Saturday, November 23, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - নভেম্বর ২০১৬চীনের রাষ্ট্রপতির বাংলাদেশ সফর নিয়ে কিছু কথা

চীনের রাষ্ট্রপতির বাংলাদেশ সফর নিয়ে কিছু কথা

china-bangladeshগত কিছুদিন আগে চীনের রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। দেশের পত্র-পত্রিকায় একে ঐতিহাসিক সফর, বাংলাদেশের জন্য বিরাট সুযোগ ও সফলতা, অর্থনৈতিক উন্নয়নের দ্বার খুলে গেল — ইত্যাদি শ্রুতিমধুর শব্দরাজি ও অলংকার সহযোগে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বড় বড় সাম্রাজ্যবাদী দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের আমাদের ছোট এই দেশে আগমন যে কেবলমাত্র আমাদের উদ্ধার করার নিমিত্তে নয় — একথা দেশের সাধারণ শিক্ষিত মানুষমাত্রেই জানেন। চীনের রাষ্ট্রপতির সফরের নিজস্ব উদ্দেশ্য আছে, লক্ষ্য আছে। বাংলাদেশের সরকারেরও নিজস্ব লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আছে। কিন্তু দুপক্ষই মুখে বলছেন বন্ধুত্ব, সহযোগিতা, পারস্পরিক বোঝাপড়া — ইত্যাদি অফিসিয়াল কথা। আমরা এ প্রবন্ধে এ সফরের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, চীন ও বাংলাদেশের দিক থেকে আলাদা আলাদাভাবে কী তাই দেখানোর চেষ্টা করবো।

সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর অর্থনৈতিক সহযোগিতা মানে জনগণের উপর আরও ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেয়া

সহযোগিতার নামে কি হয় এই আলোচনায় আমরা পরে যাব, কিন্তু চীনের ঋণ দেয়াটাকে যদি একটা বিরাট প্রাপ্তি হিসেবে আমরা ধরে নেই এবং যদি মনে করি যে, যত বেশি ঋণ পাওয়া যাবে ততই বাংলাদেশের লাভ; তাহলেও আমরা দেখতে পাব, এই সফরের আগে ও পরে দু’দেশের অফিসিয়াল কথাবার্তার মধ্যে কত ফারাক বিদ্যমান। চীনের প্রেসিডেন্ট আসার আগে পত্রপত্রিকায় লেখা হলো যে, প্রায় ৪০০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হবে এবং সেটি হবে বাংলাদেশের সর্বকালের সবচেয়ে বড় ঋণচুক্তি। কিন্ত বাস্তবক্ষেত্রে দেখা গেল চুক্তি হলো ২৪০০ কোটি ডলারের। এই ২৪০০ কোটি ডলার ঋণ বাংলাদেশ সরকার কবে পাবে? তার শর্তগুলি কী কী? এসব কোন বিষয়ই এখনও পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, “এই ঋণ আর কিছুই নয়, বাতাস মাত্র। এর কতটুকু বাংলাদেশ কঠিন করতে পারে তাই দেখার বিষয়।” তার এই কথার পক্ষে যুক্তি আছে। কারণ এই সেদিন ২০১৪ সালের মে মাসে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী জাপান সফরে গেলেন। সেখানে জাপান ৬০০ কোটি ডলারের ঋণপ্রস্তাব করেছিলো এবং ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিলো। এর বেশিরভাগ টাকাই বাংলাদেশ পায়নি। চীনের এই ঋণপ্রস্তাবও একই পরিণতি বরণ করতে পারে। তাছাড়া যে সকল প্রকল্পে চীন ঋণ দেবে বলে সম্মতি দিয়েছে, প্রথমত, সে সকল প্রকল্পের যোগ্যতা যাচাই হয়নি। দ্বিতীয়ত, ঋণের শর্ত জানা হয়নি। চীন ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে সাধারণত কঠিন শর্ত দিয়ে থাকে। তাছাড়া অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে ‘সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট’ শর্ত থাকে চীনের। অর্থাৎ চীনা ঋণে প্রকল্প চালাতে হলে চীন থেকে মালামাল ও লোকবল নেয়া বাধ্যতামূলক। তৃতীয়ত, এর সুদের হার কত তাও বাংলাদেশ ঠিক করেনি। চীনা ঋণে সাধারণত উচ্চ সুদ থাকে।

এতসব যুক্তি আসছে ঋণকে খুব গুরুত্বপূর্ণ ধরে নিয়ে। এসকল সমস্যা যদি নাও থাকে, যদি বাংলাদেশ ঠিকঠাক ঋণ পায়, তাহলেও কি দেশের মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হবে? এই ঋণের টাকা উপর থেকে নিচ পর্যন্ত আসতে আসতে পুরো ঋণের ১০-২০ শতাংশও মানুষের কাজে লাগে না। বিগত সময়ের সকল পরিসংখ্যান এটাই প্রমাণ করে। কিন্তু এই বিরাট ঋণের বোঝা বহন করতে হবে জনগণকে। এবারের বাজেটে ঋণ শোধের পরিমাণ দেখলেই তা বোঝা যায়। আর এ টাকা তোলার জন্য এই বাজেটে ট্যাক্স বসানো হয়েছে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ রাস্তার পাশের দোকানে যে কেক, বিস্কুট খায়— সেসবেও।

আরেকটা বিষয় বুঝে রাখা দরকার যে, সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো বা তাদের সংস্থাসমূহ যখন কোনো দেশকে ঋণ দেয়, সেটা সে দেশের উপকারের জন্য নিজেরা ক্ষতি স্বীকার করে দেয়, বিষয়টি কোনোভাবেই এমন নয়। গোটা বিশ্বে পুঁজিবাদের এখন মুমূর্ষু দশা। শ্রমজীবী মানুষকে শোষণ করে পুঁজিপতিরা মুনাফার যে পাহাড় জমিয়েছে তাকে খাটানোর আর কোনো জায়গা নেই। তাই সুদের ব্যবসা না করলে বিপুল পরিমাণ এই অর্থকে চালু রাখার আর কোনো উপায় নেই। এজন্য সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহ নিজেদের মধ্যে ব্যাংক তৈরি করে, অর্থনৈতিক সংস্থা তৈরি করে ও বিভিন্ন দেশকে ঋণ দেয়। এক সংস্থা কিংবা দেশ থেকে ঋণ নিয়ে আরেক সংস্থা কিংবা দেশকে গ্রহীতা দেশগুলো ঋণ পরিশোধ করে। এভাবে দেশগুলো ঋণের চক্রে পড়ে যায়। এই ঋণের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহ ঋণগ্রহীতা দেশের রাজনৈতিক বিষয়ের উপরও প্রভাব বিস্তার করে। তাই ঋণ পাওয়া না পাওয়া নিয়ে দেশের মানুষের আনন্দিত কিংবা দুঃখিত হওয়ার কোনো অবকাশ নেই।

চীন এশিয়ার মধ্যে নিজের প্রাধান্য ধরে রাখতে চায়

চীন এখন বিশ্বের একটি অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি। সে এশিয়ার দেশগুলোর সাথে অর্থনৈতিক সহায়তার প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিকভাবে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহ – যাদের উপর সাম্রাজ্যবাদী ভারতের প্রভাব বেশি সেসকল দেশের উপর চীন প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছে। বিশ্ববাণিজ্য নিয়ে চীনের বিরাট ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার মধ্যে বাংলাদেশও আছে। কারণ ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। চীনের সিল্ক রুটের যে পরিকল্পনা অর্থাৎ ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রুট’ পরিকল্পনার অংশ বাংলাদেশও। এই রুটটি চীনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীনের জ্বালানী তেলের প্রায় সম্পূর্ণটাই আমদানি করতে হয়। তেল আমদানিতে চীন বিশ্বে প্রথম। এই তেলের ৭০ শতাংশেরও বেশি আমদানি হয় উপসাগরীয় অঞ্চল ও আফ্রিকা থেকে। তাই জ্বালানী নিরাপত্তা বজায় রাখতে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা তাদের দরকার। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী সংযোগপথটি চীনের মূল ভূখন্ড থেকে শুরু করে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, মালদ্বীপের সমুদ্রবন্দরকে যুক্ত করে একবারে সোমালিয়া পর্যন্ত গিয়ে থামবে। এভাবে চীন থেকে ভারত মহাসাগর হয়ে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত এই রুটটি চীন বাস্তবায়ন করতে চায়। এটি চীনকে একইসাথে বাণিজ্যিক ও সামরিক সুবিধা দেবে। এটি ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ নামে খ্যাত। এই মুক্তার মালার একটি মুক্তা হল বাংলাদেশে চীনের প্রস্তাবিত সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর। যদিও এর অনুমতি বাংলাদেশ সরকার এখনও চীনকে দেয়নি।

আবার দক্ষিণ চীন সাগরের নিয়ন্ত্রণও চীনের দরকার। কারণ দক্ষিণ চীন সাগর; প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে। এই পথে লক্ষ লক্ষ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়। চীনের নিজের নিরাপত্তা ও বাণিজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ – এ দু’য়ের জন্যই দক্ষিণ চীন সাগরের নিয়ন্ত্রণ তার দরকার। তাই চীন সেখানে কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করেছে। দ্বীপটি এতখানি বড় যে এতে যুদ্ধবিমান ওড়ানোর জন্য রানওয়ে পর্যন্ত আছে। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীনের এ ভূমিকার সরাসরি বিরুদ্ধতা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা জাপান, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, ব্রুনেইসহ দক্ষিণ চীন সাগরের উপকূলে অবস্থিত দেশসমূহকে নিয়ে চীনকে হুমকি দিচ্ছে। কিন্তু চীন দক্ষিণ চীন সাগরের কর্তৃত্ব ছাড়তে রাজি নয়। আমেরিকা-জাপানের সাথে এই দ্বন্দে¦ ফিলিপাইন চীনের পাশে আছে। চীন সাধ্যমতো অন্য দেশগুলোকেও পক্ষে টানার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল চীনের কাছে এসকল কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

চীনের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ভারতের সাথে সম্পর্কে একটা ভারসাম্য তৈরি করলো

ভারতের যে প্রাধান্য বাংলাদেশের উপর ছিলো চীনের সাথে সম্পর্কটা আরেকটু বাড়িয়ে তোলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেই সম্পর্কটাকে একটা ভারসাম্যে নিয়ে আসলো। ভারতের সাথে, এমনকি আমেরিকার সাথেও তার দর কষাকষির ক্ষমতা বাড়ালো। চীনা রাষ্ট্রপতির বাংলাদেশ সফরের সময় ভারতের বিভিন্ন প্রত্রপত্রিকার খবরগুলো খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে ভারত খুবই চিন্তিত। চীনের অর্থনৈতিক ক্ষমতাও ভারত থেকে অনেক বেশি। তবে এই ব্যাখ্যা থেকে এ সিদ্ধান্ত টানা যাবে না যে বাংলাদেশের উপর সাম্রাজ্যবাদী ভারতের প্রভাব কমে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদী চীনের প্রভাব বাড়ছে। কারণ এখনও ভারতের প্রভাবই বাংলাদেশের উপর বেশি। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ব্যাপারে চীনের প্রস্তাবে এবারও বাংলাদেশ সাড়া দেয়নি। এটি ভারত-আমেরিকার চাপের কারণেই হচ্ছে না। ব্যাপারটাকে এভাবেই দেখতে হবে যে, এই সম্পর্কের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভারতের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে খানিকটা ভারসাম্য তৈরি করার চেষ্টা করলো এবং এভাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে তার যে দর কষাকষির ক্ষমতা থাকে, তা প্রয়োগ করলো। আমাদের দেশে অনেক বামপন্থী দল আছেন যারা দেশকে একটি স্বাধীন দেশ ভাবেন না, সাম্রাজ্যবাদীদের তাবেদার রাষ্ট্র মনে করেন। আশা করি এ ঘটনায় তাদের চোখ খুলবে।

তবে এটাও দেখা উচিত যে, চীন এশিয়ার প্রধান শক্তি হিসেবে নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করতে চায় – তা ঠিক। কিন্তু তারা এখনও আমেরিকার মতো কোন আগ্রাসী শক্তি নয়। আমেরিকার অর্থনীতিটা পুরোপুরিই সামরিক অর্থনীতি। অস্ত্র উৎপাদনই তার মূল লক্ষ্য। তাই উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনে অস্ত্র খালাস করার জন্য যুদ্ধ তার খুবই দরকার। চীনের ব্যাপারটা পুরোপুরি এমন নয়। ভবিষ্যতে কোন এক সময় এমন হতেও পারে, কিন্তু এখন নিজের ব্যবসার বৃদ্ধি, তাকে নিরাপদ রাখা ও অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠাই তার পদক্ষেপের মধ্যে আছে।

সাম্যবাদ নভেম্বর ২০১৬

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments