Saturday, November 23, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - নভেম্বর ২০১৬লেনিন — জে ভি স্ট্যালিন

লেনিন — জে ভি স্ট্যালিন

 

কমরেডস, আমাকে বলা হয়েছে এখানে আজ সন্ধ্যায় আপনারা লেনিন স্মৃতি সভার আয়োজন করেছেন এবং অন্যতম বক্তা হিসাবে আমি আমন্ত্রিত হয়েছি। আমি মনে করি না, লেনিনের কর্মকান্ডের উপর আমার তৈরী করা বক্তৃতা দেবার কোনও প্রয়োজন আছে। আমি মনে করি, মানুষ হিসাবে নেতা হিসাবে লেনিনের চরিত্রের বৈশিষ্ট্যের কয়েকটি দিক তুলে ধরার মধ্যে যদি আমি নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখি তাহলেই ভাল হবে। হয়তো এই সব তথ্যের মধ্যে কোন অন্তর্নিহিত সম্পর্ক থাকবে না, কিন্তু লেনিন সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান অর্জন করার ক্ষেত্রে সেটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। যাই হোক, যা বললাম, এই অনুষ্ঠানে তার বেশি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

পার্বত্য ঈগল
লেনিনের সাথে আমি প্রথম পরিচিত হই ১৯০৩ সালে। এটা ঠিক, এই পরিচয় ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না, ছিল চিঠি আদান-প্রদানের মাধ্যমে। কিন্তু তা আমার উপর এক অনপনেয় ছাপ ফেলেছিল, এমন ছাপ ফেলেছিল যা দলে আমার সমস্ত কাজের মধ্যেও মুছে যায়নি। তখন আমি সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে। লেনিনের কর্মকান্ড সম্পর্কে আমার জ্ঞান সেই নব্বইয়ের দশকের শেষ থেকে এবং বিশেষ করে ১৯০১ সালের পর থেকে। ইসক্রা’র আবির্ভাবের পর আমি বুঝেছিলাম, লেনিনের মধ্যে আমরা এক অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ পেয়েছি। সেই সময় আমি তাঁকে শুধু দলের একজন নেতা মনে করতাম না। মনে করতাম, তিনিই দলের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। কারণ, তিনিই একমাত্র আমাদের দলের মর্মবস্তু ও জরুরী প্রয়োজন উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। আমি যখন দলের অন্যান্য নেতাদের সাথে তাঁর তুলনা করেছি, সব সময় আমার মনে হয়েছে তিনি তাঁর সহকর্মী — প্লেখানভ, মার্টভ, অক্সেলরড ও অন্যান্যদের তুলনায় অনেক বড়। তাঁদের সাথে তুলনায় লেনিন নিছক নেতাদের একজন ছিলেন না, ছিলেন সর্বোচ্চ স্তরের নেতা, এক পার্বত্য ঈগল, সংগ্রামে ভয় ছিল তাঁর অজানা এবং যিনি রুশ বিপ্লবের অনাবিষ্কৃত পথে নির্ভীকচিত্তে দলকে পরিচালনা করে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। এমন গভীরভাবে এই ছাপ আমার হৃদয়ে অঙ্কিত হয়েছিল যে এ সম্পর্কে আমি এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে চিঠি না লিখে পারিনি। রাজনৈতিক নির্বাসনে এই বন্ধু বিদেশে ছিলেন। এ বিষয়ে তাঁর মতামত জানানোর জন্য আমি তাঁকে অনুরোধ করেছিলাম। কিছুকাল পর, ১৯০৩ সালের শেষাশেষি, আমি তখন সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত, বন্ধুর কাছ থেকে একটা সোৎসাহ জবাব পেলাম এবং লেনিনের কাছ থেকে পেলাম একটা সরল আন্তরিকতাপূর্ণ চিঠি। বোঝা গেল, আমার বন্ধু লেনিনকে চিঠিটা দেখিয়েছিলেন। লেনিনের চিঠি ছিল তুলনামূলকভাবে ছোট। কিন্তু তাতে ছিল দলের ব্যবহারিক কাজের বলিষ্ঠ ও নির্ভীক সমালোচনা। আর ছিল অদূর ভবিষ্যতে দলের সমস্ত কাজের খুব পরিষ্কার ও সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। অত্যন্ত জটিল বিষয়কে একমাত্র লেনিনই এই রকম সরল ও স্পষ্টভাবে লিখতে পারতেন। লিখতে পারতেন এমন সংক্ষিপ্ত ও বলিষ্ঠভাবে যে মনে হত প্রতিটি বাক্য শুধু কথাই বলছে না, রাইফেল থেকে বেরিয়ে আসা গুলির মত কানে বাজছে। এই সরল ও বলিষ্ঠ চিঠি আমার এই প্রত্যয়কে আরও দৃঢ় করল যে লেনিনই হলেন আমাদের দলের পার্বত্য ঈগল। একজন পুরনো আত্মগোপনকারী কর্মীর অভ্যাসের বশবর্তী হয়ে অন্যান্য চিঠির মত লেনিনের চিঠিও আমি পুড়িয়ে ফেলেছি। এজন্য নিজেকে আমি ক্ষমা করতে পারি না। সেই সময় থেকে লেনিনের সাথে আমার পরিচয়।

বিনয়
১৯০৫ সালের ডিসেম্বরে ট্যামারফোর্সে (ফিনল্যান্ড) বলশেভিক সম্মেলনে লেনিনের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়। আমি দলের পার্বত্য ঈগলকে, একজন বিরাট ব্যক্তিকে দেখার আশা করেছিলাম। শুধু রাজনীতির দিক থেকেই বিরাট নন, যদি শুনতে চান, দেহের দিক থেকেও বিশাল — কারণ আমার কল্পনায় লেনিনকে আমি চিত্রিত করেছিলাম একজন মহিমান্বিত, কর্তৃত্বব্যঞ্জক, বিরাটাকায় পুরুষ হিসেবে। তারপর ভীষণ হতাশ হলাম যখন দেখলাম অত্যন্ত সাধারণ দেখতে একজন মানুষ, দৈর্ঘে গড় উচ্চতারও নীচে। যাঁকে কোনভাবেই, আক্ষরিক অর্থে কোনভাবেই সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা করা যায় না…
এটা স্বাভাবিক বলে মনে করা হয়, একজন ‘মহান ব্যক্তি’ সভায় আসবেন দেরীতে। সভায় সমবেত সবাই তাঁর জন্য রুদ্ধ নিঃশ্বাসে অপেক্ষা করে থাকবে। আর তারপর ‘মহান ব্যক্তির’ সভায় ঢোকার ঠিক আগে ফিস ফিস করে সাবধানবাণী উচ্চারিত হবে, “চুপ! আস্তে! উনি আসছেন!” আনুষ্ঠানিকতার এই বিষয়টা আমার অনাবশ্যক বলে মনে হয়নি। কারণ, এতে মনের উপর একটা ছাপ পড়ে, শ্রদ্ধার উদ্রেক করে। খুব হতাশ হলাম, যখন জানলাম প্রতিনিধিরা আসার আগেই লেনিন সম্মেলনে হাজির হয়েছেন, কোন এক কোণায় বসে অনাড়ম্বরভাবে সম্মেলনের অতি সাধারণ প্রতিনিধিদের সাথে অতি সাধারণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন। গোপন করব না, তখন আমার মনে হয়েছিল, এ যেন প্রয়োজনীয় নিয়ম লংঘনের সামিল।

কেবল পরবর্তীকালে আমি উপলব্ধি করেছিলাম, এই সারল্য ও বিনয়, সকলের অলক্ষ্যে থাকার চেষ্টা, বা অন্ততপক্ষে সবার নজরে না পড়ে নিজেকে এমন করে রাখা এবং নিজের উচ্চপদকে জোরের সাথে প্রকাশ না করা — জনগণের নতুন নেতা হিসাবে, মানব সমাজের ‘সাধারণ স্তরের’ মানুষের নেতা হিসাবে ছিল লেনিনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্যগুলোর অন্যতম।

যুক্তির শক্তি
এই সম্মেলনে লেনিন দুটো উল্লেখযোগ্য ভাষণ দিয়েছিলেন। একটা সমসাময়িক পরিস্থিতি ও অপরটা কৃষি-সমস্যার উপর। দুঃখের বিষয়, তা সংরক্ষিত হয়নি। এই প্রেরণাদায়ী ভাষণ দুটো সম্মেলনকে প্রচন্ড উদ্দীপনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। প্রত্যয়ের অসাধারণ ক্ষমতা, যুক্তির সারল্য ও স্বচ্ছতা, সংক্ষিপ্ত ও সহজবোধ্য বাক্য, ভনিতা, হতবুদ্ধিকর অঙ্গভঙ্গি ও নাটকীয় বাক্যবিন্যাসের আশ্রয় না নেওয়া — গতানুগতিক ‘সংসদীয়’ বক্তাদের সাথে লেনিনের বক্তৃতার পার্থক্য ছিল এখানেই।
কিন্তু লেনিনের বক্তৃতার এই সব গুণাবলি তখন আমাকে আকৃষ্ট করেনি। আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম তাঁর বক্তব্যের অপ্রতিরোধ্য শক্তির দ্বারা। তাঁর বক্তৃতা ছিল বাহুল্যবর্জিত। কিন্তু তা শ্রোতাদের উপর প্রভূত প্রভাব বিস্তার করেছিল। ক্রমশই তাদের মনে যেন বিদ্যুৎ সঞ্চারিত হচ্ছিল এবং তারপর বলা যায় তাদের একেবারে অভিভূত করে ফেলেছিল। মনে পড়ে অনেক প্রতিনিধি বলেছিলেন: “লেনিনের যুক্তি শক্তিশালী বাহুপাশের মত। এ তোমায় আস্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলবে, ফাঁসের মত আঁকড়ে ধরবে। তুমি তার কব্জা থেকে নিজেকে বের করে আনতে পারবে না। হয় তোমাকে আত্মসমর্পণ করতেই হবে, না হয় চরম পরাজয় বরণ করতে হবে।” আমি মনে করি লেনিনের বক্তৃতার এই বৈশিষ্ট্য বাগ্মী হিসাবে তাঁর শিল্পকলার সবচেয়ে শক্তিশালী বিশেষত্ব।

নাকী কান্না নয়
লেনিনের সাথে আমার দ্বিতীয়বার দেখা হয় ১৯০৬ সালে আমাদের দলের স্টকহোম কংগ্রেসে। আপনারা জানেন, এই কংগ্রেসে বলশেভিকরা সংখ্যালঘু ছিল এবং তাঁরা পরাজিত হয়েছিল। পরাজিতের ভূমিকায় এই প্রথম আমি লেনিনকে দেখলাম। কিন্তু তিনি মোটেই সেই ধরনের নেতা ছিলেন না, যিনি পরাজয়ে নাকী কান্না শুরু করবেন এবং হতাশ হয়ে পড়বেন। বরং পরাজয় লেনিনকে ঘনীভূত তেজের উৎসে পরিণত করল। এর ফলে তাঁর সমর্থকেরা নতুন সংগ্রাম ও ভবিষ্যৎ বিজয়ের জন্য উদ্দীপিত হল। আমি বলেছি, লেনিন পরাজিত হয়েছিলেন। কিন্তু তা কি ধরনের পরাজয় ছিল? প্লেখানভ, অক্সেলরড, মার্টভ ও অন্যান্যরা — যাঁরা স্টকহোম কংগ্রেসে জয়ী হয়েছিলেন, তাঁর সেই বিরোধীদের দিকে আপনারা কেবল তাকিয়ে দেখুন। তাঁদের চোখেমুখে বিজয়ীর লক্ষণ প্রায় ছিল না বললেই চলে। কারণ বলতে কী, মেনশেভিকবাদের বিরুদ্ধে লেনিনের ক্ষমাহীন সমালোচনা ওঁদের দেহের একটা হাড়ও আস্ত রাখেনি। মনে পড়ছে, আমরা বলশেভিক প্রতিনিধিরা, একসাথে জড়ো হয়ে তাকিয়ে ছিলাম লেনিনের দিকে, তাঁর উপদেশ চাইছিলাম। কোনও কোনও কমরেডের ভাষণে ফুটে উঠেছিল ক্লান্তি ও হতাশার সুর। মনে আছে, তিক্তভাবে দাঁতে দাঁত চেপে লেনিন এই সব ভাষণের জবাব দিয়েছিলেন, “নাকী কান্না কাঁদবেন না কমরেডস, আমরা জিতবই, কারণ আমরা সত্য পথে চলছি।” নাকী কাঁদুনে বুদ্ধিজীবীদের প্রতি ঘৃণা, নিজেদের শক্তির উপর আস্থা, জয়লাভে বিশ্বাস — আমাদের মনে লেনিন এগুলি গেঁথে দিয়েছিলেন। আমরা অনুভব করেছিলাম, বলশেভিকদের পরাজয় সাময়িক, অদূর ভবিষ্যতে তাঁরা জিতবেই জিতবে।

“পরাজয়ে নাকী কান্না নয়” — এই ছিল লেনিনের কাজের বৈশিষ্ট্য। এর ফলে নিজের শক্তিতে আস্থাবান ও শেষ পর্যন্ত বিশ্বস্ত একটা বাহিনী তাঁর চারদিকে সমবেত হতে পেরেছিল।

দম্ভ নয়
লন্ডনে ১৯০৭ সালে, পরবর্তী কংগ্রেসে বলশেভিকরা বিজয়ী হয়েছিল। বিজয়ীর ভূমিকায় এই প্রথম আমি লেনিনকে দেখলাম। জয় কোনও কোনও নেতার মাথা ঘুরিয়ে দেয়, তাদের উদ্ধত ও দাম্ভিক করে তোলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা জয়োল্লাসে মেতে থাকে, অর্জিত বিজয় সম্মান নিয়ে বিশ্রাম করতে শুরু করে। কিন্তু এই ধরনের নেতাদের সাথে লেনিনের একটুও মিল ছিল না। বরং জয়লাভের ঠিক পরই তিনি বিশেষ সতর্ক ও সাবধানী হয়ে উঠতেন। আমার মনে পড়ছে, দৃঢ়তার সাথে লেনিন প্রতিনিধিদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন: প্রথম বিষয় হল জয়ের ফলে উত্তেজিত হয়ে পড়বেন না, অহংকারী হবেন না; দ্বিতীয় বিষয় হল বিজয়কে সংহত করুন; তৃতীয় বিষয় হল শত্রুকে শেষ আঘাত হানুন, কারণ সে পরাজিত হয়েছে — ধ্বংস হয়নি। যে সব প্রতিনিধিরা জোর গলায় বলছিল, “ মেনশেভিকরা এখন শেষ হয়ে গেছে” তাদের তীব্র ভাষায় তিনি ভর্ৎসনা করেছিলেন। তিনি সহজেই দেখিয়েছিলেন, শ্রমিক আন্দোলনে এখনও মেনশেভিকদের প্রভাব আছে, দক্ষতার সাথে তাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে এবং নিজেদের শক্তি বাড়িয়ে দেখা ও বিশেষভাবে শত্রুর শক্তি কমিয়ে দেখা চলবে না।

“জয়লাভে দম্ভ নয়” — এই ছিল লেনিনের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। এর ফলে স্থির চিত্তে তিনি শত্রুর শক্তি মূল্যায়ন করতে পারতেন এবং সম্ভাব্য বিপদ থেকে দলকে রক্ষা করতে পারতেন।

নীতির প্রতি বিশ্বস্ততা
দলের নেতারা দলের সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমতের মূল্য না দিয়ে পারেন না। সংখ্যা গরিষ্ঠতার শক্তিকে কোন নেতা না মেনে পারেন না। দলের অন্য নেতাদের তুলনায় লেনিন এটা কম বুঝতেন না। কিন্তু লেনিন কখনই সংখ্যা গরিষ্ঠের হাতে বন্দী ছিলেন না, বিশেষ করে যখনই সেই সংখ্যা গরিষ্ঠের কোন নীতির ভিত্তি থাকতো না। আমাদের দলের ইতিহাসে এমন অনেক সময় গিয়েছে যখন সংখ্যাগরিষ্ঠের মত বা দলের সাময়িক স্বার্থ ও সর্বহারার মৌলিক স্বার্থের মধ্যে সংঘাত ঘটেছে। এসব ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের বিরুদ্ধে গিয়ে নীতির পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে লেনিন কখনও দ্বিধা করেননি। সর্বোপরি আক্ষরিক অর্থে, এসব ক্ষেত্রে সবার বিরুদ্ধে একা দাঁড়াতেও তিনি ভয় পাননি। তিনি মনে করতেন, প্রায়ই বলতেন, “যে নীতি দাঁড়িয়ে আছে আদর্শের উপর, তাই একমাত্র সঠিক নীতি।”

নিম্নলিখিত দুটো ঘটনা এ বিষয়ে বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
প্রথম ঘটনা। ১৯০৯-১১ সালের কথা। তখন প্রতিবিপ্লবের আঘাতে চূর্ণ বিচূর্ণ দলে ভাঙনের প্রক্রিয়া চলছিল। দল ছিল অবিশ্বাসের যুগে। পাইকারী হারে দলত্যাগ চলছিল। শুধু বুদ্ধিজীবীরাই দলত্যাগ করছিল তা নয়, এমনকী শ্রমিকদের একটা অংশও দলত্যাগ করছিল। সময়টা ছিল দলের অবলুপ্তি ও বিপর্যয়ের সময়, তখন বে-আইনী সংগঠনের প্রয়োজনীয়তার কথাও স্বীকার করা হচ্ছিল না। কেবল মেনশেভিকরাই নয়, বলশেভিকরাও নানা উপদল ও ধারায় বিভক্ত ছিল। কারণ, অধিকাংশই শ্রমিক আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। আপনারা জানেন, সেই সময় বে-আইনী সংগঠনকে সম্পূর্ণ গুটিয়ে ফেলার ও শ্রমিকদের বৈধ উদার স্টপিলিন পার্টিতে সংগঠিত করার যে ধারণা তার উদ্ভব হয়েছিল। দলের আদর্শকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন পার্টির শক্তিকে একত্র করেছিলেন। শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনের মধ্যে সমস্ত পার্টি বিরোধী প্রবণতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, অতুলনীয় সাহস ও অধ্যাবসায়ের সাথে তিনি পার্টির আদর্শকে রক্ষা করেছিলেন।

আমরা জানি, দলের আদর্শ রক্ষার এই সংগ্রামে লেনিন পরবর্তীকালে বিজয়ী প্রমাণিত হয়েছিলেন।

দ্বিতীয় ঘটনা। তখন ছিল ১৯১৪-১৭ সালের সময়পর্ব। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ তখন চলছে জোর কদমে। তখন প্রায় বা সব কটা সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক ও সোস্যালিস্ট পার্টি সার্বজনীন দেশপ্রেমের উন্মাদনার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। এ হচ্ছে সেই সময় যখন দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক তার পতাকা পুঁজিবাদের কাছে সমর্পণ করেছিল, তখন এমনকী প্লেখানভ, কাউটস্কি, ও অন্যান্যরা উগ্র জাতীয়তাবাদের জোয়ারকে প্রতিরোধ করতে পারেননি। সে সময়, লেনিনই ছিলেন একমাত্র বা প্রায় একমাত্র ব্যক্তি যিনি উগ্র জাতীয়তাবাদ ও শান্তিবাদিতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়েছিলেন, গেজদে ও কাউটস্কির বিশ্বাসঘাতকতার নিন্দা করেছিলেন, না-ঘর কা না-ঘাটকা ‘বিপ্লবীদের’ দোদুল্যমানতাকে কলংক চিহ্নিত করেছিলেন। লেনিন জানতেন, তাঁর পিছনে রয়েছে কেবল একটা নগণ্য সংখ্যালঘু, কিন্তু তাঁর কাছে এটা চূড়ান্ত মুহূর্ত ছিল না। কারণ তিনি জানতেন নিরবচ্ছিন্ন আন্তর্জাতিকতাবাদের নীতিই হল সঠিক নীতি যার ভবিষ্যত আছে। তিনি জানতেন আদর্শভিত্তিক কর্মপন্থাই সঠিক কর্মপন্থা। আমরা জানি, একটা নতুন আন্তর্জাতিকের জন্য এই সংগ্রামেও লেনিন বিজয়ী বলে প্রমাণিত হয়েছিলেন ‘আদর্শভিত্তিক কর্মপন্থাই সঠিক কর্মপন্থা’ — এই নীতির দ্বারা আক্রমণের মাধ্যমে লেনিন নতুন ‘দুর্ভেদ্য’ অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন এবং বিপ্লবী মার্কসবাদের পক্ষে সর্বহারার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিয়ে এসেছিলেন।

জনগণের প্রতি বিশ্বাস
যাঁরা জাতির ইতিহাসের সাথে পরিচিত, যাঁরা বিপ্লবের ইতিহাস আগাগোড়া অধ্যয়ন করেছেন, দলের সেইসব তাত্ত্বিক নেতারা অনেক সময় একটা লজ্জাজনক রোগে আক্রান্ত হন। এই রোগ হল জনগণকে ভয়, জনগণের সৃজনশীল ক্ষমতায় অবিশ্বাস। এর ফলে নেতাদের মধ্যে কোন কোন সময় এক ধরনের অভিজাতসুলভ মানসিকতার জন্ম হয়। এই জনগণ বিপ্লবের ইতিহাস বিশারদ নয়, তবু পুরনো ব্যবস্থা ধ্বংস ও নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলার দায়িত্ব তাদেরই। এই ধরনের অভিজাতসুলভ মানসিকতার সৃষ্টি হয় এই ভয় থেকে যে বিষয়গুলো শিথিল হয়ে যেতে পারে, জনগণ ‘বড় বেশি ধ্বংস’ করে ফেলতে পারে। জনগণকে কেতাবী শিক্ষার দ্বারা শেখানোর চেষ্টায় এক বিজ্ঞ পরামর্শদাতার ভূমিকা পালনের ইচ্ছা থেকেই এর জন্ম।

লেনিন ছিলেন এই ধরনের নেতাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। লেনিনের মত আর কোন বিপ্লবীর কথা আমার জানা নেই যাঁর সর্বহারা সৃজনী ক্ষমতা ও তাদের শ্রেণী প্রবৃত্তির কার্যকারিতার উপর এমন প্রগাঢ় আস্থা ছিল। আমি আর কোন বিপ্লবীকে জানি না যিনি লেনিনের মত এত নির্দয়ভাবে ‘বিপ্লবী বিশৃঙ্খলা’ ‘জনগণের অনুমোদনহীন উশৃঙ্খল কার্যকলাপের’ কল্পনাশক্তিহীন ও সংকীর্ণচিত্ত সমালোচকদের চাবুক মারতে পারতেন। মনে আছে, আলাপ আলোচনা চলার সময় একবার একজন কমরেড বলেছিলেন, “বিপ্লবের পর স্বাভাবিক অবস্থা থাকা দরকার।” শ্লেষভরে লেনিন বলেছিলেন, “এটাই দুঃখজনক, যারা বিপ্লবী হতে চান তারা ভুলে যান, ইতিহাসের সবচেয়ে স্বাভাবিক ব্যবস্থা হল বিপ্লবী ব্যবস্থা।”

এই জন্য, লেনিন সেইসব লোকদের ঘৃণা করতেন, যারা জনগণকে অবজ্ঞা ও ঘৃণার চোখে দেখেন এবং জনগণকে কেতাবী জ্ঞান দিয়ে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এইজন্য সবসময় লেনিন বলতেন : জনগণ থেকে শিক্ষা নাও, তাদের কার্যকলাপ বোঝার চেষ্টা কর, জনগণের সংগ্রামের বাস্তব অভিজ্ঞতা সযত্নে অধ্যয়ন কর।

জনগণের সৃজনশীল ক্ষমতায় বিশ্বাস — এই ছিল লেনিনের কাজের বৈশিষ্ট্য। এর ফলে স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা বুঝতে এবং তার গতিকে সর্বহারা বিপ্লবের খাতে তিনি প্রবাহিত করতে পেরেছিলেন।

বিপ্লবী প্রতিভা
লেনিন জন্মেছিলেন বিপ্লবের জন্য। সত্যই তিনি ছিলেন বিপ্লবী অভ্যুত্থানের মহত্তম প্রতিভা, বিপ্লবী নেতৃত্বের সর্বোত্তম শিল্পী। বিপ্লবী অভ্যুত্থানের সময়ই তিনি সবচেয়ে খুশী হতেন, সবচেয়ে স্বচ্ছন্দবোধ করতেন। এর দ্বারা অবশ্য আমি বলতে চাইছি না, সমস্ত বিপ্লবী অভ্যুত্থানকে লেনিন সমানভাবে অনুমোদন করতেন বা সবসময় সব পরিস্থিতিতে তিনি বিপ্লবী অভ্যুত্থানের পক্ষে ছিলেন। একেবারেই তা নয়। যা আমি বলতে চাইছি তা হল, বিপ্লবী অভ্যুত্থানের সময় যেমন, তেমন আর কখনও লেনিনের প্রতিভার অন্তর্দৃষ্টি এত পুরোপুরি এত স্পষ্টভাবে দেখা যেত না। বিপ্লবী অভ্যুত্থানের সময় আক্ষরিক অর্থে তিনি প্রস্ফূটিত হতেন, পরিণত হতেন ভবিষ্যৎদ্রষ্টায়, বিপ্লবের সম্ভাব্য আঁকাবাঁকা পথ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতেন, এমনভাবে দেখতেন যেন এসব জিনিস তাঁর হাতের মুঠোয়। সঠিক ভাবেই আমাদের দলে প্রায়ই বলা হত, “জলে মাছের মত বিপ্লবের জোয়ারে লেনিন সাঁতার কাটতেন।”

এখানেই রয়েছে লেনিনের রণকৌশলগত স্লোগানের ‘আশ্চর্য’ স্বচ্ছতা ও তাঁর বিপ্লবী পরিকল্পনার ‘শ্বাসরোধকারী’ সাহসিকতা। লেনিনের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের দুটো ঘটনা আমি মনে করিয়ে দেব।

প্রথম ঘটনা। তখন ছিল অক্টোবর বিপ্লবের ঠিক পূর্ব মুহূর্ত। তখন যুদ্ধক্ষেত্রে ও পশ্চাদ্ভাগে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক, কৃষক ও সৈনিক সংকটের ফলে বাধ্য হয়ে শান্তি ও স্বাধীনতা দাবি করছিল। সেনাপতিরা ও বুর্জোয়ারা ‘শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ের উদ্দেশ্যে’ তখন সামরিক একনায়কত্বের জন্য কাজ করছিল। তখন তথাকথিত সমস্ত ‘সমাজতান্ত্রিক দল’ ও তথাকথিত ‘জনমত’ বলশেভিকদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ছিল এবং তাদের ‘জার্মানীর চর’ হিসাবে চিহ্নিত করছিল। কেরেনস্কি তখন বলশেভিকদের আত্মগোপনে যেতে বাধ্য করার চেষ্টা করছিল — ইতিমধ্যে খানিকটা সফলও হয়েছিল। তখনো পর্যন্ত শক্তিশালী ও শৃঙ্খলাবদ্ধ অস্ট্রো-জার্মান কোয়ালিশন সরকারের সেনাবাহিনী আমাদের রণক্লান্ত, বিধ্বস্ত সেনাবাহিনীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল। তখনও পশ্চিম ইউরোপের ‘সমাজতন্ত্রীরা’ ‘সম্পূর্ণ জয়লাভের জন্য যুদ্ধের’ খাতিরে তাদের সরকারের সাথে পরম সুখের মৈত্রীতে বাস করছিল।

এইরকম একটা সময়ে অভ্যুত্থান শুরু করার অর্থ কি হত? এ রকম একটা পরিস্থিতিতে অভ্যুত্থান শুরু করলে সব কিছুর বিনিময়ে তা করতে হত। কিন্তু লেনিন ঝুঁকি নিতে ভয় পাননি। কারণ তিনি জানতেন, ভবিষ্যৎদ্রষ্টার চোখ দিয়ে তিনি দেখেছিলেন, অভ্যুত্থান অবশ্যম্ভাবী এবং তা জয়যুক্ত হবেই। দেখেছিলেন, রাশিয়ার একটা অভ্যুত্থান সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ খতম করার পথ প্রস্তুত করে দেবে, দেখেছিলেন পশ্চিমের রণক্লান্ত ব্যাপক জনতাকে তা উদ্বুদ্ধ করবে, এই অভ্যুত্থান সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধে পরিণত করবে। তা সোভিয়েতসমূহের এক প্রজাতন্ত্রের অগ্রদূত হবে, এবং এই সোভিয়েতের প্রজাতন্ত্র দুনিয়াব্যাপী বিপ্লবী আন্দোলনের দূর্গের কাজ করবে।

আমরা জানি, লেনিনের বিপ্লবী দূরদৃষ্টি পরবর্তীকালে সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল। এই সঠিকতার কোনও তুলনা ছিল না।
দ্বিতীয় ঘটনা। অক্টোবর বিপ্লবের প্রথম দিনগুলোর কথা। তখন গণ-কমিশার পরিষদ শত্রুতামূলক কাজকর্মের অবসানের জন্য এবং জার্মানীর সাথে যুদ্ধ বিরতির উদ্দেশ্যে আলোচনা শুরু করার জন্য বিদ্রোহী সেনাপতি জেনারেল দুখোনিনকে বাধ্য করার চেষ্টা চালাচ্ছিল। মনে পড়ছে, লেনিন, ক্রিলেংকো (ভবিষ্যৎ প্রধান সেনাপতি) ও আমি সরাসারি তারযোগে দুখোনিনের সাথে আলোচনার জন্য পেট্রোগ্রাডে জেনারেল স্টাফের সদর দপ্তরে গেলাম। সেটা ছিল এক ভয়ঙ্কর মুহূর্ত। দুখোনিন ও রণাঙ্গনের সদর দপ্তর গণ-কমিশার পরিষদের আদেশ মানতে সরাসরি অস্বীকার করল। সেনাবাহিনীর অফিসারেরা ছিল একেবারে সদর দপ্তরের নিয়ন্ত্রণে। সাধারণ সৈনিকদের কথা বলতে গেলে, কেউ জানে না এই এক কোটি চল্লিশ লক্ষ সেনা কী করবে। কারণ তারা ছিল তথাকথিত সেনাবাহিনীর সংগঠনগুলোর অধীন আর এই সংগঠনগুলো ছিল সোভিয়েত ক্ষমতার প্রতি শত্রুভাবাপন্ন। আমরা জানতাম, এক পেট্রোগাডেই সামরিক ক্যাডেটদের বিদ্রোহ দানা বাঁধছিল। এ ছাড়াও, কেরেনেস্কি অগ্রসর হচ্ছিলেন পেট্রোগাডের দিকে। মনে আছে, তার কেন্দ্রে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর লেনিনের মুখমন্ডল সহসা অসাধারণ আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। পরিষ্কার বুঝলাম, তিনি একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছেন। তিনি বললেন, ‘চলুন আমরা ওয়্যারলেস স্টেশন যাই, এটা আমাদের খুব কাজে আসবে।’ আমরা জেনারেল দুখোনিনকে বরখাস্ত করে তার জায়গায় ক্রিলেংকোকে প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করে এক বিশেষ আদেশ জারী করব এবং অফিসারদের ডিঙিয়ে সাধারণ সেনাদের আবেদন করব, আহ্বান জানাব তাদের সেনাপতিদের ঘেরাও করতে, শত্রুতামূলক কাজ বন্ধ করতে, অস্ট্রো-জার্মান সেনাবাহিনীর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে এবং শান্তির দায়িত্ব নিজেদের হাতে গ্রহণ করতে।

এটা ছিল অন্ধকারে ঝাঁপ। কিন্তু এই ঝাঁপ দিতে লেনিন ভয় পাননি। বরং, তিনি এই কাজ করলেন আগ্রহের সাথে। কারণ, তিনি জানতেন, সেনাবাহিনী শান্তি চায় এবং পথের সমস্ত বাধা ঝেঁটিয়ে দূর করে তারা শান্তি জয় করে আনবে। তিনি জানতেন, শান্তি প্রতিষ্ঠার এই পদ্ধতি অস্ট্রো-জার্মান সেনাদের উপর প্রভাব বিস্তার করবেই এবং সমস্ত ফ্রন্টেই শান্তির আকুল আকাঙ্খার সৃষ্টি হবে। এর কোন ব্যতিক্রম হবে না।

আমরা জানি, এখানেও, লেনিনের বিপ্লবী দূরদৃষ্টি পরবর্তীকালে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল।

প্রতিভার অন্তর্দৃষ্টি, আসন্ন ঘটনাবলির অন্তর্নিহিত অর্থ দ্রুত বুঝতে পারা ও তার ভবিষ্যৎ কী হবে তা অনুধাবন করার দক্ষতা, লেনিনের এই সব গুণের ফলে তিনি বিপ্লবী আন্দোলনের সন্ধিক্ষণে সঠিক রণনীতি ও স্বচ্ছ রণকৌশল রচনা করতে পারতেন।

ক্রেমলিন সামরিক বিদ্যালয়ের স্মৃতি সভায় প্রদত্ত ভাষণ, ২৮ শে জানুয়ারি, ১৯২৪

সাম্যবাদ নভেম্বর ২০১৬

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments