঁজিবাদী শোষণের মাধ্যমে সৃষ্ট বৈষম্যের স্বরূপমানুষ যেনো বুঝতে না পারে সেজন্য আজকের প্রতিক্রিয়াশীল পুঁজিবাদ অধ্যাত্মবাদী চিন্তার প্রসার তথা ধর্মের সাথে আপোষ করে পথ চলছে।

জাতীয় ঐক্যের কথা কারা তুলছেন, কেন তুলছেন?

গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনার পর দেশের মানুষ যখন ক্ষোভে ও শোকে মুহ্যমান, এই সুযোগে জনগণের কাছে পরম পরিত্যাজ্য আওয়ামী লীগ জাতীয় ঐক্যের শ্লোগান তুললেন। তাদের ফ্যাসিবাদী শাসনে গোটা দেশের মানুষের মধ্যে বিক্ষুব্ধতা জমে আছে, যা উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে গণআন্দোলনে রূপ নিতে পারেনি- এ সবকিছুকে এখন তারা একটি শব্দের নিচে চাপা দিতে চান। একই সময়ে বিএনপিও জাতীয় ঐক্যের কথা তুললেন, কারণ তা নাহলে এমনিতেই তারা গণবিচ্ছিন্ন, তাদের আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে তারা বলেছেন জামায়েতে ইসলামী’র কথা বলে ঐক্যে বিভেদ সৃষ্টি করা যাবে না। প্রকৃতপক্ষে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রস্তাব বিএনপি মানবে না, বিএনপির প্রস্তাব আওয়ামী লীগ মানবে না- এই হবে জাতীয় ঐক্যের পরিণতি।

জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে এর পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য এসেছে সিপিবি-বাসদ এর পক্ষ থেকে। তারা সাম্প্রদায়িক শক্তি ব্যতিরেকে বাকি সকল রাজনৈতিক দলের ঐক্যের কথা বলেছেন। তাদের এই বক্তব্য আমাদের বিস্মিত করেছে। বুর্জোয়ারা সংকটে পড়ে ঐক্যের কথা বলছে, তার মধ্যে বিভিনড়ব শক্তির কি কি ধরনের মিলন-বিচ্ছেদ হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করছে — তাতে বামপন্থীদের কী? কার বিরুদ্ধে ঐক্য হবে, জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে তো? সারাদেশের মানুষইতো এর বিরুদ্ধে আছে। সরকার এর বিরুদ্ধে উদ্যোগ নেবে। এদের সাংগঠনিক শক্তিকে মোকাবেলা করবে ও এদের গড়ে ওঠার যে ভাবগত জমিন এদেশে আছে, সরকার তার শোষণের প্রয়োজনেই যাকে জারি রেখেছে, সেটিরও মূলোৎপাটন করতে হবে। এই মর্মে মানুষকে জড়ো করে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা, তার প্রতিক্রিয়াশীল সুবিধাবাদী রাজনীতি জনগণের কাছে তুলে ধরাই না বামপন্থীদের কাজ। সরকার বলেছিলেন, দেশে আইএস নেই, জঙ্গী নেই। এখন সবাই বলছেন, আছে। জঙ্গীরা সরকারের নানারকম নিপীড়ন এবং তাকে কেন্দ্র করে মানুষের যে বিক্ষুব্ধতা — তার মধ্যেই আছে, সেই কারণেই আছে। তা নাহলে এদেশে তাদের থাকার প্রশ্ন উঠতো না। তাহলে আবার সরকারের সাথেই জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার দরকার কী?

দরকার আছে। সকল বামপন্থীরাই স্বীকার করেন, সমাজটা শ্রেণীবিভক্ত। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে সকল শ্রেণীর ঐক্য বলে কিছু থাকতে পারে না। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে জাতীয় ঐক্যের মানেই হলো যত অন্যায়, অত্যাচার, নিষ্ঠুরতা সরকার করছে তাকে মানিয়ে নেয়ার জন্য সমস্ত রাজনৈতিক শক্তিকে তার পেছনে টেনে আনা। এই হলো দরকার। এই দরকারে সাড়া দিয়েছেন আমাদের তথাকথিত বিপ্লবী বামপন্থীরা। আর সাড়া দেয়াই শুধু নয়, এর প্রচারক হয়ে মাঠে নামা এই বামপন্থীদের ব্যাপারে জনগণ এখন থেকেই সচেতন না হলে ঠকবেন।

সিপিবি’র এসব ব্যাপারে ঐতিহ্য আছে। তারা ’৭৪ সালে নিজেদের দল বিলুপ্ত করে বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন, জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলেছিলেন। এবারও ঐক্যের ব্যাপারে কেউ ডাকুক না ডাকুক আমরা আছি এই দৃঢ় মনোভাব নিয়ে তারা দাঁড়িয়ে আছেন। এবার তারা একা নন, তাদের বন্ধু হয়েছেন বাসদ। কিছুদিন আগেও এই দুই দল বুর্জোয়াদের দ্বারা সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকটে বড় দুই রাজনৈতিক দলের সাথে সওয়াল করেছেন — কী করে তা থেকে তাদের উত্তরণ ঘটানো যায়। এভাবে বারবার তাদের সংকটকালে বুর্জোয়াদের পাশে দাঁড়াতে দেখা গেছে। এইরকম জাতীয় ঐক্যের কথা বলে বুর্জোয়ারা দেশে দেশে গণআন্দোলনসমূহকে নির্লজ্জভাবে দমন করে। এরা সবই জানেন। জেনেশুনেই বামপন্থী নাম নিয়ে এতবড় কেলেংকারি তারা করলেন, জনগণের প্রতি এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা তারা করলেন।

অপমানিত-অবমানিত দিশেহারা যুবকরাই গোটা পৃথিবীতে জঙ্গীদের মূল রিক্রুটমেন্ট

আমরা আগেই দেখিয়েছিলাম যে, সাম্রাজ্যবাদীরা কিভাবে এই জঙ্গীদের সৃষ্টি করেছে, কেন আজও তাদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করছে। তারা তাদের বিভিন্ন রকম চক্রান্ত ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এই সন্ত্রাসী শক্তিসমূহকে কাজে লাগাচ্ছে। আবার এই সন্ত্রাসবাদীদের জঙ্গী মনন তারা তৈরি করছে বিশ্বব্যাপী তাদের লুণ্ঠন-আগ্রাসনের কারণে যে বিক্ষুব্ধতা যুবকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে তাকে কেন্দ্র করে। বিশেষত: প্যালেস্টাইন, ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া ইত্যাদি দেশসমূহের উপর তারা যে জাতিগত ও ধর্মগত নিপীড়ণ চালিয়েছে- তা ভয়াবহ ও নির্মম। ঐ সকল দেশের অপমানিত-অবমানিত-দিশেহারা যুবকরা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য এ সকল সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সাথে যুক্ত হচ্ছে। আমাদের দেশেও পুঁজিবাদী শাসনে ও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে নিষ্পেষিত হয়ে মর্যাদাহীনভাবে বেঁচে থাকা অপমানিত-অবমানিত-দিশেহারা যুবকরা এই পথে যাচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই মনে করে তারা জ্ঞাতে ও অজ্ঞাতে সাম্রাজ্যবাদীদের পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করছে। বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের প্রকৃত শক্তি – গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক শক্তির দুর্বল অবস্থানের কারণে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সত্যিকারের লড়াইয়ের পথ না পেয়ে এই অপমানিত-অবমানিত-দিশেহারা যুব সম্প্রদায় ক্রোধে-ঘৃণায় সাম্রাজ্যবাদীদেরই চক্রান্তের ফাঁদে পড়ে আজ উগ্র ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদী পথে পা বাড়িয়েছে।

এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীসমূহ নিরীহ মানুষকে হত্যা করে সারা বিশ্বে ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছে। এই ঘটনাগুলোকে সাম্রাজ্যবাদী দেশের শাসকরা ভালভাবেই কাজে লাগাচ্ছেন। দেশের নিরাপত্তা, জাতীয় স্বার্থ ইত্যাদির দোহাই দিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দীর্ঘ ঐতিহ্য থাকা দেশসমূহেও আজ মত প্রকাশের অধিকার সঙ্কুচিত করা হচ্ছে। ফ্রান্সে গত তিন মাস ধরে চলা জরুরি অবস্থা আরও বাড়ানো হয়েছে। ঐ দেশে চলতে থাকা রেলসহ বিভিন্ন সেক্টরের শ্রমিকদের বিরাট ধর্মঘট দমন করা হয়েছে। দেশে দেশে এই ঘটনা এখন ঘটতেই থাকবে। রাষ্ট্রিয় নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রিয় জরুরি পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে এসব দেশে গণআন্দোলনসমূহকে নির্মমভাবে দমন করা হবে। দেশের মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদী আবহ তৈরি করা হবে, ডাক দেয়া হবে জাতীয় ঐক্যের। জনগণকে দেখানো হবে এই মুহুর্তে মালিক-শ্রমিক বলে কিছু নেই- সকলের ঐক্যবদ্ধভাবে এই বিপদ মোকাবেলা করতে হবে।

কিন্তু এ সময়ে মালিকরা এক টাকাও লাভ কমাবেন না। শ্রমিক শোষণ বন্ধ হবে না, বরং আরও দ্বিগুণ গতিতে চলবে। প্রতিবাদ করলে বলা হবে জাতীয় ঐক্যে চিড় ধরানো হচ্ছে, জঙ্গিবাদের হাত শক্তিশালী করা হচ্ছে। আমাদের দেশে গুলশান ও শোলাকিয়ার কাঁপুনি থামার আগেই সরকার রামপাল নিয়ে চুক্তি সম্পন্ন করে ফেলেছেন, গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছেন। এ সবই পুরনো কৌশল, চেনা ছক। কিন্তু বারবার মানুষকে তারা এভাবে ফাঁসিয়ে রাখতে পারবে না।

এই সাম্রাজ্যবাদীরা আজ সারা বিশ্বে কি ভয়াবহ কান্ড করে চলেছে। সে সন্ত্রাসীদেরও সৃষ্টি করছে, তাকে অস্ত্রও দিচ্ছে — আবার তার বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করছে। এই জঙ্গীদের প্রতিশোধপ্রবণ মন সাম্রাজ্যবাদীরা তৈরি করছে তাদেরই শোষণ-অন্যায়-অত্যাচারের কারণে যে অপমান-অবমাননাবোধ তাকে কেন্দ্র করে, আবার একে তারা ব্যবহার করছে তাদেরই স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য। দেশে দেশে তারা এক জাতির সাথে আরেক জাতির, এক সম্প্রদায়ের সাথে আরেক সম্প্রদায়ের বিভেদ লাগিয়ে রাখছে। গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে সংঘর্ষ লাগিয়ে দেশ ছাড়খার করে দিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের তেলক্ষেত্র দখলের জন্য গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে কবরস্থানে পরিণত করেছে। শিয়া-সুনিড়বদের একে অপরকে একবারে খতম করে ফেলার যুদ্ধ কী মুসলমানদের দরকার ছিলো? তাহলে দরকার কার ছিলো? কার ইঙ্গিতে নিজেরা খুনোখুনি করে পরস্পর নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে?

আজ বিশ্বব্যাপী এই সমস্ত নৃশংস জঙ্গি হামলার কারণে গোটা বিশ্বে অন্যান্য সমস্ত ধর্মাবলম্বী, সমস্ত জাতি, গোষ্ঠীর কাছ থেকে মুসলমানরা পৃথক হয়ে পড়ছে। মুসলমান মাত্রেই সন্ত্রাসী- এই চিন্তা মানুষের মধ্যে দৃঢ় হচ্ছে। সেটা আরও অপমান-অবমাননা তৈরি করছে। এ থেকে যদি দেশের তরুণরা-যুবকরা আরও চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে তো এ জাতির নিঃশেষ হয়ে যাওয়া ছাড়া কোন পথ থাকবে না। এত ক্রোধ, এত অপমানবোধ নিয়ে মহৎ কিছু দুনিয়াতে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না।

এই যুবকেরা নিজের প্রাণ ত্যাগ করতে দ্বিধা করছে না, তাদের আমরা ভেবে দেখার জন্য বলবো, যত অপমান, যত অবমাননা-শোষণ-লাঞ্চনা আজ জগতে আছে — এর উৎস কী? কারা মানুষের সর্বস্ব হরণ করে তাকে পথের ভিখিরি করছে, কারা জাতিতে জাতিতে দাঙ্গা লাগাচ্ছে, একই ধর্মের বিভিনড়ব সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা লাগাচ্ছে, দুনিয়াতে রক্তের সাগর বইয়ে দিয়ে কাদের লাভ হচ্ছে? এদের বাদ দিয়ে নিরীহ মানুষকে হত্যা করে কোনো বড়ত্বই অর্জন হবে না। বরং প্রাণ তুচ্ছ করার মতো বিরাট ক্ষমতার অপব্যবহার হবে। তার ফল ভোগ করবে সেই তারাই যাদের প্রতি ক্ষোভ থেকে তারা এ রাস্তায় এসেছে।

তাই আজ দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক শক্তির সম্মিলিত লড়াই-ই একমাত্র এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে। প্রত্যেক সম্প্রদায়ের শোষিত-নির্যাতিত মানুষকে তাদের সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে এই সকল সংকটের উৎস পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একত্রিত হতে হবে। এছাড়া আর সকল পথ মিথ্যা, ধোঁকাবাজী ও লোক ঠকানোর পথ। এ লড়াই যারা করবে, সমাজের মানুষকে সকল প্রকার শোষণের হাত থেকে মুক্ত করার লড়াই যারা ভয়হীনচিত্তে এগিয়ে নিয়ে যাবে, তাদের মধ্য থেকেই একদিন চরিত্রের বড়ত্ব ও মহত্ব নিয়ে নতুন মানুষের জন্ম হবে।

সাম্যবাদ আগষ্ট ২০১৬

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments