নদীমাতৃক বাংলাদেশের অধিকাংশ নদী আজ মৃতপ্রায়। ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে তিস্তা পারের হাজার হাজার মানুষ হাহাকার করছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা অববাহিকায় নেমে এসেছে চরম বির্পযয়। মেঘনার উজানে ভারতের বরাক নদে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের চেষ্টা হয়েছিল। এখন আরেক বিপদ ঘনিয়ে এসেছে, যার নাম আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প। ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ মহাপরিকল্পনা অনুসারে ছোট-বড় ৩৮টি নদীকে ৩০টি সংযোগকারী খালের মাধ্যমে যুক্ত করা হবে। পরিকল্পনার মূল দিক হচ্ছে নদীর এক অববাহিকার উদ্বৃত্ত পানি অন্য অববাহিকায় যেখানে ঘাটতি রয়েছে, সেখানে স্থানান্তর করা। এর আওতায় আন্তর্জাতিক নদী ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা থেকে পানি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে খরাপ্রবণ এলাকা গুজরাট, হরিয়ানা, রাজস্থান, তামিলনাড়ুতে।
অনেকদিন ধরে প্রস্তাবনার আকারে থাকলেও সম্প্রতি ভারত এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তৎপর হয়ে উঠেছে। বিজেপি সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রী উমা ভারতী গত ১৬ মে ২০১৬ বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রধান নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে খরাপ্রবণ এলাকায় পানি পৌঁছানোই এখন কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের কাজ। ২০১৫ সালের ১৩ জুলাই ভারতের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে — কেন্দ্রীয় সরকার আসাম, পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহার রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নদী সংযোগ প্রকল্প ‘মানস-সংকোশ-তিস্তা-গঙ্গা’র কাজ শুরুর উদ্যোগ নিয়েছে। এ ঘোষণা দেয়ার সময় তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রী বলেন, “এ সংযোগ প্রকল্প শুধু এ অঞ্চলের কৃষি ও পানি প্রাপ্যতাকেই সহজ করে তুলবে না, একইসঙ্গে তা দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিশাল পরিমাণ পানি চালান করবে।” মানস ও সংকোশ হল ব্রহ্মপুত্রের দুটি উপনদী, যার পানি সরিয়ে নেয়ার অর্থ হল ব্রহ্মপুত্রে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া।
নদী সংযোগ প্রকল্পের ইতিকথা
১৯৮০ সালে ভারতের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় যে জাতীয় পরিকল্পনা তৈরি করে তাতে প্রথম নদীগুলোর আন্তঃসংযোগের পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য দুই বছর পর গঠন করা হয় ‘ন্যাশনাল ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি’ নামে এক সংস্থা। এই সংস্থার উপর নদী সংযোগের সম্ভাব্যতা এবং বিভিন্ন কারিগরি, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত দিক সম্পর্কে জরিপ চালানোর দায়িত্ব পড়ে। ভারত সরকার এর পেছনে ১ হাজার কোটিরও বেশি রুপি খরচ করেছে। ফলে এদের সমীক্ষা রিপোর্টে নদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের পক্ষে জোর দেয়া হয়েছে। ১৯৮৭, ১৯৯৩ ও ২০০১ সালে প্রণীত জাতীয় পানি নীতিতে এই প্রকল্পের উল্লেখ করে এক অববাহিকা থেকে অন্য অববাহিকায় পানি নিয়ে যাওয়ার উপর জোর দেয়া হয়েছে।
নদী সংযোগ প্রকল্পের ধারণাটি বিশেষভাবে বেগবান হয় ১৯৯৯ সালে ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বে এন.ডি.এ. জোট দেশটির কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসার পর। রাজস্থান, গুজরাট, অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক ও তামিলনাড়ুর মত হিন্দীভাষী ও খরা প্রধান এলাকাগুলোতে ভোট পাওয়ার জন্যে বিজেপি এই প্রকল্পকে বিশেষ ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে অনেক বছর ধরে। এই প্রকল্পের জন্যে তারা টাস্কফোর্স গঠন করে। পরবর্তীকালে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ জোট ক্ষমতায় এসে এই প্রকল্প নিয়ে ধীরে চলো নীতি নিয়েছিল। তবে ২০১২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সেদেশের সুপ্রিমকোর্টের একটি বেঞ্চ আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প সুনির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য মনমোহন সিং-এর সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সর্বোচ্চ আদালত ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করারও নির্দেশনা দিয়েছে। আন্তঃসংযোগের জন্যে উল্লেখিত নদীগুলো যে আন্তর্জাতিক নদী এবং তার বিশাল অববাহিকা জুড়ে অন্যান্য দেশের মানুষও বসবাস করে এবং অভিন্ন নদীর পানির যে কোনোরূপ ব্যবহার যে তাদেরও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট, সুপ্রিমকোর্ট নির্দেশনা দেওয়ার সময় সে বিষয়টি পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে জিও হাইড্রোলজিক্যাল প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে সামাজিক ও পরিবেশগত প্রতিক্রিয়া যাচাইয়ের যে রেওয়াজ রয়েছে, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে নির্দেশনা দেওয়ার আগে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সেটিও এড়িয়ে গেছে।
নদী সংযোগ প্রকল্পের রূপরেখা
এ প্রকল্পের আওতায় ৩৮টি নদ-নদীকে ৩০টি সংযোগ খাল দ্বারা সংযুক্ত করা হবে। যার মোট দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে ১৫ হাজার কিলোমিটার। এদের মধ্যে কিছু নদীর উৎপত্তি হিমালয় থেকে, এদেরকে বলা হয় হিমালয়ান নদী। এই নদীগুলোকে ১৪টি খালের দ্বারা সংযোগ ঘটানো হবে। বাকি নদীগুলো দক্ষিণ ভারতের। এদেরকে বলা হয় পেনিনসুলা নদী। এদেরকে ১৬টি খালের মাধ্যমে যুক্ত করা হবে। তৈরি করা হবে ছোট বড় ৩ হাজার জলাধার। খালগুলো ৫০ থেকে ১০০ মিটারের মত প্রশস্ত হবে। গভীরতা হবে প্রায় ৬ মিটার। প্রকল্পে মোট ব্যয় হবে ১১ লক্ষ কোটি রুপি। সংক্ষেপে বললে, পরিকল্পনা বা প্রকল্পের দুটি বড় অংশ আছে। গঙ্গা ও তার কয়েকটি উপনদী যথা গন্ডক, ঘাগরা, সারদা ও যমুনা নদীকে খাল কেটে সংযুক্ত করা হবে। এ পানি সুদূর রাজস্থানে নিয়ে যাওয়া হবে। প্রকল্পের দ্বিতীয় অংশে আছে ব্রহ্মপুত্র নদী। গঙ্গা ও তার উপনদী থেকে যে পানি সরানো হবে, তা পূরণ করা হবে ব্রহ্মপুত্রের পানি দ্বারা। সে ক্ষেত্রে দুটি খাল খনন করা হবে— (১) মানস-সংকোষ-তিস্তা সংযোগ ও (২) যোগী ঘোপা-তিস্তা-গঙ্গা সংযোগ খাল। গঙ্গার তুলনায় ব্রহ্মপুত্র নিচু দিয়ে প্রবাহিত হয়। তাই পাঁচটা ধাপে ব্রহ্মপুত্রের পানিকে ১০০ মিটার উচুঁতে তুলে তারপর গঙ্গায় ফেলা হবে। অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্রের পানির মাধ্যমে পূরণ করা গঙ্গার পানি প্রবাহ কিন্তু ফারাক্কা দিয়ে বাংলাদেশে আসবে না, চলে যাবে সুদূর দাক্ষিণাত্যে। ফারাক্কা পয়েন্ট থেকে সংযোগ খাল কেটে ওড়িশার সুবর্ণরেখা ও মহানন্দার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা হবে। তারপর মহানদী, গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী ও ভাইগাই নদ-নদীগুলোকে সংযুক্ত করে কর্ণাটক, কেরেলা, তামিলনাড়– রাজ্যে পানি সরবরাহ বাড়ানো হবে।
বাংলাদেশের উপর আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের প্রভাব
দেশের সকল বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ডেকে আনবে। আমাদের পানির উৎস প্রধানত তিনটি : আন্তর্জাতিক নদীপ্রবাহ, বৃষ্টি এবং ভূগর্ভস্থ পানি। এর মধ্যে নদীপ্রবাহের অবদান দু’তৃতীয়াংশের বেশি (৭৬.৫%)। বাকি দু’টোর অবদান যথাক্রমে ২৩% ও ১.৫%। বলা বাহুল্য, সাগরের পাশাপাশি নদীর পানি বাষ্পীভূত হয়েই বৃষ্টিতে পরিণত হয়। ভূগর্ভস্থ পানির ভাণ্ডারেও নদীর অবদান বিশাল। নদীসংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র উভয় নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করা হবে। এ দুই নদী দিয়ে বর্ষাকালে পানি আসে দেশের মোট পানিপ্রবাহের প্রায় ৮০ ভাগ, শুকনো মৌসুমে ৯০ ভাগেরও বেশি। ফলে বাংলাদেশে ভারতের নদী সংযোগ প্রকল্পজনিত ক্ষয়-ক্ষতির অর্থনৈতিক মূল্যের চেয়েও প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিপর্যয় বড় হয়ে দেখা দেবে।
মরুকরণের দিকে যাবে বাংলাদেশ, বাড়বে বন্যার প্রকোপ
গঙ্গানদীতে ফারাক্কা বাঁধ দেয়ার ফলে ইতোমধ্যে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল শুকনো মৌসুমে পানি সংকটের শিকার হয়েছে। আন্তঃনদী সংযোগ খাল করে ভারত সরকার যদি ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রবাহ প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে বাংলাদেশের কৃষি ভীষণভাবে ব্যাহত হবে এবং শিল্প উৎপাদন, সেচ, বনায়ন, মৎসসম্পদ প্রভৃতির ওপর চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সারাদেশের নদী অববাহিকা অঞ্চলে বর্তমানে ও ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনবে। কালক্রমে মরুকরণের দিকে ধাবিত হবে দেশ। পানি সংকটের কারণে নদী সমূহের নাব্যতা হ্রাস পেয়ে তলদেশের উচ্চতা বেড়ে যাবে। ফলে, বর্ষা মৌসুমে অতি বর্ষণের পানি ধারণ করতে না পারায় বন্যার প্রকোপ বাড়বে এবং নদী ভাঙ্গনের সৃষ্টি হবে।
কমে যাবে পলি পরিবহন — বাড়বে লবণাক্ততা — ধ্বংস হবে সুন্দরবন
শত সহস্র বছর ধরে নদী বাহিত পলল দ্বারা গঠিত বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশ। এখনও এর গঠন প্রক্রিয়া চলছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মায় পানি প্রবাহ কমার ফলে ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহই পলির একটা বড় অংশ সাগরে বয়ে নিয়ে যায়, যে কারণে ভূমি গঠন এখনও চলছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রবাহ কমে গেলে ভূমি গঠন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে, তা সুনিশ্চিত। সমুদ্র থেকে যে লবণাক্ত পানি জোয়ারের মাধ্যমে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রবেশ করে তা অপসারণ করতে নদীর স্বাভাবিক মিঠা পানির প্রবাহ প্রয়োজন। তাতে লবণ পানি আবার সমুদ্রে গিয়ে পড়তে পারে। প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমের শুরুতে দেশের নদ-নদীতে পানি শুণ্যতা দেখা দেয়, ফলে লবণাক্ততা বাড়তে থাকে। সে কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে অনেক গাছের পাতা শুকিয়ে ঝরে পড়ে। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট অনুযায়ী খুলনা অঞ্চলের প্রধান কয়েকটি নদীতে গত কয়েক বছর ধরে লবণাক্ততা বৃদ্ধির হার ৫০ শতাংশ। এর ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল জুড়ে পৃথিবীর বৃহত্তম প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। প্রয়োজনীয় স্বাদু পানির অভাবে সুন্দরবনের সুন্দরী বৃক্ষরাজি আগামরা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সুন্দরবনকে বলা হয় দেশের ফুসফুস। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট শত ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস বুক দিয়ে আগলে রক্ষা করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে। ফলে এই বনের বিনাশের সাথে সাথে ধ্বংস হবে দেশের জীববৈচিত্র্য, বাড়বে প্রলয়ংকারী ধ্বংসাত্মক ঝড়ে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ, লক্ষ লক্ষ মানুষ হারাবে তাদের জীবিকা।
বিপর্যয় নেমে আসবে পুরো কৃষি ব্যবস্থায়
আমরা জানি, বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক কৃষি প্রধান দেশ। এদেশের রয়েছে বিস্তীর্ণ সমভূমি আর উর্বর নদীপলল সমৃদ্ধ মৃত্তিকা। বৃষ্টিবহুল উষ্ণ আর্দ্র জলবায়ু এদেশকে উৎকৃষ্ট কৃষিভূমিতে পরিণত করেছে। এক সময় এদেশের মাটিকে বলা হত সোনার চেয়েও খাঁটি। কিন্তু আজ আমাদের দেশের কৃষকরা কৃষিজমিতে সেচের জন্য প্রয়োজনীয় পানি পাচ্ছে না। গঙ্গায় পানি প্রত্যাহারের কারণে ইতোমধ্যেই দেশের অন্যতম বৃহত্তম সেচ প্রকল্প গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্প (G.K.project) এলাকায় পাম্পিং ক্যাপাসিটির প্রায় ৬০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মাটির আর্দ্রতা কমে যাওয়ার কারণে ফসল উৎপাদন কমে যাচ্ছে। উত্তরাঞ্চলসহ দেশের অনেক এলাকায় গভীর-অগভীর কোনো নলকূপে পানি পাওয়া যাচ্ছে না, পানির স্তর আশঙ্কাজনক ভাবে নিচে নেমে গেছে। চাষীরা ভীষণভাবে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ১৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত তিস্তা ব্যারেজ আজ অচল। কারণ ১০০ কিলোমিটার উজানে গজলডোবা নামক স্থানে তিস্তা নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে নিয়েছে ভারত।
আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে। প্রথম ধাক্কাটা আসবে সেচসংকট থেকে। ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকার (ব্রহ্মপুত্র-পদ্মা-মেঘনার মিলিত প্রবাহ) ১৮ জেলা উচ্চ ফলনশীল বোরো চাষের জন্য বিভিন্ন সেচ প্রকল্পের উপর নির্ভরশীল। এ প্রকল্পগুলো ৩ লাখ ৫২ হাজার ৩৭ হেক্টর জমিতে পানি সরবরাহ করে। ব্রহ্মপুত্রে পানি সংকট হলে এগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকা পাট চাষের জন্য বিখ্যাত। পাট চাষ ও পচানোর কাজে প্রচুর পানি লাগে। এতদিন ব্রহ্মপুত্র তা যুগিয়েছে। তাই ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ শুকিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে পাটচাষও বন্ধ হয়ে যাবে। অন্যদিকে, দেশে বর্তমানে যে শত শত প্রজাতির মিঠা পানির মাছ পাওয়া যায় ব্রহ্মপুত্র তার একটা বড় অংশের প্রজনন স্থল। নদী সংযোগ প্রকল্প কৃষির পাশাপাশি এই মৎস্যসম্পদকেও বিপন্নতার দিকে ঠেলে দেবে।
আর্সেনিক বিষে আক্রান্ত হবে গোটা দেশ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে আর্সেনিক দূষণের প্রধান কারণ ভূগর্ভস্থ পানির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরতা। নদীতে পানিপ্রবাহ কমে গেলে তা আরও বেড়ে যাবে। ফলে পানির স্তর আরও নিচে নেমে যাবে এবং মাটির নিচের পানিতে বেড়ে যাবে মরণব্যাধি বিষ আর্সেনিক। ভূ-গর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক দূষণের ফলে ক্যান্সারসহ মানবদেহে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধির বিস্তার ঘটবে। ২০০৩ সালের ১৯ আগস্ট দৈনিক প্রথম আলো কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজের চেয়ারম্যান অধ্যাপক দীপংকর চক্রবর্ত্তীর এক সমীক্ষা রিপোর্টের বরাত দিয়ে বলে, বাংলাদেশ-ভারত ও নেপাল এই তিন দেশের গঙ্গা-মেঘনা- ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ৫৫ কোটি মানুষ মারাত্মক আর্সেনিক দূষণজনিত ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে। এদের মধ্যে বাংলাদেশেই আছে প্রায় ৬ কোটি মানুষ। এখানে আর্সেনিক দূষণের কারণে প্রতি হাজারে ১৩ জনের ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞগণ একমত হন যে, বাংলাদেশে আর্সেনিক দূষণের ব্যাপকতা নজিরবিহীন। প্রায় ২ লক্ষেরও অধিক মানুষের শরীরে ইতোমধ্যেই আর্সেনিক আক্রান্ত রোগের বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিয়েছে।
উদ্বাস্তু হবে ১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ
আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞ দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন। ‘ভূতাত্ত্বিক, পরিবেশগত ও আর্থ-সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প’ শীর্ষক গবেষণা করেন যুক্তরাষ্ট্রের লক হ্যাভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড.মোঃ খালেকুজ্জামান, অর্বান বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনিত শ্রী বাস্তব ও ইউনিভার্সিটি অব মিসিসিপি মেডিক্যাল সেন্টারের ফজলে এস ফারুক। তাদের গবেষণায় বলা হয়েছে, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারাবে। ফারাক্কা বাঁধের আগে বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো বছরে গড়ে আড়াই বিলিয়ন টন পলি সাগরে বয়ে নিয়ে যেত। এখন এটি কমে দাঁড়িয়েছে দেড় বিলিয়ন টনে। নদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এ পলির পরিমাণ আরো কমে যাবে। এতে সাগরের লোনা পানি আরও উপরে উঠে আসবে, সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের তিন গবেষক ফ্যারন গুর্দজি, কেরি নোলটন ও কোবি প্লাত “ইন্ডিয়ান ইন্টার লিংকিং অব রিভার : এ প্রিলিমিনারি ইডোলি উমান” শীর্ষক গবেষণায় দেখিয়েছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের সুন্দরবন তলিয়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া ভূগর্ভের পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাবে।
ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ান গত ১৮ মে ২০১৬ এক প্রতিবেদনে লিখেছে, এ প্রকল্প গঙ্গা নদী ও ব্রহ্মপুত্র নদের ভাটিতে বসবাসকারী ও জীবন-জীবিকার জন্য নদীর ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশের ১০ কোটি মানুষের জীবনযাত্রার ওপর প্রভাব ফেলবে।
খোদ ভারতীয় পানি বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরাও আন্তঃনদী সংযোগের বিরোধিতা করছেন
ভারতের পরিবেশবাদীরা প্রথম থেকেই এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছেন। এ নিয়ে তারা সেখানে আন্দোলন করছেন। আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ভারতের পরিবেশবিদ বন্দনা শিভা বিজনেস টুডে’র সাথে এক সাক্ষাৎকারে (১৩ মার্চ ২০১৪) মন্তব্য করেছিলেন, ‘আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বড় ধরনের ধ্বংসাত্মক ব্যবস্থার নামান্তর মাত্র’। তিনি আরো মন্তব্য করেছিলেন ‘এটা একটা দুর্নীতির মহাপ্রকল্পের প্যাকেজ, যেটা ভারতের জীবন নির্ধারণী ইকো-সিস্টেমকে ধ্বংস করবে’। আরেকজন পরিবেশবিদ ‘ওয়াটার ম্যান অব ইন্ডিয়া’ খ্যাত রাজেন্দ্র সিং, ভারতীয় দৈনিক ‘দ্যা হিন্দু’-এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে (১০ জুন ২০১৫) বলেছেন, ‘এটা আমাদের দেশের জন্য ধ্বংসাত্মক। এ প্রকল্প একদিকে বন্যা, অন্যদিকে খরার কারণে বহু মানুষকে উদ্বাস্তু এবং তাদের অবর্ণনীয় ক্ষতি করবে। নদী কোনো রাস্তা নয়, তার একটা জীবনচক্র আছে। আন্তঃনদী সংযোগ ভারতের পানিসম্পদকে ব্যক্তিমালিকানার পথে চালিত করবে’।
ড.লাথা অনস্থা (ডিরেক্টর অব রিভার রিসার্চ সেন্টার)’র মতে, এ প্রকল্প ভারতের নদীভিত্তিক প্রতিবেশের জন্য বিপর্যয়কর হতে পারে। তিনি বলছেন, সরকার দেশের ভূগোলকে নতুনভাবে আঁকতে চাইছেন। বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, বন্য প্রাণী এবং ভাটির দিকে থাকা কৃষকের কি হবে? নদীকে শুধু পানির উৎস হিসেবে দেখলে হবে না, দেখতে হবে পূর্ণাঙ্গ ইকোসিস্টেম হিসেবে। নদী সংযোগের জন্য যে অসংখ্য খাল খনন করতে হবে, তার জন্য প্রতিবেশকে অস্বীকার করতে হবে। এটা অর্থের অপচয়। উদ্বৃত্ত পানি দেখিয়ে যে পরিমাণ পানি সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে, সে হিসেবের মধ্যেও অতিরঞ্জন আছে।
ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প আন্তর্জাতিক নদী আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন
যেসব নদী দুই বা ততোধিক দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, তাদের বলা হয় আন্তর্জাতিক নদী। বাংলাদেশের ৫৪টি নদী ভারত থেকে এবং ৩টি এসেছে মায়ানমার থেকে। অভিন্ন নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের হেলসিংকি নীতিমালায় বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র অভিন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন বিবেচনায় নেবে। ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার (আন্তর্জাতিক নদী ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত) ২নং নীতিতে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘের জলপ্রবাহ নীতিমালা কনভেনশন অনুযায়ী প্রণীত আইনে বলা হয়েছে, নদীকে এমনভাবে ব্যবহার করা যাবে না যাতে অন্য দেশ মারাত্মক ক্ষতি বা বিপদের মুখে পড়ে। নদীর পানিপ্রবাহ যে দেশগুলোর ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, সে সব দেশ স্ব স্ব ভৌগোলিক সীমানার ভেতর ন্যায় ও যুক্তিসঙ্গত ভাবে নদীর পানিপ্রবাহকে ব্যবহার করবে। কোনো পরিকল্পনা বা প্রকল্প গ্রহণ করলে (যেমন- বাঁধ নির্মাণ, নদীর গতিপথ পরিবর্তন ইত্যাদি) করলে, সে সম্পর্কে অপর দেশগুলোকে অবহিত করার বাধ্যবাধকতা থাকবে। আলোচনার মাধ্যমে নদীর ব্যবহার বিষয়ক যে কোনো সমস্যা বা আপত্তির সুরাহা করবে। এসব আন্তর্জাতিক নীতিমালা ও আইনের তোয়াক্কা না করে ভারত একতরফাভাবে নদীসংযোগ পরিকল্পনা অগ্রসর করছে। অথচ, চীন কর্তৃক ব্রহ্মপুত্রের উৎস সাংপো নদীর উপর বাঁধ দিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের ঘোষণায় ভারত সরকার জোরালো আপত্তি জানিয়েছে, বাংলাদেশকে আপত্তি জানানোর অনুরোধ করেছে।
ভারতীয় জনগণের নাম নিয়ে মূলত ভারতীয় পুঁজিপতিদের স্বার্থেই প্রণীত হচ্ছে এই আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প
নদীসংযোগ প্রকল্পের পেছনে ভারতীয় শাসকদের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী —কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘পথিকৃৎ’ নামক সাময়িকীতে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। ১৯৯৫ সালে বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসমাইল মেরা গেলডিন বলেছিলেন, ‘এই শতাব্দীতে যদি যুদ্ধ হয়ে থাকে তেল নিয়ে তাহলে আগামী শতাব্দীতে তা হবে পানি নিয়ে’। বর্তমান সময়ে কথাটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বলা হয়ে থাকে, পানির অপর নাম জীবন। অথচ এই পানিই দিন দিন দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। ‘১৯৯৮ সালে ২৮টি দেশে জলের অভাব ছিল। ২০২৫ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৬০-এর কাছাকাছি। ১৯৭০ সালের পর মাথাপিছু জল পাওয়ার পরিমাণ কমেছে ৩৩ শতাংশ।’
সাধারণ জনগণের জন্য এটা দুঃসংবাদ সন্দেহ নেই। তবে সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানিগুলোর জন্য এ এক দারুণ খবর। এর মধ্যে তারা বিরাট ব্যবসার সন্ধান পাচ্ছে। ফলে বিশ্বব্যাপী সুপেয় পানির উৎসগুলোকে দখল বা নিয়ন্ত্রণ করার কাজ তারা শুরু করে দিয়েছে। এই জলবাণিজ্যে কী পরিমাণ লাভ হতে পারে বিশ্বব্যাংক ইতোমধ্যে তা হিসেব করে ফেলেছে। তাদের হিসেবে প্রতিবছর এ অংকটা দাঁড়াবে প্রায় ১০ হাজার কোটি ডলার অর্থাৎ ৬ লক্ষ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এ জন্য তারা প্রথমেই দেশে দেশে সরকারি পানি সরবরাহ ব্যবস্থা বেসরকারিকরণ করার ব্যবস্থা করছে। তাদের আশা এভাবে বিশ্বব্যাপী একটা মুক্ত জলবাজার গড়ে তোলা যাবে।
নদীসংযোগ প্রকল্পের ক্ষেত্রেও টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান সুরেশ প্রভুর বক্তব্য অনুসারে, দেশী-বিদেশী কর্পোরেট হাউজগুলো এই প্রকল্পের সমস্ত স্তরেই অংশগ্রহণ করবে। ‘তারা জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন, জল সরবরাহ, জল ব্যবহারকারীদের ফোরাম গড়ে তুলে তাদের কাছে জল বিক্রি ইত্যাদি সব কাজই করবে’। পথিকৃৎ এর ভাষ্য অনুযায়ী, ‘নদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের আগেই দেশের নদীগুলোকে কর্পোরেট হাউজগুলোর হাতে একে একে তুলে দেওয়া হচ্ছে। নদী সংযোগ প্রকল্পের এক একটি বা একাধিক ক্যানেলকেও এইভাবে তুলে দেওয়া হবে কর্পোরেট টাইকুনদের হাতে’।
এ আলোচনার পর নিজের দেশের জনগণ ও বিজ্ঞানীমহলকেও অন্ধকারে রেখে এই বিশাল প্রকল্প গ্রহণের উদ্দেশ্য বুঝতে কিছু বাকি থাকে কি?
শুধু দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা নয়, প্রয়োজন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে নিজেদের দাবি জোরালো ভাবে উত্থাপন ও আইনি লড়াই
গতবছর জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফরের সময় ৬৫ দফা সম্বলিত যে যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেখানে ২১ নং দফায় অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছিল যে ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ব্যাপারে এমন কিছু করবে না যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। এখন উমা ভারতীর দেওয়া বক্তব্য ওই প্রতিশ্রুতিকে ভঙ্গ করলো। ১৯৯৬ সালের গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তির অনুচ্ছেদ ৯এর মাধ্যমে উভয়পক্ষ সম্মত হয় যে, দুই দেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহমান অন্যান্য যৌথ নদীগুলোর পানি বণ্টন ও ব্যবহার দুই দেশের পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতেই হবে। এক্ষেত্রে তারা সমতা, ন্যায়পরায়ণতা ও একে অপরের ক্ষতি সাধন না করার নীতিতে পরিচালিত হবে। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভারত ১৯৯৬ সালের পানি বন্টন চুক্তির অনেক ধারা রক্ষা করেনি বরং নতুন করে টিপাইমুখ বাঁধ, তিস্তার পানির একতরফা প্রত্যাহার, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলাদেশকে পানিশূণ্য করার চক্রান্ত করছে।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার যৌথ নদীগুলো নিয়ে ভারতের একের পর এক আগ্রাসী পদক্ষেপ নিয়ে বিভিন্ন সময় দাবি উঠেছে বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক ফোরাম অথবা আন্তর্জাতিক আদালত বা ট্রাইবুন্যালে নিয়ে যাওয়ার। বাংলাদেশ ফারাক্কা ইস্যুটি নিয়ে জাতিসংঘের মত বৃহৎ ফোরামে গিয়েছে এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের অবস্থানের সপক্ষে প্রস্তাবনাও গৃহীত হয়েছে। আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে দ্বি-পাক্ষিক আলোচনায় বাংলাদেশ ভারতের সাথে কার্যকর কোনো সমাধানে আসতে পারেনি। একইসাথে ভারত, চীন, নেপাল, ভুটানসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সাথে যৌথ আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে। কার্যকর করতে হবে যৌথ নদী কমিশন। কিন্তু বর্তমান ও অতীত সরকারগুলোর এসব বিষয়ে লক্ষ্যণীয় কোনো উদ্যোগ-তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়নি।
বন্ধুত্বের কথা বলে অথবা ভোটের স্বার্থে ভারত বিরোধীতা করলেও সব শাসক দলই সাম্রাজ্যবাদী ভারতের কাছে নতজানু থেকেছে
বর্তমান সরকার ভারতকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নৌবন্দর ও রাস্তা ব্যবহারের সুযোগ, বিদ্যুৎ করিডোর, রামপালে সুন্দরবন বিনাশী বিদ্যুৎপ্রকল্প, ভারতীয় বিদ্রোহীদের দমন, সমুদ্রের দু’টি গ্যাসব্লক ভারতীয় কোম্পানিকে ইজারা ইত্যাদি নানা সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু তিস্তাসহ ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা ভারতের কাছ থেকে আদায় করতে পারেনি। সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যাসহ দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। এখানকার বাজার ভারতীয় পণ্যে সয়লাব হয়ে গেছে। বর্তমান মহাজোট সরকার, অতীতের বিএনপি-জামায়াত, জাতীয় পার্টি কোনো সরকারই ভারতের কাছ থেকে অভিন্ন নদীর পানি আদায়ে দৃঢ় অবস্থান নেয়নি। শাসক বুর্জোয়া দলগুলো লুটপাট ও গদি দখল নিয়েই ব্যস্ত, জাতীয় স্বার্থ, জনস্বার্থ বা দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। ক্ষমতায় যাওয়া ও থাকার জন্য এ অঞ্চলের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ভারতের শাসকশ্রেণীর আনুকূল্য লাভের জন্য আওয়ামী লীগ-বিএনপি প্রতিযোগিতা করে। বাংলাদেশের পুঁজিপতিরাও ভারতের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়িয়ে মুনাফা করতে চায়। ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে এদেশের কৃষকসহ সাধারণ মানুষের জীবন ও প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ বিপর্যস্ত হবে— তাই এ নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। নেই বলেই এতদিনেও আন্তঃনদী সংযোগ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট ও জোরালো কোনো প্রতিবাদ দৃশ্যমান হলো না।
দেশের অভ্যন্তরেও নদী-পানিসম্পদ রক্ষা ও কাজে লাগানোর দীর্ঘমেয়াদী কোনো পরিকল্পনা শাসকদের নেই
পৃথিবীতে মিঠা পানির সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। তাই অনেকের মতে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে পানির জন্য। বাংলাদেশ মিঠা পানির এক অমূল্য ভাণ্ডার। অথচ জনস্বার্থে এই সম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবহারের কোনো কার্যকর উদ্যোগ বা পরিকল্পনা শাসকদলগুলোর নেই। বরং শাসক দলগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় অবাধে চলছে নদী-জলাশয় দখল, দূষণ, নদীভাঙন-বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে লুটপাট ইত্যাদি। ভূ-গর্ভস্থ পানি অতিরিক্ত তোলার কারণে আর্সেনিক দূষণের ঝুঁকিতে আক্রান্ত কয়েক কোটি মানুষ। অন্যদিকে বিশুদ্ধ পানির সংকটকে পুঁজি করে চলছে পানি ব্যবসা, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ধাপে ধাপে বেসরকারিকরণের পরিকল্পনা করছে সরকার। তাই আজ নদী রক্ষার সংগ্রামের সাথে গণবিরোধী শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রামকে যুক্ত করতে হবে।
আসুন, নদী ও জীবন রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হই
নদীবাহিত পলি দিয়ে গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ। শরীরে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হলে যেমন মানুষের মৃত্যু ঘটে, তেমনি নদীর পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে বা বাধাগ্রস্ত হলে ভূ-খন্ডের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। ধীরে ধীরে সেটাই হচ্ছে। সে কারণে এক সময়ের ১২০০ নদীর দেশে এখন মাত্র ২৩০টি নদী। এক ফারাক্কা বাঁধই দেশের মানচিত্র থেকে মুছে দিয়েছে ২০টি নদী। ১৯৭৬ সালে মওলানা ভাসানী লক্ষ মানুষ নিয়ে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ করেছিলেন। মাওলানা ভাসানী যে আশঙ্কা করেছিলেন, আজ তা নির্মম বাস্তব। শত হাহাকার করেও সেই প্রমত্ত পদ্মাকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। আমরা কি নীরবে তাকিয়ে নদীর মৃত্যু দেখবো?
আসুন, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশকে মরুভূমিতে পরিণত করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠে রুখে দাঁড়াই। আমাদের দল বাসদ (মার্কসবাদী) গত কয়েক বছর ধরে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যাসহ নদী ও কৃষি বাঁচানোর দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলন করে আসছে। এর অংশ হিসেবে ভারতের আন্তঃনদীসংযোগ প্রকল্প বাতিলের দাবিতে আগামী ২-৫ অক্টোবর ঢাকা-কুড়িগ্রাম অভিমুখে অনুষ্ঠিত হবে রোডমার্চ। এ কর্মসূিচ সফল করতে আপনাদের সার্বিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি।