Sunday, November 24, 2024
Homeফিচারমহান নভেম্বর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শততম বর্ষে পদার্পণ করছে

মহান নভেম্বর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শততম বর্ষে পদার্পণ করছে

পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ-ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ে শামিল হোন

14615760_1199337150089495_5423853507947918820_o
১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এ বছর ৭ নভেম্বর মহান রুশ বিপ্লব ৯৯তম বার্ষিকী পূর্ণ করে শততম বর্ষে পদার্পণ করছে। মহামতি লেনিনের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত সেই রাষ্ট্র এক নতুন সভ্যতার জন্ম দিয়েছিলো। দেখিয়েছিলো, মানুষের উপর মানুষের শোষণ কোনও চিরস্থায়ী ব্যাপার নয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শোষণ-বৈষম্যের অবসান একমাত্র তখনই হতে পারে, যখন ব্যক্তিমালিকানা ও সর্বোচ্চ মুনাফাভিত্তিক এই ব্যবস্থার বদলে সামাজিক মালিকানা ও সুষম বণ্টনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। তখনকার সময়ে ইউরোপ-আমেরিকার যে কোনও পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের তুলনায় পিছিয়ে থাকা সেই দেশ অল্প কয়েক বছরের মধ্যে ঘোষণা করতে পেরেছিলো — এদেশে কোনও বেকার নেই, অভুক্ত নেই। নারীদেরকে সকল প্রকার অপমান-জবরদস্তি থেকে মুক্ত করে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলো। রাষ্ট্রের উদ্যোগে সকলের জন্যে শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলো। সাংবিধানিকভাবে প্রত্যেক কর্মক্ষম মানুষের কাজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলো। পুঁজিবাদী সমাজের সমস্ত নোংরামি সমাজ থেকে মুছে ফেলেছিলো। সে দেশে ভিখারি ছিলো না, পতিতাবৃত্তি ছিলো না। নতুন এ সভ্যতার অভ্যুদয়কে অবাক চোখে স্বাগত জানিয়েছিলেন রম্যাঁ রল্যাঁ, বাট্রান্ড রাসেল, আইনস্টাইনসহ বিশ্ববরেণ্য মনীষীরা; আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুলের মতো বড় মানুষেরা। রুশবিপ্লব তাই মানব ইতিহাসে মহত্তম, সবচেয়ে গৌরবজনক ও দিকনির্দেশকারী ঘটনা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েতের ভূমিকা বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে লড়াকু মানুষকে প্রেরণা ও শক্তি জুগিয়েছিল
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা যখন গোটা পৃথিবীকে আতঙ্কিত করে তুলেছিলো, তখন প্রতিরোধের দূর্গ হয়ে হিটলারের বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েতের আড়াই কোটি মানুষ সেই যুদ্ধে জীবন দিয়েছিলো। রোগশয্যায় শায়িত রবীন্দ্রনাথ রেড আর্মির অগ্রযাত্রার খবর শুনে আনন্দে উদ্ভাসিত হতেন। বলেছেন, ‘পারবে, ওরাই পারবে সভ্যতাকে রক্ষা করতে’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েতের প্রতিরোধ সংগ্রামের অগ্রযাত্রায় পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। দেশে দেশে উপনিবেশিকতা বিরোধী মুক্তি সংগ্রাম গতি পেয়েছিলো, উপনিবেশের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়েছিলো বহু দেশ। পরাক্রমশালী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের জনগণের অকুতোভয় লড়াইয়ের প্রেরণা ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। আজ দেশে দেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নির্মমতা চলছে। গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে রক্তের স্রোত বইছে; ছাড়-খার করে দেয়া হয়েছে ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, ফিলিস্তিনকে। আজ যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকতো, আমেরিকাসহ সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহ নির্বিচারে এই আগ্রাসন চালাতে পারতো না। দেশে দেশে মানুষ নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পারছে, কী ক্ষতি হয়ে গেলো! সব অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সে সোভিয়েত ইউনিয়ন আজ আর নেই। দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষ হারিয়েছে তার সবচেয়ে বড় বন্ধুকে।

যাদের শ্রমে সম্পদ তৈরি হয়-পুঁজিবাদী সমাজে তারাই সবচেয়ে বঞ্চিত, সমাজতন্ত্রে এরাই দেশের মালিক
আমাদের দেশের শ্রমজীবী মানুষের কথা ভাবুন। যে কৃষক আমাদের মুখের অন্ন জোগায়, তার মুখে আহার জোটে না। কারখানায় কাজ করা শ্রমিক পায় না ন্যায্য মজুরি। দাবি তুললে জোটে পুলিশের লাঠি-গুলি। কখনও ভবন ধ্বসে কিংবা কখনও আগুনে পুড়ে মরে। এই সেদিন ফয়েল পেপার তৈরির কারখানায় পুড়ে মরলো ৩৫জন শ্রমিক! সমাজতন্ত্র দেখিয়েছিলো- সম্পদের স্রষ্টা যে, সম্পদ ভোগের অধিকারও তার। পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিক খাটে জীবিকার কাছে সে বাঁধা বলে। সমাজতন্ত্রে তার শ্রম সৃজনশীল, সে শুধু পেট চালানোর জন্যে খাটে না। আনন্দচিত্তে সোভিয়েত শ্রমিক দিন-রাত কর্মযজ্ঞে মেতে উঠেছিলো। পৃথিবীর সবচে বড় ট্রাক্টর কারখানা, সবচে বড় যন্ত্র তৈরির কারখানা— কী করেনি সোভিয়েত শ্রমিকরা! বিরাট বিরাট সমবায় ও যৌথ খামার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। হাজার হাজার স্কুল গড়ে উঠেছিলো কৃষকদের কৃষিসম্পর্কিত বিজ্ঞানশিক্ষা দেয়ার জন্যে। রাশিয়া ভ্রমণকালে রবীন্দ্রনাথ অবাক হয়ে দেখেছেন, শ্রমজীবী মানুষরাই প্রবল ঔৎসুক্যে রাত পর্যন্ত থিয়েটার দেখছে। বড় বড় লেখক-গায়ক, নাট্যকারের জন্ম হয়েছিলো সেদিন, সৃষ্টি হয়েছিলো রুচিবান দর্শকও।

সোভিয়েতের বেদনাদায়ক পতনে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের অকার্যকারিতা প্রমাণ হয় না
এতোসব মহৎ কীর্তি স্থাপনকারী সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন হলো কেনো— স্বভাবতই প্রশ্ন আসে। সমাজতন্ত্র হলো পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে উত্তরণের অন্তর্বর্তী ধাপ। দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও জনগণের মধ্যে বুর্জোয়া ভাবধারা দূর হয়ে যায় না। একদিকে উৎপাদনব্যবস্থায় ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিমালিকানার অবসানের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ, অন্যদিকে তীব্র আদর্শগত ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামের এক কঠিন ও কষ্টকর পথে তাকে অগ্রসর হতে হয়।

সোভিয়েত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা পুঁজিপতিশ্রেণির নিরন্তর ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপ যেমন ছিল, পাশাপাশি ছিল সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহের নানা চক্রান্ত। অপরিসীম মূল্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রবল ধাক্কা সামাল দিতে গিয়ে আদর্শগত চেতনার ক্ষেত্রে দুর্বলতা তৈরি হয়েছিলো। আর অন্তর্ঘাতমূলক নানা চক্রান্ত তো ছিলোই। সমাজতন্ত্রের অভ্যন্তরে পুঁজিবাদী ব্যক্তিস্বার্থের প্রবণতা ক্রমেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিলো। তখন প্রয়োজন ছিলো তীব্র আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। কিন্তু কমরেড স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর, ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে সোভিয়েত পার্টির বিংশতি কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে যে মৌলিক আদর্শগত বিচ্যুতি ঘটে, কালক্রমে ১৯৯০ সালে এসে গর্বাচেভের হাত ধরে তা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতন ঘটায়। এ বিপর্যয় বাইরের শক্তি ঘটাতে পারেনি, অভ্যন্তরের শক্তিই ঘটিয়েছিল। কমরেড লেনিন ও কমরেড স্ট্যালিন তাঁদের জীবদ্দশায় শোধনবাদের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। পরবর্তীতে কমরেড মাও সে তুং এর নেতৃত্বে শোধনবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ মতাদর্শিক সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিলো। ভারতবর্ষের বিশিষ্ট মার্কসবাদী চিন্তাবিদ কমরেড শিবদাস ঘোষও এ ব্যাপারে বিস্তৃত আলোচনা করে সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। আজ সমাজতন্ত্রের গৌরব ও অর্জনের শিক্ষা যেমন আছে, পতনের শিক্ষাও সামনে আছে। যথার্থভাবে এ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশে দেশে বিপ্লবী সংগ্রাম গড়ে উঠবেই। কারণ, পুঁজিবাদী শোষণ থেকে মুক্তির জন্যে সমাজতন্ত্র ছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নাম নিয়ে গণবিরোধী শাসন চলছে
১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত দেশে শোষণমূলক ব্যবস্থার অবসান হয়নি। বরং বৈষম্য বেড়েছে। মাত্র ৪ ভাগ মানুষের হাতে ৮৫ ভাগ সম্পদ পুঞ্জিভূত হয়েছে। গত ৪৫ বছরে কতো নির্বাচন হলো, কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নির্বাচনে প্রথম ও শেষ কথা, মানি ও মাসল পাওয়ার। তারপরও যতটুকু ঠাঁটবাট ছিল, এবার আওয়ামী মহাজোট তারও ধার ধারেনি। ভোটারবিহীন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় দফা ক্ষমতাসীন হয়ে চুড়ান্ত স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু করেছে। উন্নয়নের মুখরোচক শ্লোগান আউরে দুর্নীতি ও লুটপাটের ষোলকলা পূর্ণ করছে। জনমতের তোয়াক্কা না করে সুন্দরবনবিনাশী রামপাল প্রকল্প বাস্তবায়নের অযৌক্তিক সিদ্ধান্তে অটল আছে। অতীতের ক্ষমতাসীন ও বর্তমান শাসকরা ভোটের স্বার্থে ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার এবং ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সাথে আপোষ-সমঝোতা করে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার এমন পরিবেশের জন্ম দিয়েছে, যার ফলে খুন হচ্ছে সাধারণ মানুষ। নারী নির্যাতনের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। বিচারহীনতার এমন এক সংস্কৃতি এরা তৈরি করেছে, অসহায়তা ও উদ্বিগ্নতার পাকচক্রে মানুষ হারিয়ে ফেলছে লড়াইয়ের মনোভাব। গুম-খুন ও ক্রসফায়ার চলছে সমানে। শিক্ষাসহ জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রেই যুক্তিবাদ-বিজ্ঞানমনস্কতাকে মেরে দেয়া হচ্ছে। বৈষয়িক স্বার্থের রাজনীতির পঙ্কে নিমজ্জিত করে হরণ করা হচ্ছে তরুণদের প্রতিবাদের শক্তি। মাদক-নেশার করালগ্রাসে নিপতিত হচ্ছে যুবসমাজ। এভাবে নৈতিকতার চরম অবনমন ঘটিয়ে পুজিঁবাদী সমাজব্যবস্থা টিকে আছে।

ঠিক পথে লড়াই ছাড়া মুক্তির পথ নেই
এভাবে চলতে পারে না। হতাশা কিংবা সংগ্রামবিমুখতা পুঁজিবাদের দুঃশাসনকে আরও দীর্ঘায়িত করবে। আবার যেকোনও পথে লড়লেই মুক্তি আসবে না। এজন্যই বিপ্লবী দল প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে, ১৯৮০ সালের ৭ নভেম্বর মার্কসবাদ-লেনিনবাদের যুগোপযুগী ধারণা- শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে আমরা ‘বাসদ’ নামে দল গড়ে তুলেছিলাম। কিন্তু চলতে চলতে ঘোষিত আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে অনেকেই আমাদের সঙ্গে থাকতে পারেনি। বর্তমানে আমরা বাসদ (মার্কসবাদী) নামে সে ধারা বহন করে চলেছি। আপনাদের কাছে আমাদের আহ্বান, আমাদের দলকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করুন। আপনাদের শক্তির ওপর ভর করে আমরা সর্র্বসাধ্য দিয়ে লড়তে চাই।

leflet-%e0%a7%a8-copy

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments